#প্রেমরাঙা_জলছবি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৮
চোখে ঘুম চলে আসে হৃদিতার। ফোনটা চার্জে দিয়ে ঘুমুবে ভেবে ফোনটা হাতে নিতেই দেখে আবরারের নম্বর থেকে চারবার কল এসেছিল। ফোনস্ক্রিনটা এই মুহূর্তে একটু হলেও আনন্দ দেয় হৃদিতাকে।
মৃদু হেসে বলে, ” আবরার সাহেব! ”
কল রিসিভ করে সালাম দেয় হৃদিতা। ওপাশ থেকে সালামের জবাবও আসে তৎক্ষনাৎ। হৃদিতা আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করে,” কল দিলেন যে? কোনো প্রয়োজন?”
ওপাশ থেকে আবরার বলে ওঠে,” জি। কল দিয়েছি একটা কারণে। আপনি আগামীকাল থেকে এশার সাথে সাথে থাকতে পারবেন না?”
হৃদিতা ভাবনায় পড়ে যায়। কী বলবে সে? থাকতে পারলে ভালোই হতো কিন্তু ওখানে থাকলে নিজের কাজে কচ্ছপ গতিতে এগুতে হবে।
হৃদিতাকে চুপ থাকতে দেখে আবরার আবার বলে ওঠে,” আপনি কি শুনছেন আমার কথা? এশা রাজি হয়েছে।”
হৃদিতা আমতা আমতা করে বলে,” উনি রাজি হলেও আমার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করতে আর তাছাড়া আমি শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এরকম কোনো জব করতে পারি না৷ আপনি আমার জন্য ভেবেছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।”
” আচ্ছা ঠিক আছে। আমি যদি দুই একদিনের মাঝে অন্যকোথাও কিছু করতে পারি তবে আপনাকে জানাবো।”
” হুম। খুব ভালোবাসেন আপনি উনাকে?”
প্রশ্নটা করেই চুপ মেরে যায় হৃদিতা। চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রাখে এটা ভেবে যে ওপাশ থেকে হয়তো শক্তপোক্ত কিছু কথা ভেসে আসবে কিন্তু এলো না।
হৃদিতাকে অবাক করে দিয়ে আবরার বলে ওঠে,” হ্যাঁ, অনেক বেশি ভালোবাসি। এশা একটু খিটখিটে মেজাজের মেয়ে কিন্তু সহজ সরল খুবই ভালো একটা মেয়ে। ওর জন্য আমি সারা পৃথিবীর সাথে লড়াই করতে পারি৷ ”
” পুরুষ মানুষ কোনো নারীকে ভালোবাসলে সেই ভালোবাসায় কোনো কমতি রাখে না তাই না?”
” সবার কথা জানি না তবে নিজের কথা বলতে পারব৷ আমি এশাকে অনেক ভালোবাসি৷ ”
হৃদিতা বিছানা ছেড়ে বেলকনির দিকে আসে। সামনে প্রচন্ড রোদ। মেঝেটাও গরম হয়ে আছে রোদের তাপে, দুই মিনিটও দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না বলে আবার রুমে ফিরে এসে বিছানার একপাশে বসে।
নরমস্বরে বলে,” এতো ভালোবাসেন কেন উনাকে?”
ওপাশ থেকে সাথে সাথে জবাব আসে,” জানি না তবে ভালোবাসি।”
হৃদিতার এই ভালোবাসা পছন্দ হলো না। নিজের এই অপছন্দের কথা মাথায় রেখেই বলে উঠল,” আপনি আমাকে আর কল দিবেন না৷ বাসার সামনেও আসবেন না। কোনো খবর আর নিবেন না৷ বাড়ির সামনে যে লোকটাকে রেখেছেন তাকে তুলে নেবেন। ”
আবরার আশ্চর্য গলায় বলে,” কী বলছেন আপনি? বাড়ির সামনের লোক মানে? কে আছে সামনে?”
হৃদিতা কিছু একটা মনে করে কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেওয়ার জন্য বলে,” দুইদিন ধরে একজনকে সামনের স্টলে দেখা যাচ্ছে তাই বলছিলাম। আমার মনে হয় ভুল বুঝেছি। বাদ দিন। ”
” আপনার জব চাই না?” প্রশ্নের উত্তরে হৃদিতা সহজেই ‘না ‘ বলে দেয়।
আবরার হৃদিতার গলায় ভিন্নতা বুঝতে পারে। মেয়েটাকে তার কোনোভাবেই খারাপ লাগেনি৷ সহজ সরল লেগেছিল বলেই সাহায্য করার কথা ভেবেছিল সে।
আবরারকে চুপ থাকতে দেখে হৃদিতা নিজেই বলে ওঠে,” ফোন রাখছি।”
____
সুরাইয়া দুপুরের জন্য খাবার টেবিলে খাবার রেখে ময়না বেগমকে খাওয়ার জন্য ডাকতে যায়। ময়না বেগম বসে বসে জানালা দিয়ে পাশের বাড়ির একজনের সাথে কথা বলছিল।
সুরাইয়া এগিয়ে এসে ময়না বেগমকে খাবারের কথা বলতেই বাহিরের মহিলাটি বলে,” কী ভাগ্য, ভাবি! ছেলের বউ রান্না করে খেতে ডাকছে। আপনারও ভাগ্য আর আমাদেরও ভাগ্য। ”
ময়না বেগম তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,” হ্যাঁ, সারা দুনিয়াই তো ওরে দিয়ে দিছি ওইটুক করবে না?”
সুরাইয়া কিছু না বলে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে যায়। আশরাফ গোসল দিয়ে বের হতেই সুরাইয়া বাহিরে থেকে ভেতরে প্রবেশ করে। আশরাফ হাত দিয়ে নিজের চুল নাড়তে নাড়তে এসে সুরাইয়াকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। সুরাইয়া বারবার ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পেরে ওঠে না।
সুরাইয়া বলে ওঠে,” ছাড়ো।”
” ছাড়ব কেন? বউকে এতো তাড়াতাড়ি ছাড়ে কেউ? বোকা…”
” খেতে চলুন।”
আশরাফ সুরাইয়াকে ছেড়ে দিয়ে বলে, ” কিছু হয়েছে?”
সুরাইয়া আশরাফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,” কিছু না। চলো, খাবে চলো।”
সুরাইয়া ঘর থেকে বের হবে তখনই উমেদ এসে দরজায় দাঁড়ায়। আশরাফ এগিয়ে এসে বলে,” কিছু বলবি?”
উমেদ মাথা চুলকে বলে,” দুই হাজার টাকা হবে তোর কাছে? ঢাকা ফিরব, পকেটে টাকা নাই। ”
” কবে যাবি? কিছু বলিসনি তো!”
” কাল বিকেলে যাব। ভাবলাম এখন স্টেশনে যাই, টিকেট কেটে আসি।”
” দাঁড়া।” বলেই আশরাফ ওয়ালেট থেকে দুইটা এক হাজার টাকার নোট বের করে উমেদকে দিয়ে দেয়।
উমেদ বাড়ি থেকে বের হবে তখনই সুরাইয়া পিছন থেকে ডেকে বলে,” এখন দুপুরবেলা। বিকেলে কাটলেই হবে টিকেট৷ এখন সবাই একসাথে খেতে বসবেন আসুন।”
উমেদ কোনো কথা না বলে খাবার টেবিলে গিয়ে বসে। ময়না বেগমও এসে নিজের চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়েন। সুরাইয়ার আসতে দেরি হলে ময়না বেগম নিজেই একটা ঢাকনা তুলে চিংড়ি মাছ দেখে ভ্রু কুচকে সুরাইয়াকে ডাক দেন।
সুরাইয়া নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই ময়না বেগম বলে ওঠেন,” গলা টি*পে মে*রে ফেলতে পারছো না বলে কি চিংড়ি খাইয়ে মা*র*বে নাকি? কী ক্ষতি করেছি আমি তোমার?”
সুরাইয়া খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে মাছের তরকারির পাত্রের ঢাকনা সরিয়ে শাশুড়ির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,” অপছন্দ তো আমি, আপনার। আপনার অপছন্দনীয় হতে আমার কোনোকিছুই করতে হয় না এমনিতেই দোষ হয়ে যায়। আমি যখন এতই চক্ষুশূল তাহলে ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন কেন? আমি তো আপনার ছেলের ঘরে উঠে আসিনি। সবসময় কোনো না কোনো ভুল ধরতে বসেই থাকেন। ”
আশরাফ এসে সুরাইয়ার পিছনে এসে দাঁড়ায়। ময়না বেগম বিলাপ করতে করতে খাবার টেবিল ছেড়ে নিজের ঘরে চলে যান।
আশরাফ কিছু বলার আগেই উমেদ বলে ওঠে,” মা, তোমাদের সমস্যাটা কী? দুজনের কেউ কাউকে পছন্দ করো না। আর তুমি আজ কী করলে?খাবারের একটা ঢাকনা তুলেই এমন ব্যবহার শুরু করে দিলে? সুরাইয়া কী ক্ষতি করেছে তোমার? বাড়ি তো আসিই না, আসা বাদ দিয়েছি। বছরে একবার, দুইবার আসলেও এমন অবস্থা দেখতে হয়। মেয়েটা বাপের বাড়ি ছেড়ে এখানে পড়ে আছে আর তুমি সারাক্ষণ খারাপ ব্যবহার করেই যাচ্ছ।”
ময়না বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উচ্চস্বরে বলে ওঠেন,” আমার দোষটাই শুধু দেখলি? তোর ভাইয়ের বউ কেমন ব্যবহার করে আমার সাথে সেটা দেখলি না? মায়ের পক্ষ না নিয়ে ভাবির হয়ে কথা বলতে লজ্জা করে না তোর? এই আমি তোকে পেটে ধরেছিলাম?”
আশরাফ ইশারায় উমেদকে চুপ করতে বলে মায়ের দিকে এগিয়ে যায়। মিনতির স্বরে বলে,” মা, সুরাইয়ার হয়ে আমি মাফ চাইছি। তুমি এসো খেতে এসো। ”
আশরাফ ময়না বেগমের হাত ধরতেই তিনি টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেন। আদেশের ভঙ্গিতে বলেন,” আমাকে তুই আমার বোনের বাড়িতে রেখে আয়। আমি এ বাড়িতে থাকব না। তুই তোর বউকে নিয়ে এ বাড়িতে থাক। ”
সুরাইয়া সামনে থেকে বলে ওঠে,” সমস্যা আমার না, সমস্যা হলো আপনার, মা। আপনি আমাকে দেখতেই পারেন না। যদি এতই তিক্ততা চলে আসে তাহলে বলুন আমি আজই বাড়িতে বলি আমাকে নিয়ে যেতে। এভাবে আমার পক্ষে সংসার করা সম্ভব হচ্ছে না।”
আশরাফ সুরাইয়ার দিকে ফিরে বলে,” তুমি একটু চুপ করো প্লিজ। দুজনই কেন যে এরকম হয়ে যাও হঠাৎ করে!”
ময়না বেগম সুরাইয়াকে কথা শোনাতে শোনাতে ঘরে গিয়ে ব্যাগে নিজের কাপড় নিতে থাকেন। আশরাফ ব্যাগ কেড়ে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে বোঝায় তাতে একটু মানলেও ময়না বেগম বোনের বাড়ি যাবেনই বলে পণ করে বসেন। আশরাফ একটা শর্ত দেয়, তিনি যদি এখন খেতে বসেন তাহলে আশরাফ নিজে গিয়ে রেখে আসবেন। আর কোনো উপায় না পেয়ে ময়না বেগম রাজিও হয়ে যান।
বিকেলের দিকে আশরাফ রেডি হচ্ছে মাকে রেখে আসতে। সুরাইয়া এসে সামনে দাঁড়ায়। আশরাফ শার্টের হাতা ঠিক করছিল।
সুরাইয়া বলে ওঠে,” আম্মা যেতে চাইলো আর নিয়ে যাচ্ছ? আমার কী ভুল ছিল বলো আমায়?”
আশরাফ মৃদু হেসে বলে,” তোমার কোনো ভুল ছিল না। মা’র ও তো বয়স হয়ে যাচ্ছে তাই ওমন করেছে। মা তো অনেক দিন কোথাও যায় না আজ রেখে আসি। তুমি একটু হাসিমুখে কথা বলে এসো দেখবে ভালো লাগবে। ”
আশরাফের কথামতো সুরাইয়া শাশুড়ির রুমে চলে যায়। কথা বলার চেষ্টা করলে ময়না বেগম বলে ওঠে,” যাচ্ছি, এবার শান্তি করে থাকো। ভয় পাওয়ার দরকার নাই আমি আমার বোনের বাড়ি যেয়ে তোমার সম্পর্কে কিছু বলব না।”
সুরাইয়া বারবার মাফ চাইছে, বোঝানোর চেষ্টা করছে ময়না বেগম সেই আগের মতোই গম্ভীরস্বরে কথা বলে যাচ্ছেন।
আশরাফের ডাক শুনতেই সুরাইয়া নিজের ঘরে চলে আসে। আশরাফ নিজের ওয়ালেটে কিছু টাকা দিয়ে দিতে বলায় সুরাইয়া টাকাও বের করে দিয়ে দেয়। আশরাফ মাকে ডেকে বের হতে বলে।
সুরাইয়া আশরাফের হাত ধরে বলে,” মাকে একটু বুঝিয়ে বললে হতো না? কালকে রেখে আসতে। আজই দুপুরে ওরকম হলো আর আজই চলে যাচ্ছে। আমার ভালো লাগছে না।”
আশরাফ সুরাইয়ার দুইগালে হাত রেখে কপালে চুম্বন দিয়ে বলে,” চিন্তা কোরো না। কিছুই হবে না।”
” কিন্তু চিন্তা হচ্ছে তো।”
” কিছু হবে না। আমি মাকে রেখেই চলে আসব। উনি অনেকদিন এখানে ওখানে যান না জন্য মেজাজ খিটমিটে হয়ে গেছে। ঘুরে এলেই ভালো হয়ে যাবে। তুমি সাবধানে থেকো। আমি আসছি। ”
আশরাফ যেতে গিয়েও থেমে যায়। পিছনে ফিরে বলে,” ইয়্যুর হাজবেন্ড লাভস্ ইয়্যু।”
#চলবে…….