প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব-০৯

0
1221

#প্রেমময়ী_বর্ষণে_তুই(০৯)
লাবিবা ওয়াহিদ

বিকট ডং ডং শব্দে রায়াফ অনেকটা বিরক্ত নিয়ে পিটপিট করে তাকালো। শব্দের মাত্রা তীব্র থেকে আরও তীব্র হচ্ছে। দুই কানে হাত দিয়েও কোনো লাভ হলো না। শেষমেষ বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে পরলো। নাহ তাতেও কাজ হলো না। রায়াফ লাফ দিয়ে উঠে বসলো। চোখে-মুখে রাগী ভাব স্পষ্ট। জিনিও কিছুক্ষণ আগেই উঠেছে। রায়াফ ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো মাত্র সাড়ে ৪টা বাজে। এই সময়ে তার এতো সমস্যা যার জন্য কানের সামনে এসব বাজিয়ে কানের মাথা খাচ্ছে? শব্দটা দরজার দিক থেকেই আসছে, তাই রায়াফ দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। এগিয়ে যেতে যেতে শুনলো,

-“উঠুন, উঠুন। নামাজের সময় হয়ে গেছে উঠুন। ঘুম থেকে নামাজ উত্তম, উঠুন। গ্রামে এতো সময় নিয়ে ঘুমানো জায়েজ না উঠুন!”

আফনা এগুলো বলছে আর স্টিলের থালায় স্টিলের গ্লাস দিয়ে ধুরুম ধারুম বাজাচ্ছে। এই শব্দে মানুষ কেন, পশুপাখিও ঘুম থেকে উঠতে বাধ্য। আফনা শুধুমাত্র রায়াফের ঘুমের ১২টা বাজাতেই এসব কলকাঠি নেড়েছে। বড়লোককে এবার সে বুঝাবে ঠ্যালার নাম বাবাজি। আফনা আরও কিছু বলতে নিলেই খট করে দরজাটা খুলে রায়াফ বেরিয়ে আসে। রায়াফকে দেখে আফনার বাজানো মুহূর্তেই থেমে গেলো। আবারও এক বস্তা অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরলো। কিন্তু এই মুহূর্তে সে তার অস্বস্তিতে কান্ট্রোলে রেখেছে। রায়াফ ভ্রু-জোড়া কুচকে আফনার দিকে তাকিয়ে আছে। আফনা তার থালার একপলক তাকিয়ে রায়াফের দিকে তাকালো এবং দাঁত কেলিয়ে বললো,

-“এটাই নিয়ম৷ নামাজের সময় সকলকে উঠতে হবে, দাদীর হুকুম। তাই আমি এসেছি আপনাদের ঘুম ভাঙ্গাতে। আপনারা শহরের হলেও কিছু করার নাই, নিয়ম সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য!”

বলেই একটা পোজ মেরে আফনা চলে গেলো। আফনার মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এদিকে রায়াফ মনে মনে বললো,

-“শেষোক্ত কথা দিয়ে কী মেয়েটা আমায় খোচা মারলো? স্টুপিড একটা!”

বলেই রুমের মধ্যে ঢুকে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো। আল্লাহ মালুম আর কতদিন এখানে ঝামেলা সহ্য করতে হবে। রায়াফ আর ঘুমালো না কারণ, কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের আযান দিবে। কিন্তু তার মাথা ব্যথা একদমই কাটছে না। কফি খাওয়া বড্ড জরুরি ছিলো। কিন্তু এ সময়ে কেই বা তাকে কফি বানিয়ে খাওয়াবে? ভাবতে ভাবতেই সে ওয়াশরুম চলে গেলো।

রায়াফ চোখ গরম করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে না। ড্রাইভার সবটা চেক করে দেখলো টায়ার পাঞ্চার। ড্রাইভার রায়াফের কাছে এসে বললো,

-“টায়ার পাঞ্চার হয়েছে স্যার। কিন্তু কীভাবে হলো বুঝতে পারছি না, এখানে আসা অবধি তো সবই ঠিক ছিলো।”

রায়াফের হঠাৎ দূরে চোখ যেতেই কেউ একজন গাছের পিছে লুকিয়ে পরলো। ওড়নার কিছুটা অংশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রায়াফ এও বুঝলো এই ওড়নার অংশটি কার? রায়াফের এখন সবটা একে একে বুঝতে পারলো৷ সকালের ওই ঘটনা, এখন আবার টায়ার পাঞ্চার। রায়াফ দাঁত কিড়মিড় করে ভাবলো,

-“তোমার শাস্তি তুমি পাবে!”

