#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১৪
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
আরোহী ঢোক গিললো। কণ্ঠটা একটু নরম করে অসুস্থের ন্যায় বলল,
“তূর্ণ ভাইকে বলে দাও আমার ভীষণ মাথা ব্যথা করছে। একটু শুয়েছি।
ইরার কপালে ভাঁজ পড়লো। ভ্রু কুঁচকে সে বলল,
“একটু আগেও তো তোকে একদম ঠিক দেখে গেলাম। আয়ুশের সাথে দুষ্টুমি করছিলি। কই তখন তো মাথা ব্যথা ছিল না।”
বিরক্ত হলো আরোহী। সে বলেছে মাথা ব্যথা করছে তার মাও সুন্দরভাবে মেনে নিবে তাই না। তা না পুলিশের মতো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করছে। আরোহী কপাল কুঁচকে বলল,
“মাথা ব্যথা কি বলে আসে যে ‘আমি একটু পর আসবো?’ আয়ুশের সাথে যখন দুষ্টুমি করেছি তখন মাথা ব্যথা ছিল না এখন হয়েছে।”
মেয়ের কথায় ইরা কিছুটা চিন্তিত হলো। একটু আগেও ঠিক থাকা মেয়েটার হঠাৎ মাথা ব্যথা কেন শুরু হলো? ইরা ফের দরজায় ধাক্কা দিল। চিন্তাত সুরে বলল,
“তোর কি বেশি মাথা ব্যথা করছে? দরজা খোল তো। দেখি তো কি হয়েছে?”
“একটু শুয়েছি। তুমি এখান থেকে যাও তো এখন। একটু একা থাকতে দাও আমাকে।”
ইরা তবুও মানলো না। হাজার হলেও মায়ের মন তো। সে ফের গলা উঁচিয়ে বলতে চাইলো কিছু এর মধ্যে তূর্ণও এসে উপস্থিত হলো সেই স্থানে। কপাল কুঁচকে শুধালো,
“কি হয়েছে? দরজা খুলছে না ও?”
“না, মাথা ব্যথা করছে নাকি।”
মাথা ব্যথা শুনে তূর্ণ আর বলল না কিছু। মায়া হলো আরোহীর প্রতি। থাক মেয়েটা যখন দরজা খুলতে চাইছে না তখন খুলতে হবে না। পরে মেয়েটা সুস্থ হলে তার সাথে এসে দেখা করে যাওয়া যাবে। তূর্ণ একবার তাকালো আরোহীর কক্ষের বন্ধ দরজার পানে অতঃপর ইরার পানে তাকিয়ে বলল,
“থাক আর ডাকাডাকি করতে হবে না ওকে। মাথা ব্যথা করছে যখন শুয়ে থাকুক একটু সময়। আমি না হয় পরে আবার আসবো।”
তূর্ণ চলে চলে গেল। ইরাও আর ডাকাডাকি না করে পা বাড়ালো নিজের কাজের উদ্দেশ্যে। আরোহী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তূর্ণের কণ্ঠস্বর কর্ণে পৌঁছাতেই সে ছুটে এসেছিল দরজার ধারে। দরজায় কান পেতে সে শুনছিলো ছেলেটা কি কি বলছে।
২০.
সকাল নেমেছে ধরনীর বুকে। সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে চারিধার। আরোহী দাঁড়িয়ে রয়েছে তূর্ণদের বাড়ির সম্মুখে। তনয়াকে আগেই বলেছিল তৈরি হয়ে থাকতে। এখানে এসে আর দাঁড়াবে না। কলেজে যাবে দ্রুত। অথচ মেয়েটার দেখাই নেই কোনো। এখনও কি করছে কে জানে।
তূর্ণ দাঁড়িয়ে ছিল বাড়ির বাগানেই। অনয়ের সাথে ঘুরে ঘুরে দেখছিলো বাগানের ফুল, ফল এবং সবজির গাছগুলো। তাহমিনা বেগম বৃদ্ধ বয়সের এই অবসর সময়টা কাটান এই বাগানেই। মহিলার হাতেও জাদু আছে বলতে হবে। যে গাছ রোপণ করে সেই গাছই ঝলমলিয়ে ফুল ফলে ভরে ওঠে। তূর্ণ আশেপাশে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ চোখ পড়লো গেটের পানে। ওটা কে? আরোহী না? কিন্তু মেয়েটা গেটের বাইরে ওখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন? তনয়ার জন্য অপেক্ষা করছে ভালো কথা কিন্তু গেটের বাইরে অপেক্ষা না করে বাড়ির ভিতরেও তো আসতে পারতো। ভ্রু কুঁচকালো তূর্ণ। অনয়কে বাগানে রেখে পা বাড়ালো গেটের পানে।
তূর্ণকে গেটের দিকে আসতে দেখেই চমকালো আরোহী। হৃদস্পন্দন গাঢ় হলো তার। তূর্ণ আবার এদিকে আসছে কেন? এই ছেলে তার ভাবনা চিন্তা, জীবন, পরিকল্পনা, অনুভূতি সব তো ইতমধ্যে উল্টে পাল্টে দিয়েছে এখন কাছাকাছি এসে বাকিটুকুও শেষ করে দিবে নাকি? ঢোক গিললো আরোহী। উল্টো ঘুরে দ্রুত হাঁটা ধরলো সে। তূর্ণ তৎক্ষণাৎ পিছন থেকে ডাকলো,
“আরোহী! আরোহী!”
