#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৬
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো আরোহী অতঃপর ফাস্ট এইড বক্সটা হাতে নিয়েই হাঁটা লাগালো তূর্ণের কক্ষের পানে।
কিছুটা সময়ের ব্যবধানেই কক্ষের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো মেয়েটা। দরজাটা চাপানো। আরোহী ভদ্রতা বজায় রেখে হাত উঁচিয়ে টোকা দিল দরজায়। গলার স্বর বাড়িয়ে ডাকলো,
“তূর্ণ ভাই! তূর্ণ ভাই।”
ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তবে কি তূর্ণ ভিতরে নেই? একটু আগেই তো সকলের সামনে থেকে কক্ষে এলো ছেলেটা। তাহলে এতটুকু সময়ের মধ্যে কোথায় উধাও হয়ে গেল? আরোহী আরও কিছুটা সময় নিয়ে ডাকলো তূর্ণকে। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে অধৈর্য হয়েই এবার কোনো অনুমতি না নিয়েই দরজা ঠেলে ঢুকলো কক্ষের ভিতরে। আশেপাশে তাকিয়ে তূর্ণকে খুঁজতে খুঁজতে কর্ণে ভেসে এলো ঝুমঝুম পানির আওয়াজ। আরোহী কান খাঁড়া করলো। ওয়াশ রুম থেকে আসছে আওয়াজটা। তূর্ণ বোধহয় ওয়াশ রুমে আছে তাহলে। যাক একদিকে থেকে ভালোই হয়েছে। এই সুযোগে এইড বক্সটা রেখে কেটে পড়া যাবে। পরে জিজ্ঞেস করলে না হয় বলে দিবে,
“আপনাকে রুমে পাইনি তাই ফাস্ট এইড বক্সটা রেখে চলে এসেছি।”
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। আরোহী হাতের ফাস্ট এইড বক্সটা বিছানার উপরে রেখে পিছন ঘুরলো চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পিছন ঘুরতেই চমকে উঠলো মেয়েটা। তূর্ণ শুভ্র রঙা এক খানা তোয়ালে দ্বারা মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। সদ্য গোসল সেড়েছে বোধহয়। পড়নে তার একটা কালো রঙা ট্রাউজার মাত্র, নগ্ন দেহের উপরিভাগ। ফর্সা বক্ষে মুক্ত দানার ন্যায় বিন্দু বিন্দু পানি কনা স্পষ্ট, সাথে কিছু কাঁটা ছেঁড়ারও দাগ। আরোহীর হৃদস্পন্দন গাঢ় হলো। উন্মুক্ত পুরুষদেহ উত্তাল করলো তার হৃদয়। এ কি হচ্ছে? এমন কেন হচ্ছে? আরোহীর এ বাড়িতে যাতায়াত ছোট বেলা থেকে। তূর্ণকে এভাবে উন্মুক্ত দেহে দেখেছে দুই একবার। কই তখন তো এমন হয়নি। আরোহী চেয়েও নিজের চোখ সরাতে পারছে না। বেহায়া, নির্লজ্জের ন্যায় চোখ দুটো বারবার তূর্ণের উন্মুক্ত শরীরেই আটকে যাচ্ছে। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে মেয়েটা তাকিয়ে রইলো তূর্ণের পানেই। অতঃপর হুট করেই হাত উঁচিয়ে নিজের চোখ চেপে ধরলো মেয়েটা। ব্যস্ত হয়ে বলল,
“আমি কিছু দেখিনি।”
তূর্ণ পাত্তা দিল না আরোহীর কথা। ভাবলেশহীভাবে এগিয়ে গেল আলমারির পানে। সেখান থেকে একটা টিশার্ট বের করতে করতে বলল,
“তোকে দেখতে বারণ করেছে কে?”
আরোহী অবাক হলো। চোখ থেকে হাত সরিয়ে প্রশ্ন করলো,
“মানে?”
“মানে এতক্ষণ তো আমার উন্মুক্ত দেহ তোর দুই চোখ দ্বারা গিলে খেয়ে নিলি দিব্যি। এখন আবার ঢং করে বলছিস কিছু দেখিসনি। নাটক করছিস আমার সাথে?”
আরোহী আড় চোখে তাকালো। একবার দেখে নিল তূর্ণের পা থেকে মাথা অব্দি। আমতা আমতা করে বলল,
“আমি আপনার আন্ডার ওয়্যারের কথা বলছিলাম তূর্ণ ভাই। ট্রাউজার একটু নিচে নেমে আপনার আন্ডার ওয়্যারের গোলাপী রঙা ফুল স্পষ্ট।”
থামলো আরোহী। ঠোঁট টিপে হেসে আবার বলল,
“আপনি যে ফুল পাখিওয়ালা আন্ডার ওয়্যার পড়তে পছন্দ করেন আগে জানা ছিল না তো তূর্ণ ভাই। দেহের উপরে তো বেশিরভাগ সময়ই সব এক রঙা শার্ট, প্যান্ট চোখে পড়ে। অথচ তার নিচে ফুল, পাখি উড়ে বেড়ায়। আহা কি প্রাকৃতি প্রেমিক পুরুষ আপনি! দেহের উপরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফুটিয়ে না তুলতে পারলেও নিচে ঠিকই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা রাখেন। আপনার মতো প্রাকৃতিক প্রেমিকই তো ঘরে ঘরে চাই।”
তূর্ণ অপ্রস্তুত হলো। চোখ নামিয়ে কোমড়ের পানে তাকাতেই চোখে পড়লো সত্যিই ট্রাউজার নিচে নেমে তার আন্ডার ওয়্যার দৃশ্যমান। সবচেয়ে লজ্জাজনক ব্যাপার হলো আন্ডার ওয়্যারের গোলাপী রঙা দুই চারটা ফুলও স্পষ্ট। ভিতরে ভিতরে লজ্জায় মুষড়ে পড়লো তূর্ণ। এই মেয়েটার সম্মুখেই এমন লজ্জাজনক ঘটনা ঘটতে হলো? তবে নিজের এ লজ্জা প্রকাশ করলো না সে। দ্রুত ট্রাউজারটা টেনে উপরে তুললো, আলমারি থেকে একটা টিশার্ট বের করে জড়িয়ে নিল শরীরে। কণ্ঠ কিছুটা স্বাভাবিক রেখে বলল,
“ছিঃ আরোহী তুই তো দিন দিন লু’চ্চা মহিলাদের খাতায় নাম লেখাচ্ছিল।”
“আপনি আমাকে লু’চ্চা বললেন তূর্ণ ভাই?”
তূর্ণ এগিয়ে এলো আরোহীর পানে। হাত তুলে আঙ্গুল দ্বারা মেয়েটার কপালে একটা টোকা বসিয়ে বলল,
“তা বলবো না তো কি করবো? চোখ কোথায় কোথায় যায় তোর?”
আরোহী কপালে টোকা পড়া স্থানে হাত দিল। নাক মুখ কুঁচকে বলল,
“আমি কি ইচ্ছে করে দেখেছি নাকি? আপনার ট্রাউজার নিচে নেমে গিয়েছিল বলেই তো দেখেছি। এখানে আমার দোষ কোথায়?”
“তোর দোষ তুই দেখবি কেন?”
“তাহলে কি চোখ বন্ধ করে রাখবো নাকি? আশ্চর্য!”
“হ্যা ঠিক তাই। তোর চোখ বন্ধ করে রাখা উচিৎ ছিল।”
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো আরোহী। এই লোকের সাথে কথা বলে লাভ নেই কোনো। এর সাথে যাই বলবে তারই একটা পাল্টা অযৌক্তিক জবাব দিবে। আরোহী আর তেমন কথা বাড়ালো না। হাত দ্বারা ফাস্ট এইড বক্সটা দেখিয়ে বলল,
“ফাস্ট এইড বক্স রেখে গেলাম। ঔষধ লাগিয়ে নিবেন। আসছি আমি।”
কণ্ঠে তোলা বাক্যগুলোর সমাপ্তি ঘটিয়েই দরজার পানে পা বাড়ালো আরোহী। তূর্ণ কপাল কুঁচকালো অতঃপর বলল,
“তুই কোথায় যাচ্ছিস?”
আরোহী থমকে দাঁড়ালো। পিছন ঘুরে বলল,
“বাইরে। তাছাড়া বাড়িতে যেতে হবে। রাত হয়ে যাচ্ছে অনেক।”
“তুই চলে গেলে আমার ঔষধ কে লাগিয়ে দিবে?”
আরোহী ভেংচি কাটলো। মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“নিজের কাজ নিজে করতে শিখুন তূর্ণ ভাই। অন্যের উপর নির্ভর হয়ে আর কতদিন বাঁচবেন?”
তূর্ণ বিছানায় উঠে বসলো। তিরস্কার করে বলল,
“ছিঃ ছিঃ আরোহী। তুই এত পাষাণ হলি কবে থেকে? দেখছিস একটা মানুষ অসুস্থ। কপাল কেটেছে, হাত পা ফেটেছে। অথচ তুই কিনা এখানেও নির্ভরতা খুঁজছিস?”
থামলো তূর্য। আবার বলল,
“মেয়ে তোকে তো আমি ভালো ভেবেছিলাম। কিন্তু তুই তো একটা আস্ত খচ্চর বের হলি।”
খচ্চর! এত বড় একটা কথা। আরোহী তেড়ে গেল তূর্ণের পানে। রেগেমেগে কিছু বলবে তার আগেই ফাস্ট এইড বক্স থেকে একটা মলম বের করে হাতে ধরিয়ে দিল মেয়েটার। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
“লাগিয়ে দে তাড়াতাড়ি।”
আরোহী কটমট করলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“পারবো না আমি। মা’রা’মা’রি কে করতে বলেছে? কোনো ভদ্র ঘরের ছেলেদের কখনও শুনেছেন মা’রা’মা’রি করতে? কিসের জন্য মা’রা’মা’রি করেছেন আপনি?”
তূর্ণের দৃষ্টি শীতল হলো। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে সে তাকিয়ে রইলো আরোহীর পানে। অতঃপর আনমনেই বলল,
“তোর জন্য।”
আরোহী ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,
“মানে?”
তূর্ণের ধ্যান ভাঙলো। অপ্রস্তুত হলো সে। কথা ঘুরিয়ে বলল,
“ঔষধ লাগিয়ে দিবি নাকি তোর মাকে ডাকবো?”
পরপর আবার হুমকির স্বরে বলল,
“দাঁড়া ডাকছি এক্ষুনি। মামনি! মামনি!”
কিছুটা হকচকালো আরোহী। তার মাকে ডাকলে এখানে আবার আরেক ঝামেলা। এমনি তূর্ণ বলতে অজ্ঞান সে। মেয়েটা হাতে ঔষধ নিল। আলতোভাবে তা তূর্ণের কপালে লাগিয়ে দিতে দিতে বলল,
“এখানে আবার মাকে ডাকার কি আছে? আমাকে একটু সুন্দরভাবে বললেই হতো।”
“তোর মতো পেত্নীর জন্য আমার সুন্দর কথা আসে না।”
আরোহী অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো তূর্ণের পানে। তবে বলল না কিছুই। আস্তে ধীরে কপালে, গালে ঔষধ লাগিয়ে বলল,
“হয়ে গেছে।”
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল তূর্ণ। টিশার্টের হাতাটা একটু উপরে তুলে বলল,
“এখানে লাগিয়ে দে।”
আরোহী তাকালো তূর্ণের হাতের পানে। কনুইয়ের উপরটায় মনে হচ্ছে কালো হয়ে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। ফর্সা শরীরে সে কালো বর্ণটা যেন আরও বিদঘুটে আকার ধারণ করেছে। এতক্ষণ যাই বলুক এবার আরোহীর মায়া হলো। ইসস মা’রা’মা’রি করে নিজের কি হাল করেছে ছেলেটা। মেয়েটা বসলো তূর্ণের পাশে। ব্যথিত হৃদয় নিয়ে তার হাতের কালো অংশটাতে একটু স্পর্শ করতেই লাফিয়ে উঠলো তূর্ণ। মৃদু চিৎকারের সহীত বলল,
“মা’র’তে চাইছিস নাকি আমাকে? ওভাবে ধরেছিস কেন? আহ! ব্যথা।”
আরোহী তবুও হাতটা সরিয়ে নিল না। বরং তূর্ণের হাতটা উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে বলল,
“দেখছেন হাতটার কি অবস্থা করেছেন? আর কখনও মারামারি করবেন না।”
তূর্ণ আরোহীর কণ্ঠে বিষাদের ছোঁয়া টের পেল। এই বিষাদ কি তূর্ণের ব্যথা দেখে? ছেলেটার হৃদয়ে প্রশান্তির হাওয়া বইলো। মনে মনে বলল,
“তুই বললে আমি সব ছেড়ে দিতে পারি। আবার তোর উপরে কোনো আচ আসতে দেখলে তাকে মে’রে’ও দিতে পারি।”
৮.
রাত্রি কিছুটা গভীর। চারদিকটা নীরব নিস্তব্ধতায় ঢেকে গেছে ইতমধ্যে। জনমানবের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না কোনো। এই নীরবতার বুক চিরেই হঠাৎ তূর্ণের কক্ষের দরজায় টোকা পড়লো। তূর্ণ ঘুমায়নি এখনও। মোবাইল হাতে নিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করছিলো। রাত জাগার অভ্যাস তার। অবশ্য আজকালকার বেশিরভাগ তরুণ তরুণীর মধ্যেই এই অভ্যাসটা দেখা যায়। কেউ কেউ তো সারারাত ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউবসহ আরও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘেটে তারপর ভোরের দিকে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু এত রাতে আবার কে এসে দরজা ধাক্কা ধাক্কি করছে? বাড়ির সবাই তো ইতমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়। তূর্ণ কপাল কুঁচকালো। বিছানা ছেড়ে এগিয়ে এলো দরজার পানে, খুললো দরজাটা। সাথে সাথে চোখের সম্মুখে দৃশ্যমান হলো তূর্য চৌধুরী। এত রাতে নিজ কক্ষের সম্মুখে বাবাকে দেখে বিস্মিত হলো তূর্ণ। অবাক সুরে বলল,
“বাবা তুমি?”
তূর্য হাসলো। অনুমতি চেয়ে বলল,
“ভিতরে আসতে পারি?”
তূর্ণ ভরকে গেল কিঞ্চিৎ। তার বাবা কক্ষের ভিতরে ঢোকার জন্য অনুমতি চাইছে? ছেলেটা দ্রুত সরে গেল দরজা থেকে। মেকি হেসে বলল,
“এসো, এসো।”
তূর্য ভিতরে ঢুকলো। আশপাশটায় একবার চোখ বুলিয়ে সোজা চলে গেল কক্ষের সাথে লাগোয়া ঝুল বারান্দায়। তূর্ণও গেল তার পিছু পিছু। তূর্য আকাশের পানে তাকালো। ওষ্ঠে হালকা হাসির রেখা বজায় রেখেই বলল,
“চাঁদটা সুন্দর না?”
তূর্ণ বাবার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো আকাশের পানে। সত্যিই গোল থালার ন্যায় রূপালি এক খানা চাঁদ উঠেছে আজ আকাশ জুড়ে। স্নিগ্ধ সুন্দর জোৎস্নার আলোয় ছেয়ে গেছে শহরটা। ছেলেটা মাথা নাড়ালো। অসংখ্য সুরে বলল,
“হুম।”
“তুমি নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছো আমি এই মাঝরাতে তোমার কক্ষে এসে চাঁদ কেন দেখাচ্ছি এটা ভেবে।”
থামলো তূর্য আবার বলল,
“আমাদের বর্তমান সমাজের চিন্তা চেতনা মোতাবেক এই স্নিগ্ধ চাঁদ দেখা, একত্রে সময় কাটানো প্রতিটিই ধরে রাখা হয় প্রেমিক যুগল কিংবা দম্পতির জন্য। সন্তান এবং পিতা মাতার সম্পর্কটাকে দেখা হয় ভীষণ ভয়ার্ত দৃষ্টিতে। সমাজ নির্দিষ্ট করে রাখে সন্তান এবং পিতা মাতার সম্পর্কের মধ্যে থাকবে শুধুমাত্র গম্ভীরতা, শাসন এবং নিজের ইচ্ছে অন্যের উপরে চাপিয়ে দেওয়া। জানো তো একটা বিষয় আমাদের সমাজে ভীষণভাবে প্রচলিত রয়েছে ‘সন্তান যখন পিতা মাতার অবাধ্য হয় বা নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী কিছু করতে যায় তখন মানুষ বলে এ কেমন সন্তান যে পিতা-মাতার মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে কাজ করছে না। অবশ্যই তাকে পিতা-মাতার মতামতই মেনে নিতে হবে। জন্ম দিয়েছে তারা। সুতরাং সন্তানের জীবনে তাদের কথাই হবে শেষ কথা।”
চলবে…..