#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৪
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
“না না আমি ভূত্তা বিজ্ঞানী হবো না। আমি হবো দিদুনের গল্পের ভূত্তা কুমার আর আলোপ্পি হবে ভূত্তা কুমারী। তারপর আমার ভূত্তা কুমারীকে রাক্ষস ধরে নিয়ে যাবে। আমিও এক সাহসী ভূত্তা কুমার হয়ে সাত সমুদ্রর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে ভূত্তা কুমারীকে উদ্ধার করে আনবো।”
তূর্ণের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। থমথমে কণ্ঠে সে বলল,
“এ তোর ভূট্টা কুমারী হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। এ আপাতত আলু কুমারীই ঠিক আছে।”
অনয় নাক মুখ কুঁচকালো। আঙ্গুল তুলে বলল,
“কিন্তু আমার আলোপ্পি তো ভূট্টা কুমারীর মতো সুন্দর।”
তূর্ণ চোখ ছোট ছোট করে তাকালো অনয়ের পানে অতঃপর বলল,
“তুই কি বুঝিস সুন্দরের?”
“আমার ভূত্তা কুমারীকে।”
অনয় বেশ ভাব নিয়ে বলল কথাটা। অবাক হলো তূর্ণ। এই টুকু ছেলের কি উত্তর। আজকালকার বাচ্চাগুলো বয়সের তুলনায় অধিক বোঝে। এরা যেন পেট থেকেই পেকে বেরিয়ে আসে। তূর্ণ মুখ বাঁকালো। ভেংচি কেটে বলল,
“এসেছে আমার ভুট্টা কুমার। আরোহী তোর ভূট্টা কুমারী হবে না। অন্য কাউকে খুঁজে নে যা।”
অনয় যেন মানতে পারলো না তূর্ণের কথা। গুটি গুটি পায়ে এসে সে দাঁড়ালো আরোহীর পাশে। ছোট ছোট হাতে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটার কোমড়। কণ্ঠে জোর দিয়ে বলল,
“আলোপ্পিই আমার ভূত্তা কুমারী। আর কাউকে লাগবে না।”
কপালে ভাঁজ ফেললো তূর্ণ। একটু খানি পুঁচকে ছেলে। দুনিয়ায় পা রাখতে না রাখতেই তার জিনিসের দিকে নজর দেওয়া শুরু করেছে। ভাগ্যিস এই ছেলের জন্ম আরোহীরও অনেক পরে নয়তো আরোহীকে নিয়ে নির্ঘাত তার সাথে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটা বাঁধিয়ে দিতো। অবশ্য এখনই বা কম করছে কিসে? তূর্ণ কিঞ্চিৎ ধমকের স্বরে অনয়কে বলল,
“হপ! কোথা থেকে এসেছে আমার ভুট্টা কুমার। দূরে যা, আরোহীকে আমি তোকে দেব না।”
ব্যস হয়ে গেল। তূর্ণের এই টুকু ধমকেই নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেললো অনয়। চিৎকার করে কেঁদে উঠে দৌড় লাগালো তাহমিনা বেগমের কক্ষের পানে। যেতে যেতে কণ্ঠ উঁচিয়ে বলল,
“দাদী তূর্ণ ভাই আমাকে বকেছে। আবার ধমক দিয়েছে।”
তূর্ণ ওষ্ঠ বাঁকালো। ভেঙিয়ে বলল,
“দাদী তূর্ণ ভাই আমাকে বকেছে। আবার ধমক দিয়েছে। হাত পা এখনও পেটের মধ্যে এখনই এসেছে আমার শত্রুতা করতে। যত্তসব আজব পাবলিকে ভর্তি বাড়িঘর।”
তূর্ণের এহেন বাচ্চাদের ন্যায় আচরণে বিরক্ত হলো আরোহী। একটু খানি বাচ্চা ছেলে তার সাথেও ঝামেলা পাকাচ্ছে এ লোক। তূর্ণের ব্যবহার নিতান্তই ছেলেমানুষী এবং বাচ্চাদের বিরক্ত করা ব্যতীত আর কিছুই মনে হলো না আরোহীর নিকট। কপাল কুঁচকেই মেয়েটা বলল,
“ঐ টুকু ছেলের সাথেও আপনার ঝামেলা না করলে হয় না তূর্ণ ভাই? বুদ্ধি শুদ্ধি কি সব লোপ পেয়েছে আপনার?”
তূর্ণ ঘুরে তাকালো আরোহীর পানে। চোখ বড় বড় করে বলল,
“প্রথমে আমাকে বদমাইশ বললি, তারপর আমাকে মিথ্যা বললি এখন আবার আমার বুদ্ধি নিয়ে তুই প্রশ্ন তুলছিস তুই?”
আরোহীর বিরক্তিবোধ বাড়লো। এক প্রকার তাকে বাসা থেকে জোরজবরদস্তি করে তুলে এনেছে লোকটা, এখানে এসে আবার ঝামেলা পাকালো অনয়ের সাথে। এখন আবার সে বলছে এক আর এ কথা ঘুরিয়ে নিতে চাইছে আরেক দিকে। আরোহী নিজের বিরক্তিবোধ নিয়েই পা বাড়ালো অন্যদিকে। অমনি পিছন থেকে খপ করে তার হাতটা ধরে ফেললো তূর্ণ। ওষ্ঠ বাঁকিয়ে বলল,
“কোথায় যাচ্ছিস? তোর যে আমার থেকে এখনও অনেক শাস্তি পাওনা।”
এ পর্যায়ে আরোহীর হৃদয়ে কিঞ্চিৎ ভীত হলো। এই শাস্তির ব্যাপারটা সে তো ভুলেই বসেছিল। এখন আবার এই লোক তাকে কি না কি শাস্তি দেয় কে জানে! আরোহী ঢোক গিললো। ভীত স্বরে শুধালো,
“কি শাস্তি?”
তূর্ণ জবাব দিল না কোনো। মেয়েটার হাত টেনে নিয়ে গেল নিজের কক্ষের বারান্দায়। সেখানে কিছু বেলী ফুল গাছের চারা দেখিয়ে বলল,
“প্রথমে ফ্রেশ হবি। তারপর সুন্দর পরিপাটিভাবে বাগান থেকে মাটি এনে আমার এই বেলী ফুল গাছের চারাগুলো রোপণ করবি।”
থামলো তূর্ণ। দুই হাত তুলে হাই দিতে দিতে বলল,
“আমি এখন একটু ঘুমাবো। না গতকাল রাতে তোর যন্ত্রনায় একটু ঠিকভাবে ঘুমাতে পেরেছি আর না আজ সকালে পেরেছি। তুই তোর কাজ শুরু কর, আমি গেলাম।”
তূর্ণ চলে গেল। তবে বেলী ফুলের চারা রোপনের শাস্তি পেয়ে খুশিই হলো আরোহী। শাস্তি হলেও তার মনের মতো একটা কাজ পেয়েছে। পৃথিবীর বুকে বসবাসরত আমরা সবাই আলাদা আলাদা চিন্তাধারার অধিকারী, সবার পছন্দ অপছন্দ আলাদা। এই যেমন ফুলের ক্ষেত্রেই কারো পছন্দ গোলাপ, কারো পছন্দ বেলী, কেউ আবার ডেইজি পছন্দ করে, আবার কেউ টিউলিপ। সেক্ষেত্রে আরোহীর পছন্দ গোলাপ এবং বেলী। ছোট বেলা থেকেই কেমন যেন এই ফুল দুটোর প্রতি আলাদা একটা টান অনুভব করে আরোহী। কোথাও গিয়েছে আর এই ফুল দুটো চোখে পড়েছে কিন্তু সে এমন কখনও হয়নি। একটাকে রেখে সে কখনও অন্যটাকে বাছাই করতে পারে না। আরোহীর সর্বদাই মনে হয়,
“গোলাপ হলো ভালোবাসা, যা নিজের সৌন্দর্যকে ছড়িয়ে দিয়ে পুলকিত করে হৃদয়কে। আর বেলী হলো মায়া, যা নিজের সুভাস ছড়িয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে হৃদয়ে।”
-( কলমে : সাদিয়া শওকত বাবলি )
আর সেই ফুল দুটোর চারা দ্বারাই নিজের কক্ষের বারান্দা ভরে রেখেছে তূর্ণ। এ বাড়ির বাগানেই কিন্তু গোলাপ এবং বেলী দুটো গাছই রয়েছে তবুও তূর্ণ যে কেন আলাদাভাবে তার কক্ষের বারান্দা ভরে রাখে এ দুটো গাছে জানা নেই আরোহীর। কিন্তু বেলী গাছগুলোতে যখন ফুল ধরে আর মৃদু বাসাতে তার সুগন্ধ ভেসে আসে এ কক্ষে তখন পুরো কক্ষটা যেন স্বর্গীয় এক অনুভূতি অনুভব করায় মেয়েটাকে। ইচ্ছে হয় সারাদিন এ কক্ষে বসে থাকতে। তবে তূর্ণ তা কোনো কালেই হতে দেয় না। গোলাপ গাছে বা বেলী গাছে কুঁড়ি আসলেই এ কক্ষের আশেপাশে আর কাউকে আসতে দেয় না তূর্ণ, আরোহীকেও নয়।
৪.
