#প্রেমযাত্রা
#লাবিবা_আল_তাসফি
১.
সময়টা নভেম্বর মাসের বাইশ তারিখ। অল্প স্বল্প শীত পড়েছে। নিরু গলা অবদি কম্বল টেনে ফ্যান চালিয়ে ঘুমিয়ে আছে। এভাবে ঘুমাতে তার বেশ লাগে। হলের এই রুমটাতে সে একাই থাকে। যদিও এখানে তিনজনের থাকার ব্যাবস্থা আছে। তার দুজন রুমমেট ও আছে। কিন্তু তারা কিছুদিন হলো গ্রামে গেছে। তাই সে তার মর্জি মতো চলতে পারছে। তার রুমমেট দুজন সিনিয়র। সারাক্ষণ হুকুম চালায়। রাত দুপুরে চা খাওয়ার আবদার করে। নিরুকে না চাইতেও খাটের তলায় লুকিয়ে রাখা হিটার বের করে চা করে দিতে হয়। চিনি, চা পাতা দুটোই তার। সাথে দুটো বিস্কুট ও দিতে হয়। নিরু চাইলেও কিছু বলতে পারে না। যদি হল সুপারকে হিটারের কথা বলে দেয়!
রুমে পার্সোনাল চুল্লি রাখা হলের নিয়মে অবৈধ। নিরু সেই অবৈধ কাজটাই করছে। এজন্য তাকে মুখ বুজে সবটা সহ্য করতে হয়। ব্যাপারটা যে এখানেই শেষ এমন নয়। এই তো নবীন বরণ অনুষ্ঠানের দিন নিরুর অতি প্রিয় নীল রঙের শাড়িটা তাকে দিয়ে দিতে হয়েছে। সিনিয়র মেয়ে দুজনের মধ্যে মিতু নামের মেয়েটা রূপবতী। ফকফকা ফর্সা গায়ের রঙ। গায়ে টোকা পড়লেই রক্ত বেরিয়ে যাবে ধরনের সুন্দর। তার নজর পড়লো শাড়িটার উপর। লাজ লজ্জা ছেড়ে এসে বললো,
‘শাড়িটাতো ভিষণ সুন্দর নিরু। কিন্তু এই রঙটা তোমায় মানাবে না। তোমার গায়ের রঙ তো চাপা! নীল রঙ টকটকে ফর্সা মেয়েদের জন্য। আমার মতো।’
উত্তরে নিরু ছোট করে বলেছিল,
‘আচ্ছা।’
‘কি আচ্ছা? তুমি এক কাজ করো, শাড়িটা আমায় দিয়ে দাও। আমি তোমায় দাম দিয়ে দিব।’
‘না না আপু। আমি শাড়ি বিক্রি করবো না।’
‘আরে মেয়ে ঐ টাকায় তুমি তোমার গায়ে মানাবে এমন একটা শাড়ি কিনে নিও। লজ্জা পেতে হবে না।’
শাড়িটা নিয়ো নিলো মিতু। নিরু চেয়েও কিছু বলতে পারলো না। কেবল বিরবির করে বললো,
‘আমি সত্যিই বিক্রি করতে চাই না!’
নবীন বরণ শেষ হয়েছে মাস পাঁচেক হলো। এখনো সে টাকা নিরু হাতে পায়নি। লোকলজ্জার ভয়ে চাইতেও পারেনি। তবে নিরু ঠিক করেছে এবার গ্রাম থেকে তারা ফিরলে মিতুর কাছে সে টাকা চাইবে। কিছু ক্ষেত্রে লজ্জা না থাকা ভালো।
.
.
নিরুর আনন্দের ঘুমের বেড়াজাল ভাঙলো সহসা বেজে ওঠা ফোনের শব্দে। স্বাদের ঘুম ভাঙায় মহা বিরক্ত হলো সে। আজকাল মোবাইল নামক যন্ত্রটার প্রতি প্রচন্ড বিতৃষ্ণা জেগেছে তার। কোনোরকম শরীর টেনে তুলে কল রিসিভ করে কানে চেপে ধরতেই ওপাশ থেকে রাশভারী গলায় কেউ শুধালো,
‘এত দেরী কেন?’
নিরু তখনো ঘুমে ঢুলছে। উক্ত কথা তার মস্তিষ্ক নিতে পারল না তৎক্ষণাৎ। আর না পারলো এমন রাশভারী গলার মালিককে চিনতে। কপাল বরাবর ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,
‘কে আপনি?’
