প্রেমপরশ পর্ব-১৩

0
27

#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১৩

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

ফের ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,

“আমাকে ছেড়ে ঘুমান তূর্ণ ভাই।”

তূর্ণ ফের চোখ খুললো। নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকালো আরোহীর পানে। এখনও আরোহী এত কাছে যে! স্বপ্নটা কি শেষ হয়নি? ছেলেটা আবার চোখ বন্ধ করলো। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে চোখ খুলে আবার তাকালো। নাহ মেয়েটা এখনও তো তার সম্মুখ থেকে যাচ্ছে না। জ্বরের ঘোরে না হয় স্বপ্ন দেখছে তাই বলে বারবার এক স্বপ্ন আসবে? তূর্ণ নিজের চোখ জোড়া কিঞ্চিৎ বড় করলো। কপালে ভাঁজ ফেললো আরোহী। এবার কিছুটা রুক্ষ কণ্ঠেই বলল,

“আমাকে ছাড়ুন তূর্ণ ভাই। আমার দম আটকে আসছে।”

চমকালো তূর্ণ। এর মানে এটা স্বপ্ন নয়। এটা সত্যি! ধরফরিয়ে দূর্বল শরীর নিয়েই বিছানায় উঠে বসলো তূর্ণ। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,

“তুই তাহলে আমার স্বপ্ন ছিলি না?”

তূর্ণের থেকে ছাড়া পেয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো মেয়েটা। তবে তার একটু আগের বলা কথায় ভ্রু কুঁচকে এলো। চোখ ছোট ছোট করে বলল,

“আমি আপনার স্বপ্ন হতে যাব কেন আশ্চর্য!”

“তাহলে তুই আমায় রুমে এভাবে আমার উপরে কি করছিস?”

কথাটা বলে একটু থামলো তূর্ণ। চোখ বড় বড় করে শুধালো,

“এই তুই আমার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে আমার দুধে ধোয়া তুলসী পাতার মতো ইজ্জতের উপরে দাগ লাগানোর চেষ্টা করছিলি না তো? নয়তো আমার বুকের উপরে এসে এভাবে গড়াগড়ি করছিলি কেন?”

আরোহী হতবাক হলো। লোকটা তার নামে কিসব উল্টাপাল্টা কথা বলছে। এই লোক তাকে নিজে থেকে জড়িয়ে ধরলো। সে ছাড়তে বলার পরও ছাড়লো না। এখন কিনা বলছে সে ইজ্জতে দাগ লাগানোর চেষ্টা করেছিল। নাক মুখ কুঁচকালো মেয়েটা। থমথমে কণ্ঠে বলল,

“একদম বাজে কথা বলবেন না তূর্ণ ভাই। আমি কিছু করিনি। আমি তো এসেছিলাম আপনার জ্বর দেখতে। কিন্তু আপনার কাছে আসতেই আপনি হুট করে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। কতবার বললাম ছাড়তে ছাড়লেনই না।”

“তুই যে সত্যি বলছিস তার প্রমাণ কি? তুই তো মিথ্যাও বলতে পারিস।”

“আপনাকে মিথ্যা বলে আমার লাভ কি? তাছাড়া আমার অত শখও নেই আপনার দুধে ধোয়া তুলসী পাতার ন্যায় পবিত্র ইজ্জতে দাগ লাগানোর।”

আরোহী উঠে দাঁড়ালো। কপাল কুঁচকে রেখেই বলল,

“যাই হোক আপনার সাথে এসব আছে বাজে কথা বলার সময় নেই আমার। নিচে যাচ্ছি। মা বোধহয় অপেক্ষা করছে আমার জন্য।”

আরোহী দরজার দিকে পা বাড়ালো। তৎক্ষণাৎ তার পিছন থেকে হাত টেনে ধরলো তূর্ণ। মেয়েটা দাড়িয়ে পড়লো। তূর্ণের পানে তাকিয়ে বলল,

“কিছু বলবেন?”

