প্রেমগুঞ্জন পর্ব-০২

0
160

#প্রেমগুঞ্জন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ২

আয়েশা বেগম অশ্রুসিক্ত চোখে বড় ছেলের দিকে তাকালো। রণবীরের বেশ খারাপ লাগল সেই দৃষ্টি। তবুও যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রাখলো। খানিকটা বাধ‍্য হয়েই আয়েশা বেগম নিজের রুমে গেলেন। রণবীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাইয়ের দিকে তাকালো। শাহরিয়ারকে দেখে বেশ মায়া হলো রণবীরের। ভাইয়ের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। পরনের পাঞ্জাবির পকেট হাতরে ফোনটা বের করে হিমিশাকে কল দিলো। দুবার রিং হতেই কল রিসিভ হলো। অপরপাশ থেকে কান্নাভেজা কন্ঠে হিমিশা বলে উঠলো
-“বলেন কি হলো? ছোটভাইয়ের কি অবস্থা!”

রণবীর তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে শাহরিয়ারের মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বলল
-“ডাক্তার ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে। এখন ঘুমাচ্ছে। আব্বুর কি খবর?”

-“আরো সময় লাগবে কি অবস্থা বুঝতে। ডাক্তার তো বলল ৪ ঘন্টার আগে কিছু বলা যাচ্ছেনা। রণ এমন কেন হলো আমাদের সাথে। খুব কি প্রয়োজন ছিলো এমনটা হওয়ার। ভালোই তো ছিলাম আমরা।”

-“দেখো হিমি নিজেকে শক্ত করো। তাছাড়া মাকে কে সান্ত্বনা দিবে বলো। মাকে তো এখন তোমাকেই দেখতে হবে। আল্লাহ আছেন। টেনশন নিও না ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।”

-“কিন্তু রণ!”

-“কিন্তু কিন্তু কিছু না আমি নিরবকে ‍বলছি তোমাকে আর মাকে বাসায় পৌঁছে দিতে। আমি হাসপাতালে যাচ্ছি।”

হিমিশা হাসপাতালের চেয়ারে বসে থাকা আমেনা বেগমের দিকে তাকালো। মায়ের মলিন আর ক্লান্ত মুখটা দেখে আর না করতে পারলো না। তার উপর ছেলেটাও কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। হিমিশাকে চুপ করে থাকতে দেখে রণবীর বলল
-“ছেলে ঘুমিয়েছে?”

-“হুম”

-“আর ভেবো না ছোট বাচ্চার ও ধকল গেছে অনেক। চিন্তা করোনা আমি যাচ্ছি।”

নিজের প্রিয়তমের সস্থিমূলক কথায় বেশ সস্থি পেল হিমিশা। আর কোনো বাক‍্য ব‍্যয় না করে সে রাজি হয়ে গেল।

রণবীরও হিমিশার রাজি হওয়াতে সস্থিরতা পেল।

——————————-

তীব্র মাথাব‍্যথা নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো শাহরিয়ার। দুইহাত দিয়ে সামনের চুলগুলো পিছে টেনে ধরলো। হুট করেই হিয়ার কথা মনে পড়তেই বিছানা থেকে নেমে পড়লো সে। বাহিরে যেতে নিবে তার আগেই আয়েশা বেগম শাহরিয়ারের পথ আটকে বলল
-“কোথায় যাচ্ছিস এতো রাতে! রাত দুটো বাজে।”

শাহরিয়ার ভ্রুকুচকে গম্ভীর কন্ঠে বলল
-“হিয়া বিপদে আছে আমার যেতে হবে।”

হিয়া নাম শুনতেই রাগে লাল হয়ে গেল আয়েশা বেগম। হিসহিসিয়ে বলল
-“ওই ফালতু চরিত্রহীন লম্পট মেয়ের কথা আর বলবিনা তুই। ওই মেয়ে…”

শাহরিয়ার আয়েশা বেগমকে থামিয়ে দিয়ে বলল
-“মুখ সামলে কথা বলো মা। ও আমার ভালোবাসা।”

দুতলার উপর থেকে শাহরিয়ারের দাদি বলল
-“ওই মেয়ের হয়ে কথা বলতে লজ্জা হচ্ছেনা তোর। চুপচাপ রুমে গিয়ে রেস্ট নে। ভুলে যা ওকে।”

শাহরিয়ারের রাগে হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এলো। নিজের রাগকে কন্টোল করতে না পেরে পাশে থাকা কাঁচের ফুলদানি মেঝেতে ছুড়লো। সাথে সাথে কাঁচের ছোট ছোট টুকরোই পুরো বসার রুমে ছড়িয়ে পড়লো। শাহরিয়ার রাগী কন্ঠে বলল
-“দাদিমা ও একদম পদ্মফুলের মতো পবিত্র। খবরদার ওকে নিয়ে কিছু বলবেনা। তাহলে আমি সম্পর্ক ভুলে যাবো। ও আমার জান। আমি বিশ্বাস করি ওকে।”

কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন পায়ে বাড়ি ছাড়লো সে। পায়ে কিছু কাঁচের টুকরো গেথে গেল। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে হিয়াকে খুঁজতে লাগল সে। আশপাশের জায়গা খুঁজে খুঁজে বেশ ক্লান্ত হয়ে গেছে। তবুও দমে যাচ্ছেনা সে। টলমল পায়ে হেঁটেই চলছে সে। পায়ের কাটা জায়গা থেকে রক্ত ঝরছে তার। গাড়ির তীব্র ফ্লাশে চোখ বুজে ফেলল সে। রাস্তা থেকে সরে যাওয়া বাদ দিয়ে চোখ বুজে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।

শাদি তাড়াতাড়ি করে ব্রেক চেপে নেমে পড়লো গাড়ি থেকে। রাগান্বিত কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল
-“পাগল হয়ে গেছিস। আর একটু হলেই তো মরতি। তখন কি হতো! রাতে কি শান্তিতে ঘুমাতেও দিবিনা। আন্টি কল দিয়ে বলল তুই নাকি রেগেমেগে বাড়ি ছেড়েছিস। কি রে তুই!”

হুট করে শাহরিয়ার শাদিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। শাদি মুহূর্তেই নরম হয়ে গেল। শাহরিয়ারের পিঠে হাত রেখে বলল
-“গাড়ি উঠ”

নিজের পিঠে উষ্ণ পানি অনুভূত হতেই শাদি নরম কন্ঠে আবারও বলে উঠলো
-“গাড়িতে উঠ। আমি তোর সঙ্গে খুঁজ‍বো হিয়া ভাবিকে। আর কান্নাকাটি করতে হবেনা। কিন্তু পরে যদি ঘটনা সত্যি হয় তখন কি করবি শাহি!

শাহরিয়ার শাদিকে ছেড়ে ধীর পায়ে গিয়ে গাড়িতে বসলো। শাদি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শাহরিয়ারের এমন পাগলামি দেখে বেশ রাগ হচ্ছে তার। এখনি কি হয়ে যেত। সে যদি ব্রেকটা না চাপতো। তবুও নিজের রাগকে কন্টোল করে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি শাদির বাসার দিকে যাচ্ছে দেখে শাহরিয়ার কিছু বলতে নিবে তার আগেই শাদি বলল
-“মা কসম তুই যদি এতো রইতে আমারে বলিস যে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে তোরে আমি মাইরা ফালামু। এতো রাতে পুলিশ স্টেশনেও কেউ তোমার লিগে বসে নাই। তাই চুপচাপ আমার বাসায় যাইবা। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিয়ে তারপর ঘুরবা। ফোন টাকা কিছুই তো আনো নাই। ঢং করো আমার লগে।”

শাহরিয়ার চুপ করে জানালার দিকে ফিরে আলোহীন অন্ধকার রাস্তাটা দেখতে লাগল। হিয়াকে ছাড়া তার জীবনটাও যেন এমন আলোহীন হয়ে পড়েছে। ভাবতেই অশ্রুকণা চোখের কোণ বেয়ে পড়লো। শাদি সবটা খেয়াল করেও চুপ করে রইলো। সে বুঝতে পেরেছে তার শক্ত বন্ধুটা একটা মেয়ের জন‍্য কতটা ভেঙে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। বেশ খারাপ লাগছে তার এই বন্ধুটার জন‍্য। বাবা মা মারা যাওয়ার পর থেকে বেঁচে থাকার প্রেরণা তো তার এই দুই বন্ধুই দিয়েই। বন্ধু তো নয় নিজের ভাই সমতুল‍্য ছেলেটা আজ কতটা কষ্ট পাচ্ছে।