মেয়েটা শুনেও না শোনার ভান ধরলো। ব্যস্ত পায়ে ছুটলো কলেজের পানে। তূর্ণের কুঁচকানো ভ্রু জোড়া আরও কুঁচকে গেল। মেয়েটা কি তাকে কোনোভাবে এড়িয়ে চলছে? নয়তো এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। গতকাল কল করলো মেসেজ করলো একটারও উত্তর দেয়নি আরোহী। তারপর বাড়িতে গেল দেখা করতে তখনও মাথা ব্যথার দোহাই দিয়ে দরজা খুললো না। আর এখন তাকে দেখে এক প্রকার পালিয়ে যাচ্ছে। কাহিনী কি? সে তো এমন কিছু করেওনি যার দরুন মেয়েটা তাকে এড়িয়ে চলবে। না এবার ব্যাপারটা একটু খাতিয়ে দেখতে হচ্ছে।
২১.
দুপুরের সময়। আকাশের সূর্যটা তার উজ্জ্বলতা বাড়িয়েছে আগের তুলনায়। সাথে উত্তপ্ততাও ছড়িয়ে দিয়েছে বেশ। যদিও সূর্যের আশেপাশে কিছু সংখ্যক মেঘের দেখা মিলছে কিন্তু তাতে গরম কমছে না মোটেই। তূর্ণ দাঁড়িয়ে রয়েছে আরোহী এবং তনয়ার কলেজের সম্মুখে একটা চায়ের দোকানে। মেয়েটা সত্যি সত্যিই কি তাকে এড়িয়ে চলছে নাকি এটা তার মনের ভুল সেটা বুঝতে হবে আগে তারপর অন্যকিছু।
কিঞ্চিৎ সময়ের ব্যবধানেই কলেজ ছুটি হলো আরোহী এবং তনয়ার। তারা দুজনই বেরিয়ে এলো কলেজ থেকে। তূর্ণও হাতে একটা চায়ের কাপ নিয়ে এমন এক স্থানে দাঁড়ালো যাতে স্বল্পতেই আরোহীর নজরে পড়ে। মেয়েটা যদি তাকে সত্যিই এড়িয়ে চলে তাহলে তাকে দেখেই লুকিয়ে চুরিয়ে চলে যাবে, তনয়া তূর্ণের কাছে যেতে চাইলেও যেতে দিবে না। জোরপূর্বক নিয়ে কেটে পড়বে। আর যদি এড়িয়ে না চলে তাহলে আগে যেমন তাকে রাস্তায় দেখলেই ছুটে কাছে যেতো তেমনভাবে ছুটে যাবে। তূর্ণ যেন আরোহী তনয়াকে দেখতেই পায়নি এমনভাবে চায়ের কাপে চুমুক বসালো। কিন্তু কলেজের গেট থেকে বেরিয়ে আসতেই ছেলেটাকে চোখে পড়লো আরোহী এবং তনয়ার। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। আরোহী এত চায় যাতে তাকে তূর্ণের সম্মুখে পড়তে না কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাকে বারবার এই লোকের সম্মুখেই পড়তে হয়। এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো মেয়েটা। তূর্ণের ভাবনাকে সত্যি করে দিয়ে সে লুকিয়ে পড়লো তনয়ার আড়ালে। কিন্তু কি আর থামে? ভাইকে দেখে উৎফুল্ল হলো সে। হাত উঁচিয়ে ডাক দিতে গেল তূর্ণকে। হকচকালো আরোহী। তৎক্ষণাৎ সে নিজের হাত দ্বারা টেনে ধরলো তনয়ার হাত। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“কি করছিস কি?”
“তূর্ণ ভাইকে ডাকছি।”
“উনাকে ডাকতে হবে না। বাড়িতে চল তাড়াতাড়ি।”
তনয়া তাকালো আরোহীর পানে। ভ্রু কুঁচকে শুধালো,
“কেন?”
আরোহী আমতা আমতা করলো। মেয়েটার টেনে নিয়ে সামনের দিকে যেতে যেতে বলল,
“বাড়িতে কাজ আছে আমার। উনাকে ডাকলেই এখন আবার হাঁসের মতো প্যাক প্যাক শুরু করবে। তারপর বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেরী হয়ে যাবে।”
“কি এত কাজ বাড়িতে তোর?”
“আছে। অত কথা বলার সময় নেই এখন। বাড়িতে চল তো।”
তনয়াকে টেনে নিয়ে চলে গেল আরোহী। তূর্ণ সোজা হয়ে দাঁড়ালো এবার। কাঁপলে ফুটে উঠলো গুটি কয়েক ভাঁজ। একটু আগ পর্যন্ত তার হৃদয়ে সন্দেহ ছিল যে আরোহী তাকে এড়িয়ে চলছে এবার তা বিশ্বাসে পরিণত হলো। কিন্তু কথা হলো মেয়েটা হঠাৎ তাকে এড়িয়ে চলছে কেন? সে কি এমন করেছে? মেয়েটার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার বা খারাপ কিছু করেছে বলেও তো মনে পড়ছে না।
২১.
রাতের আঁধারে ছেয়ে গেছে চারপাশটা। চারদিকে শীতল হাওয়া বইছে। আকাশ জুড়ে এখনও মেঘের আনাগোনা। তবে আজ বোধহয় পূর্ণিমা। মাঝে মাঝে মেঘের আড়াল থেকে এক খানা গোল থালার ন্যায় রূপালি চাঁদ উঁকি ঝুঁকি মে’রে দেখা দিচ্ছে। যেন সে মেঘেদের সাথে লুকোচুরি খেলায় মত্ত হয়েছে। ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চাঁদ আর মেঘেদের লুকোচুরি খেলা দেখছিলো আরোহী। ঠিক তখনই তার কাঁধে এসে একটা শক্তপোক্ত পুরুষালী হাত থামলো। চমকে উঠলো মেয়েটা। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো তার। এই রাতে এখানে কে এসেছে? আবার ভুতের মতো কাঁধে হাত রাখছে। সত্যিকারে ভু’ত টু’থ নয় তো? আরোহীর ভয় হলো। পুরো ছাদে সে একা। যদিও আয়ুশ এসেছিল তার সাথে কিন্তু ওয়াশ রুমে যাবে বলে চলে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। আয়ুশও যদি ফিরে এসে থাকে তাহলেও এ হাত তার নয়। তার মতো একটা বাচ্চা ছেলের হাত এত বড় নয়। ভয় হলো আরোহীর। সৃষ্টিকর্তার নাম জপতে জপতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সে পিছনে। অমনি চমকে উঠলো আরও। ধরফরিয়ে উঠলো কলিজাটা। একি! এ তো ভুতের চেয়েও বড় কেউ। তূর্ণ এখানে কি করছে? কখন এসেছে? কেন এসেছে? ঢোক গিললো মেয়েটা। আমতা আমতা করে বলল,
“আআআপনি! কখন এলেন?”
“কেন এখানে এসে তোর কোনো সমস্যা করলাম নাকি?”
তূর্ণের তীক্ষ্ম কণ্ঠস্বর। এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো আরোহী। জোরপূর্বক হেসে জবাব দিল,
“না সমস্যা হবে কেন? হঠাৎ এলেন তো তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি?”
“হঠাৎ না এলে তো তোকে পেতাম না। আমার নাম শুনলেই তো হয় দরজা বন্ধ করতি নয়তো পালাতি।”
আরোহী ফাঁকা ঢোক গিললো। এ লোক কি সব ধরে ফেলেছে? সবচেয়ে বড় কথা তূর্ণ কি ধরে ফেলেছে যে সে তাকে এড়িয়ে চলছে? তাহলে তো মহাবিপদ। একে তো নিজের অনুভূতি নিয়ে পালিয়ে কূল পাচ্ছে না মেয়েটা। তার উপর আবার না এই এড়িয়ে চলার ধাক্কা সইতে না পেরে তূর্ণ তাকে একটা আছাড় মে’রে দেয়। আরোহী চোখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকালো। এলোমেলো ভঙ্গিতে ছাদের দরজার পানে পা বাড়িয়ে বলল,
“চলুন নিচে গিয়ে কথা বলি। আপনি নাকি আগের দিনও আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন কিন্তু তখন আমার মাথা ব্যথা ছিল।”
তূর্ণ তৎক্ষণাৎ পিছন থেকে হাত ধরে আটকে দিল আরোহীকে। তীক্ষ্ম স্বরে বলল,
“মাথা ব্যথা ছিল নাকি মাথা ব্যথার ভান ধরে ছিলি যাতে আমার সাথে দেখা করতে না হয়।”
ধরা পড়ে যাওয়ায় চো’রে’র ন্যায় এদিকে ওদিক তাকালো আরোহী। তবে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা চালালো সে। স্বপক্ষে সাফাই গাইতে বলল,
“ককই? আর আমি আপনার সাথে দেখা না করার জন্য মাথা ব্যথার ভান ধরবো কেন? সত্যিই আমার মাথা ব্যথা ছিল।”
তূর্ণ কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো আরোহীর পানে। অতঃপর হুট করেই প্রশ্ন করলো,
“এড়িয়ে চলছিস কেন আমাকে?”
যে ভয়টা পাচ্ছিলো তাই হলো। তূর্ণ শেষ পর্যন্ত ধরেই ফেলেছে যে আরোহী তাকে এড়িয়ে চলছে। এরপর যে কি হবে আল্লাহই জানেন। মেয়েটা মোড়া মোড়ি শুরু করলো। নিজের হাতটা ছাড়াতে চাইলো তূর্ণের হাত থেকে। ক্রোধে রি রি করে উঠলো ছেলেটার শরীরটা। একে তো এই মেয়ে তাকে এড়িয়ে চলার মতো গুরুতর অপরাধ করেছে এখন আবার তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই পালাতে চাইছে। কই এত বছরে সে তো কখনও এড়িয়ে চলতে পরলো না আরোহীকে আর এই দুই দিনের পুঁচকে মেয়ে কিনা তাকে এড়িয়ে চলার মতো দুঃসাহস দেখিয়েছে? চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো তূর্ণের। হ্যাঁচকা টানে আরোহীকে ফেললো নিজের বুকের উপর। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“বল কেন এড়িয়ে চলছিলি আমাকে।”
আরোহী দূরে সরে যেতে চাইলো তূর্ণের থেকে। হাত দ্বারা ছেলেটাকে বক্ষে বল প্রয়োগ করে বলল,
“কোথায়? আমি আপনাকে এড়িয়ে চলবো কেন? এটা নিশ্চয়ই আপনার ভুল ধারনা।”
তূর্ণ আরোহীর ধরে রাখা হাতটা পিছনে মুচড়ে ধরলো সাথে সাথে। হিসহিসিয়ে বলল,
“আবার মিথ্যা বলছিস এত সাহস তোর।”
হাতের ব্যথায় চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে নিল আরোহী। ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল,
“হাত ছাড়ুন তূর্ণ ভাই। লাগছে আমার।”
“লাগুক। লাগার জন্যই তো ধরেছি। কয়েকদিন ধরে তোকে দেখতে না পেয়ে আমারও লেগেছে ভীষণভাবে। তোর এড়িয়ে চলা যে আমাকে কষ্ট দেয় তা তুই বুঝিস না?”
আরোহী অবাক হলো। চোখ বড় বড় করে তাকালো তূর্ণের পানে। পলক ঝাপটে প্রশ্ন করলো,
“আমার এড়িয়ে চলা আপনাকে কষ্ট দেয়? কেন দেয়?”
তূর্ণ উত্তর দিল না আরোহীর প্রশ্নের। বরং মেয়েটার হাতটা আরও জোরে মুচড়ে ধরে বলল,
“আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দে। এড়িয়ে চলছিস কেন আমাকে? সমস্যা কি তোর?”
চলবে…..