“আর একটু থাক না।”

থামলো তূর্ণ। কিছুটা ইতস্তত করে ফের বলল,

“না মানে একা একা ভালো লাগছিলো না তাই বললাম।”

আরোহীর হাঁসফাঁস লাগছে। বিশেষ করে যখন থেকে সে উপলব্ধি করতে পেরেছে সে তূর্ণকে ভালোবাসে তখন থেকে কেমন একটা একটা লাগছে। বারবার মনে হচ্ছে এই বুঝি তূর্ণ ধরে ফেললো তার মনের কথা। এই বুঝি ভালোবাসার অপরাধে তাকে ঠাঁটিয়ে দুটো চড় মা’র’লো, এই বুঝি সবাইকে বলে দিল সব। ঐ যে কথায় আছে না ‘চোরের মনে পুলিশ পুলিশ।’ আরোহীর অবস্থাও হয়েছে অনেকটা তেমন। তূর্ণ কিছু বুঝুক বা না বুঝুক তার হৃদয় দিশেহারা হয়ে উঠছে। তবে ছেলেটার এমন আকুল আবদার ফেলতে পারলো না সে। হাঁসফাঁস লাগার সাথে সাথে তূর্ণের জন্য খারাপও লাগছে কিঞ্চিৎ। ছেলেটা অসুস্থ, একা একা আছে। তাকে একটু হলেও সঙ্গ দেওয়া উচিৎ তার। আরোহী নিঃশব্দে বসে পড়লো তূর্ণের পাশে।‌ হাসলো ছেলেটা। আবারও বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে বলল,

“মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দে তো। আমি ঘুমাবো আবার।”

আরোহী চোখ বড় বড় করলো। ইতস্তত করে তাকালো তূর্ণের পানে। এমনিই মেয়েটার হৃদয় তূর্ণের জন্য দিশেহারা। তার মধ্যে ছেলেটা আবার তাকে স্পর্শ করতে বলছে। এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো আরোহী। আমতা আমতা করে বলল,

“ঘুমান আপনি। এর জন্য মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হবে কেন?”

“কেমন ঘুম আসছে না এখন আর। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে হয়তো ঘুম চলে আসতো।”

“আমি পারবো না আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে।”

তূর্ণ একটু এগিয়ে আরোহীর পাশ ঘেঁষলো। মেয়েটার হাতটা নিয়ে রাখলো নিজের মাথায়। অতঃপর বলল,

“আমার ঘুম যখন তুই ভাঙিয়েছিস তখন মাথায় হাত বুলিয়ে আবার তুই ই ঘুম পাড়িয়ে দিবি। তাড়াতাড়ি হাত বুলিয়ে দে।”

আরোহীর অস্বস্তি লাগছে ভীষণ। সে তূর্ণের মাথায় হাত বুলিয়ে না দিয়ে চুপচুপ বসে রইলো। অমনি ধমকে উঠলো ছেলেটা। রুক্ষ স্বরে বলল,

“কি হলো হাত বুলিয়ে দিচ্ছিস না কেন?”

আরোহী এবার ইতস্তত বোধ নিয়েই হাত বুলানো শুরু করলো তূর্ণের মাথায়। ছেলেটা চোখ বন্ধ করলো। কিঞ্চিৎ সময়ের মধ্যেই পাড়ি জমালো ঘুমের দেশে।

