প্রেমপরশ পর্ব-১২

0
20

#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১২

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

তূর্ণের ভীষণ ইচ্ছে হলো আরোহীকে একটু ছুঁয়ে দিতে, ভালোবাসে অন্তত মেয়েটার ললাটের মধ্যভাগে একটা গাঢ় চুম্বন করতে। তবে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো। নিজের পুরুষ তাত্বিক মনভাবকে দমন করতে মেয়েটার দিক থেকে নজর ঘুরিয়ে নিল সে। সে আদেশ দিল,

“ভিতরে যা আরোহী।”

আরোহী গেল না। বরং হাত দুটো মেলে দিল বৃষ্টির মাঝে। ওষ্ঠে তার মন মাতানো হাসি। বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা বিন্দুগুলোকে সে আলতোভাবে ছুঁয়ে দিতে দিতে বলল,

“আর একটু পরে যাই না।”

তূর্ণ আড় চোখে তাকালো মেয়েটার পানে। হৃদকম্পন বাড়লো আরও। প্রবল এই বর্ষনের মধ্যে মেয়েটার রূপ যেন স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে আরও। বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা বিন্দু গায়ে মেখে উতলা করে তুলছে তূর্ণের হৃদয়। ঢোক গিললো বেচারা। ফের বলল,

“একটু পর না এখনই ভিতরে যা আরোহী।”

আরোহী তবুও গেল না। এবার হাতের সাথে একটা পা ও সে বাড়িয়ে দিল বৃষ্টির মধ্যে। মুহুর্তেই বৃষ্টি ফোঁটা ফোঁটা বিন্দুরা ভিজিয়ে দিতে শুরু করলো তার পা খানা। আরোহী পা দুলালো। ওষ্ঠে হাসির উপস্থিতি রেখেই বলল,

“পায়ে এখন আলতা আর নূপুর হলে দেখতে বেশি ভালো লাগতো।”

কথাটা বলার প্রায় সাথে সাথেই ধমকে উঠলো তূর্ণ। রুক্ষ স্বরে বলল,

“ভিতরে যাবি নাকি।”

আকস্মিক ধমকে কেঁপে উঠলো আরোহী। এতক্ষণ তো সব ভালোই ছিল। কি সুন্দর ব্যবহার করলো এই লোক তার সাথে। তাহলে হঠাৎ কি হলো যে এভাবে ধমকে উঠলো। মেয়েটা তাকালো তূর্ণের পানে। কপাল কুঁচকে শুধালো,

“কি হয়েছে তূর্ণ ভাই? হঠাৎ এভাবে ধমকাচ্ছেন কেন?”

“কথা শুনছিস না কেন তাহলে? ভিতরে যেতে বলছি যাচ্ছিস না কেন?”

আরোহী চোখ ছোট ছোট করলো। ভেংচি কেটে বলল,

“যাব না আমি। কি সুন্দর বৃষ্টি! দেখতে ভালো লাগছে।”

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল তূর্ণ। মেয়েটা এখনও নিজের দিকে খেয়াল করেনি হয়তো। যদি খেয়াল করতো তবে এতক্ষণে লাজে মুষড়ে পড়তো। ছুটে পালাতো তূর্ণের সম্মুখ থেকে। একটু সময় নিল তূর্ণ। অতঃপর বলেই ফেললো,

“নিজের পা হতে মাথা অব্দি দেখ একবার। তারপর যদি তোর মনে হয় আমার সামনে থাকা উচিত তবে থাক নয়তো ভিতরে যা।”

আরোহী ভ্রু কুঁচকে তাকালো নিজের পানে। অমনি চমকে উঠলো। বৃষ্টির পানিতে ভিজে কি বিশ্রী দেখাচ্ছে তাকে। শরীরের প্রতিটি ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যেন। আর সে কিনা এভাবে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল এই লোকের সম্মুখে! আবার তাকে ভিতরে বারবার ভিতরে যেতে বলার পরও সে যায়নি। লজ্জায় মুষড়ে পড়লো আরোহী। আর এক মুহূর্তও তূর্ণের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পেল না সে। এক দৌড়ে চলে গেল গৃহের ভিতরে। তূর্ণ হাসলো। ভেজা চুলগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে সেও নেমে পড়লো বৃষ্টির মধ্যে। আজ রাতটা হোক না একটু বৃষ্টিময়, সুন্দর।

১৫.
বিকালের সময়। চারিদিকটায় এখনও সূর্যের উজ্জ্বল বিরাজমান। আজ বৃষ্টি নেই তেমন। তবে সূর্যের আশেপাশে কিছু মেঘের আনাগোনা লেগে রয়েছে। কখন আবার গগন কাঁপিয়ে বৃষ্টি নেমে পড়ে কে জানে! আরোহী বসে রয়েছে নিজ কক্ষের বারান্দায়। নরম দৃষ্টিতে দেখছে চারপাশের প্রাকৃতি। তূর্ণের সাথে তার দেখা হয়েছে গোটা একটা দিন কেটে গেছে। এর মধ্যে আরোহী আর ঐ পুরুষের মুখোমুখি হয়নি, কথাও বলেনি। তূর্ণও তার সামনে আসেনি কিংবা কল করেনি। যাক ভালোই হয়েছে তূর্ণ তার থেকে দূরে দূরে রয়েছে। সেদিন রাতে যা ঘটলো। মনে পড়লেও মেয়েটার ভিতরটা লজ্জায় শিউরে ওঠে। মেয়েটার ভাবনার মধ্যেই তার কক্ষে এলো ইরা। ডেকে বলল,

“আমি আর আয়ুশ একটু তূর্ণদের বাড়িতে যাচ্ছি। তুই যাবি?”

তূর্ণদের বাড়িতে! ও বাড়িতে যাওয়া মানেই তো তূর্ণের মুখোমুখি হওয়া। সেদিন রাতের ঐ লজ্জাজনক ঘটনার পর কোন মুখে আরোহী ঐ লোকের সম্মুখে দাঁড়াবে? না না ও বাড়িতে যাওয়া যাবে না এখন। মেয়েটা এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো। কিছুটা ব্যস্ত হয়ে বলল,

“না না আমি যাব না। তোমরা যাও।”

ইরা আর সাধলো না মেয়েকে। স্বাভাবিক কণ্ঠ বলল,

“আচ্ছা আমরা যাচ্ছি তাহলে। সন্ধ্যার আগেই চলে আসবো। তুই দরজা আটকে ভিতরে থাকিস।”

কথাটা বলেই পিছন ঘুরলো ইরা। দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,

“যাই গিয়ে তূর্ণকে দেখে আসি একটু। জ্বরে ছেলেটা নাকি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে।”

আরোহী চমকালো।‌ কার জ্বর? তূর্ণের! সেদিন যা বৃষ্টিতে ভিজেছে তাতে জ্বর ওঠারই কথা। সকালে বৃষ্টিতে ফুটবল খেললো। আবার রাতে তার সাথে ভিজলো। কিন্তু তূর্ণের জ্বর তো ভয়ংকর। সহজে তার জ্বর ট্বর আসে না। তবে যখন আসে তখন ছেলেটাকে নাজেহাল করে তোলে। আরোহীর মায়া হলো। হৃদয়ে কেমন একটা খারাপ লাগা অনুভব করলো। তূর্ণকে নিয়ে চিন্তা হলো ভীষণ। ছেলেটা ঠিক আছে তো? কতটা জ্বর উঠেছে? মেয়েটা তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলো সাথে সাথে। মাকে পিছন থেকে ডেকে বলল,

“মা আমি যাব।”

ইরা দাঁড়ালো। পিছন ঘুরে ভ্রু কুঁচকে বলল,

“তুই না একটু আগে বললি যাবি না?”

জোরপূর্বক হাসলো আরোহী। কিছুটা ইতস্তত করে বলল,

“বাসায় একা একা থেকে কি করবো? তাই ভাবলাম ও বাড়ি থেকেই ঘুরে আসি একটু।”

১৬.
কিঞ্চিৎ সময়ের বিলুপ্তি ঘটিয়েই তূর্ণদের বাড়িতে এসে পৌঁছালো ইরা, আয়ুশ এবং আরোহী। তাদের দেখেই এগিয়ে এলো পৃথা। ইরাকে এক হাতে আগলে নিয়ে বলল,

“তোমাকে তো দেখাই যায় না। আমাদের এদিকে একদম আসোই না।”

“সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকি। তাছাড়া কয়দিন ধরে যা বৃষ্টি তাই আসা হয় না।”

থামলো ইরা। ফের বলল,

“তূর্ণ কোথায়? শুনলাম ওর নাকি খুব জ্বর।”

“আর বলো না। কাল থেকে জ্বরে হুশই ছিল না ছেলেটার। ঔষধ টৌষধ খাওয়ানোর পর একটু কমেছে জ্বরটা। ঘুমাচ্ছে এখন।”

তূর্ণের ঘুমানোর কথা শুনে ইরা আর উপরে গেল না। পৃথার সাথেই খোশ গল্পে বসলো সে। আয়ুশও আর তূর্ণের কক্ষের পানে না গিয়ে অনয়ের সাথে দুষ্টুমিতে মাতলো। এমনিই জ্বর ছেলেটার তার মধ্যে আবার তার ঘুমে বিরক্ত করার দরকার কি? তবে আরোহী এই সুযোগটাই নিতে চাইলো। তূর্ণের ঘুমের মধ্যেই একবার তাকে দেখে আসতে চাইলো। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর ঐ পুরুষের মুখোমুখি হওয়ার শক্তি এই মুহূর্তে মেয়েটার মধ্যে নেই। সেদিন রাতের কথা ভেবে এখনই কেমন ভিতরে ভিতরে লজ্জা, অস্বস্তি হচ্ছে। মুখোমুখি হলে তো আরও হবে। সকলের অগোচরে আরোহী ধীর পায়ে উপরে উঠলো। পা টিপে টিপে ঢুকলো তূর্ণের কক্ষে। কিন্তু একি! চারদিকটা অন্ধকারে ঘেরা। কক্ষের জানালা গুলোও সব বন্ধ আবার লাইটও নিভানো। মেয়েটা এদিক ওদিক হাতরে জানালার ফাঁকা থেকে আসা আবছা আলোয় কক্ষের বৈদ্যুতিক লাইটটা জ্বালালো। অতঃপর বিছানার পানে ফিরতেই চমকে উঠলো সে। হৃদস্পন্দন গাঢ় হলো পূর্বের তুলনায়। তূর্ণ উদম শরীরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। কোমড় অব্দি একটা কাঁথা টানা শুধুমাত্র। পিঠ জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘামের উপস্থিতি। ঢোক গিললো বেচারী। বুকের মধ্যটায় কেমন দ্রীম দ্রীম আওয়াজ হচ্ছে তার। আরোহী আর গেল না তূর্ণের নিকটে। উল্টো ঘুরে পা বাড়ালো দরজার পানে। তখনই তার কর্ণে ভেসে এলো অস্পষ্ট স্বরের কিছু শব্দ। মেয়েটা থমকে দাঁড়ালো। পিছন ফিরে তাকালো বিছানার পানে। তূর্ণ ইতমধ্যে চিৎ হয়ে শুয়েছে, বিরবিরিয়ে বলছে কিছু। কপালে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সম্ভবত কোনো বাজে স্বপ্ন দেখছে বা কিছু। আরোহী আর বেরিয়ে গেল না কক্ষ থেকে। ফিরে গিয়ে দাঁড়ালো বিছানার নিকটে। একটু ঝুঁকে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো তূর্ণ কি বলছে তা। কিন্তু কিছুই তো শোনা যাচ্ছে না স্পষ্ট। কি বলছে এই ছেলে? আরোহী আর একটু ঝুঁকলো। একদম তূর্ণের মূখের নিকট কর্ণ নিয়ে শোনার চেষ্টা করলো তার কথা। কিন্তু কিছু শোনার পূর্বেই তূর্ণ হঠাৎ জড়িয়ে ধরলো আরোহীকে। শক্ত করে চেপে ধরলো নিজ বক্ষের সাথে। হকচকিয়ে উঠলো মেয়েটা। একজন পুরুষের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে শিউরে উঠলো তার দেহ খানা। বুকের ভিতরে অবস্থানরত ছোট্ট হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠলো যেন দ্রুত বেগে। মেয়েটা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো তূর্ণের বাঁধন থেকে। কিন্তু পারলো না। ছেলেটা আরও শক্তভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল তাকে। চোখ দুটো বন্ধ রেখেই অস্থির হয়ে বলল,

“তুই আমার, শুধুমাত্র আমার।”

আরোহী অবাক হলো। তূর্ণ কার কথা বলছে? কাকে এতটা অস্থির হয়ে নিজের বলে জাহির করছে? মেয়েটা চোখ তুলে তাকালো তূর্ণের মুখ পানে। কিঞ্চিৎ অবাক সুরেই বলল,

“কার কথা বলছেন আপনি তূর্ণ ভাই? কে আপনার?”

তূর্ণ জবাব দিল না আরোহীর প্রশ্নের। চোখ বন্ধ করে সে বারবার বলে যাচ্ছে,

“তুই আমার, শুধুমাত্র আমার। তোকে আমি হারাতে পারবো না। আমি ভালোবাসি তোকে, ভীষণ ভালোবাসি।”

আরোহী ভ্রু কুঁচকালো। তবে কি তার তূর্ণ ভাই কারো সাথে প্রেম করে বা কাউকে ভালোবেসে? মেয়েটার হঠাৎ বুক কাঁপলো। অদ্ভুত এক কষ্টদায়ক অনুভূতি ঘিরে ধরলো তাকে‌। বুকের মধ্যে যেন তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। বারবার মনে হচ্ছে তূর্ণ অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারে না, কিছুতেই না। এমন কেন হচ্ছে তার সাথে? তূর্ণ অন্য কাউকে ভালোবাসতেই পারে এতে তার ভিতরে তো এমন হওয়ার কথা নয়। তবে কি তার হৃদয়ে তূর্যের জন্য কোনো অনুভূতি রয়েছে? না এ হতে পারে না। তাদের মধ্যকার সম্পর্কটা শুধুমাত্র ভাই বোনের সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ। ছোটবেলা থেকে তো তারা ভাই বোন হিসেবেই বড় হয়েছে। সেখানে হৃদয়ে এমন এক অনুভূতির স্থান দেওয়াও পাপ। তাছাড়া তার হৃদয়ে তূর্ণের জন্য এমন অনুভূতি রয়েছে জানাজানি হলে বাড়ির সবাই কি ভাববে? নিশ্চই তাদের দুই পরিবারের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যাবে। আর তূর্ণই বা কি ভাববে? নির্ঘাত ঠাস ঠাস করে দুটো থাপ্পর লাগিয়ে দিবে তার দুই গালে। তারপর ধমকে বলবে,

“ছিঃ ছিঃ আরোহী শেষ পর্যন্ত এই ছিল তোর মনে? তুই এভাবে কলুষিত করলি আমাদের মধ্যকার ভাই বোনের সম্পর্ককে। এভাবে আমাদের দুই পরিবারের সম্পর্ককে নষ্ট করলি? তোকে যেন আমার আশেপাশে আর কখনও না দেখি।”

আরোহী ঢোক গিললো। নিজেকে তূর্ণের বাঁধন থেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হলো ভীষণভাবে। কিন্তু সে ব্যর্থ। এত বড় শক্তপোক্ত এক পুরুষের সাথে তার মতো এক চুনোপুঁটির পারা কি সহজ নাকি? মেয়েটা শেষে আর উপায় না পেয়ে একটু জোরেই ডেকে উঠলো,

“তূর্ণ ভাই! তূর্ণ ভাই!”

এরপরেও কোনো হেলদোল দেখা গেল না তূর্ণের মধ্যে। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো মেয়েটা। দুই হাত তুলে সে ধাক্কা মারলো তূর্ণকে। ফের ডাকলো,

“তূর্ণ ভাই! তূর্ণ ভাই!”

তূর্ণ এ পর্যায়ে নড়েচড়ে উঠলো। নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকালো সে চোখ মেলে। আরোহীকে এত কাছে দেখে ওষ্ঠে হাসি ফুটে উঠলো তার। ভাবলো জ্বরের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে। তাই আর অতটা মাথা ঘামালো না সে বিষয়টা নিয়ে। আরোহীকে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেই চোখ বন্ধ করলো আবারও। ভ্রু কুঁচকালো মেয়েটা। ফের ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,

“আমাকে ছেড়ে ঘুমান তূর্ণ ভাই।”

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে