প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব-১৯ এবং শেষ পর্ব

0
1765

#প্রেমময়ী_বর্ষণে_তুই
লাবিবা ওয়াহিদ

| শেষাংশ |

আফনাকে রায়াফ যখন সারপ্রাইজের কথা বলেছিলো ও ঠিক পরেরদিনই ওকে প্রপোজ করবে ভেবেছিলো কিন্তু তখন তার চাচ্চু জানায় কৌশল আবারও সোনিয়াকে দিয়ে কিছু কার্যসিদ্ধি করতে যাচ্ছে। এর মাঝে আফনাকে তারা মারতেই সময় নেবে না। এ শুনে রায়াফ বেশ বিচলিত হয়ে পরে। প্ল্যান করলো সোনিয়ার সাথে ভালোবাসার নাটক করবে। পরমুহূর্তে আবার ভাবলো এতে তো আফনাকে ঠকানো হবে। তাই রায়াফ চিন্তা করলো কী করলে ভালো হবে, ওর এসব চিন্তার মাঝে ফাহান শেফাকে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ওদের সাথে বিজনেসের কাজেও দুইদিন বিজি ছিলো৷ এর মাঝে শেফা একদিন এসে বলে তার খালাতো ভাই মানে শাকিল তাদের বিষয়ে ঠিক কী কী প্ল্যান করছে। শাকিল যে শেফারই খালাতো ভাই রায়াফ তখনো জানতো না। শেফার মুখে শুনতেই তার ইনফর্মারের কল এলো আফনাকে কারা যেন তাড়া করেছে।

সেদিন আফনার মুখে তার সম্পর্কে এসব অভিযোগ শুনে রায়াফের ভেতরটা শীতল হয়ে গেছিলো। পরমুহূর্তে রায়াফ যখন আফনার থেকে জানতে পারলো শাকিল তাকে অপহরণ করার চেষ্টা করেছে তখন রায়াফের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। পরেরদিন সে শেফাকে বলে যে করেই হোক পরের প্ল্যান যেন শাকিলের থেকে জেনে নেয়। শেফাও রায়াফের কথামতো কাজ করতে থাকলো। এদিকে রায়াফ আরেকটা প্ল্যান করে। সোনিয়াকে সে বলে,

-“আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাসো, তবে আমিও অন্য কাউকে ভালোবাসি। তাই তুমি কখনোই আমার লাইফ পার্টনার হওয়ার চিন্তা করো না। তুমি যদি আমার বন্ধু হয়ে থাকতে চাও, তাহলে থাকো নয়তো জাস্ট লিভ!”

রায়াফের এক কথায় সোনিয়া রাজি হয়ে গেলো। কারণ, তার পরের প্ল্যান হাসিলের জন্য রায়াফের আশেপাশেই তাকে থাকতে হবে। এদিকে রায়াফ কৌশিলে সোনিয়ার বাবার নাম্বারটা সোনিয়ার ফোন থেকে ব্লক করে দেয় আর রায়াফ এদিক দিয়ে কৌশলকে জানায় তার মেয়ে রায়াফের কাছে আছে। কৌশল যদি বাংলাদেশ না আসে, কোনরকম চালাকীর চেষ্টা করে তাহলে সোনিয়াকে সেই মুহূর্তেই শেষ করে ফেলবে। এতে কৌশল ভয় পেয়ে যায়, রায়াফ জানে সোনিয়া তার একটি দুর্বল পয়েন্ট। তবে কৌশল প্রথমে রায়াফের কথা বিশ্বাস করেনি, যখন সোনিয়াকে টানা দুইদিন কল করেও সোনিয়াকে পেলো না তখন সে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। ইভেন রায়াফ ছবিও পাঠায়, কৌশল আরও ২৪ ঘন্টা সময় নিয়ে বাংলাদেশ আসে।
এরমাঝে সোনিয়াকে রায়াফ জানায়, আজ আফনাকে সে প্রপোজ করবে। সেই হিসেবে সোনিয়াও নিজের প্ল্যান সাজিয়ে নেয়। সেই প্ল্যান শাকিলকে জানাতেই শেফা কৌশলে তা জেনে নেয়। শাকিল এখনো জানে না রায়াফের কাজিনই শেফার উডবি!
শেফা রায়াফকে সবটা জানাতেই সেও তার প্ল্যান করে ফেললো। সোনিয়ার ব্যবহার করা একটা রুমাল আগেই জিনিকে দিয়ে শুকিয়ে নেয় যাতে পরবর্তীতে কাজে দেয়।
প্ল্যান অনুযায়ী আফনা এলো না, সোনিয়া চিরকুট দিলো আর রায়াফও ব্যথিত হওয়ার নাটক করলো। সোনিয়া যেতেই রায়াফ পুরানো প্রথা কুকুরকে দিয়ে শুকিয়ে শুকিয়ে সোনিয়ার গোডাউনে চলে আসলো। ফাহান এদিম দিয়ে পুলিশকেও সঙ্গে এনেছে। রায়াফ এর মাঝে কৌশলকে জানিয়ে দেয় তার মেয়েকে এখানে বন্দি করেছে সে। কৌশল এখানে নিজের মেয়ের হাতেই মরবে কে জানতো?

তবে রায়াফ মনে করে এর চেয়ে ব্যাটার শাস্তি এই দুনিয়ায় আর নেই। যাকে জীবনে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো সে যদি তোমার খুনি হয় এ বিষয়টা কেউ একদমই মানতে পারে না। সেখানে রায়াফের বাবা হিমেলকে কৌশল মেরে দোষ দিয়েছিলো রিক্তার। আফনা অজ্ঞান হয়ে পরতেই রায়াফ জলদি আফনাকে হসপিটালে নিয়ে যায় এবং সবাইকে হসপিটালে আসতে বলে। আধ ঘন্টার মাঝেই সকলে চলে আসলো। আফনার বাবা-মা, রায়াফের মা এবং চাচা। শেফা আগে থেকেই আফনার মাকে থামানোর চেষ্টা করছে। এদিকে আফনার বাবা নির্বাক হয়ে রায়াফকে দেখছে। কাউকে একনাগাড়ে টিভি, সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখার পর হুট করে সামনাসামনি দেখাটা একটু অস্বাভাবিক-ই অনুভব হয়। তবে এখানে তার ক্ষেত্রে কারণ ভিন্ন। রায়াফ তার মেয়ের জন্যই পাগল প্রায় হয়ে আছে, যেন কোন পাগলা প্রেমিক। কিছুক্ষণ বাদে ডক্টর বের হতেই জানায় আফনা ঠিক আছে, তবে তার রেস্টের প্রয়োজন।

রাত এখন প্রায় ১২টা। এই রাত ১২টায়-ই হসপিটালের সামনে রিপোর্টার এবং রায়াফের ফ্যানদের ভীড় জমেছে। রায়াফ আফনাকে দেখে এসে আফনার বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো। রায়াফের দৃষ্টি মেঝের দিকে স্থির। আফনার বাবা তখনো রায়াফের দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে। রায়াফ অতি শীতল কন্ঠে বললো,

-“আমি বুঝতে পারছি না আমার কথাগুলো আমি কীভাবে আপনার কাছে বর্ণনা করবো, আপনি আমার থেকে বয়সে অনেক বড় এবং আপনি আফনার পিতা। আমি আফনাকে ভালোবাসি আঙ্কেল এবং তার হাতদুটো সারাজীবনের জন্য ধরতে চাই, তাকে বিয়ে করতে চাই। আপনি কী আমার প্রস্তাবে রাজি?”

আফনার বাবা হালকা হাসলো এবং বললো,

-“এখন প্রস্তাব দিয়ে কাজ কী হু? তোমার দাদী তো আগে থেকেই আমার মেয়েকে তোমার বউ উপাধি দিয়ে দিয়েছে, জাস্ট বিয়ে নামক সিলমোহর লাগানো বাকি!”
রায়াফ অবাক হয়ে আফনার বাবার দিকে তাকালো। আফনার বাবা চোখ দিয়ে আশ্বাস দিলো যার অর্থ সে রাজি। রায়াফ তা বুঝে ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করলো।

-“আমি তোমার স্ট্যাটাস দেখে নয় তুমি একজন ভালো মানুষ দেখে আমি আমার একমাত্র মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিবো। তবে কথা দাও আমার মেয়েকে সবসময় হাসিখুশি রাখবে? আমি কখনোই আমার এই চাঁদমুখীর কষ্ট দেখতে পারি না যে!”

-“কথা দেয়ার কী আছে আঙ্কেল, আপনি বললেও কী না বললেও কী আপনার মেয়ে আমার কাছে অনেক ভালো থাকবে। শুধু দোয়া করুন আমাদের জন্য!”

আফনার বাবা পরম আদরে রায়াফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ বাদে রায়াফ নিচে গিয়ে সকলকে জানিয়ে দিলো আগামী ২৬ তারিখ তার এঙ্গেজমেন্ট এবং কার সাথে এটাও জানিয়ে দেয়। আফনা পরেরদিন ঘুম থেকে জেগে দেখলো সে হসপিটালের বেডে। এবং তার দু-পাশে দুই বান্দা। কলি এবং ইরা! ইরা মুচকি হেসে বললো,

-“কী মিসেস রায়াফ ঘুম ভাঙলো?”

আফনা প্রথমে ঘুমের ঘোরে হুম বললেও পরমুহূর্তে লাফ দিয়ে উঠার চেষ্টা করতেই মাথার যন্ত্রণায় শুয়ে পরলো। কলি এবং ইরা চটজলদি আফনাকে শুইয়ে দিয়ে বললো,

-“পাগল নাকি তুই? এভাবে লাফ দিলি কেন?”

-“মিমিসেস রারায়াফ মামানে?”

-“উহ! এমন ভাব যেন কিচ্ছু বুঝে না। এই ফাজিল, আগে থেকে বললে কী আমরা তোর জামাইরে খেয়ে ফেলতাম? যদিও আগে রায়াফের জন্য পাগল ছিলাম কিন্তু এখন তো সে আমাদের দুলাভাই। আর যাই হোক আমরা দুলাভাইয়ের দিকে নজর দেই না বুঝলি?”

আফনা এখনো ওদের কথার আগামাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। গতকাল তো রায়াফের প্রপোজাল দেয়ার কথা ছিলো অতঃপর সে কিডন্যাপ হলো, মাথায় আঘাত পেলো তারপর? তারপর তো মাত্র সে ঘুম থেকে উঠলো। তাহলে সে মিসেস রায়াফ কখন হলো? হলেও তার মনে কেন পরছে না? এমন নানা কনফিউশান তাকে ঘিরে ধরলো। তখনই রায়াফ হাতে একটি বক্স নিয়ে কেবিনে আসলো। রায়াফ হেসে বললো,

-“শালিকাদের আমার বউয়ের সাথে কথা বলা শেষ হলে আমিও কী সুযোগ পেতে পারি?”

-“এমা এ কী বলছে জিজা, বউ তো আপনারই পারমিশনের কিছু নেই। আমরা যাচ্ছি, বাই আফনা!”

বলেই দুজন শুড়শুড় করে কেটে পরলো। এদিকে আফনা লজ্জায় লাল। আফনা বিরবির করে বললো,

-“সবগুলা বেশরম। কিসব লাগামহীন কথাবার্তা। ও আল্লাহ বেশরম গুলাকে আমার কপালেই বা কেন জুটালে?”

রায়াফ আফনার পাশে বসতেই বলে উঠলো,

-“গুড মর্নিং বউ!”

-“কে আপনার বউ?”

-“কেন তুমি।”

-“বিয়ে কখন হলো!”

-“আরে হবে হবে, টেনশন নিও না তো!”

-“হাহ! প্রপোজালের খবর নেই সে একেবারে বিয়ে করতে হাজির হয়েছে!”

-“তো তুমি চাও আমু তোমায় প্রপোজ করি?”

-“চাইলেও কী না চাইলেই বা কী? প্রপোজ করতে তো আপনাদের মতো ফেমাস মানুষের প্রেস্টিজে লাগে!”

রায়াফ ওই মুহূর্তে হাটু গেড়ে আফনার সামনে বসলো। আফনা চোখ বড় বড় করে রায়াফের দিকে তাকালো।

-“প্রেমময়ী বর্ষণে প্রথম হাঁপানো অবস্থায় দেখেছিলাম তোমায়, সেই অবস্থায় আমার হৃদয় কেড়েছিলে তুমি। আমি আমার এই হৃদয়কে খুঁজতে খুঁজতে কখন যে সেই হৃদয়ের পুরোটা তোমায় স্ব-ইচ্ছায় দিয়ে দিলাম বলতে পারি না। তবে আমার জীবনের প্রতিটি প্রেমময়ী বর্ষণে তোকে চাই আদুরী। আমার হৃদয়ের প্রতিটি শ্রাবণ ধারায় শুধুই তুই! হবি কী আমার জীবনের অংশ? হ্যাঁ ভালোবাসি তোমায়। হাতে-হাত রেখে তোমার সাথেই জীবনের বাকিটা জীবন কাটাতে চাই। আমার এই সাদা-কালো জীবনে তোমার রঙে রাঙিয়ে তুলতে পারবে না, আদুরী?”

রায়াফের অগোছালো কথায় আফনা স্তব্ধ হয়ে যায়। রায়াফ যে তার জন্য এতো আবেগ জমিয়ে রেখেছিলো সে কোনদিন ভাবতে পারেনি। আফনার চোখের কোণ ভিঁজে গেছে। সে নিজের অজান্তেই মাথা নাড়লো। রায়াফ খুশিতে আফনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আফনাও পরম আবেশে চোখ বুজে রইলো। আজ যেন তার খুশির সমাপ্তি নেই। ভালোবাসার মানুষকে জীবনে পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। হ্যাঁ, আফনাও রায়াফকে ভালোবাসে।

কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে গেলো। রায়াফ আফনাকে ছেড়ে দিয়ে তার হাত থেকে মিনি বক্স থেকে একটি ঘড়ি বের করলো। আফনা ঘড়িটি দেখে অবাক হয়ে রইলো। এই ঘড়িটা কিনতেই তো সে পরিশ্রম করেছিলো কিন্তু এতিমখানার বাচ্চাদের জামা-কাপড় কিনতে গিয়ে সব টাকাই খরচ করে ফেলেছিলো। রায়াফ আফনার হাত টেনে ঘড়িটা পরিয়ে দিতে দিতে বললো,

-“জানি তোমার মনে অনেক খুচখুচানি তাও আমি তোমার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিবো না। কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর আড়ালে থাকাই শ্রেয়। ২৬ তারিখ এঙ্গেজমেন্ট তাই আজ তোমায় রিং না দিয়ে ঘড়ি দিলাম। চিন্তা করিও না তোমার জামাইর আরও ভালো সামর্থ্য আছে!”
আফনা হাসলো। ২৬ তারিখ যথারীতিতে ওদের এঙ্গেজমেন্ট সম্পূর্ণ হয়। সেদিনই রায়াফ তার ভালোবাসাকে সারা দুনিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
আফনার ফাইনাল ইক্সাম হতে আরও ১ মাস বাকি তাই আফনার বাবা বলে পরীক্ষার পরেই যেন ধুমধামে বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়। রায়াফ ভেতরে ভেতরে ফাটলেও আফনার বাবার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানায়। কিছুদিন পর রায়াফের ১ বছর পূর্ণ হলো এবং তার খেলার সময় এলো।
রায়াফ আফনাকে বিদায় দিয়ে এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢুকে গেলো। আর আফনা চোখের জল মুছে রায়াফের পানে তাকিয়ে বললো,

-“আপনি জিতে খুব শীঘ্রই আমার কাছে ফিরে আসুন, খেলোয়াড় সাহেব! আমি আপনার অপেক্ষায় রইলাম।”

~সমাপ্ত।

বিঃদ্রঃ গল্পটির সিজন ২ আছে। পুরো গল্পটি সবার কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন। আসসালামু আলাইকুম।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে