#প্রেমগুঞ্জন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ৩(শেষ_পর্ব)
শাহরিয়ার উত্তরের আশা না করে ভিতরে চলে গেল।
ভিতরে যেতেই দেখতে পেল আজিম সাহেব মলিন মুখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। শাহরিয়ার এগিয়ে গিয়ে বেডের পাশে থাকা টুলটা টেনে বসলো। দুইহাত দিয়ে আজিম সাহেবের হাতটা ধরে বলল
-“আব্বু এখন কেমন আছেন!”
আজিম সাহেব কাঁপা হাতে শাহরিয়ারের হাত ধরে অপরাধী কন্ঠে বলল
-“আমাকে ক্ষমা করে দিও বাবা।”
-“না না আব্বু আপনি কেন ক্ষমা চাচ্ছেন। আর হিয়া নিশ্চিত কোনো বিপদে পড়েছে।”
মুহূর্তে আজিম সাহেব খানিকটা গম্ভীর কন্ঠে বললেন
-“ওর কথা বাদ দেও তুমি।”
শাহরিয়ার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
-“আব্বু কিভাবে ভুলে যাই ওকে। ও আমার হবু বউ ছিলো না। বিবাহিত বউ ছিলো আব্বু। যদিও ও আমার বিবাহিত স্ত্রী সেহেতু আমি ওর মিসিং ডায়েরি করতেই পারি। কিন্তু তাও যেহেতু ওকে তুলে নিতে পারিনি তাই আপনার পারমিশন নিতে এসেছি।”
আজিম সাহেব গম্ভীর কন্ঠে বললেন
-“সমাজে মাঝে এমনিতেই তো নাক কাটিতেছে। এখন আবার পুলিশের ঝামেলা। তাছাড়া ওতো নিজ ইচ্ছায় হারিয়েছে।”
শাহরিয়ার নিজেকে যথাসম্ভব গম্ভীর করে বলল
-“আমি এতো কিছু জানিনা। আমি ওকে বিশ্বাস করি। ও আমাকে ধোকা দিতে পারেনা। আপনি বাবা হয়ে নিজের মেয়েকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমি যাবোই পুলিশের কাছে। সমাজ আমাকে খাওয়াবে পড়াবে না।”
কথাগুলো বলেই আজিম সাহেবের কোনো কথা না শুনে বেড়িয়ে গেল শাহরিয়ার। আজিম সাহেব পরপর কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাহরিয়ারের যাওয়ার পানে।
হিমিশা শুধু অপলক দৃষ্টিতে শাহরিয়ারের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু বলার মনমানুষিকতা পেল না সে। কিইবা বলবে সে।
———————–
শাহরিয়ার দীর্ঘ সাতদিন খুঁজেছে হিয়াকে। পুলিশও খুঁজে চলছে তাকে। এবার বেশ বিরক্ত শাদি আর নিরব। দুইজন শাহরিয়ারকে বুঝিয়েছে যে হিয়া তাকে ধোকা দিয়েছে। কিন্তু শাহরিয়ার বুঝতে নারাজ।
তিনজনই ক্লান্ত চিত্তে রেস্টুরেন্টের একটা টেবিলে বসে আছে। শাদি আর নিরব গোগ্রাসে খেয়েই চলছে। আর শাহরিয়ার নিজের ফোন বের করে হিয়ার ছবি দেখছে। হুট করেই একটা অপরিচিত নাম্বার দেখে কপাল কুচকালো শাহরিয়ার। দুই তিনবার রিং হয়ে কেটে গেলেও চতুর্থবারের বার কল রিসিভ করে কানে ধরলো শাহরিয়ার। অপরপাশ থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসতেই বসা থেকে উঠে দাড়ালো শাহরিয়ার। অস্থির কন্ঠে বলল
-“কান্না করছো কেন জান! কি হয়েছে তোমার! কে কি করেছে বলো আমায়!”
হিয়া কান্না থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই পারছে না। কান্নাগুলো যেন মুহূর্তেই দলা পাকিয়ে আসছে। এতে যেন শাহরিয়ারের অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। হিয়া কান্নাভেজা ভাঙা কন্ঠে বলল
-“আপনি বাঁচান আমাকে তমা আপু মেরে ফেলবে আমাকে। আপনি আসুন প্লীজ। আমাকে আপনার কাছে নিয়ে চলুন।”
শাহরিয়ারে কপাল কুচকে এলো। সে খানিকটা চেঁচিয়ে বলে উঠলো
-“তমা! তুমি কোথায় জান? ও তোমাকে কোথায় রেখেছে?”
হিয়া ভয় নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলল
-“তমা আপুদের বাসার বাগানের দিকের ভাঙা ঘরে আমায় আটকে রেখেছে। আজ রাতে নাকি কার কাছে আমাকে বেঁচে দিয়ে আপনাকে বিয়ে করবে।”
শাহরিয়ারের রাগে চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। সে রাগান্বিত কন্ঠে বলল
-“আমি আসছি জান। তোমার কিছু হতে দিবোনা আমি।”
হিয়া অস্থির কন্ঠ বলে উঠলো
-“একা আসবেনা কিন্তু এখানে বেশ কিছু পাহাড়াদার আছে। তাদের একজনেরই ফোন এটা। আপনি আসুন তাড়াতাড়ি। কেউ একজন আসছে ফোন রাখতে হবে আমার।”
বলেই হিয়া কল কেটে দিলো। শাহরিয়ার সব খুলে বলল শাদি আর নিরবকে। দুইজনই বেশ অবাক হলো। তমা তো শাহরিয়ারের চাচাতো বোন। অবশ্য এর আগে শাহরিয়ার আর হিয়া ঘরোয়া ভাবে বিয়ে হয়েছিল দুই পরিবারের আর ওরা দুইজন ছাড়া কেউ জানেনা। তমা এমনটা করতে পারে কল্পনার বাহিরে ছিলো তাদের।
ওরা তিনজন আর কিছু পুলিশ নিয়ে কিছুসময়ের মধ্যে তমাদের বাসায় পৌঁছালো। তমা আর ওর মা বসার রুমে বসে চা খাচ্ছিলো। শাহরিয়ারকে দেখে খুশি হলেও পুলিশ দেখে খানিকটা ভরকে যায় তমা। তবুও নিজের মুখে জোরপূর্বক টেনে শাহরিয়ারের কাছে এগিয়ে গিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই শাহরিয়ার পরপর দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দেয় তমার গালে। থাপ্পড়ের বেগ এতটাই জোরে ছিলো যে তমা পড়ে যেতে নেয়। তমা মা ওকে ধরে বলল
-“শাহরিয়ার এ কেমন ব্যবহার তোমার। মানলাম তোমার প্রেমিকা বিয়ে না করে ভেগেছে তার রাগ তুমি আমার মেয়ের উপর ঝাড়বে।”
শাহরিয়ারের রাগে শরীর তরতর করে কাঁপছে। নিরব ওকে ধরে ঘৃণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
-“আপনাদের লজ্জা করেনা অন্যায় করে এখন নাটক করছেন। আমরা জানি সব। অফিসার তমাকে ধরুন।”
দুইজনই বেশ চমকে উঠে। ওদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শাহরিয়ার বাগানের দিকে গেল। পুলিশ পাহাড় দেওয়া লোকদের ও ধরে নিলো। শাহরিয়ার দরজা ভাঙতেই হিয়াকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখলে। হিয়ার পায়ে বেড়ি দিয়ে আটকানো। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে মুখের সামনে ফর্সা মুখে মলিনতার ছাঁপ। ঠোঁটে পাশে রক্ত জমে আছে। হাতের কাঁচের চুড়িগুলো হাতে বিধে রক্ত শুকিয়ে আছে। উজ্জ্বল মুখটায় যেন এক অন্ধকার হয়ে গেছে। সাতদিনেই যেন ওজন কমে গেছে। নিভু নিভু দৃষ্টিতে হিয়া শাহরিয়ারকে দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকতে দেখে মলিন মুখেও যেন এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো হিয়ার।
শাহরিয়ারের বুকে এসে লাগল সেই হাসি। চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরলো। শাহরিয়ার ছুটে হিয়ার কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো আষ্টেপৃষ্ঠে। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। হিয়াও মুচকি হেসে ক্লান্ত হাতে শাহরিয়ারকে জড়িয়ে ধরলো।
হিয়াকে বাঁধন থেকে মুক্ত করে ওর ছোট মুখটা নিজের হাতে মুঠে নিয়ে অসংখ্য চুমু এঁকে দিলো হিয়ার মুখে। ওকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হতেই নিরব আর শাদি মুখ টিপে হাসতে লাগল। যা দেখে বেশ লজ্জা পেল হিয়া। লজ্জায় মুখ গুজলো শাহরিয়ারের বুকে। শাহরিয়ার মুচকি হাসলো।
গাড়ির পিছন সিটে বসে শাহরিয়ার হাতটা ব্যান্ডেজ করে দিয়ে ঠোঁটের কাঁটা জায়গায় সযত্নে পরিষ্কার করে দিয়ে একটা ব্রেড নিয়ে হিয়ার সামনে ধরলো। এক কামড় দিতেই হুট করেই হিয়া বমি করে দিলো। নিরব গাড়ি ব্রেক করে পিছনে তাকালো। শাদিও চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকালো পিছনের দিকে। হিয়া অপরাধী কন্ঠে বলল
-“সরি আসলে সাত দিন তেমন কিছু না খাওয়ায় ব্রেডটা খেতেই বমি হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারিনি।”
শাহরিয়ার স্বাভাবিক কন্ঠেই টিস্যু চাইলো শাদির কাছ থেকে। টিস্যু দিয়ে হিয়ার মুখটা পরিষ্কার করে নিজের টিশার্টও পরিষ্কার করে হিয়াকে পানি খাইয়ে দিলো। হিয়াকে নিজের কাছে টেনে ওর বুকে নিয়ে বলল
-“চোখ বন্ধ করো। বেশিক্ষণ লাগবেনা এখনই বাসায় পৌঁছে যাবো আমরা।”
শাদি আর নিরবকে পিছনে তাকিয়ে থাকতে দেখে শাহরিয়ার ভ্রুকুচকে বলল
-“তোদের আবার কি হলো! সামনে ফিরে রাস্তা দেখ। তাড়াতাড়ি বাসায় চল দেখছিস না আমার বউয়ের কষ্ট হচ্ছে।”
নিরব কিছু না বলে ড্রাইভ করতে লাগল। আর শাদি বকবক করতে লাগল মনে মনে।
বাসায় ফেরার আগে শাহরিয়ার দুই বাসার মানুষকে একসঙ্গে তাদের বাসায় ডেকেছে। সবাই চিন্তিত হয়ে বসার রুমেই বসে ছিলো। কলিং বেল বাজতেই হিমিশা গিয়ে দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল শাহরিয়ারের কোলে হিয়াকে দেখে। শাহরিয়ার চুপচাপ বাসায় ঢুকে বসার রুমের সোফায় এনে হিয়াকে কোল থেকে নামিয়ে বসিয়ে দিলো। সবাই ইতিমধ্যে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেছে হিয়া দেখে তাও আবার এই অবস্থায়। শাহরিয়ার শান্ত কন্ঠে অবাক হয়ে থাকা হিমিশাকে উদ্দেশ্যে করে বলল
-“ভাবি একটু গরম দুধ নিয়ে আসো তো।”
হিমিশা দৌড়ে গিয়ে রান্নাঘর থেকে দুধ গরম করে নিয়ে এসে শাহরিয়ারের হাতে দিলো। শাহরিয়ার সযত্নে হিয়াকে খাইয়ে দিতে লাগল। অর্ধেক গ্লাস দুধ খেয়ে হিয়া না করলে শাহরিয়ার আর জোর করলো না। এবার সে চোখ ঘুরিয়ে তাকালো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা সবার দিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব ঘটনা খুলে বলল সে সবার কাছে। এমনকি চিঠিটাও যে তমা কপি করিয়ে লিখিয়েছে তাও বলল।
শাহরিয়ার মুখে সব শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। সবার ভিতরেই একটা অপরাধবোধ কাজ করতে লাগল। কেউ তো বিশ্বাস করতেই পারেনি মেয়েটাকে। কিন্তু শাহরিয়ার সবসময় বিশ্বাস করেছে মেয়েটাকে। আমেনা বেগম মেয়ের কাছে এসে মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন। হিয়া ফুপিয়ে কেঁদে দিলো। আয়েশা বেগম অপরাধী দৃষ্টি হিয়ার দিকে তাকালো। আস্তে করে হিয়ার হাত ধরে বলল
-“আমাকে তুই ক্ষমা করে দে মা। আমি তোকে…!”
হিয়া আয়েশা বেগমকে থামিয়ে দিয়ে বলল
-“মামুনি এভাবে বলোনা। আর পরিস্থিতি তো অন্যরকম ছিলো। আর মা কি কখনো মেয়ের কাছে ক্ষমা চায় বলো তো।”
আয়েশা বেগম এক চিলতে হেসে বুকে টেনে নিলো হিয়াকে। শাহরিয়ার এবার গম্ভীর কন্ঠে বলল
-“আর একটা কথা আমি আমার বউকে এখন আর ওই বাসায় যেতে দিবোনা। যেহেতু আমাদের বিয়ে আগেই হয়েছে। আমরা একসঙ্গে থাকবো। আর রইলো সবাইকে জানানো তা না হয় জানানো যাবে। আমি তোমাদের সবার কাছে পারমিশন চাইনি। আমার সিদ্ধান্ত জানিয়েছি। তাই আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না। আর জান চলো ঘরে যাবে। ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে রেস্ট নিবে। আর সবাইকে বলছি চোখে দেখা জিনিস যে সবসময় সত্যি হয় না এটা তোমার ভুলে যেও না।”
কথাগুলো বলেই শাহরিয়ার হিয়াকে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।
পরিশেষে আমরা চোখে যা দেখি সবসময় তা নাও হতে পারে। তাই সর্তকতার সাথেই চলা উত্তম।
#সমাপ্ত