#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৫
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
নিচু স্বরে বললেন,
“তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে আজ। আমি যেন এই বুড়ো বয়সে এসেও আবার নতুন করে তোমার প্রেমে পড়লাম প্রিয়তমা।”
পৃথা লজ্জা পেল। এই লোকটা আর ভালো হলো না। আগেও ঠোঁটকাটা, নির্লজ্জ, লাগামহীন ছিল এখনও তাই আছে। মানুষের বয়স বাড়লে নাকি তার ভিতরে একটা ভার ভার্থিকতা চলে আসে কিন্তু এ লোক বুড়ো হওয়ার পরও শুধরালো না? পৃথা আড় চোখে একবার সবার পানে তাকিয়ে দেখলো কেউ তাদের কথা শুনেছে কিনা। নাহ বোধহয় শোনেনি। সবাই নিজের ভাবে খেতে শুরু করেছে। পৃথা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মুখ বাঁকিয়ে নিচু স্বরে বলল,
“বুড়ো বয়সে ভীমরতি।”
তূর্য ওষ্ঠ প্রসারিত করলো। মৃদু স্বরে গান ধরলো,
“চুল পাকিলেই লোকে হয় না বুড়ো, আসল প্রেমের বয়স এই শুরু।”
তূর্যদের অর্থাৎ বাড়ির বয়জ্যেষ্ঠদের খাবার পালা শেষ হতেই বাড়ির ছোটদের পালা এলো। টেবিল দখল করে একপাশে বসলো আরোহী, তনায়া, তুলি এবং তানিয়া। আর অন্যপাশে বসলো তূর্ণ, তৌফিকের ছেলে নাহিয়ান, ইমনের দুই ছেলে ইমদাদ এবং ইনান। এদের মধ্যে তূর্ণ সবার বড়। নাহিয়ান এবং ইমদাদ পিঠোপিঠি হলেও ইনান এবং আরোহীদের তুলনায় বড়। পৃথা সবাইকে খাবার দিতে শুরু করলো। সবাইকে দিয়ে আরোহীর প্লেটে খাবার তুলে দিতেই চোখ বড় বড় করে ফেললো তূর্ণ। ব্যস্ত হয়ে বলল,
“ওকে একটু কম কম দাও মা। দিন দিন খেয়ে খেয়ে যে হারে মোটা হচ্ছে কয়দিন পর না ফেটে যায়। তখন আবার আমাকেই ঝামেলায় পড়তে হবে।”
আরোহী চোখ ছোট ছোট করে তাকালো তূর্ণের পানে। থমথমে কণ্ঠে শুধালো,
“আপনাকে ঝামেলায় পড়তে হবে কেন?”
“তুই ফেটে গেলে তোর বাপ মা তো কেঁদে কেটে জ্ঞান হারাবেন সাথে সাথে। আয়াশটাও ছোট কি করতে হবে না হবে ভেবেই কূলকিনারা করতে পারবে না। এ বাড়ির সবাইও তোর শোকে কাতর হয়ে ছিটকে পড়বে। তখন বাড়ির বড় ছেলে এবং তোর একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আমাকেই শক্ত থাকতে হবে। তোর ফাটা দেহ কোলে তুলে, কাঁধে তুলে ছুটতে হবে হাসপাতালের অলিতে গলিতে।”
কি বেহুদা চিন্তাধারা। নাক মুখ কুঁচকালো আরোহী। নিজের প্লেটটা টেনে খাবার মুখে তুলতে তুলতে বলল,
“প্রথমত আমি মোটেও মোটা নই তূর্ণ ভাই। আর দ্বিতীয়ত আমি ফেটে গেলে আপনার আমাকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে হবে না। আমাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য আপনি ছাড়াও নাহিয়ান, ইমদাদুল ভাই আছে।”
“সবার হার্ট দূর্বল। ওরা তোর ফাটা দেহের পানে তাকিয়েই জ্ঞান হারাবে। আবার হাসপাতালে কখন নিবে?”
“তূর্ণ ভাই আপনি কিন্তু….”
এইটুকু বলতেই আরোহীকে থামিয়ে দিল ইমদাদুল। খেতে খেতে বলল,
“হ্যা যে আরোহী। সেদিন তোর পিছনে যে ছেলেটাকে দেখলাম ছেলেটা কে যে?”
প্রশ্নটা করার সাথে সাথে সকলের চোখ মুখ যেন চকচক করে উঠলো। তনয়া আর তুলি খাবার রেখেই তাকালো আরোহীর পানে। উৎসুক হয়ে শুধালো,
“কোন ছেলে রে?”
আরোহী ঢোক গিললো। সেদিন রাস্তায় হুট করেই কোথা থেকে একটা ছেলে এসে প্রেম নিবেদন করেছিল তাকে। কোথাকার ছেলে, কোন ছেলে কিছুই জানে না সে। শুধুমাত্র কয়েকদিন রাস্তা থেকে কলেজে যাতায়াতের সময় দেখেছিল তারপরই প্রেম নিবেদন। কিন্তু এরা সেই সামান্য ঘটনাটাও জেনে নিয়েছে? এদের যন্ত্রণায় দেখা যাচ্ছে কোথাও শান্তি নেই। এখানে যারা যারা উপস্থিত আছে বিশেষ করে তূর্ণ একবার যদি বাবা মায়ের কানে এ কথা তুলে দেয় তবে দেখা যাবে কাল থেকে সাথে বডিগার্ডের আবির্ভাব ঘটে গেছে। জোরপূর্বক হাসলো আরোহী। আমতা আমতা করে বলল,
“কোন ছেলে? আমি তো কোনো ছেলেকে চিনি না।”
ইমদাদুলের কপালে ভাঁজ পড়লো। সন্দিহান সুরে বলল,
“তাহলে আমার বন্ধু ফাহাদ কি আমাকে মিথ্যা বলল? ও নাকি দেখেছে তুই কোন ছেলের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলি। এবং তোদের দেখে নাকি ওর মনে হয়েছে ছেলেটা তোকে বিরক্ত করছে তাই আমাকে বলল।”
“ফাহাদ ভাই কি দেখতে কি দেখেছে। তুমিও তার কথা বিশ্বাস করে নিলে?”
“ছেলেটা কে ছিল?”
তূর্ণের শীতল কণ্ঠস্বর। খাওয়া থেমে গেছে তার আরও আগে। এতক্ষণ শুধুমাত্র আরোহীর মুখ পানে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিল ছেলেটার পরিচয় জানার জন্য। কিন্তু মেয়েটা তো একের পর এক মিথ্যা বলেই যাচ্ছে। আরোহী ফাঁকা ঢোক গিললো। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে আবার বলল,
“তোমারা কোন ছেলের কথা বলছো আমি তো তাই বুঝতে পারছি না।”
সাথে সাথে ধমকে উঠলো তূর্ণ। গলা বাড়িয়ে বলল,
“আমি সত্যিটা শুনতে চাইছি।”
তূর্ণের আকস্মিক ধমকে কেঁপে উঠলো আরোহী। চুপসে গেল উপস্থিত অন্যরাও। তূর্ণ যে ক্ষেপে গেছে তা বুঝতে বাকি রইলো না কারো। আরোহীও আমতা আমতা শুরু করলো। কিছুটা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,
“আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু আমি তা সাথে সাথেই প্রত্যাখ্যান করেছি।”
কথাটা শেষ হতে না হতেই তূর্ণের চেহারার রং বদলালো। চোখ দুটোতে কেমন রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে, চোয়ালটাও শক্ত হয়ে উঠেছে। হুট করেই খাওয়া রেখে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ছেলেটা। অবাক হলো সকলে। নাহিয়ান কিছুটা অবাক সুরেই শুধালো,
“কি হলো ভাই খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলে যে? খাবে না আর?”
তূর্ণ উল্টো ঘুরে পা চালালো। যেতে যেতে বেশ ভারী কণ্ঠে বলল,
“পেট ভরে গেছে আমার। তোরা খা।”
৬.
সন্ধ্যার সময়। সূর্যটা ডুবে গিয়ে চারদিকে আঁধারে ঢেকে গিয়েছে অনেকটাই। শহরের বুকটা আলোকিত হয়ে উঠেছে কৃত্রিম সোডিয়ামের আলোর ঝলকানিতে। আরোহীরা এখনও বাড়ি ফিরেনি। বড় ছোট সবাই মিলে আসর জমিয়েছে বাড়ির বসার কক্ষে। পৃথা, ইসরাত, অনন্যা তিনজন মিলে ট্রেতে করে চা এনে রাখলো টি টেবিলে। একে একে চায়ের কাপ তুলে দিতে শুরু করলো সকলের হাতে। ঠিক তখনই বাড়ির সদর দরজা দিয়ে আবির্ভাব ঘটলো তূর্ণের। ছেলেটার পানে তাকিয়েই আঁতকে উঠলো সকলে। ধুলো মাখা জামা কাপড়, চুলগুলো এলোমেলো, কপালের কিছু অংশ কাটা। দেখেই মনে হচ্ছে কোথাও থেকে মা’রা’মা’রি করে ফিরেছে এ ছেলে। তবুও যেন কেউ বিশ্বাস করতে পারলো না তূর্ণ মা’রা’মা’রি করে ফিরেছে। এমনি আরোহীর সম্মুখে যেমনই হোক না কেন এলাকা এবং পরিবারে ভদ্র ছেলে হিসেবে নাম ডাক রয়েছে বেশ। এসব মা’রা’মা’রি, ঝামেলা তার চরিত্রের সাথে যায় না কখনও। তাহলে আজ কি এমন হলো যে মা’রা’মা’রি করে ফিরতে হলো? ছেলের এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে তার পানে ছুটে গেল পৃথা। হাত বাড়িয়ে ছেলেটার মুখে গালে বুলিয়ে দিয়ে অস্থির হয়ে শুধালো,
“কি হয়েছে? এ অবস্থা কেন তোর? কোনো এক্সিডেন্ট হয়েছে কি?”
“না মা’রা’মা’রি করেছি।”
তূর্ণের নির্লিপ্ত ভঙ্গিমা। চমকালো সকলে। যে কথাটা মাথায় এলেও বিশ্বাস করতে চায়নি কেউ তাই তবে সত্যি হলো। তূর্ণ শেষ পর্যন্ত নিজের ভদ্রতার খোলস ছেড়ে মা’রা’মা’রি করে ফিরেছে? এতক্ষণ ছেলের জন্য মায়া দেখালেও এবারে চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো পৃথার। ভারী কণ্ঠে বলল,
“বাইরে গিয়ে মা’রা’মা’রি করে ঘরে ফিরবে এই শিক্ষা দিয়েছিলাম আমি তোমাকে? দিন দিন অধঃপতন হচ্ছে তোমার।”
তূর্ণের চোখ মুখের কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। পূর্বের ন্যায়ই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সে বলল,
“কখনও কখনও প্রিয় কিছুর জন্য অধঃপতনও শ্রেয়।”
কথাটা বলে তূর্ণ পরপর তাকালো আরোহীর পানে। তবে তার এই ছোট্ট একটা বাক্যের গভীরতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নি কেউই। পৃথা যেন পূর্বের তুলনায় আরও ক্ষীপ্ত হলো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
“কি এমন প্রিয় বস্তু যার জন্য তুমি মা’রা’মা’রি করতে দ্বিধাবোধ করোনি। তোমার এই মা’রা’মা’রি’র জন্য তোমার বাবাকে, আমাদের প্রতিবেশীদের নিকট কতটা ছোট হতে হবে জানো তুমি?”
পৃথার কথা শেষ হতে না হতেই মুখ খুললো তূর্য। ছেলে মা’রা’মা’রি করে বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়িতে ফিরলেও এতক্ষণ বেশ নির্লিপ্ত হয়ে চা পান করছিল সে। কিন্তু এ পর্যায়ে পৃথা তার নাম নিয়ে টানাটানি করায় আর চুপ থাকতে পারলো না। চা রেখে উঠে দাঁড়ালো। স্ত্রীর কথার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলল,
“আমি মোটেই ছোট হইনি আমার ছেলের মা’রা’মা’রি’তে বরং গর্ববোধ হচ্ছে। এতদিনে না একটা কাজের কাজ করেছে সে।”
পরপর তূর্ণের পানে ফিরে তাকালো তূর্য। কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,
“জিতে ফিরেছো তো? মা’রা’মা’রি’তে হারাটা কিন্তু আমার একদম পছন্দ নয়।”
পৃথা হতবাক হলো। সাথে মেজাজটাও বিগড়ে গেল। কোথায় ছেলে এত বড় একটা কান্ড ঘটিয়ে এসেছে তাকে বকবে, বুঝাবে তা নয় আরও উস্কে দিচ্ছে। বাবা মায়ের এমন প্রশ্রয় দেওয়ার জন্যই তো আজকাল ছেলে মেয়েরা এত সাহস পাচ্ছে, বিগড়ে যাচ্ছে। ছেলে মেয়ে ভুল করলে প্রথমেই যদি বাবা মা তা শক্ত হাতে প্রতিরোধ করে, শাসন করে তবে ছেলে মেয়েরা পরবর্তীতে আর সেই কাজ করার সাহস করে না। পৃথা দাঁতে দাঁত চাপলো। কিছুটা রুক্ষ কণ্ঠে বলল,
“এই আপনার জন্যই ছেলেটা বিগড়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।”
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাইরে চলে যাচ্ছে। মা’রা’মা’রি করে এসেছে তূর্ণ তবে ঝগড়া লাগার সম্ভাবনা রয়েছে তার বাবা মায়ের মধ্যে। অনন্যা এগিয়ে এলো তূর্ণের পানে। কিছুটা ব্যস্ত হয়ে বলল,
“ছেলেটা মা’রা’মা’রি করে জখম হয়ে ঘরে ফিরেছে। আগে ওর দিকে আমাদের একটু তাকানো উচিৎ। তারপর না হয় কি হয়েছে, কেন হয়েছে জানা যাবে।”
ইসরাত, ইরা, আয়ুশ, তৌফিক এবং অন্যান্যরাও সায় জানালো অনন্যার কথায়। তৌফিক তূর্ণের পানে তাকিয়ে বলল,
“তুই কক্ষে যা। ফ্রেশ হ। আমি ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে আসছি।”
প্রত্যুত্তরে তূর্ণ বলল না কিছুই। আরোহীর পানে শেষ একবার তাকিয়ে হাঁটা ধরলো সিঁড়ির পানে।
৭.
কিছুটা সময় গড়ালো। আরোহীরা আজ রাতে যতটুকু সময় এখানে কাটাবে বা হৈচৈ করবে বলে পরিকল্পনা করেছিল তাতে ভাটা পড়লো তূর্ণের মা’রা’মা’রি করে বাড়ি ফেরায়। বাড়ির ছোট সদস্যরা অর্থাৎ তনায়া, তুলি, ইমদাদ, নাহিয়ান, তানিয়া, ইনান সবাই যেন তূর্ণের শোকে দিশেহারা হয়ে উঠেছে। তারা একেকজন হয়তো কেঁদে দিতে পারলে শান্তি পেত। সকলের অবস্থা দেখে মনে মনে ভেংচি কাটলো আরোহী। একটু কপালই তো কেটেছে। তা নিয়ে সকলের কত আদিখ্যেতা। পুরো মাথাটা ফাটলে আরও ভালো হতো। তাও যদি লোকটার তার পিছনে লাগা বন্ধ হতো। এদের এত আদিখ্যেতা আর সহ্য হলো না মেয়েটার, উঠে দাঁড়ালো সে। অন্য দিকে পা চালাতেই পিছন থেকে ডাক পড়লো। তৌফিক ডেকে বলল,
“এই ফাস্ট এইড বক্সটা তূর্ণের ঘরে নিয়ে যা তো।”
আরোহী থমকে দাঁড়ালো। এদিক ওদিক তাকিয়ে হাত উঁচিয়ে তর্জনী আঙ্গুলটা নিজের পানে তাক করে বলল,
“আমি?”
তৌফিক এগিয়ে গেল আরোহীর পানে। ফাস্ট এইড বক্সটা মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“হ্যা তুই নিয়ে যা। আমার হঠাৎই একটু কাজ পড়ে গেছে। সেখানে যেতে হবে আবার।”
“কিন্তু, আমি তো….”
আরোহীর কণ্ঠে তোলা বাক্যটা পুরোপুরি শেষ করতে দিল না তৌফিক। ব্যস্ত হয়ে বলল,
“তাড়াতাড়ি নিয়ে যা। ছেলেটা বোধহয় অপেক্ষা করছে।”
তৌফিক চলে গেল। হতাশ হলো আরোহী। যারে দেখতে পারে না। তার সম্মুখেই ঘুরে ফিরে যেতে হয় তাকে। কিন্তু কি আর করার। যেতে তো হবেই। বড়দের কথা ফেলা নিশ্চই কোনো ভালো মেয়ের কর্ম নয়। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো আরোহী অতঃপর ফাস্ট এইড বক্সটা হাতে নিয়েই হাঁটা লাগালো তূর্ণের কক্ষের পানে।
চলবে…..