#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_২০(অন্তিমপর্ব)
লাল টকটকে রঙের শাড়ি পরিহিত নারী বাহির বাহিরে উমেদের পাশেই দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছে। ময়না বেগম বিছানার একপাশে বসে আছেন। সুরাইয়া ময়না বেগমকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে বুঝিয়েই যাচ্ছে উমেদ আর মেয়েটাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসতে কিন্তু ময়না বেগম কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। ছেলের প্রতি অগাধ বিশ্বাস রেখেছিলেন তিনি। ছেলে এমন একটা কাজ করে বসবে সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি।
আশরাফ ময়না বেগমের ঘরে আসতেই ময়না বেগম বলে ওঠেন,“তুই ওদের চলে যেতে বল আমি ওদের ঘরে তুলব না।”
আশরাফ উমেদের কাছে থেকেই মায়ের ঘরে এসেছিল। মায়ের কথা শুনে পাশে গিয়ে বসে। মাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,“আম্মা, মেয়েটা এতিম। ছোটোবেলা থেকে সৎমায়ের কাছে বড় হয়েছে। বাবা যতদিন ছিলেন ততদিন তবু একটু ভালো ছিল। মেয়েটার বাবা গতমাসে মারা যায়। উমেদ মেয়েটাকে প্রাইভেট পড়াতো। মেয়েটার বাবা মারা যাওয়ার পর পড়ানো বন্ধ হয়ে যায়। সৎমা এই মেয়েটার ওপর অত্যা*চার শুরু করে। বয়স্ক একলোকের সাথে বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছিল। উমেদ জানতো মেয়েটা তাকে ভালোবাসে। তার এই অবস্থা জানতে পেরে ওকে নিয়ে চলে এসেছে।”
ময়না বেগম এবার উৎসুক নয়নে আশরাফের দিকে তাকায়। নরমস্বরে শুধায়,“মেয়েটা এতিম?”
আশরাফ ওপর-নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,“হ্যাঁ। আম্মা, মেয়েটাকে তুমি অন্তত একটু ভালোবাসো। তুমিও যদি বিমুখ হও তাহলে মেয়েটার কী হবে বলো তো!”
ময়না বেগম সুরাইয়ার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করে,“আমার কি মেনে নেয়া উচিৎ? তুমি কী ভাবছো?”
সুরাইয়া মাথানিচু করে বলে,“আম্মা, জানালা দিয়ে দেখলাম মেয়েটা খুব সুন্দর। আপনার ছেলে যা বলছে তা হয়তো সত্যি তা না হলে উমেদ এমন করতো না।”
ময়না বেগম বলে ওঠেন,“আমার কী করা উচিৎ সেটা বলো।”
“ওদের মেনে নিন, আম্মা। আমার একটা কথা বলার মানুষ দরকার।”
ময়না বেগম গম্ভীর হয়ে কিছু একটা ভাবেন। তারপর বলেন,“গহনা যেগুলো তোমাকে দিলাম ওগুলো ভালো করে রেখেছ?”
সুরাইয়া একপাশে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “জি।”
“ওখান থেকে একসেট দাও। আমি আবার তোমাকে গহনা বানিয়ে দেব। নতুন বউকে খালি হাতে বাড়িতে নিয়ে আসা ভালো দেখায় না।”
সুরাইয়া দৌঁড়ে নিজের ঘর থেকে গহনার একটা বক্স এনে ময়না বেগমের হাতে দিয়ে আরেকটা শপিংয়ের ব্যাগ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,“আম্মা, এই শাড়িটা বউকে দেবেন। নতুন বউ নতুন শাড়ি পরবে।”
ময়না বেগম মৃদু হেসে বলেন,“তুমি কিন্তু মেয়েটা ভালো আছো।”
ময়না বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সুরাইয়া আশরাফের কাছে এসে বাহুতে নিজের কাধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলে,“দেখেছ শেখ সাহেব, ইয়্যুর আম্মা লাইকস্ মি।”
আশরাফ বাহিরের দিকে দেখে সুরাইয়ার কোমর জড়িয়ে ধরে বলে, “তার ছেলে আপনাকে আরও বেশি ভালোবাসে সেটা দেখতে পান না? আন্ধা হো কিয়া?”
সুরাইয়া নিজেকে আশরাফের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গালে একটা চুমু দিয়ে বলে,“তার ছেলের বউও আপনাকে ভালোবাসে শেখ সাহেব।”
সবাই বাহিরে এসে উমেদ এবং উমেদের স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে আসে৷ দুজনকে সুরাইয়া ঘরে পাঠিয়ে দেবে তখন মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,“তোমার নাম যেন কী?”
মেয়েটা মাথা তুলে নরমগলায় বলে,“আমার নাম আলো।”
সুরাইয়া মৃদু হেসে উমেদের দিকে তাকায়।
“আজকের কাজে আমি খুব খুশি হয়েছি৷ আলোকিত হোক আপনার জীবন। দুজনে খুব সুখী হন দোয়া করি। স্ত্রীকে ভালোবাসায় রাখবেন।”
উমেদ ওপর নিচ মাথা নাড়িয়ে মৃদু হাসে।
সুরাইয়া ময়না বেগমের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মায়ামাখা চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে,“শোনো আলো, আজ থেকে আমরা তিনজন বন্ধু। আমি, তুমি আর আম্মা।”
আলো হেসে সুরাইয়ার কথা মেনে নেয়৷ ময়না বেগম সুরাইয়াকে ডান পাশে এগিয়ে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নেন৷ আলোর দিকে আরেক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “তুমিও এসো। তুমি দূরে কেন?”
মায়ের স্নিগ্ধ আচরণে আশরাফ এবং উমেদ একে অপরকে দেখে দুজন একসাথে বলে ওঠে,“আমরা দূরে থাকব!”
______
অভ্রর বাবা-মা হৃদিতার মা-বাবাকে প্রায় রাজি করিয়ে ফেলেছেন আজই এই বিয়ে বাড়িতেই অভ্র আর হৃদিতার বিয়ে দিয়ে দেবেন। এক অনুষ্ঠানে দুইটা অনুষ্ঠান হয়ে যাবে।
কথা শেষ করে নাহার বেগম হৃদিতার কাছে চলে যান। হৃদিতা হলুদের জন্য তৈরি হচ্ছিল। তার সাথে আরও কয়েকটা মেয়ে আছে৷ সবাই একসাথে সাজগোজ করছে। নাহার বেগম ঘরে প্রবেশ করেই দেখেন হৃদিতা হলুদ শাড়ি পরেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছে। মাকে দেখে আয়নার সামনে থেকে সরে মায়ের কাছে এসে দাঁড়ায়।
নাহার বেগম খাটে বসা মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে আবার হৃদিতার দিকে তাকায়।
“হলুদ শাড়িটা খুলে লাল একটা শাড়ি পরে নে, মা। ”
“লাল কেন? এটা ভালো লাগছে না? ঠিকই তো আছে।”
নাহার বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,“আজ তোর বিয়ে।”
ভ্রু কুচকে মায়ের দিকে তাকায় হৃদিতা। জানতে চায়,“কী বললে? আজ বিয়ে? কী বলো মা?”
“সবাই বসে ঠিক করল আজই বিয়েটা হবে।”
“আমি অন্যকারো সাথে চলে যাচ্ছি? মনে হচ্ছে আমাকে জোর করে ধরে বেধে আমাকে একদিনের মধ্যে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছ। আমি তো বিয়েতে রাজি হয়েছি। রাজি না হলে এই ব্যবহার করলে মানা যেত। আমি বড়ো করে অনুষ্ঠান না করে বিয়ে করব না। বউ সাজব, ছবি উঠব কত কী করব!”
“আমারও মন সায় দিচ্ছে না। আমার মেয়ের বিয়ে কেন এভাবে হবে? তুই অভ্রর সাথে কথা বল। ওকে বল বিয়েটা পরেই ধীরেসুস্থে হোক।”
“উনি কোথায়?”
“বাহিরেই আছে।”
“আচ্ছা আমি আসছি।”
হৃদিতা শাড়ির কুচি উঁচু করে রুমে থেকে বেরিয়ে অভ্রকে খুঁজতে থাকে। তিন চার জায়গায় খুঁজে বাহিরের উঠোনে তাকে পেয়ে যায়৷ কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। হৃদিতা সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। অভ্র হৃদিতাকে দেখে ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় জানতে চায়, “কী হয়েছে?”
হৃদিতা নিম্নস্বরে বলে,“ফোন কাটুন কথা আছে।”
অভ্র কথা শেষ করে কল কেটে হৃদিতাকে বলে,“কী হয়েছে শুনি?”
“সবাই কি পা*গল হয়ে গেল?”
অভ্র এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,“কে পা*গল হলো?”
“সবাই পাগলামি করতেছে।”
“কী নিয়ে?”
“আপনাকে আর আমাকে নিয়ে।”
“কী করছে?”
“আজই বিয়ের কথা বলছে৷”
“কী? আমি বর সেজে বউকে আনতে যাব। আপনি জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখবেন।এভাবে কে বিয়ে করবে?”
হৃদিতা এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। অনুযোগভরা কণ্ঠে বলে ওঠে,“আমি বউ সাজবো, ছবি উঠব। প্লিজ আপনি সবাইকে নিষেধ করুন আমরা এখন বিয়ে করব না। ভাইয়ার বিয়েটা হয়ে যাক।”
অভ্র এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,“আমার বলায় কাজ হলে ট্রিট দিবেন?”
“ট্রিট?”
“হ্যাঁ। ”
“আমি আপনাকে ট্রিট দেব?”
“একটা চুমু দিলেও হবে।”
“লা*ত্থি দিলে হবে না?”
“হবু বরকে লা*ত্থি দিতে পারবেন?”
“পারব। এবার গিয়ে সবাইকে নিষেধ করুন।”
“চলুন একসাথেই গিয়ে বিয়ে ভেঙে দিয়ে আসি আমার হবু বাচ্চার মা।”
হৃদিতা হেসে বলে,“আমরা বিয়ের এক বছর পরই বেবি নেব, বুঝছেন? সেদিন আমার এক্সের বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছিল, সে বলল এক্সের বউ নাকি চলে গেছে। আমরা হ্যাপি ফ্যামিলি হয়ে দেখিয়ে দেব।”
অভ্র হৃদিতার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,“কাউকে কিচ্ছু দেখাতে হবে না। আপনি চোখবন্ধ করে শুধু আমাকে ভালোবাসবেন। শুধু আমাকে। দুনিয়ার কোনকিছু আর আপনার দেখতে হবে না। আপনি শুধু আমাকে দেখবেন।”
হৃদিতা মৃদু হেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,“সৃষ্টিকর্তা এত ভালো কিছু আমার করে রেখেছিলেন!”
~সমাপ্ত