-“হায় আল্লাহ আমায় কী ওই সাদা ইলিশটা দেখে ফেললো নাকি? ধুর! দেখলে তো সব ফিনিশ হিয়ে যাবে ওই অপদার্থের মতো!”

আরেকবার উঁকি দিয়ে দেখলো রায়াফ ভেতরের দিকে চলে যাচ্ছে। আফনা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো এবং নিজের কাজে চলে গেলো।
.
-“ভাই আপনি এতো বড় প্লেয়ার, আপনার সাথে তো এক ম্যাচ হওয়াই চলে কী বলেন? অনেকদিনের ইচ্ছে আপনার সাথে কিছুটা সময় হলেও খেলার।”

রায়াফ মুচকি হাসলো ইসহাকের কথায়। ইসহাকের পাশে থাকা আদনানও মন ভরে রায়াফকে দেখছে। কতো বছরের সাধনা যেন আজ সফল হলো। রায়াফ হেসে বললো,

-“ঠিক আছে, জাস্ট এক ওভার খেলবো। আর ব্যাট আমি ডান হাতেই নিতে পারবো, তুমি তো জানোই আমার বাম হাতে ইঞ্জুরি।”

-“বুঝেছি।”

রায়াফ তার ডান হাতে ব্যাটটা নিয়ে তার ব্যাটিং এর পজিশনে দাঁড়ালো। কিছু ছোট বাচ্চারাও এসেছে ওদের খেলা, বিশেষ করে রায়াফকে দেখতে। রায়াফের অবশ্য এখন আর এসবে অস্বস্তি হচ্ছে না।
রায়াফ নিজের পজিশনে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকাতেই দেখলো আফনা হাতে একটা ঝুড়ি নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। রায়াফ ততক্ষণে একটা ফন্দি করে ফেললো সাথে তার বলটা ঠিক কোনদিকে ছুঁড়বে সেটাও। আফনা তখনো খেয়াল করেনি মাঠে রায়াফ খেলছে। ইসহাক বল ছুঁড়তেই রায়াফ জোরে ছক্কা মারলো। বাচ্চারা সবাই চেঁচিয়ে উঠলো। রায়াফের ছয় হলেও আফনার বারোটা বাজলো। বলটা আফনার কোমড়ের সাইডে সজোরে লাগলো। আফনা ঝুঁড়ি ফেলে কোমড়ে হাত দিয়ে “আল্লাহ গো” বলে চেঁচিয়ে বসে পরে। আফনার চিৎকার শুনে ইসহাক দৌড়ে আফনার দিকে গেলো। রায়াফ সেখানে দাঁড়িয়েই মুখ চেপে হাসছে। এক পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে সে। ফাহানও আফনার দিকে চলে গেলো। রায়াফ হাসতে হাসতে আফনাদের দিকে চলে গেলো। আফনার তার কোমড়ে হাত দিয়ে চেঁচিয়ে বললো,

-“কোন হতচ্ছাড়া রে! চোখে দেখিস না? উফফ মাগো, আমার কোমড় মনে হচ্ছে ভেঙ্গে গেলো। উফফ! যে না দেখে মারছিস তার চোখ দিয়ে আমি গোল্লা ছুট খেলবো!”

-“কোথায় বল লেগেছে বোন, তুই ঠিক আছিস?” ইসহাক উত্তেজিত সুরে বলে উঠে। ইসহাকের মুখে বোন ডাকটা শুনে ফাহানের ভালো লাগা মুহূর্তেই ফুঁস! ইসহাককে দেখে আফনা কাঁদো কাঁদো সুরে বললো,

-“ভাইয়া, দেখ না কোন কানায় আমার দিকে বল ছুঁড়সে!”

তখনই রায়াফ ওদের মাঝে আসলো এবং আফনার কথাগুলোও শুনলো। রায়াফ গলা খাকারি দিয়ে বললো,

-“কানা বল ছুঁড়া মানুষটা নয়, কানা হচ্ছো তুমি। তোমার ধ্যান কোথায় ছিলো? আগে থেকে খেয়াল করে সরে দাঁড়াওনি কেন? ইসহাক তোমার বোন কী মানসিক রোগী নাকি?”

রায়াফের কথায় আফনা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। আফনার মুখশ্রী দেখে রায়াফ তার ঠোঁটজোড়া আলতো প্রসারিত করে ইঙ্গিতে বললো,

-“কেউ অন্যের জন্য ফাঁদ পাতলে নিজেই সেই ফাঁদে গলা অবধি ডুবে যায়। নেক্সট টাইম কারো সাথে লাগতে যেও না। নয়তো কোমড় নয়, পুরো মানুষটাই তুমি হারিয়ে যাবা!”

বলেই হনহন করে চলে গেলো রায়াফ। আফনা সেখানে বসেই সাপের ন্যায় ফোঁসফোঁস করতে লাগলো।

-“ও আল্লাহ! কলির বাচ্চা আস্তে চাপ দিতে পারিস না? বরফ দেয়ার কী দরকার?’

-“বরফ দিলেই ব্যথা জলদি কমবে তাই এই ব্যথা চুপচাপ সহ্য কর, কিছুই করার নেই!”

আফনা রায়াফের কথা ভাবতে ভাবতে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-“এর প্রতিশোধ আমি নিবোই, রায়াফ সানভী!”

আজ বিয়ের জন্য সকলে শপিং এ যাবে। গতকাল ইসহাক এবং নিহার এঙ্গেজমেন্টের অনুষ্ঠান হয়েছে। আজ বিয়ের শপিং এ শহরে যাচ্ছে। ইসহাক নিহাকেও নিবে ঠিক করেছে। ফাহান গেলেও রায়াফ যাবে না। তার এসব মোটেও পছন্দ না। তাই ফাহান জোর করেনি, জিনিকে রায়াফের কাছে রেখে চলে গেলো। আফনা যখন শুনলো রায়াফ যাবে না তখন সে নানান বাহানা দিয়ে নিজেও থেকে গেলো দাদীর কাছে। আফনা কাজ করে দাদীর বাসায় যাওয়ার নাম করে বের হলো আর ভাবতে লাগলো আজ কীভাবে রায়াফকে শায়েস্তা করা যায়। সেদিনের পর পাক্কা ২দিন আফনা কোমড়ের ব্যথায় ভুগেছে।
রায়াফ হয়তো ভাবছে আফনা থেমে যাবে কিন্তু আফনাও যে থেমে যাওয়ার পাত্রী নয়। তাই আফনা নানান ছক আঁকতে আঁকতে দাদীর কাছে যাচ্ছিলো। ওদের দুই বাড়ির মাঝামাঝি একটা বিশাল পুকুর পরে। ওই পুকুরটা আফনাদের পারিবারিক পুকুর। আফনার পুকুরের দিকে চোখ যেতেই দেখলো রায়াফ পুকুরের ঘাটে বসে দূরে তাকিয়ে আছে। রায়াফকে ওই অবস্থায় দেখে আফনার মাথায় আবারও একটা দুষ্টু বুদ্ধি আসলো। আফনা ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো। রায়াফ তখনো ভাবনায় মত্ত।
আফনা আস্তে ধীরে রায়াফের পিছে এসে দিলো এক ধাক্কা। রায়াফও তাল সামলাতে না পেরে পা পিছলে পুকুরে গিয়ে পরলো। আর আফনা জোরে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো,

-“এই আফনার পিছে লেগে কোনো কাজ নেই খেলোয়াড় সাহেব! এই আফনা কী জিনিস এখনো আপনি বুঝেননি!”

রায়াফ তার চোখ কচলে কয়েকবার কাশি দিয়ে রাগি চোখে আফনার দিকে তাকালো। আফনার হাসিটা যেন কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতো। রায়াফ জোরে “জিনি” বলে ডাকতেই জিনি কোথা থেকে এসে আফনাকেও ধাক্কা দিলো। আফনাও ঠিক একইভাবে পা পিছলে রায়াফের পাশেই পরলো। আফনা কাচুমাচু হয়ে পানির থেকে উঠতেই জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। আফনা পানির মধ্য থেকে মাথা উঠাতেই রায়াফ আফনার মাথায় হাত দিয়ে কয়েকবার আফনাকে পানির মধ্যে চুবালো। ঘাটের উপরের সিঁড়ি থেকে জিনি লেজ নাড়িয়ে ওদের চুবাচুবির খেলা দেখছে। জিনি বেশ মজা পাচ্ছে ওদের এমন কর্মকান্ডে।

~চলবে।

বিঃদ্রঃ রিচেক দেয়া হয়নি তাই ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে