#প্রেমময়ী_বর্ষণে_তুই(১৮)
লাবিবা ওয়াহিদ
এক সুনসান নদীর তীরে রায়াফ ডেকোরেশন সেট করতে ব্যস্ত। আজ সে আফনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিবে। অনেক হয়েছে লুকোচুরি, আর নয়। কথায় আছে শুভ কাজে দেরী করতে নেই। তখনই রায়াফের একটা পার্সেল ডেলিভারি আসলো। রায়াফ হাসিমুখে সেই পার্সেলটা গ্রহণ করলো। ওদিকে ফাহান তার গার্ডদের দিয়ে সব কাজ করিয়ে নিচ্ছে। একসময় সে আফনাকে পছন্দ করলেও এখন তার পছন্দের তালিকায় আরেকজন যে তার পাশেই কাজে হাত লাগাচ্ছে। সে হচ্ছে তার এক ক্লায়েন্ট এর মেয়ে। তার সাথেই কিছুদিন আগে ঘুরতে গিয়েছিলো এবং সেখানেই প্রপোজালও দেয়। শেফা সেদিনই তাকে এক্সেপ্ট করে কারণ, মনে মনে সে নিজেও ফাহানকে পছন্দ করতো! রায়াফ অদূরে বসে থাকা সোনিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-“কী হলো এদিকে আসো।”
সোনিয়া কৃত্রিম হাসি হেসে বললো,
-“নাহ, রায়াফ। আমি এখানেই ঠিক আছি!”
মুখে এ-কথা বললেও সোনিয়া মনে মনে রাগে ফুঁসছে।
-“আমিও দেখবো রায়াফ তুমি ওই মেয়েকে কীভাবে প্রপোজাল দেও। ওই মেয়ে এখানে আসতে পারলে তো?”
এদিকে রায়াফ মনে মনে হাসছে আর বারংবার জিনির দিকে তাকাচ্ছে। জিনি রায়াফের পানেই তাকিয়ে আছে। রায়াফ জিনির সামনে হাটু গেড়ে বসে বললো,
-“যা শিখিয়ে দিয়েছি তা তুই পারবি তো?”
জিনি ঘনঘন লেজ নাড়তে লাগলো যার অর্থ সে পারবে। রায়াফ হেসে জিনির মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিলো। এবার রায়াফ উঠে দাঁড়িয়ে আফনাকে কল করলো। আফনা কল রিসিভ করতেই রায়াফ বললো,
-“নদীর দিকে আসতে পারবে?”
-“কেন?”
-“সারপ্রাইজ। শাড়ি পরে আসবে!”
বলেই রায়াফ কল করলো দেয়। আফনা হ্যালো হ্যালো করলো কিছুক্ষণ। যখন বুঝলো অপরপাশ থেকে কল কেটে দিয়েছে তাই আফনা ফোন রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।
“নদীর পাড় শাড়ি পরে যাবে কেন? তার মানে কী রায়াফ তাকে প্রপোজ করবে?”
ভাবতেই আফনার গাল জ্বলে উঠলো। এতো অপেক্ষার পর ফাইনালি… আফনা কিছু না ভেবেই একটা নীল শাড়ি নিয়ে রেডি হতে চলে যায়। আধ ঘন্টা বাদে আফনা বেরিয়ে গেলো।
★
রায়াফ কাজ করছিলো তখনই তার ফোনে কল আসলো। রায়াফ পকেট থেকে ফোন বের করে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই রায়াফ পৈশাচিক হাসি হাসলো। সে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠলো,
-“আমি বাংলাদেশ এসে পৌঁছিয়েছি! বলো আমার মেয়ে কোথায়?”
রায়াফ হাসি আটকিয়ে বললো,”হোটেল গিয়ে একটু রেস্ট করুন, সময়মতো আপনার মেয়ের এড্রেস জানিয়ে দিবো!”
-“রায়াফ! তোকে একবার হাতের মুঠোয় পাই! তোর বাপের মতোই তোরে আমি শেষ করে দিবো!”
রায়াফ কিছু না বলেই হাসতে হাসতে কল কেটে দিলো। এদিকে ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করার পরেও আফনা এলো না। রায়াফ আফনার ফোনে ট্রাই করেও পেলো না। বারবার ফোন সুইচড অফ বলছে। রায়াফ চিন্তায় পরে গেলো। কিছুক্ষণ বাদে সোনিয়া দৌড়ে এসে একটা চিরকুট দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
-“রায়াফ এটা পড়ো!”