শাদির বাসায় যাওয়ার পর শাদি জোর করে শাহরিয়ারে পায়ের ক্ষত পরিষ্কার করে দিয়েছে গালাগালি করে। ফজরের আযান দিতেই দুইজন একসঙ্গে নামাযে বসে পড়লো। শাদি খেয়াল করলো শাহরিয়ার মোনাজাতে শুধু একটা কথাই বলে যাচ্ছে
-“আমার ভালোবাটাকে ভালো রেখো মাবুদ।”

নামাজ শেষ হতেই শাদি একদৃষ্টিতে শাহরিয়ারের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো
-“এতো ভালোবাসিস ওকে।”

শাহরিয়ার মুচকি হেসে বলল
-“বের হবো চল।”

শাদি তপ্ত শ্বাস টেনে জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে দিলো। শাহরিয়ার বলল
-“কিছু টাকা দে তো।”

শাদি চোখ ছোট ছোট কে বলল
-“কেন ময়না খালি হাতে দেবদাস হয়ে বের হওয়ার সময় মনে ছিলো না যে টাকা লাগবে।”

শাহরিয়ার শাদির এমন অতিরিক্ত কথায় বিরক্তিতে চোখমুখ কুচকে বলল
-“দিবিনা বললেই হয়। তুই থাক আমি গেলাম।”

বলেই শাহরিয়ার হাঁটা দিলো। শাদি হতভম্ব হয়ে গেল। সবটা বোধগম্য হতে বেড সাইট টেবিলের উপর থেকে টাকা, ফোন আর গাড়ির চাবি নিয়ে দৌড় দিলো। হাঁপাতে হাঁপাতে শাহরিয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে বলল
-“হালা তুই এমন কেন!বললামই তো আমি ও যাবো তোর সঙ্গে।”

নিরব ভ্রুকুচকে গাড়ির ভিতর থেকে বলল
-“তোদের আবার কিহলো!”

শাহরিয়ার একপলক শাদির হাঁপানো মুখে দিকে তাকিয়ে বলল
-“কি হবে! তুই এখানে!”

নিরব শাহরিয়ারের ফোন আর কিছু টাকা এগিয়ে দিয়ে বলল
-“রণ ভাইয়া পাঠালো।”

শাহরিয়ার অজান্তেই হাসলো একটু। গাড়ি উঠতে উঠতে শাদিকে উদ্দেশ্য করে বলল
-“যাবি না গাড়ি টান দিবো।”

শাদি তাড়াহুড়ো করে গাড়ির পিছনের দরজা খুলে উঠে বসে বলল
-“কি রে তুই?”

শাহরিয়ার কোনো উত্তর করলো। নিরব লুকিং গ্লাসে শাদির দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে কথা বলে নিলো। নিরব গলা খাকিয়ে বলল
-“কোথায় যাবি!”

শাহরিয়ার আস্তে করে বলল
-“হাসপাতালে যেখানে আব্বু ভর্তি সেখানে।”

নিরব কথা না বাড়িয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হলো। হাসপাতালে হিয়ার আব্বুর কেবিনের সামনে আসতেই হিমিশা শাহরিয়ারকে দেখে উঠে দাড়ালো। শাহরিয়ার নরম কন্ঠে বলে উঠলো
-“আব্বুর জ্ঞান ফিরছে শুনলাম। আমি কি যেতে পারি।”

হিমিশা এই অগোছালো শাহরিয়াকে দেখে নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হচ্ছে। তার ছোট বোনটার জন‍্যই তো ছেলেটা আজ এতো অগোছালো। শাহরিয়ার উত্তরের আশা না করে ভিতরে চলে গেল।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে