প্রেমপরশ পর্ব-০৭

0
65

#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৭

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

তূর্য আকাশের দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে তূর্ণের পানে তাকালো। প্রশ্ন করলো,

“তুমি এই কথাগুলোর মানে বোঝো?”

তূর্ণ ডানে বামে মাথা ঝাঁকালো। অর্থাৎ সে বোঝে না তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল তূর্য। বারান্দার মেঝেতে বসতে বসতে বলল,

“এর মানে তোমার মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই। তুমি তোমার পিতা মাতার মতামতকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য। তারা তোমার উপরে তাদের নিজস্ব মতামত চাপিয়ে দিবে আর তোমার হাজার কষ্ট হলেও হাসিমুখে তা হজম করে নিতে হবে। তাছাড়া কিছু মাতা পিতা রয়েছে সন্তান তাদের মতের বিরুদ্ধে গেলে তাদের মারধর করে, জনসম্মুখে অপমান করে। ফলস্বরূপ সন্তানের মধ্যে একটা জেদের সৃষ্টি হয়। পিতা মাতাকে নিজেদের শত্রু মনে করে। এক সময় এই জেদের বশেই তারা বিপথে চলে যায়। অথচ পিতা মাতা যদি ছোট বেলা থেকেই তার সন্তানের বন্ধু চেষ্টা করতো। সন্তানদের মতামতের গুরুত্ব দিতো, তাদের উপরে চড়াও না হয়ে, জনসম্মুখে তাকে অপমান না করে ঠান্ডা মাথায় বুঝাতো। সমাজের নিয়ম নীতি, ন্যায় অন্যায় সম্পর্কে ধারণা দিতো তবে সন্তান বিপথে হয়তো যেতো না।”

থামলো তূর্য। ইশারা করে তূর্ণকেও বসতে বলল পাশে। তূর্ণ পাশে বসতেই ফের বলতে শুরু করলো,

“আমি সেইসব পিতাদের মধ্যে নই যারা তাদের সন্তানদের উপরে নিজের মতামত চাপিয়ে দেয়, মারধর করে কিংবা জনসম্মুখে অপমান করে। সন্তানের কাছে একজন পিতা হয়ে ওঠার পূর্বে একজন বন্ধু হয়ে ওঠা অধিক জরুরী। আমার কাছে আমার মতামতের মতোই তোমাদের মতামতও গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই মতামত অবশ্যই ন্যায়সংগত হতে হবে।”

তূর্ণ মাথা নুইয়ে নিল। তূর্য তাকালো তার পানে। ঠান্ডা কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,

“মা’রা’মা’রি করেছো কেন? আমি কি তোমাকে মা’রা’মা’রি’র শিক্ষা দিয়েছিলাম?”

তূর্ণ এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো। সে যে তূর্যকে ভয় পায় তেমন নয় তবে শ্রদ্ধা করে ভীষণ। তূর্ণ সময় নিল একটু। ঢোক গিলে বলল,

“মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল।”

“মাথা গরম হয়ে গেলেই আঘাত করতে হবে? যেকোনো বিষয় দুইভাবে সমাধান করা যায়। প্রথমত শান্তিপূর্ণভাবে আর দ্বিতীয়ত মা’রা’মা’রি কিংবা ঝামেলায় জড়িয়ে। তুমি কি শান্তিপূর্ণভাবে তোমার সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছিলে?”

তূর্ণ তাকালো বাবার পানে। কণ্ঠটা একটু স্বাভাবিক করে বলল,

“করেছিলাম তো। প্রথমে আমি শান্তিপূর্ণভাবেই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওরাই ঝামেলা শুরু করলো। হুট করেই ঘু’ষি বসালো আমার শরীরে। আমিও নিজের রাগটা ধরে রাখতে পারিনি। ব্যস বেঁধে গেল হাতাহাতি।”

তূর্য ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। গা ঝাড়া দিয়ে বলল,

“তাহলে ঠিক আছে। কেউ শান্তি না চাইলে তোমারও এত দায় পড়েনি শান্তি ধরে রাখার। কেউ একটা দিলে তাকে তিনটা দিয়ে আসবে। তবে প্রথমে অবশ্যই শান্তিপূর্ণভাবে সকল সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে নিবে, মুরুব্বিদের সাথে বেয়াদবি করবে না।”

তূর্ণ অবাক হলো। এতক্ষণ এতকিছু বুঝিয়ে শেষে কিনা এই বলল তার বাবা! তূর্ণ ভেবেছিল মা’রা’মা’রি’র বর্ণনা দেওয়ার পর তূর্য রেগে যাবে। গম্ভীর স্বরে বলবে,

“কুকুর তোমাকে কামড় দিলে কি তুমিও কামড় দিবে? তোমার মা’রা’মা’রি করা একদম উচিৎ হয়নি।”

কিন্তু তূর্য তো একদম উল্টো কথা বলল। আরও সাহস দিল তাকে। এই জন্যই তো বাবাকে এত ভালো লাগে তূর্ণের। ছেলেটা দুই হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো তূর্যকে। বলল,

“তোমার মতো বাবা পেয়ে সত্যিই আমি ধন্য।”

তূর্য হাসলো। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে চুপ থেকে হুট করেই প্রশ্ন করলো,

“ভালোবাসো আরোহীকে?”

তূর্ণ বাবাকে ছেড়ে দিল। সে যেমনই হোক না কেন এভাবে হুট করে বাবার সম্মুখে ভালোবাসার কথা বলতে কেমন লজ্জা লাগছে। তূর্য বুঝে নিল যা বোঝার। উঠে দাঁড়ালো সে। নিজ কক্ষে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। তবে ফিরে যাওয়ার আগে ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলে গেল,

“ভালোবাসলে আগলে রাখতে জানতে হয়। আগলে রেখো তাকে।”

৯.
দীর্ঘ এক রাতের অবসান ঘটিয়ে আকাশে স্থান করে নিয়েছে উজ্জ্বল এক সূর্য। চারদিকটা ভরে উঠেছে আলোয় আলোয়। আরোহী ঘুম থেকে উঠে পরিপাটি হয়ে বেড়িয়ে পড়লো কলেজের উদ্দেশ্যে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে সোজা এলো তূর্ণদের বাড়ির সম্মুখে। তনায়াকে আগে থেকেই কল করে বলে রেখেছিল তৈরি হয়ে বাসার সামনে দাঁড়াতে। দুজন একসাথে কলেজে যাবে। তনয়াও তাই করেছে। দাঁড়িয়ে ছিল বাড়ির সামনেই। আরোহী আসতেই দেখেই হাত উঁচালো সে। গলা বাড়িয়ে বলল,

“এত দেরী করলি কেন? আমি সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি তোর জন্য।”

আরোহী হাঁটার গতি বাড়ালো। লম্বা লম্বা পা ফেলে এলো তনায়ার সম্মুখে। কিছুটা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল,

“খেতে খেতে দেরী হয়ে গিয়েছে একটু।”

তনায়া আর কথা বাড়ালো না। দাঁড়িয়ে না থেকে হাঁটা ধরলো সে। আরোহীকে তাড়া দিয়ে বলল,

“এখন আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি চল। আজ প্রথমেই ঐ টাকলু মানিক স্যারের ক্লাস। দেরী হলেই আবার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে।”

“তা যা বলেছিস।”

আরোহীও পা চালালো তনয়ার সাথে সাথে। ঠিক তখনই পিছন থেকে ডাক পড়লো। তনয়া আর আরোহী থমকে দাঁড়ালো। পিছন ফিরে দেখলো তূর্ণ শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে তাদের পানেই এগিয়ে আসছে। কপাল কুঁচকালো দু’জনেই। তবে তনয়া নম্র কণ্ঠে বলল,

“কিছু বলবে ভাইয়া?”

তূর্ণের থমথমে মুখশ্রী। গম্ভীর কণ্ঠে কিছু বলবে তার আগেই ভেসে এলো আরোহীর কণ্ঠস্বর। মেয়টা বিরক্তি নিয়ে বলল,

“যা বলার তাড়াতাড়ি বলবেন। আমার কলেজ আছে।”

তূর্ণ কপাল কুঁচকালো। তীক্ষ্ম কণ্ঠে বলল,

“একই স্থানে একই সাথে দাঁড়িয়ে রয়েছিস তোরা দুজন। একসাথে কলেজে যাচ্ছিস এবং আমি তোদের একসাথেই ডেকেছি। তনয়া কি সুন্দর নম্রভাবে আমাকে প্রশ্ন করলো আর তুই খচ্চরের মতো প্রশ্ন করলি কিসের জন্য?”