১৭.
রাত্রি গভীর। চারদিকটা কৃষ্ণ কালো আঁধারে ঢাকা পড়ে গেছে। আকাশে মেঘের আনাগোনা থাকায় এ আঁধারে যেন আরও নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। চারদিকে বিরাজ করছে শুনশান নীরবতা। আরোহী বিছানায় শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। দুই চোখে তার ঘুম নেই মোটেই। বারবার শুধু তূর্ণের কথা মনে পড়ছে। তূর্ণকে সে ভালোবাসে কথাটা স্মরণে আসলে হৃদয় কেঁপে উঠছে। যে ছেলেকে সে ছোট বেলা থেকে ভাই মেনেছে তার প্রতি এমন অনুভূতি নিশ্চই বাঞ্ছনীয় নয়। আরোহীর কাছে এটা কোনো অনুভূতি নয় বরং পাপ মনে হচ্ছে পাপ। মেয়েটার এই মুহূর্তে নিজেকে ঘোর পাপী মনে হচ্ছে। সে কিভাবে এমন একটা কান্ড ঘটাতে পারলো? আরোহীর হৃদয় দিশেহারা হয়ে উঠলো। আবার খারাপও লাগছে তার। জ্বরের ঘোরে তূর্ণ বারবার ভালোবাসি ভালোবাসি বলছিলো। কাকে বলছিলো সে কথাটা? নিশ্চই তূর্ণ কোনো মেয়েকে ভালোবাসে।‌ নয়তো জ্বরের ঘোরে এতটা ব্যাকুল হয়ে সে ঐ কথা বলতো না। আরোহীর কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে তূর্ণ তাকে কেন ভালোবাসলো না। সে যেভাবে ভালোবাসে তূর্ণও তো তাকে সেভাবে ভালোবাসতে পারতো। কিশোরী বয়সে মেয়েটা প্রথম প্রেমে পড়লো তাও এমন একটা মানুষের যে কিনা অন্য একজনকে ভালোবাসে! আরোহীর কান্না পেল ভীষণ। সব কিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে তার। বুকটা ভারী হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে যেন বুকের উপরে কেউ ১০০ মন ওজনের একটা পাথর চাপিয়ে দিয়েছে যা তার জন্য বহন করা দুস্কর। মেয়েটা জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিল। নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো। না না এসব সে কি ভাবছে? তূর্ণের সাথে তার কোনোদিনই কিছু সম্ভব না। উল্টো তার মনের কথা কেউ জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এখন থেকে নিজেকে তূর্ণের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে তাকে। ছেলেটার প্রতি তার মনে তৈরি হওয়া অনুভূতির নিঃশেষ ঘটাতে হবে। যে অনুভূতির কোনো ভবিষ্যৎ নেই সেই অনুভূতির প্রসারন না ঘটানোই শ্রেয়।

১৮.
সময় প্রবাহমান। সময়ের এই প্রবাহমান গতিতে কেটে গেছে দিন তিনেক। তূর্ণের জ্বর কমে গেছে এর মধ্যে। তবে সর্দি কাশি রয়ে গেছে এখনও। সেদিনের পর আর তূর্ণের সাথে দেখা হয়নি আরোহীর। সেদিন যে মেয়েটা চলে গেল তারপর আর এ মুখো হলো না। তূর্ণও অসুস্থ থাকায় এ কয়দিন কল টল করেনি তাকে। কিন্তু আজ কল না করলেই নয়। ভিতরে ভিতরে কেমন অস্থির লাগছে তার। মনে হচ্ছে এক যুগ কেটে গেছে সে আরোহীর দেখা পেয়েছে। তূর্ণ অস্থির ভঙ্গিতেই নিজের মোবাইলটা হাতে তুলে নিল। কল‌ লাগালো আরোহীর নাম্বারে। কিন্তু মেয়েটা কল ধরছে না। রিং বেজে যাচ্ছে অথচ তার কোনো খোঁজ নেই।

আরোহী বসে ছিল মোবাইলের পাশেই। সে দেখেছে তূর্ণ কল করেছে। তূর্ণের নামটা দেখেই মেয়েটার মনটা আঁকুপাঁকু করে উঠেছিল কল ধরার জন্য কিছু নিজেকে সে নিয়ন্ত্রণ করেছে। না সে কিছুতেই কলটা ধরবে না। ঐ লোকটার সাথে কথা বললে দেখা যাবে সে আরও তার মায়ায় পড়ে গেছে। আর ভুলতে পারছে না। তার চেয়ে এর সাথে দেখা না করা কিংবা কথা না বলাই শ্রেয়। মোবাইলে কল বাজতে বাজতে থেমে গেল, পরপর আবার বাজলো, একের পর এক কল এলো তূর্ণের তবুও কলটা ধরলো না সে। শেষে বাধ্য হয়ে তূর্ণ একটা মেসেজ করলো,

“তুই হয়তো মোবাইলের কাছে নেই। কাছে এলে একটা মিস কল দিস।”

আরোহী দেখলো মেসেজটা তবে উত্তর দিল না কোনো।

১৯.
দিন গড়িয়ে রাতের দেখা মিলেছে। সূর্যের আলোয় আলোকিত হওয়া শহরটা এই মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সোডিয়ামের কৃত্রিম আলোয়। তূর্ণ হাতে মোবাইল নিয়ে বসে আছে। সেই বিকালে সে আরোহীকে কল করেছিল। তাও একটা দুইটা না পুরো ৭ টা। তখন না হয় মেয়েটা মোবাইলের কাছে ছিল না কিন্তু এখনও অব্দি কি সে এক বারের জন্যও মোবাইলের কাছাকাছি আসেনি? দেখেনি যে তাকে মিস কল দিতে বলা হয়েছে? আচ্ছা মেয়েটার আবার কিছু হয়নি তো? তার মতো জ্বরে পেয়েছে, কোনো বিপদ আপদ হয়েছে কিংবা মোবাইল চো’রে নিয়েছে! তূর্ণের হৃদয় অস্থির হলো। কোনো রকমে শরীরে একটা শার্ট চাপিয়ে সে বেড়িয়ে পড়লো বাড়ি থেকে।

****

কিছুটা সময়ের ব্যবধানেই তূর্ণ এসে পৌঁছালো আরোহীদের বাড়িতে। কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে দিল ইরা। তূর্ণকে দেখে এক গাল হাসলো সে। দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল,

“আরে তূর্ণ বাবা যে। আয় আয় ভিতরে আয়। জ্বর কমেছে তোর?”

কথাটা বলে আর তূর্ণের উত্তরের অপেক্ষা করলো না ইরা। নিজেই ছেলেটার কপালে হাত ছুঁইয়ে দেখলো জ্বর আছে কিনা। জ্বর নেই দেখে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। স্বাভাবিক স্বরে বলল,

“বস এখানে। আমি বরং তোর জন্য কিছু বানিয়ে নিয়ে আসি। কতদিন পর এলি আমাদের বাসায়। তার উপর অসুস্থ শরীর।”

তূর্ণ এদিক ওদিক তাকালো। চারদিকে নজর ঘুরিয়ে কিছুটা ইতস্তত করে বলল,

“আরোহী আর আয়ুশ কোথায়? ওদের দেখছি না যে।”

“ঘরেই আছে।”

কথাটা বলে গলা উঁচালো ইরা। ডেকে বলল,

“আরোহী আয়ুশ কই তোরা? তূর্ণ এসেছে।”

তূর্ণ এসেছে শুনে আয়ুশ ছুটে এলেও আরোহী নিজ কক্ষের দরজা আটকালো তৎক্ষণাৎ। হৃদস্পন্দন বাড়লো তার। এই লোক এই সময়ে তাদের বাড়িতে এসেছে কেন? নিশ্চই সে কল ধরেনি তাই। না না সে কিছুতেই তূর্ণের সম্মুখে যাবে না। যতটা সম্ভব ঐ লোকটার থেকে এড়িয়ে চলতে হবে। একজন পুরুষ অন্য কাউকে ভালোবেসে এই সত্যটা জেনেও সে কিছুতেই তার দিকে পা বাড়াতে পারে না, কিছুতেই না। আরোহী এলো না তূর্ণের সম্মুখে। কপাল কুঁচকে এলো ছেলেটার। সন্দিহান স্বরে সে প্রশ্ন করলো,

“আরোহী ঠিক আছে তো? ওর কিছু হয়নি তো?”

“আরে না কি হবে? ঠিকই আছে। হয়তো আমার ডাক শুনতে পায়নি তাই আসছে না। তুই বস আমি এক্ষুনি ডেকে দিচ্ছি ওকে।”

ইরা পা চালিয়ে গেল আরোহীর কক্ষের সম্মুখে। হাত উঁচিয়ে টোকা দিল বন্ধ দরজায়। ডেকে বলল,

“আরোহী! আরোহী! শুনছিস আমার কথা? তূর্ণ এসেছে। ডাকছে তোকে।”

আরোহী ঢোক গিললো। কণ্ঠটা একটু নরম করে অসুস্থের ন্যায় বলল,

“তূর্ণ ভাইকে বলে দাও আমার ভীষণ মাথা ব্যথা করছে। একটু শুয়েছি।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে