#প্রেমময়ী_বর্ষণে_তুই(০৩)
[অনেকের অভিযোগ “লিলি” নামটা খাপছাড়া লাগছে তাই নায়িকার নাম “লিলি”-র বদলে ” আফনা” রাখা হলো।]
শুভ্র সকালের মিষ্টি রোদে আগাম বৃষ্টিতে ভেঁজা প্রতিটি সবুজ পাতা চিকচিক করছে। সোনালী রোদের ঝাপটায় প্রকৃতি যেন লজ্জায় নিজেদের আবৃত করার চেষ্টায় মত্ত। পাখিদের মধুময় গান এবং শীতল স্নিগ্ধ বাতাসে আজ পরিবেশটা একদম মন ভালো করার মতোন। এমন সুন্দর একটা পরিবেশে বল কোথা থেকে আসলো সেই বিষয়টাই একনাগাড়ে ভেবে চলেছে রায়াফ। বলটির গতি ছিলো ধীর, রায়াফ কিছুটা এগোতেই দেখতে পায় একটি মেয়ে তার দিকেই ছুটে আসছে। কাউকে এদিকে আসতে দেখে রায়াফ তৎক্ষনাৎ মাস্ক দ্বারা তার অর্ধেক মুখমন্ডল আবৃত করে ফেললো। মেয়েটি দৌড়ে আসার সময়ই দেখতে পেলো বলটি তার সামনে থাকা লম্বা ছেলেটির মুঠিতে। তা দেখে আফনা রায়াফের সামনে এসে দাঁড়ায় এবং হাঁটুতে দু’হাতের ভর দিয়ে একনাগারে হাঁপাতে লাগলো।
রায়াফ চোখ বড় বড় করে আফনার দিকে তাকিয়ে রয়। মেয়েটি কেন তার সামনে এসে দাঁড়ালো? আর এতো সকালে বাহিরে কী করছে? তার মগজে এতো এতো প্রশ্নের পাহাড় হলেও আপাতত কোনো উত্তরই ঠাহর করতে পারলো না। আফনা হাঁপাতে হাঁপাতে রায়াফের দিকে তাকালো। ছেলেটির চোখের দিকে তাকিয়ে কোনোরকম ভনিতা না করেই বলে উঠলো,
-“বলটি দেন!”
আফনার এমন কথায় রায়াফ আবারও চমকে উঠলো। দুজনেই চোখে চোখ রাখা। রায়াফ একদম চুপ করে আফনার আঁখিপল্লব দেখতে ব্যস্ত। ছেলেটিকে ভাবনায় মত্ত হতে দেখে আফনা তার সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
-“বলেছি বলটা দেন!”
রায়াফের ধ্যান ভাঙলো। সে কোনরকম বিভ্রান্তি ছাড়াই বলটি দিলো। আফনা ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যেতে নিবে এমন সময়ই রায়াফ অস্ফুট সুরে বলে উঠলো,
-“আপনি এই সাতসকালে বল দিয়ে কী করছেন?”
রায়াফের প্রশ্নে আফনা থেমে পছে ফিরে দাঁড়ায়। উত্তর দিলো,
-“ক্রিকেট খেলছি!”
এবার যেন রায়াফের ঝটকার পরিমাণ সীমানা অতিক্রম করে ফেললো। আবারও অস্ফুট সুরে বলে উঠে,
-“ক্রিকেট তাও এই ভোরে? এ আবার কেমন কথা?”
-“একটা ছোট ভাই থাকলে বুঝবেন কী কী করতে হয়। ডেয়ারে ফাঁসলে যা হয় আর কী। আর এই ভোরবেলায় মানুষজন থাকে না তাই আমার জন্য এটাই পারফেক্ট সময়!”
বলেই একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে সে দৌড়ে চলে গেলো। আফনার কথাগুলোতে রায়াফের কেমন কৌতুহল জাগলো। অদ্ভুত এই মেয়ে। তাই সে পরের কাহীনি বোঝার জন্য আফনার পিছু নিলো। কিছুটা দূরেই বিরাট মাঠ। সেখানে গিয়ে দেখলো এক বাচ্চা ছেলে একটি ব্যাট তার পাশে ফেলে হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। যেন সে খুবই ক্লান্ত। আফনা যাওয়ার পর আদনান বলে উঠে,
-“একটা বল আনতে এতক্ষণ লাগে?”
-“তুই চুপ কর! আমার সময় লাগলে নিজে গিয়ে আনলি না কেন? এখন ব্যাট আমায় দে, তুই বল ছুঁড়বি!”
-“এই না, এগুলার নিয়ম নেই। তুমি কী নিয়ম জানো না?”
-“তোর নিয়মের গুল্লি মারি! তোর সাথে খেলছি এটাই তোর সাত কপালের ভাগ্য! ডেয়ার ইজ ডেয়ার! এতো নিয়ম মানতে পারবো না!” বলে একপ্রকার জোর করে ব্যাটটা আদনানের হাত থেকে নিয়ে নিলো। আদনান বিড়বিড় করে আফনাকে বকতে বকতে বল নিয়্ব তার পজিশনে গেলো।
রায়াফ দূরে দাঁড়িয়ে দুই ভাই-বোনের কান্ডকারখানা দেখছে। সত্যি বলতে সে বিষয়টা বেশ এঞ্জয় করছে।
আদনান বল ছুঁড়তেই আফনা ছক্কা মারলো। আফনা আনন্দে জোরে লাফিয়ে উঠলো। অতঃপর ব্যাট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আদনানের উদ্দেশ্যে বেশ জোরেই বলে উঠলো,
-“দেখেছিস, আমি রায়াফ সানভির চেয়েও কতো ফাস্ট!? জীবনে প্রথম ক্রিকেট খেলেই ছক্কা মেরে দিলাম। আর ওই রায়াফ জীবনে প্রথম কী এমন পারসে? বুঝেছিস আদনান! কোচ কখনো খেলে না, আমি ক্রিকেট অপছন্দ করি বিধায় বেচারী গার্লস’রা বিভিন্ন দলে ভাগ হচ্ছে। চিন্তা করে দেখ, ১১জনের মধ্যে আমি বাদ যাওয়ায় আরেক প্লেয়ার ঢুকতে পারছে, হু হা হা!!”
এসব আন্তাজি লজিক শুনে রায়াফের কাশি উঠে গেলো। তার সামনে দাঁড়িয়েই এক মেয়ে তাকে বুক ফুলিয়ে ইনসাল্ট করছে এবং তুলনাও করছে? ভারী আশ্চর্য মেয়ে তো! পরমুহূর্তে এ ধরণের আন্তাজি লজিক ভেবে রায়াফ নিশব্দে হাসলো। এই দুই ভাই-বোনের মাঝে আর না থেকে সে সেখান থেকে চলে গেলো। আদনান বলের দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে বলে,
-“তোরে জীবনেও ওসব জাতীয় দলে ঢুকাবে না। যখন ট্রেনিং নিতে যাবি না, তখন তোরে লাথি উষ্টা দিয়ে ক্যাম্প থেকে বের করবে। তাই ওই ভাইবা ফাউ কামাই কইরো না মনু!”
-“তুই নিজেই ফাউল তাই আমাকে নিয়ে জ্বলিস। যাইহোক ব্যাপার না, এখন জলদি কর। আম্মু ঘুম থেকে উঠার আগেই বাসায় যাওয়া লাগবে নয়তো নাস্তা খাওয়া বুঝায় দিবে।”
আদনান আর দেরী করলো না। দুজন খেলে ধুলে সাতটার পরে বাসায় পৌঁছালো। তবে দুজন তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে দেরী-ই করে ফেলেছে। আম্মু ঘুম থেকে উঠে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সিঁড়ির নিচে থেকে দুজন তাদের মহীয়সী আম্মাকে দেখতে পেয়েছে কিন্তু ভয়ে এগোতে পারছে না। আফনা এবং আদনান একে অপরের দিকে তাকিয়ে দেখলো জামা-কাপড় কিছুটা নোংরা হয়েছে। আদনান আফনাকে ফিসফিসিয়ে বললো,
-“আপু, এখন কীভাবে যাবো? মা তো ঠিকই বুঝে গেছে আমরা বাসায় নেই।”
-“আস্তে কথা বল। বাবাই ছাড়া উপায় নেই। বাবাই তো সাড়ে সাতটার পর ঘুম থেকে উঠে কিন্তু আম্মা আমাদের হাতেরকাছে পেলে তার পাঁচ মিনিটও লাগবে না আমাদের কিমা বানাতে?”
-“সেটাই তো ভয়।” কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো আদনান! ওদের ফিসফিসানি আম্মুর কান অবধি চলে যায়। উনি অতি কঠিন গলায় বলে উঠে,
-“আফনা, আদনান! আমায় বাধ্য করবি না তোদের ধরে নিয়ে আসতে, তাই বলছি এখনই আমার সামনে আয়। নয়তো দুটোর একটাও কোনোরকম ছাড় পাবি না!”
আফনা এবং আদনান উভয়েই মাথা নিচু করে ভীতু গলায় নিয়ে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আম্মার সামনে এসে দাঁড়ালো। আম্মা আবার বললেন,
-“ভেতরে আয়!”
