#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১০
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
গলা উঁচিয়ে বলল,
“জোনাকি পেয়েছি তূর্ণ ভাই। জোনাকি পেয়েছি। এ প্রাণীর পা*ছা*য়*ও বাতি জ্বলে।”
তূর্ণ মাত্রই ঘুমিয়েছিল। এর মধ্যে হঠাৎ দরজা ধাক্কা এবং অনয়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ধরফরিয়ে উঠলো সে। তড়িঘড়ি করে বসলো বিছানায়। সম্পূর্ণ বিষয়টা মস্তিষ্কে ধারণ করতে সময় লাগলো একটু। অনয় এসেছে বুঝেই ব্যস্ত হয়ে বিছানা ছাড়লো সে। দরজা খুলে শুধালো,
“কি হয়েছে? এত রাতে এত চিৎকার চেঁচামেচি করছিস কেন?”
অনয় ঝটপট জবাব দিল,
“জোনাকি! বসার রুমে একটা বড় জোনাকি এসেছে।”
তূর্ণ অবাক হলো কিছুটা। এই বর্ষার দিনে জোনাকি এলো কোথা থেকে? এখনও বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির অস্তিত্ব রয়েছে। এই বৃষ্টির মধ্যে সচরাচর জোনাকি তো দেখা যায় না। তূর্ণ ছোট্ট অনয়ের কথাকে ততটা পাত্তা দিল না। কি দেখতে না কি দেখে ফেলেছে আর জোনাকি জোনাকি বলে ছুটে এসেছে এই রাতে। ছেলেটা কণ্ঠে বিরক্তি এটে বলল,
“কি দেখতে না কি দেখে জোনাকি জোনাকি বলে চিল্লিয়ে ম’র’ছি’স। যা ঘরে যা, ঘুমা গিয়ে।”
থামলো তূর্ণ কপালে ভাঁজ ফেলে আবার বলল,
“এই এত রাতে তুই বাইরে কি করছিস? ছোট কাকাই আর ছোট কাকি তো ঘুমিয়েছে বোধহয়। তুই নিশ্চই তাদের পাশ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে উঠে এসেছিস।”
অনয় কানে নিল না তূর্ণের শেষের বলা কথাগুলো। বরং তার প্রথম বলা কথাগুলোর ঘোর প্রতিবাদ করে বলল,
“না না ওতা জোনাকিই ছিল। তুমি বলেছিলে না জোনাকির পা*ছা*য় বাতি জ্বলে। এর পা*ছা*য়ও বাতি জ্বলছিলো। আমি স্পষ্ত দেখেছি।”
“কি রঙের বাতি জ্বলতে দেখেছিস এর পা*ছা*য়? নীল আলো, লাল আলো, সবুজ আলো নাকি সাদা আলো?”
অনয় চিন্তায় পড়ে গেল। মোবাইলের আলোর মতো ঐ আলোটাকে কি রং বলে? সাদাও তো বলা যায় না। অনয় কিঞ্চিৎ সময় নিয়েও আলোর রং খুঁজে পেল না। অতঃপর সে হাত বাড়িয়ে নিজের ছোট ছোট হাত দ্বারা ধরলো তূর্ণের হাত। টেনে সম্মুখের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“চলো আমার সাথে। দেখে আসবে কি রঙের বাতি জ্বলে।”
তূর্ণ একবার ভাবলো যাবে না সে। পরক্ষণেই আবার ভাবনার পরিবর্তন করলো। একবার হলেও তার অনয়ের সাথে গিয়ে দেখা উচিৎ। না থাকুক জোনাকি তবুও যাওয়া উচিৎ। নয়তো এই বিচ্ছুটা আজ রাতে তাকে আর ঘুমাতে দিবে না। একটু পর পর এসে জোনাকি জোনাকি বলে চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় তুলবে। তূর্ণ বিরক্তিভাব নিয়েই হেঁটে গেল অনয়ের পিছু পিছু। বসার কক্ষে যেতেই চোখে পড়লো তূর্যকে। ততক্ষণে সে দরজা আটকে হাতে মোবাইল নিয়ে নিজ কক্ষের পানে পা বাড়িয়েছিল। তবে হঠাৎ এত রাতে তূর্ণ এবং অনয়কে ঘুরঘুর করতে দেখে থমকে দাঁড়ালো সে। ভ্রু কুঁচকে শুদালো,
“তোমারা এত রাতে না ঘুমিয়ে এখানে কি করছো?”
তূর্ণ অনয়ের পানে এক পলক তাকালো। অতঃপর জবাব দিল,
“ঐ একটু ঘুমিয়েছিলাম। কিন্তু অনয় আবার কি যেন দেখাবে করে তুলে নিয়ে এলো।”
অনয় অবশ্য তূর্য আর তূর্ণের কথার পানে খেয়াল করলো না। চোখ বুলিয়ে সে আশেপাশে খুঁজলো জোনাকিকে। কিন্তু জোনাকি কোথায়? এই টুকু সময়ে জোনাকি কোথায় চলে গেল? পা*ছা*য় বাতি জ্বলা তেমন কোনো প্রাণীকে তো চোখে পড়ছে না কোথাও। তবে কি চলে গেল জোনাকি? অনয় আশেপাশে নজর ঘুরাতে ঘুরাতেই বলল,
“এখানেই তো ছিল জোনাকি। এখন কোথায় গেল?”
“কোনো জোনাকি টোনাকি নেই। বৃষ্টির মধ্যে জোনাকিদের তো খেয়ে দেয়ে কাজ নেই যে ভিজে ভিজে তোকে দেখা দিতে আসবে। যা ঘরে গিয়ে ঘুমা।”
“না জোনাকি এসেছিল। আমি সত্যিই দেখেছি। আর তুমি যেমনতা বলেছিলে এর পা*…”
অনয়ের পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই হাত উঁচিয়ে তার মুখ চেপে ধরলো তূর্ণ। জোনাকির যে ঐতিহাসিক সংজ্ঞা সে দিয়েছে সে সংজ্ঞা তার বাবা শুনলে নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক করবে, আর মান ইজ্জত যা যাবার তা তো যাবেই। অনয় নিজের মুখ থেকে তূর্ণের হাত সরাতে চাইলো। কিন্তু তূর্ণ হাত সরালো না। আমতা আমতা করে বলল,
“তোর জোনাকি বোধহয় আমাদের এখানে আসতে আসতে উড়ে গেছে। কাল আমরা দু’জন মিলে জোনাকি খুঁজবো আবার। এখন ঘরে চল।”
পরপর তূর্ণ বাবার পানে তাকালো। বিদায় নিতে বলল,
“আমরা ঘুমাই গিয়ে। তুমিও ফ্রেশ হয়ে নাও।”
অনয়কে নিয়ে তূর্ণ তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। তূর্য আর ঘাটলো না বিষয়টা নিয়ে। এমনিও বাইরে থেকে এসেছে সে। এই মুহূর্তে তার ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া প্রয়োজন। ক্ষুধায় পেটের মধ্যে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে।
১৩.
বর্ষাকাল। এই সময়ে সূর্যের দেখা দেখা পাওয়াই যেন কঠিন হয়ে উঠেছে। সারাদিন আকাশে শুধু কালো মেঘের আনাগোনা আর ঝাঁকে ঝাঁকে বৃষ্টির আগমন। তূর্ণ এই বৃষ্টির মধ্যেই বন্ধু বান্ধবদের সাথে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো ফুটবল খেলার উদ্দেশ্যে। বৃষ্টির মধ্যেই তো ফুটবল খেলার আসল মজা। বেশ কয়েকজন বন্ধু বান্ধব নিয়ে বাড়ির কাছে পিঠেই এক মাঠে এলো ছেলেটা। সকলের পড়নেই হাফপ্যান্ট আর টিশার্ট। তারা আর সময় ব্যয় করলো না খুব বেশি। নিজেদের মতো করে খেলা শুরু করলো স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই। বৃষ্টির কারণে আশেপাশে খেলা দেখার মতো তেমন দর্শক নেই বললেই চলে। তবে মাঠের একদম শেষ প্রান্তে কিছু ছেলেমেয়েদের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকের মাথাতেই ছাতা থাকায় তেমন একটা মুখ দেখা যাচ্ছে না কারো। তূর্ণ সেদিকে বেশি খেয়াল করলো না। দৌড়ে ঝাঁপিয়ে শরীরে কাটামাটি মেখে খেলছে সে। কিন্তু মাঠের ঐ প্রান্ত থেকে তূর্ণের একজন বন্ধু সোহাগ দৌড়ে এলো তার পানে। ছাতা মাথায় দেওয়া ছেলে মেয়েগুলোর পানে ইশারা করে বলল,
“ওটা তোর বোন না?”