প্রশ্নটা অহেতুক। সেভ করা নম্বরটিতে জ্বলজ্বল করছে কলদাতা ব্যক্তির নাম। কিন্তু নিরু ঘুমের বশে তা দেখতে পায়নি। অপর ব্যক্তি ফোনের ওপাশ থেকে শান্ত গলায় বললো,
‘নম্বরটা তাহলে এখনো সেভ করোনি?’
নিরুর ঘুমের হ্রেস কিছুটা লঘু হয়েছে। মস্তিষ্ক সচল হতেই সে কান থেকে ফোন নামিয়ে চোখের সামনে ধরলো। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ‘চৌধুরি সাহেব’ নামটি। নিরু তৎক্ষণাৎ জিভ কাটে। ফোন কানে চেপে ছোট করে বলে,
‘দুঃখিত। আসলে..’
‘ঘুমাচ্ছিলে?’
‘হুম।’
‘বিরক্ত করলাম?’
‘তা কেন?’
ওপাশের লোকটা খানিক হাসলো। শুধালো,
‘বিকেল হলে দেখা করো? আমি তোমার হলের সামনে আসবো।’
কথাটা বলেই লাইন কেটে দিল। নিরু উত্তর দিতে পাররো না। প্রততিবার দেখা করার কথা উঠলে এমনটাই করে লোকটা। নিরুর মুখ থেকে ‘না’ শোনার মতো খারাপ জিনিস সে শুনতে চায়না। যদিও আজ নিরু না করতো না।
_____________
সাদাফের সাথে নিরুর দেখা হয়েছিল বরিশাল যাবার পথে। বাসে তাদের সিট পাশাপাশি ছিল। দুর্বল ভাগ্য নিয়ে জন্মানো নিরুর ভাগ্যে সেবার জানালার পাশের সিট ছিলো না। সাদাফের ছিল জানালার পাশের ছিট। লোকটা গম্ভীর ধাঁচের। নিরু বাসে উঠে তার পাশে বসার পর একবার ও ঘার ফিরিয়ে তাকায়নি। পুরোটা সময় জানালা থেকে বাহিরে তাকিয়ে ছিল।
নিরুর বাস যাত্রায় বমি করার অভ্যাস আছে। বাসে ওঠার আগে সে বমির ওষুধ খেয়ে উঠেছে। তবুও কেমন পেট মুচড়ে উঠছে। হাত দিয়ে নাক মুখ চেপে স্থির হয়ে বসে আছে সে। এতক্ষণে তার পাশে থাকা রোবট মানুষটা কথা বলে উঠে।
‘খারাপ লাগছে আপনার?’
নিরু কেবল মাথা উপর নিচ করে উত্তর জানালো। সাদাফ ভদ্রলোকের মতো জানালার সিটটা নিরুকে দিয়ে দিলো। জানালার গ্লাস টেনে সরিয়ে দিতেই নিরু বড় করে শ্বাস ছাড়লো। বাহির থেকে আসা ফুরফুরে বাতাসে শ্বাস নিতেই সব খারাপ লাগা নিমিষেই হারিয়ে গেলো। নিরু পাশ ফিরে সাহেদকে দেখলো। লোকটার হাইট মিডিয়াম হবে। গায়ের রঙ কালো বলা চলে না। একটু উজ্জ্বল। মুখ জুড়ে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। শক্ত চোয়াল। পোশাক আসাকে তাকে ভদ্র পরিবারের বলেই মনে হলো। কানে হেডফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। নিরু একবার ধন্যবাদ দিতে চাইলো। কিন্তু কিভাবে? কানে যে লোকটা হেডফোন গুঁজে রেখেছে। নিরু তবুও নরম গলায় ডাকলো,
‘এই যে! শুনছেন?’
নিরু ভেবে নিয়েছিল লোকটা শুনতে পাবে না। কিন্তু সে শুনতে পেলো। চোখ মেলে তাকালো সরাসরি নিরুর চোখে। কি প্রকট সে চাহনি! নিরু তাকিয়ে থাকতে পারলো না। চোখ সরিয়ে আবারো তাকালো। লোকটা তার দিকে সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়লো,
‘কিছু বলবেন?’
কাটকাট প্রশ্ন। কথার ধরনেরই বোঝা যাচ্ছে মানুষটা খুব একটা কথা বলে না। যতটুকু বলে সেটাও খুব কাটকাট। নিরু অপ্রস্তুত হেসে বললো,
‘ধন্যবাদ।’
‘কেন?’
‘এই সিটটার জন্য।’
‘এরপর থেকে নিজের সমস্যা গুলো মুখ খুলে বলবেন। অহেতুক কথা না বলে প্রয়োজনের কথা গুলো বলতে শিখুন।’
ঠান্ডা ভাবে করা অপমান নিরুর হজম হলো না। তবুও গলা চেপে হজম করে নিলো। এভাবে মানুষ তাকে মুখের উপর বাচাল বলার পরও সে কিছু বলতে পারলো না দেখে ভেতরটা কেমন হাঁসফাঁস করছে। এটা তার একটা রোগ। কেউ কিছু বললে সে উত্তর না দিয়ে থাকতে পারেনা। যতক্ষণে সে উত্তর দিবে না ততক্ষন সে অন্য কাজে মন দিতে পারবে না। মাথার ভেতর ঐ একটা ব্যাপার ঘুরঘুর করে বেড়াবে। নিরু তার অতি পরিচিত স্বভাব বদলাতে পারলো না। পাশে বসে থাকা অতিব ভদ্রলোককে ছোট করে ডাকল,
‘এই যে! শুনুন?’
সাদাফ তার পাশে বসা মেয়েটার এমন ঘ্যানঘ্যান স্বভাবে অতিষ্ঠ প্রায়। এই জায়গায় কোনো ছেলে হলে এতক্ষণে এক ধমকে চুপ করিয়ে দিত সে। কিন্তু মেয়ে হওয়ায় যত বিপত্তি। ধমক দিলেই দেখাগেল কেঁদে কেটে একাকার করলো। তখন আরো এক বাজে অবস্থা ক্রিয়েট হবে। এসব ভেবেই সে ছোট করে শ্বাস ফেলল। পাশে ফিরে ভ্রু উঁচু করতেই মেয়েটা বেশ কনফিডেন্স নিয়ে বললো,
‘দেখুন আমি একদম বাঁচাল নই। এটা মিসআন্ডারষ্টান্ডিং ছিলো।’
সাদাফ ছোট করে জবাব দিলো,
‘আচ্ছা।’
নিরু এমন জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারলো না। তার ভেতরটা হাঁসফাঁস করছে। লোকটা সত্যিই কি বুঝেছে!
পুরোটা যাত্রায় লোকটার সাথে তার আর কথা হলো না। নিলু একবার ভেবেছিল ডেকে শুনবে সে কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণে নিজ সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। এমন নাক উঁচু স্বভাবের মানুষের সাথে কম কথা বলা শ্রেয়। জানালা থেকে বাহিরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কিছু একটা আবিষ্কার করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে ঘুমকে আবিষ্কার করলো। ঘুম ভাঙলো যখন তখন বেলা পড়ে গেছে। যাত্রিরা সকলে নেমে গেছে প্রায়। তার দিকে অদ্ভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার প্রতিবেশী সিটের মালিক। নাক কুঁচকে বললো,
‘আপনি কি ঘুমানোর জন্য এতটা পথ পাড়ি দিলেন?’
নিরুর কিছুটি অস্বস্তি বোধ হয়। এভাবে অচেনা কারো সামনে ভুষভুষ করে ঘুমানোটা অবশ্যই গর্ব করার মতো কিছু না। তার উপর জন্মসুত্রে পেয়ে যাওয়া নাক ডাকা ব্যপারটা যদি ঘটে থাকে তবে এ মুহূর্তে তার উঠে দাঁড়ানোর থেকে জানালা থেকে বাহিরে ঝাঁপ দেওয়া শ্রেয়।
‘আপনি কি এখানেই থাকতে চাচ্ছেন? তবে আমি চললাম। ফাঁকা বাসে একা একটা মেয়েকে ফেলে রেখে যাওয়াটা অপরাধ বোধ হচ্ছিলো তবে এবার আর যেতে অসুবিধা নেই। চললাম মিস।’
কথা শেষ হতে কালো রঙের ব্যাগটা কাঁধে চাপিয়ে সত্যিই পা বাড়ালো বাহিরে। এতক্ষণ থমকে থাকা নিরু নড়েচড়ে ওঠে। নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে দ্রুত বাস থেকে নামে। সাদাফ ততক্ষণে বড় বড় পা ফেলে অনেকটা দূরে এগিয়ে গেছে।
চলবে……
(বি.দ্র: ইহা একটি ছোট গল্প। ভালোবাসা আপনাদের)