#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১৫ ( শেষ পর্ব )
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
তূর্ণ উত্তর দিল না আরোহীর প্রশ্নের। বরং মেয়েটার হাতটা আরও জোরে মুচড়ে ধরে বলল,
“আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দে। এড়িয়ে চলছিস কেন আমাকে? সমস্যা কি তোর?”
আরোহী হাতের ব্যথায় দিশেহারা হয়ে উঠলো। আঁখি দ্বয় ভরে উঠলো মুহুর্তেই। নিজেকে তূর্ণের বাঁধন থেকে ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করেও পারলো না। শেষ পর্যন্ত সে সিদ্ধান্ত নিল সব সত্যি বলে দিবে। তারপর যা হবার হবে। তূর্ণ রেগে গেলে না হয় ক্ষমা চেয়ে নেওয়া যাবে তার কাছে। ভালোবাসা তো কোনো অপরাধ নয়। আর এই ভালোবাসার ক্ষেত্রে করো হাতও থাকে না। কখন কাকে কার ভালো লেগে যাবে কেউ জানে না। তাছাড়া এভাবে আত্মীয় এবং কাছাকাছি বাড়ি হওয়ায় তূর্ণের থেকে তার বেশিদিন লুকিয়ে থাকাও সম্ভব না। মেয়েটা নিজের চোখ বন্ধ করে নিল। জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে ধাতস্থ করলো নিজেকে। অতঃপর বলল,
“আমি আপনাকে ভালোবাসি তূর্ণ ভাই।”
তূর্ণ চমকালো। হাতটা আলগা হয়ে এলো তার। সে কি সত্যি শুনছে নাকি ভুল? নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না ছেলেটা। হতবাক স্বরে বলল,
“কি বললি আবার বল তো।”
আরোহী পিটপিটিয়ে খুললো চোখ জোড়া। আমতা আমতা করে বলল,
“আমি আপনাকে ভালোবাসতে চাইনি তূর্ণ ভাই। তবুও কিভাবে কিভাবে যেন হয়ে গেল নিজেও জানি না।”
থামলো মেয়েটা। জ্বীহ্বা দ্বারা ওষ্ঠ ভিজিয়ে ফের বলল,
“আমাকে মাফ করে দিন তূর্ণ ভাই। আমি জানি আমি ভুল করেছি। ছোট ছোটবেলা থেকে যাকে ভাই ভাই বলে মুখে র’ক্ত তুলেছি তাকে এভাবে ভালোবাসা নিশ্চই অপরাধ। তবে আমি চেষ্টা করছি আপনাকে ভোলার। তাই তো আপনার থেকে দূরে দূরে থাকছি, এড়িয়ে চলছি।”
তূর্ণ মন দিয়ে শুনলো আরোহীর বলা সব কথাগুলো। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে সে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার মুখ পানে। অতঃপর হুট করেই তার হাত টেনে পা বাড়লো নিচের দিকে। হকচকিয়ে উঠলো আরোহী। ভয় জাগলো হৃদয়ে। এই ছেলে তাকে টেনে নিয়ে নিচে যাচ্ছে কেন? এখন কি তূর্ণ তার এই ভালোবাসার কথা সবাইকে বলে দিবে? বাড়ির সবাই কথাটা জানতে পারলে নিশ্চই ঝামেলা হবে। তাকে খারাপ ভাববে সবাই। দুই পরিবারের মধ্যে একটা মনমালিন্যের সৃষ্টি হবে। আর ইরা এবং আরুশ! তারা তো তাকে মে’রে’ই ফেলবে। আরোহী ভীত হলো। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বলল,
“আপনি কি সবাইকে এ কথা বলে দিবেন তূর্ণ ভাই? দয়া করে কাউকে কিছু বলিয়েন না। তাহলে যে ঝামেলা হয়ে যাবে অনেক।”
তূর্ণ যেন কিছুই শুনলো না। আগেই মতোই আরোহীর হাত টেনে ধুপধাপ পা ফেলে হাঁটছিলো। মেয়েটা দিশেহারা হয়ে উঠলো। নিজের উপর নিজের রাগ লাগলো ভীষণ। তাকে ভালো মানুষী করে সব সত্যি কে বলতে বলেছিল? এখন পড়লো তো বিপদে। আরোহীর কান্না পেল ভীষণ। ধুপ করে সে বসে পড়লো মেঝেতে। ডুকরে কেঁদে উঠে বলল,
“আমি আপনাকে আর ভালোবাসবো না তূর্ণ ভাই। তবুও দয়া করে বাড়ির কাউকে কিছু বলবেন না। মা জানতে পারলে নির্ঘাত মে’রে ফেলবে আমাকে।”
তূর্ণ পাশ পিছন ঘুরে তাকালো আরোহীর পানে। থমথমে কণ্ঠে বলল,
“কাকে কি বলবো না বলবো তা পরে দেখা যাবে। আগে নিচে চল।”
“আমি কোথাও যাব না। আমি এখানেই বসে থাকবো। আপনি বাড়িতে ফিরে যান।”
“কথা বাড়াস না আরোহী। উঠে নিচে চল বলছি।”
তূর্ণের শক্ত কণ্ঠস্বর। আরোহী তবুও উঠলো না। ঠাঁয় বসে থেকে বলল,
“আপনি এমন কেন করছেন তূর্ণ ভাই। বলছি তো আমি আপনাকে আর ভালোবাসবো না। নিজেকে শুধরানোর চেষ্টা করবো। আপনার থেকে সবসময় দূরে থাকবো।”
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো তূর্ণ। হুট করেই কোলে তুলে নিল মেয়েটাকে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল,
“তোর যা বলার বলে দিয়েছিস। এরপর তুই আমার থেকে দূরে যাবি নাকি কাছে আসবি তা আমি ঠিক করবো তুই না।”
ইরা বসার কক্ষের সোফায় বসে টিভি দেখছিলো। হঠাৎ আরোহীকে তূর্ণর কোলে আসতে দেখে চমকালো সে। টিভি বন্ধ করে দ্রুত ছুটে গেল মেয়ের পানে। ব্যস্ত হয়ে শুধালো,
“কি হয়েছে ওর? তুই ওকে কোলে নিয়েছিস কেন? পড়ে ব্যথা ট্যাথা পেয়েছে নাকি?”
তূর্ণ আরোহীকে কোলে থেকে নামিয়ে দিল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“তোর কি হয়েছে তুই ই বল।”
আরোহী আমতা আমতা শুরু করলো। জোরপূর্বক হেসে বলল,
“কই কিছু না তো।”
ইরা ভ্রু কুঁচকালো। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো তূর্ণ। একটু সময় নিয়ে বলল,
“আমি আর আরোহী দুজন দুজনকে ভালোবাসি। বিয়ে করতে চাই।”
তূর্ণের কথায় চমকে উঠলো আরোহী এবং ইরা দুজনেই। এ ছেলে এসব কি বলছে? আরোহীর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। শুধুমাত্র সেই নয় তূর্ণও ভালোবাসে তাকে? তাহলে সেদিন ঐ জ্বরের ঘোরে ভালোবাসি ভালোবাসি কথাটা তাকেই বলেছিল ছেলেটা। অথচ সে কি না কি ভেবে নিয়েছিল। আবার তূর্ণকে এড়িয়েও চলতে শুরু করেছিল। মাথাটা ঘুরে উঠলো ইরার। ভালোবাসি পর্যন্ত না হয় ঠিকই ছিল কিন্তু এ ছেলে তো বিয়ে পর্যন্ত চলে গেছে। তূর্ণকে তাদের পছন্দ নয় এমন নয়। ছেলেটাকে তারা ছোট থেকে দেখে আসছে। আজকালকার যুগে এমন ছেলে পাওয়া ভার। ইরা এবং আরুশ তো একবার ভেবেও ছিল যে তূর্যের নিকট তূর্ণকে জামাই হিসেবে চাইবে। কিন্তু সাহসের অভাবে কখনও বলতে পারেনি। আজ সেই সুযোগ তূর্ণের মাধ্যমে নিজেই দ্বরগোড়ায় এসে পৌঁছালো। তবে এভাবে তো আর বিয়ে হয় না। তূর্য পৃথার সাথে কথা বলতে হবে। আরুশও বাসায় নেই এই মুহূর্তে। ইরা ইতস্তত করলো। আমতা আমতা করে বলল,
“বিয়ে বললেই তো আর বিয়ে দিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তোর মা বাবার সাথে কথা বলতে হবে। তারপর দুই পরিবার মিলে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে তবেই বিয়ে না হবে।”
তূর্ণ নির্বিকার ভঙ্গিতে একটু এগিয়ে গিয়ে বসলো সোফায়। গা এলিয়ে দিয়ে বলল,
“তাদের কল করে এখানে আসতে বলো। যা হবার আজই হবে।”
ইরা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল। কটমট করে তাকালো আরোহীর পানে। মেয়েটার দিকে একটু ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,
“এমনিতে তো আমাদের সামনে তূর্ণকে একদম দেখতে পারিস না। এখন এগুলো কি? আমাদের মান সম্মান আর কিছু রাখলি না।”
আরোহীর মুখশ্রী চুপসে গেল। মায়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে সে কি উত্তর দিবে ভেবে পেল না। সবচেয়ে বড় কথা কোথা থেকে কি হয়ে গেল তাই মাথায় ঢুকছে না তার। এড়িয়ে যাওয়ার জন্য তূর্ণ তাকে চোটপাট দেখালো, সেও ভালো মানুষী করে ভালোবাসি বলে দিল। তূর্ণ তখন কোনো কথা বলল না এখানে এসে সরাসরি বলে দিল বিয়ে করবে? এ কথা ছাদে বললে কি এমন হতো?
২২.
রাত ১০ টার অধিক। ইরাদের বাড়িতেই মজলিস বসেছে তূর্ণ আর আরোহীর বিয়ের ব্যাপারে। দুই পরিবার যখন আগে থেকেই চেনাজানা তখন আর বিয়ের ব্যাপারে কেউ দ্বিমত করেনি। তাছাড়া তূর্য তো আগে থেকেই সবটা জানতো। সেই সামলে নিল সবটা। তবে শেষ সময়ে এসে বাঁধ সাধলো আরুশ। কিছুটা ইতস্তত করে বলল,
“আরোহী এখনও ছোট। সামনে এইচএসসি। পরীক্ষার পর বিয়েটা দিলে হতো না।”
তূর্য সাথে সাথে প্রতিবাদ করলো। আরুশের পানে তাকিয়ে বলল,
“পরীক্ষার জন্য কি এদের প্রেম আটকে রাখতে পারবি তুই? কাছাকাছি বাড়ি সারাদিন দেখা হবে, প্রেম চলবে। তুই আমি যতই আটকানোর চেষ্টা করি না কেন এরা ঠিকই নিজেদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ ভালোবাসা বজায় রাখবে। তার থেকে বিয়ে দিয়ে দেই। প্রেম নামক হারাম সম্পর্কে না থেকে হালাল সম্পর্কে থাকুক।”
তূর্যের কথার উপরে আর কেউ কিছু বলার মতো পেল না। সে তো ভুল কিছু বলেনি। এখন পড়াশোনার ক্ষতি হবে, পরীক্ষা খারাপ হবে ভেবে বিয়ে দিবে না। কিন্তু তাই বলে তো আর এদের প্রেম আটকে থাকবে না। তা তারা ঠিকই চালিয়ে যাবে। তার থেকে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই শ্রেয়। তূর্যরা আর দেরী করলো না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজী সাহেবকে ডেকে বিয়েটা তূর্ণ আর আরোহীর চার হাত এক করে দিল।
২৩.
মধ্যরাত। চারদিকটা নীরব নিস্তব্ধয় ছেয়ে গেছে। আঁধারে ঢেকে গেছে ধরনীর বুকটা। তূর্ণ আর আরোহীর বিয়ের পর সকলে বাড়িতে চলে গেলেও তূর্ণ রয়ে গেছে এ বাড়িতেই। তূর্ণ আজ এখানেই থাকবে। সিদ্ধান্ত হয়েছে আরোহীর পরীক্ষার আগ পর্যন্ত সে বাবার বাড়িতেই থাকবে। পরীক্ষা শেষ হলে একসাথে ধুমধাম করে তুলে নিয়ে যাবে। তবে আজ যেহেতু তাদের বিয়ে হয়েছে তাই তূর্ণ প্রথম রাতটা এখানেই কাটাবে। আরোহীকে চটজলদি শুধুমাত্র একটা শাড়ি পড়িয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে বাসরঘরে। মুখে কোনো সাজগোজের ছাপ নেই। বুকের মধ্যে কেমন ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। কোথা থেকে কি হয়ে গেল মস্তিষ্ক ধরতে পারছে কিছুই। এক হিসেবে একটু আগেই সে ভালোবাসি কথাটা স্বীকার করলো এর মধ্যে তার বউও হয়ে গেল। সম্পর্কটা কেমন এক পলকে বদলে গেল। আরোহীর ভাবনার মধ্যেই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো তূর্ণ। কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো আরোহী। হৃদস্পন্দন গাঢ় হলো তার। তূর্ণ এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো বিছানার পানে। মেয়েটার হৃদয় ভীত হলো। ঢোক গিলে সে ঠাঁয় বসে রইলো সেখানেই। অমনি ধমকে উঠলো তূর্ণ। গম্ভীর স্বরে বলল,
“বাসর রাতে স্বামী কক্ষে এলে তাকে যে সালাম দিতে হয় জানিস না? সালাম কর বেয়াদব।”
আরোহী কেঁপে উঠলো। ফাঁকা ঢোক গিললো ফের। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে মিনমিনিয়ে বলল,
“আসসালামুয়ালাইকুম।”
“আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে বল।”
আরোহী বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তূর্ণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
“আসসালামুয়ালাইকুম।”
তূর্ণ ওষ্ঠ প্রসারিত করলো। সালামের জবাব দিয়ে হুট করে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটাকে। মৃদু কণ্ঠে বলল,
“তোর বলা তখনকার কথাটার উত্তর শুনবি না?”
আরোহী কপালে ভাঁজ ফেললো। ভ্রু কুঁচকে শুধালো,
“কোন কথাটার?”
“তখন ছাদে যে বললি আমাকে ভালোবাসিস।”
আরোহী কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল। তৎক্ষণাৎ মাথাটা নুইয়ে ফেললো সে। তূর্ণ আরও গাঢ় ভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল মেয়েটাকে। তার চুলের ভাঁজে আলতোভাবে একটা চু’মু খেয়ে বলল,
“আমিও ভালোবাসি তোকে।”
( সমাপ্ত )