সময় গড়ালো কিছুটা। দুপুর হয়ে এসেছে। আকাশের সূর্যটা ধীরে ধীরে ধরা দিতে শুরু করেছে উজ্জ্বল হয়ে। ঘন্টা দুয়েকের মতো ঘুমিয়ে তূর্ণের ঘুম ভাঙলো মাত্রই। একটু সময় নিয়ে সে উঠে বসলো বিছানায়। আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে খুঁজলো আরোহীকে। মেয়েটা কি এ কক্ষে আছে এখনও নাকি বেরিয়ে গেছে? তূর্ণ বিছানা ছেড়ে এগিয়ে গেল বারান্দার পানে। নাহ মেয়েটা নেই কোথাও। বেলী গাছের চারাগুলোও বেশ পরিপাটিভাবে রোপন করা। হয়তো নিজের কাজ শেষে বেরিয়ে গেছে এ কক্ষ থেকে। তূর্ণ আর বেশি ঘাটলো না। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে ওয়াশরুমের পানে গেল ফ্রেশ হতে।
****
এই প্রায় দুপুরে বাড়ির বউরা অর্থাৎ তূর্য চৌধুরীর স্ত্রী পৃথা, তৌফিক চৌধুরীর স্ত্রী ইসরাত, তারেক চৌধুরীর স্ত্রী অনন্যা তিনজনই রান্নাঘরে। হাতে হাতে বেশ মুখরোচক খাবার তৈরিতে ব্যস্ত তারা। মাঝে মাঝেই সাপ্তাহিক ছুটির দিনই গৃহে এমন মুখরোচক খাবারের আয়োজনের হিড়িক লাগায় গৃহিণীরা। তাদের কর্তারাও এ হিড়িকে খুশি বেশ। বাড়ির বউদের রান্নার ব্যস্ততার এই ক্ষণেই আবার তাহমিনা বেগমের কক্ষে আড্ডা বসিয়েছে বাড়ির মেয়েরা। আড্ডার এক পর্যায়ে হুট করেই আরোহীর চুল টেনে ধরলেন তাহমিনা বেগম। চুলগুলো খুলে দিয়ে বললেন,
“চুলে তেল দিস না কতদিন ধরে বুড়ি? চুলগুলো কেমন রুক্ষ খসখসে হয়ে গেছে।”
তাহমিনা বেগমের কথা শেষ হতেই ওষ্ঠ প্রসারিত করলো তৌফিকের মেয়ে তনয়া। কেমন রসিকতার সুরে বলল,
“তূর্ণ ভাইয়ের যন্ত্রণায় মনে হয় চুলে তেল দেওয়ার কথাও ভুলে বসেছে আরোহী।”
তনয়ার কথায় সায় জানিয়ে হেসে উঠলো তূর্ণের ছোট বোন তুলি আর তৌফিকের আরেক মেয়ে তানিয়া। আরোহী আর তনয়া প্রায় সমবয়সী এবং এক শ্রেণীতেই পড়াশোনা তাদের। তবে তুলি আর তানিয়া আবার তাদের তুলনায় বয়সে কিছুটা ছোট। তারা দুজন এ বছর দশম শ্রেণীতে। তাহমিনা বেগম একটু উল্টে পাল্টে দেখলেন নাতনির রুক্ষ চুলগুলো। কপাল কুঁচকে বললেন,
“পৃথার থেকে চুলের আয়ুর্বেদিক তেলের বোতলটা নিয়ে আয় তো কেউ। মেয়েটা কি অবস্থা করেছে সুন্দর চুলগুলোর।”
তুলি উঠে দাঁড়ালো। বলল,
“আমি আনছি এক্ষুনি।”
আরোহীও উঠে দাঁড়ালো সাথে সাথে। তুলিকে বাঁধা দিয়ে বলল,
“আমি আনছি তোর যেতে হবে না। সাথে একটু এও দেখে আসি মামীরা আজ কি কি রান্না করছে।”
কথাটা বলেই পরপর খোলা চুলে দৌড়ে কক্ষে থেকে বেরিয়ে পড়লো মেয়েটা। তবে পথিমধ্যেই বাঁধলো বিপত্তি। বেখেয়ালীতে দৌড়াতে গিয়ে কারোর সাথে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লো সে মেঝেতে। হকচকিয়ে উঠলো মেয়েটা, সাথে কিঞ্চিৎ ব্যথা পেল কোমড়েও। তৎক্ষণাৎ কোমড় চেপে ধরলো আরোহী। চোখ তুলে সম্মুখে তাকাকেই দেখা পেল তূর্ণের। কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে। আরোহী কপাল কুঁচকালো। সব স্থানেই কেন এই লোক! কাল রাত থেকে যেন তূর্ণ তার কপালে শনি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনি যা করার তা তো করেছেই এখন ধাক্কা খেল তাও এর সাথে। আরোহী উঠে দাঁড়ালো। বিরক্তি নিয়ে বলল,
“দেখে হাঁটতে পারেন না তূর্ণ ভাই? দিলেন তো আমাকে ফেলে।”
তূর্ণ কপাল কুঁচকালো। আরও কিছুটা সময় নিয়ে চেয়ে রইলো আরোহীর পানে। অতঃপর হুট করেই বুকে হাত দিয়ে বলল,
“তুই এভাবে দিনে দুপুরে চুল খোলা দিয়ে পেত্নীর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল কেন আরোহী? আর একটু হলে তো আমি হার্ট অ্যাটাক করেই বসতাম।”
আরোহী কটমট করলো। এ লোক যে অভিনয় করছে তা বুঝতে বাকি নেই। একটা মানুষ কিভাবে যে এত অভিনয় করতে পারে তা ভেবে পায় না মেয়েটা। আরোহীর আর এই মুহূর্তে এই বদ লোকের সাথে কথা বাড়াতে ইচ্ছে হলো না। কত বড় সাহস এর তাকে পেত্নী বলেছে। যেখানে চুল খোলা দিলে অন্যরা তাকে বলে অপ্সরা লাগছে সেখানে এ বলছে পেত্নী লেগেছে। বদমাইশ লোক একটা। আরোহী রাগে গজগজ করতে করতে তূর্ণের পাশ কাটালো। কিছুটা দূরে গিয়ে আবার ফিরে তাকালো পিছনে। গলা বাড়িয়ে বলল,
“আমাকে পেত্নী বললেন না? দেখবেন আপনার বউ একটা পেত্নী হবে।”
তূর্ণ চোখ গরম করলো। তেড়ে গিয়ে বলল,
“কি বললি আবার বল তো।”
আরোহী দাঁড়ালো না আর এক মুহূর্তও। এক দৌড়ে সে চলে গেল রান্নাঘরে পানে। তূর্ণ হেসে ফেললো। মাথা চুলকে বলল,
“আসলেই আমার বউ একটা পেত্নী হবে।”
৫.
সূর্যটা মাথার উপরে। বাড়ির বয়জ্যেষ্ঠ পুরুষেরা খাবার টেবিলে খেতে বসে পড়েছে ইতমধ্যে। টেবিল এখন তূর্য, তৌফিক, তারেক, আরুশ, ইমনের দখলে। আর দৌড় ঝাপ করে তাদের খাবার পরিবেশন করছে পৃথা, ইসরাত, অনন্যা, ইরা এবং ইমনের স্ত্রী লাবনী। সকলের শরীরেই আজ ভাঁজ ভাঙা নতুন শাড়ি জড়ানো। একটা উৎসব উৎসব ভাব ফুটিয়ে তুলতেই বোধহয় এই সাজসজ্জা। পৃথা সকলকে খাবার দিতে দিতে গিয়ে দাঁড়ালো তূর্যের পাশে। নম্র কণ্ঠে শুধালো,
“আপনাকে আর এক পিস মাছ দেই?”
তূর্য চোখে ইশারা করলো। পৃথা আশেপাশে তাকালো। এত মানুষের মধ্যে লোকটা আবার কানে কানে কি বলতে চাইছে? পৃথা একটু ইতস্তত করলো। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
“যা বলার পরে বলবেন।”
তূর্য মানলো না। চোখের ইশারায় তবুও নিচে ঝুঁকতে বলল। পৃথা আশেপাশে তাকালো অতঃপর সকলের চোখের আড়ালেই ঝুঁকলো একটু। তূর্য আশেপাশে চোখ বুলালো একবার। নিচু স্বরে বলল,
“তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে আজ। আমি যেন এই বুড়ো বয়সে এসেও আবার নতুন করে তোমার প্রেমে পড়লাম প্রিয়তমা।”
চলবে….