#প্রেমযাত্রা
#লাবিবা_আল_তাসফি
২.
ঝকঝকে আকাশটা হঠাৎ করেই ভিষণ বিষণ্ণ হয়ে পড়েছে। জৌলুষতা কমে কেমন মলিনতায় ছেয়ে পড়েছে। খানিক বাদেই ঝর ঝর করে অশ্রু ঝরাবে। নিরুর বৃষ্টি পছন্দ। তবে এই মুহূর্তে নয়। অগোছালো চুল আর হাতে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে ভিষণ বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। তার উপর রাস্তা চেনা নেই। এই মুহূর্তে দেবদূত হয়ে হাজির হলো তার প্রতিবেশী সিটের মালিক। স্বভাব সুলভ নাক উঁচু করে বললো,
‘ঠিকানা বলুন গাড়িতে তুলে দিচ্ছি।’
নিরু লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঠিকানা জানালো। ঠিকানা শুনতেই সে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়। পরক্ষণে রাশভারী গলায় বলে,
‘আমাকে ফলো করুন।’
অচেনা একটা মানুষকে ভরসা করতে নিরুর ভিষণ ভয় হচ্ছিলো। তবুও কেন যেন তার মন বলছিলো একটু ভরসা করেই দেখি!
সেবার অনাকাঙ্খিত ভাবে নিরুর পুরো যাত্রাই সাদাফের সাথে কাটলো। নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতেই তাদের পথ আলাদা হলো। নিরু বিনয়ের সহিত তাকে ধন্যবাদ জানালেও মানুষটা তার নাক উঁচু স্বভাবের জন্য কোনো প্রতি উত্তরে করলো না। এই প্রথমবারের মতো এমন অপমান নিরু মেনে নিলো। তার দয়ার মন এত উপকার করার জন্য এই সামান্য অন্যায় ক্ষমা করতে তার হ্রদয় দ্বিতীয়বার ভাবেনি। তবে বাড়িতে পৌঁছাবার পুরোটা পথ নিরু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছে এই ছোট্ট পৃথিবীতে লোকটার সাথে যেন তার আর দেখা না হয়। নিরুর এই প্রার্থনা উপরওয়ালা কবুল করলোনা বোধহয়। মামাবাড়িতে পৌঁছে সারাদিনের ধকল কাটাতে ছোট একটা ঘুম দিয়ে উঠে যখন রাতের খাবার খেতে খাবার ঘরে যায় তখনি তার চোখ আকাশে। মামাতো ভাই কাফির পাশেই বসে সাদাফ। কালো রঙের পোলো টিশার্ট জড়ানো গায়ে। চুলগুলো এখনো ভেজা। কিছুক্ষণ পূর্বেই শাওয়ার নিয়েছে বোধহয়। পাশেই মামি দাঁড়িয়ে তার প্লেটে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। নিরুর পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলো। অযথাই এই লোকের সামনে পড়ে ঝামেলা না বাড়ানো শ্রেয়। কিন্তু তার কপাল যে মোটেই অমন ভালো নয়। দু পা আগাতেই পেছন থেকে মামি ডেকে উঠলো।
‘ওদিকে কোই যাস? খাইতে বস আয়। সারাদিন ধকল গ্যাছে। খাওয়া শ্যাষে লম্বা ঘুম দিবি, শরীর ফুরফুরা হইবে। আয় আয় খাবার দিতাসি।’
নিরু বোকা হেসে খাবার টেবিলের দিকে অগ্রসর হলো। আড়চোখে একবার সাদাফকে দেখে নিলো। নিরুর দিকেই তাকিয়ে আছে। তার চোখ ভিষণ শান্ত। নিরুকে সামান্য তম বিষ্ময় ভর করেনি তার। যেন নিরুর এখানে থাকাটাই স্বাভাবিক। নিরু টেবিলে বসতেই সাদাফ পুনরায় কাফির সাথে কথায় মগ্ন হলো। কিন্তু নিরু অস্থিরতার শিকার হলো। এই একই টেবিলে বসে খাওয়াটা তার পক্ষে অসম্ভব বলে মনে হলো। কাজেই সে প্লেট হাতে সাবধানে উঠে যেতে নিলো। এবারো সে ধরা খেলো। কাফি কপালে ভাঁজ ফেলে বলে উঠলো,
‘তুই আবার কই যাস? খাবার শেষ কর। ফুপু শুনলে তোর মাথার চুল সব তুলে ফেলবে। বাঁচতে চাইলে নো নাটক, ঝটপট খাবার শেষ কর।’
নিরু থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কি একটা জঘন্য অবস্থা! এই লোকের সামনেই এসব বলা লাগলো? নিরুর চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। এই অপমান সে কিভাবে হজম করবে। আড় চোখে তাকালে দেখা গেলো সাদাফ মাথা নিচু করে খাবারে মনযোগ দিয়েছে। তা দেখে নিরু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঝটপট পায়ে তার থাকার ঘরে চলে যায়। এই মুখ নিয়ে সে আর কখনোই সাদাফের সামনে যেতে পারবে না। সম্মানের কানাকড়িও নেই তার সাদাফের কাছে।
রাত প্রায় বারোটা। বাড়ির সকল বাতি নেভানো। সকলে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। নিরুর বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। তার দুই পাশে দুই মামাতো বোন শুয়েছে। বিছানা শেয়ার করার অভ্যাস না থাকায় তাকে এই সমস্যা ভোগ করতে হচ্ছে। নিরু ফোনে সময় দেখে বিছানা ছেড়ে নেমে আসে। গায়ে ওড়না জড়িয়ে পা টিপে টিপে শিড়ি ঘরে আসতেই শক্ত কিছুর সাথে সজোরে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়। পায়ে ব্যাথা পেয়ে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলেই পুরুষালি গলা ব্যস্থ হয়ে বলে ওঠে,
‘কে নিরু? ব্যাথা পেয়েছেন?’
নিরু মৃদু গলায় জবাব দেয়,
‘হুম।’
‘আমার হাত ধরে উঠতে চেষ্টা করুন।’
সাদাফ হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এই অন্ধকারে সাদাফের অন্ধকার অবয়ব স্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে। নিরু সাদাফের হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়। সাদাফ চাপা গলায় বলে,
‘বেশি লেগেছে? হাঁটতে পারবেন।’
‘হুম পারবো।’
‘এত রাতে এখানে করছেন?’
‘হাঁটছিলাম।’
‘এই অন্ধকারে? নাকি আপনি অন্য জগতের প্রাণি যা রাতে ঘুরে বেড়ায়। সুদর্শন পুরুষ দেখলে ছলনা করে বশে নিয়ে রক্ত খেয়ে নেয়। এমন কিছু কি?’
‘আমি রক্ত খাই না।’
‘বুঝলাম! আপনি একটু ভিন্ন ধর্মী। তবে আমাকে কেন বশ করতে চাইছেন?’
‘আজব! আমি আপনাকে বশ কেন করবো?’
‘সেটা তো আপনি জানেন।’
‘আপনি অদ্ভূত!’
সাদাফ হাসে। ফোনের ফ্লাস অন করে সিঁড়ির দিকে তাক করে বলে,
‘আমি ছাদে যাচ্ছিলাম। এর মাঝে আপনি উড়ে এসে পড়লেন। এসেছেন যখন দুকাপ কড়া করে চা করে নিয়ে ছাদে আসুন। অন্যথায় এন্ট্রি মানা।’
নিরুর জবাবের অপেক্ষা করলো না। দু তিন সিঁড়ি বাদে বাদে লাফিয়ে ছাদেয়ে উঠে গেলো। নিরুর মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো খানিকক্ষণ। এই লোককে দেখলেই তার নিজের সম্মানহানির কথা মনে পড়ে। আর ভাগ্য কিনা বারবার তাকে এই লোকের সামনে এনে হাজির করে।
এরপর থেকে রোজ তিন চারবার করে সাদাফের সাথে তার দেখা হতো তার। খুব কম সময় কথা হতো। প্রতিবার সাদাফ নিজ থেকে কথা শুরু করতো। বরিশালে সাদাফ ছিলো মাত্র চারদিন। কিন্তু এই চারদিনেই যেন গুরুজনদের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলো। নিরুর মা হলো সাদাফের অন্যতম ভক্ত। যখন সে জানতে পারলো সাদাফ ঢাকায় নিরুর হলের কাছেই থাকে তখন খুব করে আবদার করে বললো,
‘বাবা তুমি আমার মেয়ে নিরুটাকে একটু দেখে রেখো। মেয়েটা দূরে থাকে একা। বুকের ভেতরটা সবসময় ফাঁকা হয়ে থাকে। তুমি কাছেই আছো শুনে এখন থেকে একটু স্বস্তি পাবো।’
সাদাফ তার কথা রেখেছে। সপ্তাহে একদিন সে নিরুর সাথে যোগাযোগ করে। নিরুর কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চায়। মানুষটা ভিষণ দায়িত্বশীল। নিজের দায়িত্ব থেকে কখনো পিছিয়ে যায় না। নয়তো কেন সে অচেনা এক মেয়ের এত যত্ন নিবে?
……
নিরু বিছানা থেকে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। জানালার পাশে মস্ত এক মেহগনি গাছ। এই গাছটার একটা ডাল নিরের জানালা ঘেঁষে। ডালটায় প্রায়শই একটা নাম না জানা পাখি এসে বসে। মিষ্টি গলায় ডাকে। আজ আসেনি। নিরু ব্যস্ত পায়ে ফ্রেশ হতে যায়। বারোটায় ক্লাস আছে। এই ভরদুপুরে ক্লাস করার ব্যাপারটা নিরুর ভিষণ অপছন্দ। এত এত সুন্দর সময় থাকতে ভরদুপুরেই কেন?
আজকের বিকেলটা সুন্দর। মিষ্টি উজ্জ্বল আকাশ। মৃদু মৃদু বাতাস বইছে। নিরু তার আর সাদাফের সম্পর্কটা নিয়ে ভিষণ ভাবুক হয়ে আছে। তাদের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক নেই। তবুও কোথাও যেন একটা অধিকার বোধ আছে। এই যেমন সাদাফ তাকে ম্যাসেজ করে জানিয়েছে নীল রঙের শাড়ি পড়তে। চুল সুন্দর করে খোঁপা করতে। যে কেউ কি এমন আবদার করতে পারে? করলেও বা নিরু কেন শুনবে? কিন্তু প্রশ্নটা যখন সাদাফকে নিয়ে নিরু তখন ভিষণ বাধ্য মেয়ে।
সাদাফের বর্ণনা মতোই সেজেছে নিরু। চুল সুন্দর করে খোঁপা বেঁধেছে। হাতে নীল রঙের কাঁচের চুড়ি পড়েছে। চোখে মোটা কাজল। আর কপালে নীল টিপ। ঠোঁটে রঙ ছোঁয়ানো মানা। এভাবেই তাকে বেশ লাগে।
নিরু হলের গেট থেকে বের হতেই সাদাফকে দেখতে পেলো। রিকশার উপর বসে আছে। তার পড়নে হলুদ পাঞ্জাবী। চুল ব্যাকব্রাশ করা। হাতে এক গুচ্ছ সাদা গোলাপ। নিরুর বুকটা কেমন করে ওঠে। সাদাফ কখনোই ফুল হাতে দেখা করেনা। তবে আজ কেন?
‘উঠে আসেন ম্যাডাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়েছেন।’
‘দুঃখিত।’
‘এভাবে তো ক্ষমা করা যাচ্ছে না। তবে অন্যভাবে যেতে পারে।’
নিরু পিটপিট করে তাকায়। ছোট করে বলে,
‘কিভাবে?’
‘আজ একটু বেশি সময় দিতে পারবে?’
কেমন করুন শোনালো কথাটা। নিরু জবাব দিতে পারলো না। গলা আটকে আছে তার। সাদাফ হয়তো বুঝলো। মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো,
‘উঠে এসো।’
রিকশা চলছে আপন গতিতে, গন্তব্যহীন ভাবে। সাদাফ মনোযোগ সহকারে গোলাপের কাটা ভাঙছে। নিরু বারবার সেদিকে লক্ষ্য করছে। তার মন ছটফট করছে। গোলাপ গুলো তার জন্য তো? এখনো দিচ্ছে না কেন তবে? তার ভাবনার মাঝেই অনুভব হলো তার খোঁপায় খুব যত্ন নিয়ে সাদাফ ফুল গুঁজে দিচ্ছে। নিঃশ্বাস আটকে এলো। শক্ত হয়ে বসে রইলো সে। নিজের ভেতরের অস্থিরতা সে কিছুতেই সাদাফকে বুঝতে দিবে না।
‘নিরু?’
‘হুম।’
‘আন্টি আমাকে তোমায় দেখে রাখার দায়িত্ব দিয়েছিলো। আমি কি সেটা পালন করতে পেরেছি?’
নিরু পাশ ফিরে তাকায়। সাদাফ তার দিকেই তাকিয়ে। নিরু বুঝতে পারেনা হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন।
‘পেরেছি কি?’
নিরু মাথা নাড়ায়। সাদাফ বলে,
‘মুখে বলো।’
‘হুম।’
‘গুড। তাহলে আমি যদি পুরোপুরি ভাবে তোমার দায়িত্ব নিতে চাই তাতে কোনো আপত্তি আছে? আমার মনে হয় আমি আমার দায়িত্ব বুঝে নিতে পারবো। তোমার কি মনে হয়? পারবো?’
বোকা নিরু সাদাফের কথার অর্থ বুঝলো না। তবে সাদাফ দায়িত্বশীল তাই সে নির্দ্বিধায় বলে উঠলো,
‘হুম পারবেন।’
সাদাফ মুচকি হাসে। বলে,
‘ তবে নিজেকে প্রস্তুত করো।’
‘কেন?’
‘আমার কাঁধে ভর করতে।’
‘কেন? আমার পায়ে তো সমস্যা নেই!’
সাদাফ হো হো করে হেসে ওঠে। নিরুর মাথায় টোকা দিয়ে বলে,
‘বুদ্ধু মেয়ে। নো প্রব্লেম আমার এমনটাই পছন্দ।’
নিরু পাশ ফিরে হাসে। মাঝে মাঝে বোকা সাজতে মানা নেই। নিজেকে গোপন করতে ওটাই একমাত্র উপায়।
সমাপ্ত