দুজন বেশ ভালো বুঝলো আজ তাদের কপালে দুঃখ আছে তাই কোনো কথা না বলেই ভেতরে চলে গেলো। আম্মা ভেতরে এসে সদর দরজা সজোরে বন্ধ করে দেয়, এতে যেন ওদের রূহ কেঁপে উঠলো। আম্মা আদনানের উদ্দেশ্যে বলে,
-“রুমে গিয়ে গোসল করবি অতঃপর নিজে কাপড় কাঁচবি এটাই তোর শাস্তি! যা এখন।”
আদনান বিনা বাক্যে সুড়সুড় করে নিজের রুমে চলে গেলো। আদনান যেতেই আম্মা আফনার কান টেনে বললো,
-“এই ফাজিল! তুই অনার্স পড়ুয়া মেয়ে হয়ে লজ্জা করে না এভাবে মাঠে গিয়ে দৌড়াতে? আদনান নাহয় বাচ্চা তা তুই কোন বাচ্চা হ্যাঁ? ”
-“আউচমা লাগছে! উফ। ছাড়ো, সব তোমার ছেলের দোষ! তোমার ছেলেই আমায় ডেয়ার দিয়ে বাধ্য করেছে।”
-“নিকুচি করি তোর ডেয়ারের। আর যদি এসব ফাউ গেম খেলিস তখন আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না। এখন যা গিয়ে গোসল সেরে কাপড় কাঁচ! আমি নাস্তা বানাতে গেলাম।” বলেই আম্মা কান ছেড়ে কিচেনের দিকে চলে গেলেন। আফনা তার কানে হাত বুলাতে বুলাতে নিজের রুমে চলে গেলো।
★
রায়াফ তার দাদীর কোলে মাথা রেখে নিশ্চুপ হয়ে সকালের সময়টা একনাগাড়ে ভেবে চলেছে। দাদীমা রায়াফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
-“কী হলো আমার নাতীটার? আজ তার ব্যবহার অন্যরকম ঠেকছে? কী ব্যাপার হু?”
রায়াফ হাসলো। অতঃপর দাদীর কোল থেকে মাথা উঠিয়ে বাঁকা হেসে বলে,
-“কিছু না দাদী। সকালে বের হয়ে অনেকটাই হালকা লাগছে।”
-“ঠিক আছে বুঝলাম। তোর চাচার সাথে দেখা করলি না যে?”
-“গতকাল চাচ্চু তো তার খাতা দেখতে বিজি ছিলো তাই ডিস্টার্ব করিনি!”
-“এই ছেলেকে নিয়ে পরেছি আরেক জ্বালায়। সারাদিন এই বই খাতা নিয়ে পরে থাকে। এরে কে প্রফেসর হতে বলেছে বল তো? আবার কারি কারি স্টুডেন্ট এসেও ভরে যায়!”
-“প্রফেসর হওয়া তো খারাপ কিছু না দাদী। আচ্ছা তুমি বিশ্রাম করে বসো আমি চাচ্চুর কাছে যাচ্ছি।”
বলেই রায়াফ তার চাচার রুমে চলে গেলো। চাচ্চু তখন মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলো। রায়াফ রুমে প্রবেশ করতে করতে বললো,
-“কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত চাচ্চু?”
হঠাৎ কারো কন্ঠসর পেয়ে চাচ্চু খাতা থেকে চোখ সরিয়ে রায়াফের দিকে তাকায়। রায়াফকে দেখে হেসে বললো,
-“আরে আমার ছেলে এসেছে যে। বসো বসো। আর সরি গতকাল রাতে তোমায় বেশি সময় দিতে পারিনি। ইক্সাম হচ্ছে, সেসব খাতাপত্র নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছি।”
-“আমি বুঝেছি তোমার অবস্থা, তা এভাবে চিন্তিত হয়ে আছো কেন?”
-“আর বলিস না, এক স্টুডেন্ট কি-সব কুকথা লিখে খাতা ভরে ফেলেছে। এই যেমন ধর,
“একুশ বাইশ ইলিশ
অপদার্থ এবার ফিনিশ!”
“তেরো মাছে ভাতের ঘি
জুতো মাজে ফিজিক্সের ঝি!”
রায়াফ হতভম্ব হয়ে গেলো এধরণের ছন্দ শুনে। এই মুহূর্তে তার ঠিক কী-ধরণের রিয়েকশন নেয়া উচিত ঠাহর করতে পারলো না। চাচ্চু আবার বলে উঠলো,
-“এর মতো বেয়াদব স্টুডেন্ট আমি আমার এ-জনমেও পাইনি। ভাবতে পারছো কতোটা বেয়াদব?”
-“ছেলে নাকি মেয়ে?”
-“মেয়ে।”
®লাবিবা ওয়াহিদ
~চলবে।
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।