তূর্ণ বল নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে জবাব দিল,
“কোন বোন?”
“ঐ যেন নাম! হ্যা হ্যা তনয়া আর আরোহী।”
তূর্ণ থেমে গেল। কপালে ভাঁজ পড়লো তার। সকাল ১১ টা কিংবা সাড়ে এগারোটা বাজে কেবল। এখন তো তনয়া এবং আরোহীর কলেজে থাকার কথা। তারা এখানে কি করছে? তূর্ণ বল ফেলে রেখেই ছুটে গেল মাঠের শেষ প্রান্তে। সেখানেই গিয়েই চোখে পড়লো একটা ছেলে আরোহীকে কিছু কদম ফুল দিচ্ছে। আরোহীও উৎফুল্ল হয়ে সে কলমগুলো লুফে নিচ্ছে। তূর্ণের হৃদয়টা ধক করে উঠলো। মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। এ কি দৃশ্য দেখছে সে সম্মুখে। আরোহী অন্য কারো থেকে ফুল নিচ্ছে? কেন নিচ্ছে? এই ছেলের সাথে মেয়েটার সম্পর্ক কি? তবে কি তার অগোচরে আরোহী অন্যকারো সাথে সম্পর্ক গড়েছে? চিনচিনে ব্যাথার আবির্ভাব ঘটলো তূর্ণের হৃদয়ে। সাথে ক্রোধেও দিশেহারা হয়ে উঠলো। এর জন্য মেয়েটাকে সেই কিশোর বয়স থেকে আগলে রেখেছিল? এর জন্য এত বছর ধরে মেয়েটাকে চোখে চোখে রেখে নিজ হৃদয়ে অনুভূতির পাহাড় তৈরি করেছিল! তূর্ণ ক্রোধে দিক বেদিক হারিয়ে আর একটু এগিয়ে গেল আরোহীর পানে। ঠাস করে একটা থাপ্পর লাগিয়ে দিল মেয়েটার ফর্সা গালে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“কলেজের নাম করে এখানে বসে রঙ্গ তামাশা করছিস? এই বয়সেই পেকে গেছিস?”
আকস্মিক তূর্ণের কণ্ঠস্বর কর্ণে পৌঁছাতেই চমকে গেল আরোহী এবং তনয়া। আরোহী গালে হাত দিয়ে হতবাক হয়ে তাকালো তূর্ণের পানে। তনয়াও গালে হাত দিল তৎক্ষণাৎ। আরোহীর গালে থাপ্পড় তো পড়ে গিয়েছেই এখন আবার তার গালেও পড়ে কিনা কে জানে। তূর্ণকে এই স্থানে হঠাৎ দেখে মেয়ে দুটোর হৃদয়ে ভয় জন্মেছে বেশ তবে আরোহী কিঞ্চিৎ লজ্জাবোধও হচ্ছে। গালে হাত দিয়ে মেয়েটা এদিক ওদিক তাকালো। এখানে তূর্ণের বন্ধুরা তার বন্ধুরা কত মানুষ। সবার সম্মুখে তূর্ণ তাকে এভাবে মা’র’তে পারলো! তার কোনো অন্যায় হলে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বকতে পারতো বা মা’র’তে পারতো। এখন সে বড় হয়েছে। এত বড় মেয়েকে এভাবে জনসম্মুখে থাপ্পর মে’রে অপদস্থ করার মানে কি? আরোহীর চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হলো। আহত স্বরে বলল,
“আপনি আমাকে মা’র’লে’ন তূর্ণ ভাই?”
“হ্যা মে’রে’ছি। আরও দুইটা থাপ্পড় দেওয়া উচিৎ ছিল তোকে। কলেজ বাদ দিয়ে এখানে এই ছেলেদের সাথে তামাশা শুরু করেছিস?”
কথাগুলো বলতে বলতেই তূর্ণ আরোহীর হাত থেকে কদম ফুলগুলো কেড়ে নিল। কাদামাটির মধ্যে সে ফুলগুলো ফেললো ক্ষীপ্ত হয়ে। অতঃপর তা পা দ্বারা পিষে দিয়ে বলল,
“আবার ছেলেদের থেকে ফুল নিচ্ছিস? এই টুকু বয়স তার মধ্যে রাত বিরাতে ফেসবুকে পোস্ট করিস ‘আই লাভ ইয়্যু পাশের বাড়ির চ্যাংরা পোলা’ আবার কলেজ বাদ দিয়ে ছেলেদের সাথে আড্ডা দিস। মনে রং লেগেছে তোর? তোর মনের রং যদি আমি শেষ করে না দিতে পেরেছি তবে আমার নামও তূর্ণ না।”
আরোহী নজর ঘুরিয়ে আশেপাশের সবার দিকে তাকালো আরেকবার। সবাই কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তার পানে। মেয়েটার হৃদয়ে অভিমানেরা হানা দিল। নাক ফুলিয়ে বলল,
“আপনি খুব খারাপ তূর্ণ ভাই। সব সময় আমাকে না মা’র’লে না বকলে আপনার পেটের ভাত হজম হয় না বোধহয়। আমিও চাই না আপনার পেটের ভাত হজম হোক। আপনি আমার সাথে আর কখনও কথা বলবেন না আর আমিও বলবো না।”
কথাগুলো বলে ঐ স্থানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না আরোহী। কান্নারা দলা পাকিয়ে শব্দ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে তার গলা থেকে, ফর্সা নাকের ডগাটাও লাল হয়ে গেছে ইতমধ্যে। কিন্তু এত মানুষের মধ্যে কাঁদতে চাইলো না মেয়েটা। এমনিই একটু আগে একটা থাপ্পড় খেয়েছে। এখন আবার এত বড় মেয়ে হয়ে জনসম্মুখে কেঁদে কেঁটে নিজের মান ইজ্জত হারানোর কোনো ইচ্ছা নেই আরোহীর। তাই সে কিছুটা ব্যস্ত ভঙ্গিতেই দৌড় লাগালো বাড়ির পানে। তার পিছু পিছু তনয়া এবং বাকিরাও ছুট লাগালো।
আরোহী এবং তনয়া চলে যেতেই তূর্ণের কাঁধে হাত রাখলো সোহাগ। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“একটু বেশি হয়ে গেল না? মেয়েটাকে থাপ্পড় মা’রা’টা কি ঠিক হয়েছে তোর?”
তূর্ণ রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো সোহাগের পানে। গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিল,
“এটা শুধুমাত্র আমার আর ওর ব্যাপার।”
সোহাগ আর কথা বাড়ালো না। হয়তো সে বুঝে নিয়েছে কিছু একটা। তাছাড়া তূর্ণের চোখে মুখেও ক্রোধের আভাস। এই সময়ে এর সাথে কথা বাড়ানো মানে আবার একটা ঝামেলার সৃষ্টি। পরে দেখা যাবে আরোহীর রাগ সে এই মাঠের মধ্যেই ঝাড়বে। তাই সোহাগ খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই চাপড় লাগালো তূর্ণের কাঁধে। মাঠের মধ্যে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“এত রাগ রাখলেও আবার হয় না। চল খেলাটা শেষ করি এখন।”
১৪.
রাত খুব বেশি নয়। ঘড়ির কাঁটায় টিক টিক ধ্বনি তুলে জানান দিচ্ছে রাত কেবল নয়টা। তূর্ণ বসে রয়েছে তার কক্ষে। সকালের পর আরোহীর সাথে আর দেখা হয়নি তার। তবে মেয়েটাকে থাপ্পড় মে’রে এখন নিজেরই খারাপ লাগছে। তখন আরোহী চলে যাওয়ার পর ঐ কদম ফুল দেওয়া ছেলেগুলোর সাথে কথা বলেছে তূর্ণ। ছেলেগুলো আরোহীর ক্লাসমেট ছিল এবং ঐ ফুল দেওয়া নেওয়ায় মেয়েটার দোষ ছিল না কোনো। শুধু শুধুই সে একটা থাপ্পড় মে’রে দিল মেয়েটাকে। তূর্ণের ভাবনার মধ্যেই তার কক্ষের দরজায় টোকা পড়লো। মিনমিনে কণ্ঠে তনয়া বলল,
“ভাইয়া ভিতরে আসবো?”
“আয়।”
তনয়া গুটি গুটি পায়ে ঢুকলো ভিতরে। দাঁড়ালো তূর্ণের মুখোমুখি। আমতা আমতা করে বলল,
“একটা কথা বলতে এসেছিলাম।”
“বলে ফেল।”
চলবে…..