#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১১
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
“একটা কথা বলতে এসেছিলাম।”
“বলে ফেল।”
তনয়া একটু সময় নিল। ইতস্তত করে বলল,
“আজকে যা হয়েছে তাতে আরোহীর দোষ ছিল না কোনো। আর ঐ ছেলেগুলোও আমাদের ক্লাসমেট ছিল।”
তূর্ণ জানে আরোহীর দোষ ছিল না তবুও সে বলল,
“ক্লাসমেট ছিল বলে কি তাদের হাত থেকে ফুল নেওয়া যাবে নাকি?”
“না তা নয়। আসলে হয়েছে কি আজ কলেজে ঐ ছেলেগুলো কতগুলো কদম ফুল নিয়ে এসেছিল। এই ভেজা বর্ষায় ঐ সুন্দর সুন্দর কদম ফুল দেখে আমি আর আরোহী নিজেদের লোভ সামলাতে পারিনি। ওদের নিকট ফুলের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে ওরা বলে মাঠের কাছের কদম গাছে নাকি অনেক ফুল ফুটেছে। আমরা তো আর গাছে উঠতে পারি না তাই ওদের নিয়ে মাঠের কাছের কদম গাছটার কাছে গিয়েছিলাম।”
“ক্লাসের সময় কেন গিয়েছিলি? ক্লাস বাদ দিয়ে কদম ফুল কিসের?”
“বৃষ্টির কারণে আজ ক্লাসে তেমন ছাত্র ছাত্রী আসেনি। তাই আমরাও ক্লাস না করেই চলে এসেছিলাম আর কি।”
তূর্ণের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। রুক্ষ কণ্ঠে সে বলল,
“চলেই যখন এসেছিলি তখন বাড়িতে আসতি। আমরা কি মরে গিয়েছিলাম? আমি ছিলাম, অন্যরা ছিল ওদের বলতি কদম ফুল এনে দেওয়ার জন্য। ক্লাস পালিয়ে অন্য ছেলেদের নিয়ে গেলি কেন?”
“না মানে…”
তূর্ণ কটমট করলো। ধমকের সুরে বলল,
“তোকে আর মানে মানে করতে হবে না। আপাতত চোখের সামনে থেকে সর। নয়তো একটাকে তো কানের নিচে দিয়েছি এবার তোকেও দেব।”
তনয়া ঢোক গিললো। আর কিছু বলার সাহস পেল না সে। বেশি কিছু বলতে গেলে দেখা যাবে থাপ্পড় খেয়ে গাল বেঁকে গেছে। এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো মেয়েটা। চুপচাপ বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে।
১৪.
রাত বেড়েছে। চারদিকটা কেমন শুনশান নীরবতায় ছেয়ে গেছে। চারপাশের আঁধারটাও গাঢ় রূপ ধারণ করেছে ইতমধ্যে। বৃষ্টিটাও নেই। তূর্ণ নিজের মনের অপরাধবোধ এবং খারাপ লাগাকে দমাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে। প্রথমে সে আরোহীর বাড়ির দিকে রওনা দিয়েও আবার উল্টো দিকে ঘুরলো। কিছুটা সময়ের ব্যবধানেই এসে পৌঁছালো মাঠের কাছের সেই কদম গাছটার নিচে। হলুদ আর সাদার সংমিশ্রণে ফুটে থাকা সুশ্রী কদমে ভরে রয়েছে গাছটা। এই রাতের আঁধারে কদমগুলো যেন আরও স্নিগ্ধ এবং সুন্দর রূপ ধারণ করেছে। তূর্ণ মোবাইলের ফ্ল্যাশের আলোয় তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো কদমগুলো। এই ফুলের জন্যই তো আজ এত কিছু। মেয়েটার কদম ফুল এত পছন্দ তাকে বললেই পারতো তাহলে তো আর থাপ্পড় খেতে হতো না। অবশ্য আরোহীর সব ফুলই পছন্দ। ছোটবেলা থেকেই মেয়েটা বেশ ফুলপ্রেমী। কিন্তু এখন সমস্যা হলো এই কদমগুলো তূর্ণ পাড়বে কিভাবে? সব ফুল উপরের দিকে। নিচের দিকে কোনো ফুল নেই বললেই চলে। ছেলেমেয়েরা হয়তো নিচের দিকের সব ফুল ছিঁড়ে ফেলেছে। তূর্ণ কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে গাছের আশপাশটা পর্যবেক্ষণ করলো। অতঃপর মোবাইলের আলোর সাহায্যেই গাছে চড়তে শুরু করলো। কিন্তু এখানেও সমস্যা। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে গাছটা কেমন পিচ্ছিল হয়ে গেছে। হাতে মোবাইল নিয়ে এই পিচ্ছিল গাছে ওঠা কি এতটাও সহজ নাকি? তবুও হার মানলো না তূর্ণ। অনেক কষ্টে উঠলো সে গাছে। ইতমধ্যে গাছের বাকলের সাথে তার নরম চামড়ার ঘর্ষণে হাত পা ছুঁলে রক্তের দেখাও মিলেছে। তবুও থেমে থাকেনি ছেলেটা। গাছের ডগায় উঠে এক গুচ্ছ কদম ছিঁড়ে হাতে নিয়েই ক্ষান্ত হলো সে। অতঃপর ওষ্ঠে এক টুকরো বিশ্ব জয়ের হাসি ঝুলিয়ে নেমে এলো নিচে।
নিচে নেমে আর দেরী করলো না তূর্ণ। এক ছুটে এসে দাঁড়ালো আরোহীদের বাড়ির সম্মুখে। মোবাইল ঘেটে কল লাগালো মেয়েটার নাম্বারে। আরোহী ঘুমাচ্ছিল। গভীর ঘুমে নিমগ্ন সে। এর মধ্যেই হঠাৎ করে বালিশের পাশে রাখা তার মোবাইলটা বেজে উঠলো প্রবল ঝংকার তুলে। বিরক্ত হলো মেয়েটা। এত রাতে আবার কে কল করে ঘুম নষ্ট করছে কে জানে! আরোহী ঘুমঘুম চোখে মুখে মোবাইলটা হাতে নিল। নিভু নিভু দৃষ্টিতে স্ক্রীনে তূর্ণের নামটা দেখেই তার চোখের ঘুম উবে গেল। হৃদয়ে অভিমানেরা নড়েচড়ে উঠলো আবারও। একটু কিছু হলেই লোকটা তাকে থাপ্পড়ের উপরে রাখে। পরে আবার আদিখ্যেতা দেখাতে আসে। এ যেন ‘জুতা মে’রে গরু দান।’ এবারে তো মে’রে’ছে একদম শুধু শুধু। এখন আবার এসেছে ঢং দেখাতে। সেও এবার আর এর ঢং এ গলবে না। একদম কল ধরবে না ঐ লোকের। কিন্তু এ লোক তো থামছে না। একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে। আরোহী একবার ভাবলো মোবাইলটা বন্ধ করে দিবে। পরক্ষণেই আবার ভাবলো কলটা একবার ধরে দেখা যাক লোকটা কি বলে। উল্টা পাল্টা কিছু বলা শুরু করলে না হয় কল কেটে মোবাইলটা বন্ধ করে দেওয়া যাবে। আরোহী কল রিসিভ করে মোবাইল কানের কাছে ধরলো। থমথমে কণ্ঠে বলল,
“আসসালামুয়ালাইকুম। এত রাতে কল করেছেন কেন?”
তূর্ণ সালামের উত্তর দিল। অতঃপর বেশি কথা না বাড়িয়ে বলল,
“নিচে আয়।”
আরোহী ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“কেন?”
“আগে আয় তো নিচে তারপর দেখবি।”
কথাটা বলেই পরপর কল কাটলো তূর্ণ। আরোহী ভ্রু কুঁচকে রেখেই বিছানা ছাড়লো। লম্বা লম্বা পা ফেলে গিয়ে দাঁড়ালো জানালার নিকট। উঁকি দিয়ে দেখলো তূর্ণ সত্যিই দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু এত রাতে এ লোক এখানে কি করছে? সকালে থাপ্পড় মে’রে হয়নি এখন আবার এসেছে! মেয়েটা বিছানার পাশ থেকে ওড়না নিয়ে পরিপাটিভাবে গায়ে জড়িয়ে নেমে এলো নিচে। দরজা খুলে গিয়ে দাঁড়ালো তূর্ণের পিছনে। ভারী কণ্ঠে শুধালো,
“সমস্যা কি? এত রাতে আবার আমাদের বাড়িতে এসেছেন কেন?”
তূর্ণ পিছন ফিরে তাকালো। আরোহীর চোখ মুখ স্পষ্ট ক্রোধের ছাপ। মেয়েটা নিশ্চই তার উপরেই রেগে আছে। হাসলো তূর্ণ। তার হাতে ধরে থাকা কদমগুচ্ছ বাড়িয়ে দিল মেয়েটার পানে। মোহিত কণ্ঠে আওড়ালো,
এই ভেজা বর্ষায়,
এক গুচ্ছ কদম হাতে
আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি
তোমারই অভিমুখে ।
তুমি কি নিবে এ কদমগুচ্ছ?
নাকি ফিরিয়ে দিবে আমায়?
-( কলমে : সাদিয়া শওকত বাবলি )
তূর্ণের কণ্ঠে এমন বাক্য শ্রবণে চমকালো আরোহী। এই রাতে এখানে এসে এই লোক এমন প্রেমময় বাক্য আওড়াচ্ছে কেন? একে আবার ভুতে টুথে ধরলো নাকি? নাকি অন্যকিছু। আরোহীর হৃদয়ে বিভিন্ন প্রশ্নেরা হানা দিতে শুরু করলো। এতদিনের কাজিন সম্পর্কটা ভেঙে অন্য সম্পর্কের আভাস দিতে শুরু করলো তাকে। হৃদস্পন্দন বাড়লো তার। তবে তার এই আভাসের উপরে এক বালতি পানি ঢেলে খেকিয়ে উঠলো তূর্ণ। ধমকের সুরে বলল,
“কি হলো ফুলগুলো ধরবি নাকি ফেলে দেব?”
আরোহীর ভাবনা চিন্তায় ভাটা পড়লো। নিজের উপর নিজে বিরক্ত হলো ভীষণ। এসব সে কি ভাবছিলো? এই খবিশ লোক আর অন্য অনুভূতি? অসম্ভব। হতে পারে কোনো কবিতার লাইন এনে তার সম্মুখে ঝেড়ে দিয়েছে। এ ব্যতীত আর কিছুই নয়। আরোহী মুখ বাঁকালো। ভেংচি কেটে বলল,
“আপনার কদম আপনিই রাখুন। আমর লাগবে না।”
“তুই নিবি না এই ফুলগুলো?”
“না।”
“নিশ্চিত হয়ে বলছিস তো?”
“শতভাগ নিশ্চিত।”
হঠাৎই তূর্ণ ভোল বদলালো। এতক্ষণ শক্ত কণ্ঠে কথা বললেও এই পর্যায়ে এসে কণ্ঠ নরম করলো সে। হাত দুটো উল্টে পাল্টে দেখিয়ে বলল,
“তোর জন্য কদম আনতে গিয়ে দেখ হাত দুটোর কি অবস্থা হয়েছে। আর এখন তুই বলছিস নিবি না?”
আরোহী পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো তূর্ণের হাতের পানে। সত্যিই হাতদুটো ছেঁলে ছুঁলে একাকার অবস্থা। ফর্সা হাত দুটোতে লাল রক্ত লেগে আছে। মায়া লাগলো মেয়েটার। এই কদমগুচ্ছ আর ফিরিয়ে দিতে পারলো না সে। হাত বাড়িয়ে নিল হাতে। থমথমে কণ্ঠে বলল,
“শুধুমাত্র আপনার হাতের অবস্থা দেখে মায়া লেগেছে বলে নিলাম নয়তো নিতাম না।”
তূর্ণ ওষ্ঠ প্রসারিত করলো। আরোহীর হাত টেনে বলল,
“চল একটু হেঁটে আসি।”
আরোহী দ্বিরুক্তি করলো না। থমথমে মুখশ্রী নিয়ে হাঁটা শুরু করলো তূর্ণের পাশে পাশে। দুজনের মধ্যেই নীরবতা বিরাজমান। কেউ কথা বলছে না কোনো। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নীরবতা ভাঙলো তূর্ণ। কিছুটা ইতস্তত করে বলল,
“সকালে তোকে থাপ্পড় মা’রা’র জন্য আমি মোটেই অনুতপ্ত নই। তবে এই বর্ষায় সবার আগে তোকে কদম দিতে না পারায় আমি সত্যিই অনুতপ্ত।”
আরোহী অবাক হলো। গোল গোল চোখে তূর্ণের পানে তাকিয়ে বলল,
“তার মানে আপনি বলতে চাইছেন আপনি আমাকে থাপ্পড় মে’রে ঠিক করেছেন?”
“অবশ্যই ঠিক করেছি। আরও দুটো থাপ্পড় মা’রা উচিৎ ছিল তোকে। একে তো ক্লাস না করে চলে এসেছিস তার মধ্যে আবার ছেলেদের নিয়ে গিয়েছিলি কদম পাড়তে।”
“এখানে দোষের কি আছে? শুধু কদম পাড়তেই তো গিয়েছিলাম আর তো কিছু নয়।”
“আর কিছু হলে তুই এখনও জীবিতও থাকতি না।”
আরোহী দাঁড়িয়ে পড়লো। ওষ্ঠ ফাঁকা করে বলতে চাইলো কিছু। এর মধ্যেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। ভিজিয়ে দিতে শুরু করলো প্রাকৃতিকে। বর্ষার এই এক দোষ। বলা নেই কওয়া নেই যখন তখন গগণ কাঁপিয়ে বৃষ্টি নেমে পড়ে। এমন হঠাৎ বৃষ্টিতে তূর্ণ এবং আরোহী দুজনেই চমকালো বেশ। তূর্ণ মেয়েটার হাত টেনে দৌড় শুরু করলো পিছন ঘুরে। এক দৌড়ে তারা এসে দাঁড়ালো আরোহীদের বাড়ির সম্মুখে। তবে এত তাড়াহুড়া করেও বৃষ্টির পানি থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারলো না তূর্ণ এবং আরোহী। দু’জনের শরীরই ভিজে একাকার। তূর্ণের বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে এলো। মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে সে তাকালো আরোহীর পানে। অমনি থমকে গেল বেচারা। হৃদস্পন্দন গাঢ় হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। বৃষ্টিতে ভিজে মেয়েটার শরীরে থাকা টিশার্টটা লেপ্টে গেছে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মেয়েটার শরীরের প্রতিটি ভাঁজ স্পষ্ট তূর্ণের নিকট। বেচারা হাঁসফাঁস করে উঠলো। হৃদয়ে নিষিদ্ধ অনুভূতিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো মুহুর্তেই। হাজার হলেও সে পুরুষ মানুষ তো। তূর্ণের ভীষণ ইচ্ছে হলো আরোহীকে একটু ছুঁয়ে দিতে, ভালোবাসে অন্তত মেয়েটার ললাটের মধ্যভাগে একটা গাঢ় চুম্বন করতে।
চলবে…..