রায়াফ চটজলদি সোনিয়ার থেকে সেই চিরকুট নিয়ে পড়া শুরু করলো।
-“আমি জানি তুমি আজ আমায় প্রপোজ করবে, তবে আমি তোমায় গ্রহণ করতে পারবো না। কারণ আমি তোমায় ভালোবাসি না!”
ইতি
আফনা।
রায়াফ যেন সেখানেই থমকে দাঁড়ালো। সোনিয়া এদিকে পৈশাচিক হাসি হাসছে। সোনিয়া আবারও বলে উঠলো,
-“ডোন্ট বি স্যাড! আচ্ছা আমি তাহলে যাই? তুমিও বাসায় ফিরে যাও!”
বলেই সোনিয়া হাসতে হাসতে চলে গেলো। যেতে যেতে কাউকে কল করে বললো,
-“এদিকের কাজ হয়ে গেছে, বাকিটার জন্য আমি আসছি!”
সোনিয়া চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ বাদেই রায়াফ এদিক সেদিক তাকিয়ে হাতের চিরকুটটা ছিঁড়ে ফেলে দিলো এবং ফাহানের উদ্দেশ্যে বললো,
-“আফনার হ্যান্ডরাইটিং নিঁখুত ভাবেই কপি করেছে কিন্তু কথায় আছে না অতি চালাকের গলায় দড়ি? সেই জায়গায় ক্ষুদ্র ভুলটাই করে ফেলেছে। চিঠিতে “তুমি” বলে সম্বোধন করেছে অথচ আফনা আমায় সারাজীবন “আপনি” করে বলেছে।”
-“এখন কী প্ল্যান বি?” ফাহান বললো।
-“ইয়েস!” বাঁকা হেসে চোখে সানগ্লাস দিলো রায়াফ।
এদিকে ঘন্টাখানেক কেটে গেলো আফনা কল ধরছে না দেখে আফনার মা কান্নাকাটি লাগিয়ে দিয়েছে। সে বারবার বলছে “আমার মেয়েকে এনে দাও, আমার মেয়েকে এনে দাও! কোথায় আমার মেয়ে? কেন বাড়ি ফিরছে না?”
এদিকে আফনার বাবাও সমানভাবে চিন্তিত। তখনই একটি আননোন নাম্বার থেকে ওদের ফোনে কল আসলো। কলটা আসলে শেফা করেছে। আফনার বাবা নিজেকে স্বাভাবিক করে কলটি রিসিভ করলো।
-“হ্যালো কে?”
-“আঙ্কেল আমি আফনার এক বান্ধুবি শেফা!”
আফনার বাবা ভ্রু কুচকে বললো,”আমার মেয়ের তো ‘শেফা’ নামের কোনো বান্ধুবি নেই? তাহলে তুমি কে?”
শেফার হাত থেকে রিক্তা ফোনটি নিয়ে বললো,”ভাইজান আমি রিক্তা বলছি। আপনি কী ভাবীকে ফোনটি দিবেন?”
আফনার বাবা চিনতে পেরে আফনার মাকে ফোন ধরিয়ে দিলো। রিক্তা কোনরকমে আফনার মাকে বুঝিয়ে দিলো যে আফনা তার কাছে আছে এবং আজ তার কাছেই থাকবে। আফনার মা প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে রাজি হয়ে গেলো। রিক্তা কল কাটতেই শেফা বলে উঠলো,
-“ওরা পারবে তো জেম্মা?”
-“আল্লাহ ভরসা!” বলেই একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো রিক্তা।
★
আফনার সেন্স ফিরতেই পিটপিট করে তাকালো এবং বোঝার চেষ্টা করলো সে ঠিক কোথায় আছে। কিছুক্ষণ এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলো সে একটি কাঠের চেয়ারে বাঁধা অবস্থায়, আর জায়গাটাও দেখে মনে হচ্ছে কোনরকম পরিত্যক্ত গোডাউন! আফনা নিজের বাঁধা হাত খোলার চেষ্টা করতে লাগলো আর মিনমিন করে বলতে লাগলো,
-“কী একটা অবস্থা। শেষ পর্যন্ত কিনা সিনেমার হিরোইনদের মতো আমারেও এভাবে এসব জায়গায় বেঁধে রেখেছে। আবার কিনা পরিচালকরা বলে, ‘এটি সম্পূর্ণ কল্পকাহীনি, এর সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই!’ হাহ ঢং!”
এসব ভাবতে ভাবতেই দড়ি কিছুটা ঢিলে করে ফেললো। যাক তাহলে বেশি শক্ত করে বাঁধেনি। কিন্তু সে এখন কী করবে? কীভাবে পালাবে? আর সবচেয়ে বড় কথা তাকে এখানে আনলোই বা কারা? এরকম নানান কথা ভাবতে ভাবতে আফনা যেই দড়ি থেকে পুরোপুরি হাতটা সরিয়ে আনবে তখনই কারো উপস্থিতি টের পেলো! আফনা সাথে সাথে আবারও দড়ির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ফেললো। যে-ই আসুক, সে যদি বুঝে যায় আফনা দড়ি খুলে ফেলেছে তাহলে এখান থেকে পালানোর চান্স নেই। আফনা চুপ করে বসে আছে আর মুখশ্রী এমন করে রেখেছে যেন সে এসবে বড্ড ভয় পাচ্ছে। আসলেই ভয় পাচ্ছে তবে অতোটাও না! তখনই আফনার সামনে চেয়ার টেনে বসলো শাকিল! শাকিলকে দেখে আফনার থুঁ থুঁ ফেলতে মন চাইছে। শাকিল দাঁত কেলিয়ে বলে,
-“হোয়াট’স আপ সুন্দরী? কেমন লাগছে আমার আপ্যায়ন?”
-“এখানে কেন এনেছেন আমায়?”
-“উপরওয়ালার কাছে চিরজীবনের মতো পাঠাতে।”
আফনা চুপ করে মাথা নিচু করে রাখলো। আফনার এমন চুপসে যাওয়ার কারণে শাকিল ভাবলো আফনা এবার ভয় পেয়েছে তাই সে হাসতে শুরু করলো। আফনা মাথা নিচু করলেও এদিকে চোখ দিয়ে আশেপাশের মেঝেতে কিছু খুঁজতে লাগলো। বেশ কিছু লোহার খন্ডাংশ এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তবে তার ডানপাশে একটি মোটা করে লোহার খন্ড আছে। সে শাকিলকে কথায় ব্যস্ত রেখে খুবই সাবধানে হাত খুলে লোহার খন্ডটি নিয়ে শাকিলের মুখ বরাবর দিলো এক বারি। ভাগ্যিস পা বাঁধেনি। শাকিলের চিৎকার শুনে বাইরে থেকে শাকিলের কয়েকটা চ্যালা এসে হাজির হলো। আফনা ওদের থেকে পিছিয়ে দূরে গিয়েছে এবং কাঁপা গলায় বলতে লাগলো,
-“কেউ কাছে আসবে না!”
তখনই পেছন থেকে ভারি কিছু দিয়ে কেউ সজোরে আঘাত করলো! আফনার হাত থেকে লোহার খন্ডটি পরে গেলো, আফনা মাথায় হাত দিয়ে ধীর পায়ে পিছে ফিরলো। সোনিয়া হাতে একটা লোহার খন্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেটা দিয়ে মাত্রই আফনাকে আঘাত করেছে। সোনিয়া সেটা ফেলে হাতে পিস্তল নিয়ে আফনার দিকে তাক করে বললো,
-“রায়াফ শুধুই আমার বুঝেছিস? ওকে পাওয়ার জন্য আমি সব করতে পারি, এমনকি তোকে উপরে পাঠাতেও আমার হাত কাঁপবে না!”
আফনার সব কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে, শরীরটাও ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। সোনিয়া যেই গুলিটা চালালো আফনাকে তখনই কেউ পাশ থেকে টেনে নিলো যার ফলে গুলিটা গিয়ে লাগলো দরজায় দাঁড়ানো কৌশলের। সোনিয়ার সামনের দিকে তাকিয়ে “ড্যাড” বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো। এদিকে আফনা রায়াফের বুকেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। রায়াফ নিজেও আফনাকে চিৎকার করে ডাকলো কিন্তু আফনা কোনোরকম সাড়া দিলো না। পুলিশ আসলো এবং সোনিয়াকে বন্ধুকসহ হাতে নাতে পাকড়াও করলো। এদিকে সোনিয়া ড্যাড, ড্যাড বলে চিৎকার করে কাঁদছে। সে কিছুতেই তার বাবাকে ছেড়ে যেতে চাইছে না কিন্তু পুলিশের কর্মীরা তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো। কৌশলের ডেড-বডি সেখানেই পরে রইলো। সোনিয়ার সাথে থাকা বাকি গুন্ডাগুলোকেও গ্রেফতার করলো তবে শাকিল সুযোগ বুঝে পালিয়ে যায়।
পরেরদিন নিউজপেপারে ছাপলো “মেয়ের হাতে বাবার খুন!” সাথে ছাপলো সোনিয়া এবং কৌশলের ছবি।
সেই নিউজ দেখে নিউজপেপারটা ভাঁজ করে ড্রয়ারে স-যত্নে তুলে রাখলো রিক্তা। তখনই তার ঘরে ধীর-পায়ে আফনা প্রবেশ করলো৷ আফনা প্র্যাগনেন্ট। তাই সে ইদানীং বেশ খিটখিটে মেজাজের হয়ে গেছে। সে এসেছে রায়াফের নামে বিচার দিতে। আফনা নাক ফুলিয়ে বললো,
-“দেখো মামনি, তোমার ছেলে আমাকে ফেলে আবারও মাঠে ব্যাট বল পিটাইতে গেছে, আমার এবং বাবুর চিন্তা তার একদমই নেই। মামনি তুমি ওনার বিচার না করলে আমি কিন্তু আম্মুর কাছে চলে যাবো!”
-“বিচার দিতে কিনা তুমি উপর থেকে নিচে আসলে?”
-“না মামনি, খেলোয়াড় যাওয়ার আগে নিচে রুম শিফট করে দিয়ে গেছে!”
-“তাহলে কীভাবে বললে আমার ছেলে তোমাদের ভুলে গেছে।”
আফনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-“তাহলে বল পিটাইতে দেশের বাইরে কেন গেল?”
-“এটাই তো ওর পেশা! দেশের হয়ে খেলছে সে। কতো মানুষ তার জিতের জন্য অপেক্ষা করে আছে।”
-“থাকুক, তাতে আমাদের কী? বুঝেছি তুমিও ওনার সঙ্গ নিচ্ছো! ঠিক আছে, কারো সাথে কথা বলবো না।”
বলেই আফনা হনহন করে চলে গেলো। রিক্তা সেখানে চোখের মোটা ফ্রেমের চশমাটি ঠিক করতে করতে হাসতে লাগলো। তখনই রিক্তার ফোনে কল এলো। রিক্তা ফোন হাতে তুলে দেখলো রায়াফ কল করেছে। রিক্তা রিসিভ করতেই রায়াফ তাকে সালাম জানালো। রিক্তা সালামের উত্তর নিতেই রায়াফ বললো,
-“আফনা কোথায় মা?”
-“আছে, তবে বেশ চটে আছে!”
-“এগুলা ভাল্লাগে বলো তো মা? দেশের বাইরে কী আমি ঘুরতে আসছি? ওরে বুঝানোর আগেই ফোন বন্ধ করে রেখে দিছে! কে বুঝাবে ওরে মা?”
-“এসময়ে এমন হয়-ই বাবা, তবে তুই চিন্তা করিস না আমি এদিকটা সামলে নিবো!”
-“ঠিক আছে মা। আজ খেলা আছে, দোয়া করিও! তোমার বউমা তো আমার সাথে কথা বলতেই নারাজ!”
রিক্তা হেসে দিলো। রায়াফও হালকা হেসে বললো, “ঠিক আছে রাখছি, আল্লাহ হাফেজ মা!”
বলেই রায়াফ কল কেটে দেয় এবং আনমনে বলে উঠে,
“ও প্র্যাগনেন্সির জন্য সিক নয় মা, দুই বছর আগের সেই ঘটনাতেই এমন হাল হয়েছে ওর। তবে চিন্তা করিও না বউ, দেশে ফিরে আবারও তোমায় সিঙ্গাপুর নিয়ে যাবো। ডক্টর বলেছে, ইনশাল্লাহ আমি আমার আগের আফনাকে পাবো!”
বলেই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এবার কল করলো শেফাকে। শেফা যেন আফনার সাথে সাথে থাকে সেই কথা বলে কল কাটলো। ফাহান এবং শেফার বিয়ে আরও আগেই হয়েছে ইভেন দেড় বছরের একটা ছেলেও আছে। শেফার সাথে কথা বলা শেষ হতেই রায়াফ অতীতে ডুব দেয়।
~চলবে।
বিঃদ্রঃ রিচেক করা হয়নি তাই ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।