#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৯
শাশুড়ি স্বর্ণের গহনাগুলো নিয়ে গুটিগুটি পায়ে সুরাইয়ার দরজায় এসে দাঁড়ান। দরজায় নক করার শব্দ হতেই সুরাইয়া গিয়ে দরজা খুলে দেয়। বাহিরে ময়না বেগমকে দেখে ভেতরে আসতে বলে দরজাটা ভালোভাবে খুলে দেয় সুরাইয়া। ভেতরে আসতে বলে পাশে দাঁড়িয়ে যায়। ময়না বেগম গহনাগুলো নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলেন,
“আশরাফ কল দিয়েছিল তোমাকে?”
সুরাইয়া বিছানায় রাখা ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,“ফোনটা হয়তো সাইলেন্ট আছে।”
“আমিও ওয়াশরুম থেকে ঘরে এসে দেখি আশরাফ কল দিচ্ছে। রিসিভ করব তখনই ফোন বন্ধ হয়ে গেল।”
“আমি দেখছি আম্মা, বসুন আপনি।”
ময়না বেগম চেয়ার টেনে বসলেন। সুরাইয়া ফোনটা নিয়ে আশরাফকে কল লাগায়। রিং হতেই আশরাফ কল কে*টে দেয়। সুরাইয়া দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার চেষ্টা করে কিন্তু ফলাফল একই। সুরাইয়া অসহায় চোখে ময়না বেগমের দিকে তাকায়।
“আম্মা, কল ধরছে না আপনার ছেলে।”
ময়না বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন,“ব্যস্ত আছে হয়তো। পরে কল দিও। আচ্ছা এদিকে এসো এবার।”
সুরাইয়া ফোনটা হাতে নিয়েই ময়না বেগমের পাশে গিয়ে বসলো। দুদিন হলো ময়না বেগমের ব্যবহারে সে মুগ্ধ হচ্ছে। তিনি পাল্টেছেন, সত্যিই তিনি পাল্টে গিয়েছেন। গম্ভীরভাবে থাকলেও অন্যরকম সত্তা যেন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে।
ময়না বেগম গহনার কয়েকটা বাক্স নিয়ে এসেছিলেন। একে একে বাক্সগুলো খুলে সুরাইয়ার সামনে মেলে ধরেন তিনি। সুরাইয়া সবগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিয়ে ময়না বেগমের দিকে তাকায়।
নিম্নস্বরে বলে ওঠে,“এগুলো এখানে কেন এনেছেন, আম্মা?”
ময়না বেগম গহনাগুলাও নাড়তে নাড়তে বলে,“এগুলো সব তোমার।”
অবাক হয় সুরাইয়া। প্রশ্ন করে বসে, “আমার মানে? আমার তো কোনো গহনা নেই আম্মা।”
“এগুলো সব তোমার। আমার কাছে ছিল। তোমার আমানত আমি তোমার কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। তুমি এগুলো তোমার কাছেই রাখো, মা।”
ময়না বেগমের মুখে মা ডাক শুনে শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সুরাইয়া। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে- ঠিক শুনলো তো সে নাকি ভুল শুনলো! বুক ভারি হয়ে আসছে তার। চোখটাও কেমন জ্ব*লছে হয়তো এখনই টলমল করে উঠবে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সুরাইয়া। ময়না বেগম গহনার দিক থেকে চোখ তুলে সুরাইয়ার দিকে দৃষ্টি দেন।
সুরাইয়াকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বলেন, “কী হলো? চুপচাপ আছো কেন? ”
সুরাইয়া আনমনে বলে ওঠে,“আপনাকে আমার অপরিচিত লাগছে, আম্মা।”
ময়না বেগম মৃদু হেসে বলেন, “অপরিচিত লাগারই কথা। আগে তো দজ্জাল শাশুড়ি ছিলাম।। এখন একটু ভালো হতে চাইছি। তবে এই পরিচয় এর পরিচিত হয়ে নিতে পারো। ”
এবার আর কোন বাঁধ মানে না, চোখ টলমল করে উঠে সুরাইয়ার। গলায় বলে ওঠে, “আমাকে একটা চিমটি কাটবেন, আম্মা। মনে হচ্ছে এটা স্বপ্ন, আর ঘুম ভেঙ্গে গেলে আপনিও চলে যাবেন। ”
ময়না বেগম শব্দ করে হেসে ওঠেন। সুরাইয়া মুগ্ধ নয়নে সেটা দেখতে থাকে। হাসি থামিয়ে ময়না বেগম সুরাইয়া কে ছুঁতেই আশরাফের গলা শুনতে পাই দুজন।
সুরাইয়া বসা থেকে উঠে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আশরাফ থেকে দেখে বলে ওঠে,“ফোন ধরছিলেন না কেন? কিছু হয়েছে? আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল। আম্মা বলল আপনি নাকি উনাকেও ফোন দিয়েছিলেন। আমার ফোনটা সাইলেন্ট ছিল। আম্মা এসে আমাকে বলল আপনি কল দিয়েছিলেন তারপর কল দিলাম কিন্তু আপনি তো রিসিভ করলেন না।”
আশরাফ ঘরে প্রবেশ করতে করতে বলে, “আম্মার ঘরে যাও, নিয়ে আসছি কথা আছে। ”
ঘরে ঢুকেই ময়না বেগমকে দেখে আশরাফ বলে ওঠে, “ওহ আম্মা তুমি এখানে! আচ্ছা দাঁড়াও কথা আছে। ”
আশরাফ নিজের ফোনটা চার্জে বসিয়ে ময়না বেগমের পাশে এসে বসে। সুরাইয়া দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। আশরাফের মুখ দেখে সে বুঝতে পেরেছে সিরিয়াস কিছু ঘটেছে। কী ঘটেছে সেটা শুনতেই চুপচাপ দাঁড়ায় সে।
আশরাফ ময়না বেগমের দিকে চেয়ে স্বর নরম করে বলে, “আম্মা, তোমার ছোট ছেলে আসছে। সন্ধ্যায় হয়তো চলে আসবে। আমাকে কল দিয়েছিল। তোমাকে হয়তো কল দিয়ে সাহস করে উঠতে পারেনি তাই আমাকে কল দিয়েছিল।”
ময়না বেগম ভ্রু কুচকে শুধায়,“কি হয়েছে? পরিষ্কার করে বল। বাড়িতে আসবে ভালো কথা, আমাকে বলার সাহস পাচ্ছে না কেন?”
আশরাফ একবার সুরাইয়ার দিকে তাকায়। তারপর আবার ময়না বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে, “উমেদ বিয়ে করেছে, আম্মা।”
____
একটা ঘরে কয়েকজন মিলে সমাবেশ বসিয়েছে। তাদের মুখ্য বিষয় অভ্র আর হৃদিতার বিয়ে। হৃদিতা খবর পেয়ে ঘরের বাইরে পায়চারি করছে।
মাকে খুঁজতে খুঁজতে অভ্র হৃদিতার সামনে এসে দাঁড়ায়। হৃদিতাকে দেখে অভ্র মৃদু হেসে বলে, “আপনার সাথে তো কথা বলারই সুযোগ পাচ্ছিলাম না। মাথা ব্যথা কমেছিল? ”
হৃদিতা বলে ওঠে, “তখন তো কমে ছিল এখন তো বেড়ে যাচ্ছে।”
এদিক ওদিক তাকিয়ে অভ্র ভ্রু কুচকে বলে, “এখন বেড়ে যাচ্ছে মানে? কী হয়েছে? ”
“সবাই মিলে আমার বিয়ে ঠিক করছে। ”
অভ্র হতভম্ব চোখে হৃদিতার দিকে তাকায়। ভ্রু সটান বিস্তৃত করে বলে,“আপনার বিয়ের কথা হচ্ছে মানে? কীসব কথা বলছেন আপনি? আপনার বিয়ের কথা চলছে মানে? কোথায় শুনলেন? আপনার বাবা তাহলে আমাকে এত গুলো দিন আগে আপনার কথা কেন বলেছিল?”
হৃদিতা চোখ কঠিন করে কর্কটস্বরে বলে ওঠে, “বিয়ের কথা আপনার সাথেই হচ্ছে কিন্তু বিয়ে বাড়িতে অন্য কারো বিয়ের কথা হচ্ছে এটা কেমন শোনায় বলুন তো? বিয়ে বাড়িতে কেন আমার বিয়ের কথা হবে?”
অভ্র স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। বুকে হাত রেখে মৃদু হেসে বলে ওঠে, “ আমার সাথেই আপনার বিয়ের কথা হচ্ছে সেটা আগে বলবেন না? আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম। ”
“ভয় পাওয়ার কি আছে? বিয়ে করাই তুমি এই উদ্দেশ্য, যাকে তাকে বিয়ে করলেই হলো।”
“ জি না ম্যাম। বিয়ে করা উদ্দেশ্য না, আপনাকে বিয়ে করা উদ্দেশ্য।”
হৃদিতা এবার একটু গম্ভীর হয়। মাথা নিচু করে বলে, “আমাকে ছেড়ে দেওয়ার মানুষের অভাব নেই। যখনই আমি কারো হওয়া শুরু করি তখনই সে আমাকে ছেড়ে যায়। ”
অভ্র চকিতে বলে ওঠে, “আপনাকে আমার করতে এসেছি আমি। ছেড়ে যেতে আসিনি।”
“আপনাকে কিছু জানানোর আছে আমার।”
“এখানেই বলবেন? আশেপাশে অনেক মানুষ। ”
“ছাদে যাবেন? ”
“যাওয়া যায় প্রস্তাবটা মন্দ না। ”
হৃদিতার কথামতো অভ্র হৃদিতার কিছু কিছু ছাদে চলে যায়। সেখানেও দু একজন পিচ্চি খেলছিল। অভ্র তাদের বুঝিয়ে নিচে পাঠিয়ে দেয়। হৃদিতা ততক্ষণ ছাদের এক পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। অভ্রও দেরি না করে সেখানে উপস্থিত হয়।
অভ্র রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বলে, “এবার বলুন। আচ্ছা আগে বলুন আমার সাথে বিয়েতে আপনার কোন অমত নেই তো? মন থেকে বলবেন প্লিজ।”
হৃদিতা এখন চুপ করে থেকে বলে, “আপনাকে আমার অপছন্দ না।”
“পছন্দ?”
“ভেবে নিতে পারেন।”
“আচ্ছা নিলাম। এবার আপনার কথাটা বলুন ।”
হৃদিতা মুহূর্ত কয়েক অভ্রর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে তারপর বেশ স্বাভাবিকভাবেই বলে, “একজনের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল। তার নাম ইথার। বেশ ভালো চলছিল আমাদের সম্পর্ক। আমাদের বললে ভুল হবে, বিষয়টা শুধু আমার ছিল। সে আমাকে কষ্ট করে সহ্য করে গেছে।”
অভ্র মনোযোগ দিয়ে হৃদিতার কথা শুনছিল। হৃদিতা থেমে যাওয়ায় সে বলে ওঠে, “তারপর আপনি তাকে বিয়ের কথা বলেন। আপনার পড়াশোনাও শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তাকে একটা জব নিতে বলেন। সে নিচ্ছিল না। আপনি নিজেই জব করার চিন্তাভাবনা করেন। তারপর আপনি আপনাদের কথা তার বাসায় জানাতে বলেন। সে সেটাও করছিল না। আপনি শুধুমাত্র তাকে পেতে কোর্ট ম্যারেজ ও করতে চেয়েছিলেন। এই ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই সে বিদেশে পাড়ি জমায়। আপনার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। সে যে বিদেশে গিয়েছে সেটাও আপনি অন্য কারো কাছে থেকে জানতে পারেন। এসব হয়ে যাওয়ায় আপনি খুব ভেঙে পড়েন। তারপর ধীরে ধীরে এই পর্যন্ত এসেছেন। মাঝে হয়তো একটা জবও নিয়েছিলেন।”
হৃদিতা অভ্র কথায় অবাক হয়। জিজ্ঞাসু চোখে অবরোধ দেখে তাকায়। প্রশ্ন করে ফেলে, “আপনি এত কিছু জানলেন কিভাবে? ”
অভ্র মৃদু হেসে বলে, “আপনাকেই আপনার বাবার কথায় অনেকটা জেনে ফেলেছি আপনার বাহিরের খবরা-খবর জানব না?”
অভ্র হৃদিতাকে রেখে ছাদ থেকে যেতে যেতে বলে, “অতীতের সবটুকু ভুলে আমার হতে প্রস্তুত হয়ে যান। ”
#চলবে….