#প্রেমময়_নিবৃত
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
‘গেটের সামনে আসেন তো!’
ফোনের এপাশ থেকে কথাটা শুনে খানিকটা চমকালাম। দৃষ্টি এদিক ওদিক করে কাচুমাচু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এসময় গেটের বাইরে আসবো কেনো?’
‘কোনো সমস্যা আছে? ক্লাস তো মনে হয় না আছে! ক্লাস থাকলে তো এসময় কল তুলতেন না। তাহলে?’
আমি কিছু না বলে নিশ্চুপ রইলাম। সত্যিই এখন আমার ক্লাস নেই। ক্লাস নেই বললে ভুলই হবে। মূলত ক্লাস থাকলেও আমি ক্লাসটা করছি নাহ৷ এই ক্লাসটা এতো বিরক্ত লাগে তা বলার মতো নাহ তাই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এসে বান্ধবীদের সাথে লাইব্রেরিতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। কিন্তু এই সময় উনি হঠাৎ গেটের বাইরে কেনো যেতে বললেন তা বুঝে আসলো নাহ। আমার ভাবনার মাঝেই নিবৃত ফের বললো,
‘কথা বলেন না কেন?’
আমি ছোট্ট করে বললাম, ‘আপনি কি এসেছেন?’
উনি মনে হয় বিরক্ত হলো। মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ করে একটু তেতে উঠেই বললেন, ‘আমার আসা না আসা দিয়ে আপনার কি! কয়বার বললাম গেটের বাইরে আসতে!’
উনার কথা শুনে আপনাআপনি মুখটা কুঁচকে গেলো। মনে মনে কয়েকটা বকা দিয়ে বললাম, ‘আসছি!’ নিবৃত খট করেই কল কেটে দিলেন। আমি ফোনের দিকে তাকিয়ে পরপর আরো কয়েকটা বকা দিয়ে বান্ধবীকে বললাম, ‘তোরা বস! আমি একটু আসি!’
‘কিরে কই যাস!’
‘আসতেছি! বস।’
ব্যাগ আর ফোন নিয়ে দৌড় লাগালাম। মনের মাঝে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিলো। উনি কি সত্যি এসেছে নাকি! ২০৫ কিলোমিটার রাস্তার দূরত্ব আমাদের মাঝে। গুটি গুটি পায়ে গেইটের বাহিরে এসে উনাকে নজরে পড়লো নাহ। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম। অনেক মানুষের আনাগোনা থাকলেও নির্দিষ্ট লোকটার দেখা নেই৷ যদিও আমি সিউর ছিলাম না তবুও উনাকে না দেখতে পেয়ে ভীষণ মনঃক্ষুণ্ন হলাম। মাথা নিচু করে ফোনের দিকে তাকাতেই ফোনটা ভাইব্রেট হতে শুরু করে। নিবৃতের কল দেখে মন খারাপ রেখেই কল রিসিভ করে কানে তুললাম। আমার কোনো শব্দ করার আগেই নিবৃত নিজেই বললেন,
‘ডান পাশে তাকান!’
আমি সাথে সাথেই তাকালাম। সামনেই দুইটা বাইক নিয়ে চারজনের মতো দাঁড়িয়ে আছে। নিবৃত্ত ঠান্ডা কণ্ঠে বললেন, ‘এদিকে আসেন!’
আমি ফট করেই বললাম, ‘আপনি কি আমাকে এই বাইকওয়ালাদের কাছে পা’চার করে দিবেন নাকি!’
নিবৃত কটমটিয়ে উঠলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘থা’প্রিয়ে আপনার কান গরম করে দেবো। জলদি আসেন!’
এরপরই আবার কল কেটে গেলো। আমি গাল ফুলিয়ে রাস্তার পাশ ঘেঁষে একদমই আস্তে হাটতে শুরু করলাম। এতোটাই আস্তে হাঁটছি যে ২ মিনিটের রাস্তা অন্তত আমার ১০ মিনিট তো লাগবেই। টুং করে ফোনো শব্দ হতেই দেখলাম নিবৃতের টেক্সট। ছোট্ট করে লিখছে,
‘পিঁপড়াও এর থেকে জোড়ে হাঁটে। আমি যদি এগিয়ে যাই তবে কিন্তু মাথায় তুলে আছাড় মা’রবো!’
সাথে সাথেই আমার হাঁটার গতি বেড়ে গেলো অটোমেটিক। এই লোকটাকে যে পরিমাণে ভয় পাই এই ভয়টা যদি নিজের আব্বুকেও পেতাম তবুও বোধহয় জীবনে ভালো কিছু হতো! ২ মিনিটের মাথায় অডিটোরিয়ামের সামনে দাঁড়াতেই উনি বাইক থেকে নেমে এলেন। আমার সামনে এসেই হেলমেট খুলে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে চমৎকার একটা হাসি দিলেন। আমি তো শেষ! ড্যাবড্যাব করে উনার হাসির দিকে তাকাতেই উনার হাসি মিলিয়ে গেলো। গম্ভীর সুরে বললো,
‘এভাবে দেখার কি আছে?’
মনে মনে ভীষণ করে বকা দিলাম। কোনো উত্তর না দিয়েই মাথা নিচু করে থাকলাম। আমি অন্যসময় প্রচুর কথা বলতে পারলেও এই লোকটার বেলায় চুপচাপ হয়ে যায়। উহু সবসময় না। যখন টেক্সট করি তখন নিজের মতো যতো আজাইরা প্যাচাল আছে সব বলি কিন্তু কলে মেপে মেপে কথা বলি। সেখানে লোকটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভাবতেই আমার ভয়ে গায়ের লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কোনোরকমে কাচুমাচু করে একপাশে দাঁড়াতেই উনি গলা ছেড়ে পেছনের ছেলে গুলোকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘দোস্ত তোরা ঘুরে আয়!’
উনার ফ্রেন্ডরা মাথা নাড়িয়ে বাইক নিয়ে ছুটে গেলো। উনি আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিচু স্বরে বললেন, ‘চলেন!’
আমি চমকে উঠে গড়গড় করে বললাম, ‘কোথায় যাবো? আমি কোথাও যাবো নাহ। ক্লাস আছে আমার। গেলাম!’
উল্টো ঘুরে চলে আসতে নিলে উনি তড়িঘড়ি করে ব্যাগ টেনে ধরলেন। আমার মুখটা নিমিষেই কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো৷ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই বললেন, ‘ক্লাস করে উদ্ধার করেছেন আমাকে! এখন আমার সাথে চলুন। এটা কিন্তু ইনবক্স না যে আমার হাত এসে আপনাকে থা’প্পড় দিতে পারবে নাহ!’
আমার মুখে পুরোপুরি আঠা লাগিয়ে বন্ধ করে দিলাম। উনি আমার থেকে একটু খানি দূরত্ব রেখে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। আমাদের কলেজের পাশের ছোট্ট একটা রাস্তা আছে। ওখানে শুধু রিক্সা, সিএনজির চলাচল। উনি আমার সাথে পা মিলিয়ে সেই ছোট্ট রাস্তাতেই হাঁটা লাগালেন। আমি আড়চোখে একবার, দুবার করে কয়েকবার তাকালাম। লোকটা আমার প্রিয় রঙের শার্ট পড়েই এসেছে। আচ্ছা লোকটা একটু বেশিই সুন্দর নাকি! কথাটা মনে হতেই ফট করে আশে পাশে তাকালাম। কয়েকটা মেয়ে সরাসরিই আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। বিশেষ করে আমার পাশে হাঁটতে থাকা নিবৃতের দিকে। হুট করেই আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। উনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকাতেই দিন দুনিয়া ভুলে ছ্যাত করে উঠে বললাম,
‘আপনাকে আসতে কে বলেছে হ্যাঁ? আর এসেছেন ভালো কথা! এতো সাজগোজ করে কে আসতে বলছে? মাস্ক পড়েননি কেনো?’
এটুকু বলতেই উনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মাথার তা’র কি আবার খুলে গেছে? এমনিই বলি আপনার মাথায় সমস্যা আছে!’
আমি ফোঁস করে উঠলাম। উনি আমার ব্যাগ টেনে ধরে হাঁটতে লাগলেন। আমি ফুঁসতে ফুঁসতেই হাঁটতে থাকলাম। উনি বুকপকেট থেকে কৃষ্ণচূড়া নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
‘আপনার প্রিয় কৃষ্ণচূড়া!’
আমি হাত বাড়িয়ে ফুল নিলাম। প্রসন্ন চিত্তে হেঁসে উনার দিকে তাকালাম। লোকটা বুঝি আমার পছন্দ-অপছন্দও এতো মনে রাখে! কই কখনো তো বুঝতে দেয় না! আমি উনার শার্টের এক কোণা চেপে ধরতেই উনি তাকালেন আমার দিকে। আমি বায়না করার স্বরে বললাম, ‘এটা হিজাবের ওপর সুন্দর করে গুঁজে দেন!’
‘আমি! আমি এসব পারি না। এনে দিয়েছি নিজে গুঁজে নেন!’
‘দেন না!’
উনি আর কথা বাড়ালেন না। নিঃশব্দে হিজাবের পিন দিয়ে সুন্দর করে গুঁজে দিলেন। আমি ঠোঁট কামড়ে হাসলাম। আশে পাশে অনেক বাগানবিলাসের গাছ আছে। আমি নিঃশব্দেই হাঁটছিলাম আর চারপাশ দেখছিলাম। ছোট রাস্তা পেড়িয়েই বড় রাস্তার মোড়। ভীষণ ভীড়ভাট্টা পেরিয়ে তবেই এখান থেকে যেতে হবে। আমি একবার শুধু নিবৃতের মুখের দিকে তাকালাম। উনি নিজের ফোনটা পকেটে পুড়ে নিয়ে আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন। ভীড় ঠেলে সুন্দর করেই আমাকে নিয়ে বেড়িয়ে আসলেন। খেয়াল করলাম এতো ভীড়ের মাঝেও কারোর সাথে মোটেও ধাক্কা লাগেনি আমার। সবার থেকে আগলে নিয়েই খুব সন্তর্পণে এগিয়ে চলেছে নিবৃত। রোদের ঝাপ্টায় বেশ গরম লাগছিলো। গলাটাও বেশ শুকিয়ে গেছে। উনি হুট করেই আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কোথায় যেনো গেলেন। গরমের তাপে আমার ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়। মিনিট খানেক ঘুরতেই উনি ছুটে এলেন। হাতে পানির বোতল ধরিয়ে দিয়ে নিজের ফোনে মন দিলেন। মুখে কিছুই বললেন নাহ। আমি নিঃশব্দে হেঁসে পানি পান করলাম৷ দুজনে চুপচাপ হেঁটে ফুলের দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলাম। বরাবরই ফুলের ওপর আমার অগাধ দুর্বলতা। সেই দুর্বলতা থেকেই পা দুটো আর বাড়াতে মন চাইলো নাহ। নিবৃত নিজেও এগোলেন নাহ। ফুলের দোকান থেকে কতগুলো গোলাপ, জারবেরা, রজনীগন্ধা নিয়ে হাতে ধরিয়ে দিলেন। কোলাহল পেড়িয়ে দুজনেই লেকের পাড়ে বসলাম। আইসক্রিম নিয়ে ধরিয়ে দিলেন হাতে। জোরেই বললেন,
‘বাচ্চা মেয়ের প্রেমে পড়েই বিপদে পড়েছি। আইসক্রিম, চকলেট, হাওয়াই মিঠাই দিয়েই আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে।’
আমি চোখ বড় বড় করে তাকাতেই উনি হিজাবের ওপর এলোমেলো হয়ে যাওয়া কৃষ্ণচূড়া ঠিক করে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘তবুও আমার এই বাচ্চা মেয়ের প্রেমই ভালো। কথায় কথায় ধমক দেওয়া যায়। বাচ্চা মেয়েটা ভয়ে কাচুমাচু করে যখন কথা বলে তখন আমার ভীষণ মজা লাগে। এই যে এখন কৃষ্ণচূড়া গুঁজে বসে আছে! বাচ্চা মেয়েটা কি জানে তাকে কি পরিমাণ স্নিগ্ধ লাগছে!’
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকালাম। উনি শব্দ করে হেঁসে উঠলেন। এই প্রথম তাকে এভাবে হাসতে দেখে আমি মুগ্ধতা নিয়ে তাকালাম। উনি এক হাত বুকের বাম পাশে রেখে ঠোঁট কামড়ে বললেন,
‘এভাবে তাকাবেন না কৃষ্ণচূড়া। আমার এখানে লাগে! আপনার এই দৃষ্টিতে আমার ভেতর যে তোলপাড় করে দেয় এটা কি বোঝেন? বুঝবেন কেমন করে? আপনি তো বাচ্চা মেয়ে। আমার হৃদয়ের ব্যাথা আপনি আর বুঝবেন কেমন করে! এই যে মিস কৃষ্ণচূড়া আপনি এতো মায়ায় বাঁধেন কেমন করে?’
প্রথম বারের মতো উনার মুখে প্রেমময় বাক্য শুনে আমি স্তব্ধ। আমি বুঝি লোকটা কি ভীষণ ভালোবাসে আমাকে কিন্তু আজ অব্দি কখনোই ভালোবাসি বলেনি আমাকে। তবে হাজার বার হাজার ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে তার ভালোবাসার গভীরতা। আজকের এই প্রেমময় নিবৃত আমার কাছে ভীষণ নতুন। একদমই ভীষণ! আমি কোনো কথা ছাড়াই হুট করেই উনাকে জড়িয়ে ধরলাম। উনার বুকে মাথা রেখে শুনতে থাকলাম একেকটা বিট! আহা শান্তি।
সমাপ্ত..