আরোহী তেতে উঠলো। কটমট করে বলল,

“আপনি আমাকে খচ্চর বললেন?”

“খচ্চরকে খচ্চর বলবো না তো কি বলবো?”

“ভাইয়া!”

আরোহী একটু উচ্চস্বরেই ডাকলো তূর্ণকে। সাথে সাথেই ছেলেটার কলিজাটা লাফ দিয়ে উঠলো। বুকে হাত দিয়ে বিরবিরিয়ে বলল,

“এমনিই তো সম্পর্কের দোহাই দিয়ে সারাদিন তূর্ণ ভাই তূর্ণ ভাই করে মেয়েটা হার্টে সমস্যা বাঁধিয়ে দিয়েছে। এখন আবার মাঝ রাস্তায় জোরে জোরে ভাইয়া ডেকে ভাই বোনের সম্পর্কের গভীরতা জাহির করতে চাইছে!”

পরপর গলা বাড়ালো তূর্ণ। কিঞ্চিৎ ধমকে আরোহীকে বলল,

“তোর মা আর আমার বাপ চাচাতো ভাই বোন জানি। তাই বলে মাঝ রাস্তায় এত জোরে ভাইয়া ডেকে আমার হার্ট অ্যাটাক করিয়ে দিতে চাইছিস নাকি?”

আরোহী কপাল কুঁচকালো। চোখ ছোট ছোট করে বলল,

“আপনি আমার ভাই তাই পৃথিবীর সকল স্থানে হোক তা মাঝ রাস্তায় ভাইয়াই ডাকবো। তা জোরে হোক কিংবা আস্তে। এতে হার্ট অ্যাটাকের কি আছে?”

তূর্ণ আশেপাশে তাকালো। একটু এগিয়ে দাঁড়ালো আরোহীর পাশে। কণ্ঠ কিছুটা খাদে নামিয়ে বলল,

“আজকাল শুনেছি মেয়েরা নাকি ছেলেদের প্রথমে ভাইয়া ডেকে পরে ছাইয়া বানাতে চায়। তুইও কি আমাকে তেমন কিছুই বানাতে চাইছিস আরোহী?”

আরোহী অবাক হলো। সে কি বলল আর এ লোক কোথায় নিয়ে গেল। সম্পর্কের খাতিরে তো সর্বদা ভাইয়া বলেই এ লোককে সম্বোধন করে আরোহী। আর আজ সেই ভাইয়া সম্বোধনকে টেনে হিচড়ে ছাইয়া পর্যন্ত নিয়ে গেল? আরোহী কপাল কুঁচকালো। বিরক্তিভরা কণ্ঠে বলল,

“একদম আজেবাজে কথা বলবেন না তূর্ণ ভাই। আমি আপনাকে….”

এই টুকু বলতেই মেয়েটাকে থামিয়ে দিল তূর্ণ। আতঙ্কিত স্বরে বলল,

“আমি কিন্তু মোটেই তোর মতো একটা দজ্জ্বাল, ঝগরুটে মহিলার ছাইয়া হতে ইচ্ছুক নই। এসব চিন্তা বাদ দে আরোহী। আর একটু ভালো কিছু ভাব।”

আরোহীর বিরক্তি বাড়লো। কটমট করে সে তাকালো তূর্ণের পানে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“পারবো না ভালো কিছু ভাবতে। আমি খারাপ কিছুই ভাববো আপনার কি?”

“তার মানে তুই স্বীকার করছিস যে তুই আমাকে নিয়ে আজে বাজে কথা চিন্তা করিস। আমাকে ছাইয়া বানাতে চাস।”

নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেল আরোহী। রাগের বশে কি বলতে কি বলে ফেললো এখন তা নিয়েও এই লোক কথা শুনাবে। অবশ্য আরোহী যা বলেছে তাতে এই অর্থই দাঁড়ায় যে সে খারাপ কিছু ভাবে। মেয়েটা বিব্রতবোধ করলো। আমতা আমতা করে বলল,

“তেমন কিছু নয় তূর্ণ ভাই। ওটা জাস্ট কথায় কথায় বলে ফেলেছি।”

তূর্ণ গায়ে মাখলো না আরোহীর কথা‌। তনয়ার পানে এক পলক তাকিয়ে মুখ নামালো আরোহীর কানের কাছে। ফিসফিসিয়ে বলল,

“ছিঃ ছিঃ আরোহী। এই ছিল তোর মনে? আচ্ছা মনে মনে তুই আমাকে নিয়ে কতদূর ভেবেছিস? মান ইজ্জত কিছু রেখেছিস আমার? নাকি তাও হরণ করে নিয়েছিস?”

আরোহীর কান গরম হলো। ছিঃ ছিঃ এসব কি বলছে এই লোক। সে কি বলল আর সেই ছোট কথাটা কোথায় চলে গেল। লজ্জা, সংকোচে হাঁসফাঁস করে উঠলো মেয়েটা। এখানে আর দাঁড়াতে চাইলো না। এখানে যতক্ষণ দাঁড়াবে তূর্ণ ততক্ষণ এই কথাটা নিয়ে বিশ্লেষণ করবে। এর থেকে এখান থেকে কেটে পড়াই শ্রেয়। আরোহী অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে পা কলেজের পানে। তনায়াকে তাড়া দিয়ে বলল,

“কলেজে গেল চল। নয়তো দাঁড়িয়ে থাক।”

তনয়া এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলো তূর্ণ এবং আরোহীর কথোপকথন। এ দুজন যখনই সামনা সামনি আসে তখনই ঝগড়া বাঁধে। এ আর নতুন কিছু নয়। তাই আর আগ বাড়িয়ে এদের ঝগড়ায় ঢোকেনি সে। তবে এখন আরোহীর তাড়া শুনে সেও তাড়া লাগালো। ছুট লাগালো মেয়েটার পিছু পিছু। তূর্ণ ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। সেও হাঁটা ধরলো ওদের পিছনে‌। গতকাল যখন থেকে শুনেছে আরোহীকে কেউ পটাতে চাইছে, প্রেম নিবেদন করেছে তখন থেকে আর শান্তি পাচ্ছে না ছেলেটা। একটাকে তো মে’রে ধরে শাসিয়ে এসেছে। কিন্তু এরপর যদি আর কেউ আবার মেয়েটার পিছু লাগে। আরোহীকে ছিনিয়ে নিতে চায় তার থেকে? না না এই মেয়েটাকে নিয়ে কোনো ধরণের ঝুঁকি নিতে চায় না তূর্ণ। তাই এখন থেকে মেয়েটাকে সর্বদা চোখে চোখে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।

১০.
কিছুটা সময় অতিবাহিত হতেই কলেজে পৌঁছালো আরোহী এবং তনয়া। ক্যাম্পাস ইতমধ্যে অনেকটাই জনশূন্য হয়ে পড়েছে। সকলের বোধহয় ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আরোহী এবং তনয়া ব্যস্ত পায়ে গিয়ে দাঁড়ালো ক্লাসের নিকটে। জানালা থেকে দেখলো মানিক স্যার নামক মধ্যবয়স্ক অধ্যাপক অধ্যাপক ঘুরে ঘুরে পাঠদান করছেন। মাথার মধ্যভাগে তার তেল চকচকে টাকটা স্পষ্ট। এখন যদি সম্মুখের দরজা থেকে ক্লাসে ঢোকার চেষ্টা করে তবে নির্ঘাত লোকটা তাদের বকাবকি করে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে আর যদি না ঢুকে ক্লাস মিস দেয় তবে বাড়িতে নালিশ পাঠাবে। উভয় দিকে সংকট। এখন কোন দিকে যাবে তারা? আরোহী এবং তনয়া একে অপরের পানে তাকালো অতঃপর ঘুরে গেল ক্লাসের পিছনের দিকে। মাথা নিচু করে লুকিয়ে ঢুকতে নিল ক্লাসে। ঠিক তখনই ভেসে এলো গম্ভীর এক কণ্ঠস্বর,

“ওখানেই দাঁড়িয়ে যাও।”

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে