#প্রীতিকাহন❤️
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২২
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
খাওয়া ফেলে উঠে দাঁড়ালো নবাব। সামনে পা বাড়িয়েও থেমে গেল। ফিরে এসে চেয়ারে ভর দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালো, “আমার ফোনের পাসওয়ার্ড ভয়ংকর কিছু ছিল না। যদি ভালোবাসতে আমায় তাহলে বুঝতে পারতে পাসওয়ার্ড ছিল মিষ্টি।… হ্যাঁ, আমার ফোন, ই-মেইল আইডি, ফেইসবুক আইডি, এমনকি ব্যাংকের কাজকর্মেও আমি এই মিষ্টি নামক পাসওয়ার্ডই ব্যবহার করি। এমনটা কবে থেকে করা শুরু করেছি জানো? যেই দিন আমার হৃদয় তোমাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে কবুল করেছিল সেই দিন থেকে। কিন্তু আফসোস এসবের মূল্য আমাকে এভাবে পেতে হলো।”
নবাব চলে গিয়েছিল দ্রুত পায়ে। ওর চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে যেই কান্নার ঝড় ঘুরপাক খাচ্ছিলো মিষ্টির হৃদয়ে, সেটা চাপা দিতে না পেরে টেবিলের ওপর হাত রেখে মুখ গুঁজে দিয়েছিল মিষ্টি। আর সাথে সাথেই অঝোরে কেঁদে উঠেছিল।আশেপাশের মানুষ তাকিয়ে দেখছে– এই ভাবনা এলো না তার মাঝে কারণ তার মন কেবল একটা কথাই আওড়াচ্ছে, “আমাকে তুমি ভুল বুঝলে নবাব, ভুল বুঝলে।”
“ধ্যাত!” হঠাৎ বিরক্তি ভরা কন্ঠে ছোট্ট একটা শব্দ কানে আসতেই মুখ ফিরিয়ে নবাবকে দেখলো মিষ্টি। ক্যাপ আর মাস্কের জন্য চেহারা দেখা না গেলেও সে বুঝতে পারছে নবাব এখন তিক্ত মেজাজে আছে। রেস্টুরেন্টে ঘটে যাওয়া কাহিনির পর মিষ্টি আর নবাবের সাথে কথা বলেনি। নবাবও তেমন আগ্রহ দেখায়নি। তবে প্রয়োজনে এটা সেটা বলেছিল।
“কী হয়েছে?” নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে মিষ্টি নবাবকে জিজ্ঞেস করলো কিন্তু নবাব জবাব না দিয়ে নিজের পকেটে হাত চালাতে ব্যস্ত। নবাবের হাবভাবে মিষ্টি ঠাওর করলো কিছু একটা খুঁজছে নবাব। তাই আবার জিজ্ঞেস করলো, “কী হয়েছে বলছো না কেন?”
মুখ ফিরিয়ে ফুঁসে উঠলো নবাব, “তোমাকে বললে কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?”
যথেষ্ট শান্ত গলায় মিষ্টি জবাব দিলো, “রেস্টুরেন্টে সবার সামনে আমার চরিত্র উপস্থাপন করলে। কিচ্ছুটি বলিনি। তোমার যদি মনে হয় এত কথা শোনানোর পরও তোমার মন ভরেনি। তাহলে একটা মাইক হাতে দাঁড়িয়ে পড়ো। স্টেশনের সবাইকে জানিয়েও দাও আমি একটা রাক্ষসী, বেইমান আর তোমার সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ আমি ছিবলে ফেলে দিচ্ছি। তোমাকে আমি…” থেমে গেল মিষ্টি। প্রচন্ড কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। এদিকে মিষ্টির হঠাৎ কান্নায় নবাবের রাগ উবে গেল। সে হতভম্বের মতো বসে রইলো। কিছু বলার জন্য ভাবছে কিন্তু অগোছালো হওয়া শব্দভাণ্ডারে ডুব দিয়েও কোনও শব্দ তুলতে পারলো না।
“নবাব, আমি তোমার মৃত্যু চাই– এটা বলার আগে আমাকে গুলি করে মেরে দিতে পারলে না? আমি বেইমানি করেছি– এমন বলার আগে একবারও আমার কথা ভাবলে না?” নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে মিষ্টি জানতে চাইলো কিন্তু নবাব প্রশ্নের বিপরীতে মাথা নুইয়ে নিলো।
“আমি তোমার অজান্তে ফোন নাড়াচাড়া করেছি কিন্তু তোমাকে মারার পরিকল্পনা করতে নয়। আমাদের পরিবারের হালচাল জানতে। তোমার এবং তোমার পরিবারের জন্য আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল। তাই ভেবেছিলাম, আমি সবাইকে বুঝিয়ে এখান থেকেই তোমাকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিবো যাতে তোমার কোনও ক্ষতি না হয়। কিন্তু তুমি তো আমাকে বেইমান বানিয়ে দিলে।” মিষ্টি বলে গেল আর নবাব নিরবে শুনে গেল।
“সেই ছোট্টবেলা থেকে তোমাকে ভালোবাসি। আমার ভালোবাসাটা হয়ত বোন হিসেবে। তাই বলে ভালোবাসি না এটা বলতে পারলে?… আমার মতো স্বামী খাদক মেয়ের জীবন কেমন হতে পারে তুমি কি দেখোনি নবাব?”
“ওহ্… মিষ্টি… থামো এবার…” একটা কষ্ট ভেসে এলো নবাবের কন্ঠে কিন্তু মিষ্টি থামলো না। পূর্ন দৃষ্টিতে নবাবকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কেন থামবো? আমি তো এমনই; স্বামী খাদক, তাই না বলো? আজকে তো আবার নতুন নাম পেলাম, বেইমান।” শেষ বাক্যে তাচ্ছিল্যের সুরের সাথে হালকা হেসে উঠলো মিষ্টি। এতে নবাব নিজের মাঝে থাকা অপরাধ বোধটা আবার জাগ্রত হলো। আশেপাশে তেমন কোনও মানুষ নেই। তবে যারা আছে, তারা মিষ্টি এবং নবাবের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে যেন সার্কাস দেখছে।
“আর পরিবারের চিন্তা করি শুধু– এটাই তো বলেছিলে। যদি পরিবারের চিন্তা থাকতো তবে তোমাকে কবুল বলে গ্রহণ করতাম না।” মিষ্টির কথার প্রেক্ষিতে নবাব এবার চোখ তুলে তাকালো, “কবুল বলে হয়ত আমার ওপর করুণা করলে। তুমি তো জানোই আমি যত উগ্রবাদী মানুষই হই না কেন তোমায় একটা আঁচড়ও লাগতে দিবো না।”
“নবাব, কেউ আমায় কোনওদিনও বুঝলো না। ভেবেছিলাম তুমি হয়ত আমায় বুঝবে কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস দেখো, তুমিও আমাকে বুঝলে না।”
“ভুল বললে তুমি…” হাত দেখিয়ে নবাবকে থামিয়ে দিয়ে মিষ্টি বললো, “কোনটা ভুল আর কোনটা সঠিক, সেই ব্যাখ্যা আমি আর এখন শুনতে চাই না নবাব। তুমি যেই কাজ করছিলে, সেটাই করো আর আমাকে একা থাকতে দাও।” এই বলে মিষ্টি খানিকটা সরে গিয়ে বসলো মুখ ফিরিয়ে। ওকে অপলক চোখে দেখে পুনরায় নিজের পকেটে হাত চালালো নবাব। এরপর যেন নিজেকেই বলে উঠলো, “ফোনটা তবে হোটেলেই ফেলে এলাম?”
.
উদয়ন এক্সপ্রেস চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে সিলেট প্রস্থান করলো রাত নয়টা চল্লিশ মিনিটে। ট্রেন ছেড়ে দিতেই সিটে হেলান দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো নবাব।
“আবর্জনা সিলেটে ফেলে রেখে যাচ্ছি বলে বড্ড শান্তি লাগছে।” আনমনে কথাটা বলে মিষ্টিকে দেখলো নবাব। স্টেশনে উত্তেজিত হওয়ার পর মেয়েটা ওর সাথে আর একটা কথাও বলেনি। এখন নবাবের খুব ইচ্ছে হচ্ছে মিষ্টির সাথে কথা বলতে কিন্তু কোথাও একটা বাঁধা অনুভব করে ইচ্ছে বাতিল করলো সে।
আগে যত্রতত্র ঘুম আসতো না নবাবের চোখে। কিন্তু যবে থেকে সে মিষ্টিকে নিয়ে ছোটাছুটি করছে, তবে থেকে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে দিলেই ঘুম এসে ধরা দেয়। কখন যে চোখের পাতা এক বাঁধনে আবদ্ধ হয়েছে, সেটা টের পায়নি নবাব। হঠাৎ একটা গোঙানির শব্দে তার ঘুম উড়ে যেতে সে সোজা হয়ে বসে। মিষ্টির দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠে নবাব, “এই মিষ্টি, কী হয়েছে তোমার?”
দুই হাতে মাথা চেপে মিষ্টি চাপা কান্নায় কুঁকড়ে উঠছে। অনেক কষ্টে সে অস্ফুটস্বরে বললো, “কি… কিছু হয়নি… আ… আমার।”
“না হলে এমন করছো কেন? এই মিষ্টি, কী হয়েছে বলো না?” অস্থির হয়ে উঠলো নবাব।
সিটে মাথা রেখে আবার সরিয়ে নিচ্ছে। চোখ-মুখ খিঁচে কোনওমতে জবাব দিলো, “মা…মাথা ব্যথা করছে ভী…ভীষণ।”
“কেন? হঠাৎ মাথা ব্যথা করছে কেন?” হঠাৎ নবাবের হুঁশ হলো মিষ্টির হাইপোটেনশন আছে। আগে প্রায়শই ব্লাড প্রেসার লো হতো আর মাথা ব্যথায় ছটফট করতো। দুপুরে মিষ্টি কিছু খায়নি বিধায় এমনটা হচ্ছে আর এটা মাথায় আসতেই অনতিবিলম্বে নবাব উঠে দাঁড়ালো। ব্যাগ থেকে কিছু শুকনো খাবার আর পানির বোতল হাতে মিষ্টিকে বললো, “এগুলো খেয়ে নাও। দেখবে ঠিক হয়ে গেছে।” মিষ্টি কোনও জবাব দিলো না। নবাব এসব বলার আগে যেমন বসে ছিল মাথায় হাত চেপে এখনও তেমনই বসে আছে মিষ্টি।
“এই মিষ্টি, খেয়ে নাও। তোমার ব্লাড প্রেসার হয়ত লো হয়ে গেছে। আমার পাগলামির জন্য দুপুরে খাওয়া হয়নি তোমার। তাই তো এমনটা হলো। এখন আর না খেয়ে থেকো না।” শেষের দিকের কথাগুলোতে নবাবের কন্ঠ ভারী শোনালো। নিজের অসহ্য যন্ত্রণার মাঝে মিষ্টি নবাবের কষ্ট অনুভব করতে না পারলেও বুঝতে পারছে, মিষ্টির এখন কিছু খাওয়া দরকার।
হাত বাড়িয়ে প্রথমে পানির বোতল নিলো মিষ্টি এরপর অন্য হাতে মুখের হিজাব তুলে দিতেই নবাবের হৃদয় চাপা কষ্টে কুঁকড়ে উঠলো। ফ্যাকাশে আর ভেজা চোখের এই মুখটা নবাবকে বাধ্য করলো নিজেকে প্রশ্ন করতে, “কী করলি নবাব তুই? রাগ আর অভিমানে মেয়েটার এমন হাল করলি? এটাই কি তোর ভালোবাসা?”
কষ্টটা বুকে ভারী হতেই চোখ বুজে সেটা হৃদয় গহীনে আরও চাপা দিতে চাইলো নবাব। শুকনো মুখ দিয়ে যখন জল গড়িয়ে পড়লো মিষ্টির গলনালি দিয়ে এতেই কিঞ্চিৎ পরিবর্তন হয়ে গেল মিষ্টির মুখাবয়ব। কুয়াশা ভেদ করে আসা একরত্তি সূর্যের আলোর মতো স্বস্তি দেখা দিলো নবাবের মনে।
“এবার এগুলো খেয়ে নাও।” নরম কন্ঠে নবাব বললো এবং পাউরুটি আর কলা এগিয়ে দিলো। মিষ্টি নিঃশব্দে একটা পাউরুটি নিয়ে দাঁত বসিয়ে দিলো। শুকনো পাউরুটি যখন দাঁতের তলায় পিষে দলা হলো, তখন সেটা গিলতে গিয়ে পানির প্রয়োজন হলো। পানির সাহায্যে পাউরুটি পাকস্থলীতে পাঠিয়ে মিষ্টি এবার তাকালো নবাবের দিকে। কথা বলতে তার ইচ্ছে করছে না কারণ সেই শক্তিই যেন নেই মিষ্টির দেহে তবুও বললো, “তুমিও খাও। আমার একা খেতে ভালো লাগছে না যদিও একাই খাচ্ছি।”
ঠোঁট প্রসারিত হলো নবাবের। মিষ্টির দিকে তাকিয়েই সে একটা পাউরুটি হাতে নিলো। আলতো কামড়ে যখন আস্ত পাউরুটিকে ভাগ করলো, তখন ফ্যাকাশে চেহারায় হালকা হেসে মিষ্টিও খেতে শুরু করলো।
“ভাই, এমন করছো কেন?” ম্যাসেজ পাঠিয়ে জবাবের অপেক্ষা করছে মিষ্টি। এখন রাত এগারোটা। পড়াশোনা নেই বিধায় আজকে তাড়াতাড়িই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে মিষ্টি। ভার্সিটিতে পড়াশোনা করার সুবাধে এখন তার নিজের একটা চকচকে স্মার্টফোন আছে। এখন সেই চকচকে ফোন শোভা পাচ্ছে তার সরু আঙুলের ভাঁজে। আজকে হঠাৎ করে মান-অভিমানের পালা শুরু হয় নবাব এবং মিষ্টির মাঝে। অহেতুক রেগে গিয়ে নবাব বলেছে, “খাবো না আমি আজকে রাতে।”
“বাচ্চাদের মতো এমন কেন করছো? আঠারো হয়ে গেছে তোমার। এখন নিশ্চয়ই বাচ্চা নও তুমি।”
“বাচ্চা যখন নই, তখন যেটা বলছি সেটা নিয়ে আনসান করছো কেন? তুমি যে আমাকে ভাই ডাকো আমি তাতে কিছু বলি? তোমার ভালো লাগে তাই তুমি ভাই ডাকো। আমার আপু ডাকার ইচ্ছে নেই তাই আমি ডাকবো না।”
আজকে হঠাৎ করে নবাব ম্যাসেজে মিষ্টিকে নাম ধরে জিজ্ঞেস করে, “এই মিষ্টি, তুমি কি এখনই ঘুমিয়ে পড়বে?” এতে খুব বেশি অবাক হলেও মিষ্টি তার মতো করে জবাব দিয়েছিল, “না ভাই।”
“রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ কি মিষ্টির?” এবার আর মিষ্টি চুপ থাকতে পারেনি, “ভাই, তুমি হঠাৎ করে আমাকে আমার নাম ধরে ডাকছো কেন?”
“কেন? কী হয়েছে তাতে?”
“তুমি তো আমার চেয়ে ছোট।” মিষ্টি জবাব দিয়েছিল।
“ছোট তো কী হয়েছে? আমি তোমার ছোট বলে কী আপু বলতে হবে? আমি তো তোমার বন্ধু আর বন্ধুকে কেউ আপু বলে?”
চলবে…
#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২৩
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
“দেখো ভাই, আমি যেহেতু তোমার বড় তাই আমাকে আপু বলেই ডাকতে হবে।” বেশ কিছুক্ষণ ভেবে মিষ্টি ম্যাসেজ পাঠালো নবাবকে আর প্রতিত্তোরে নবাব জানালো, “ঠিক আছে, যখন চাও না আমি তোমাকে বন্ধু মনে করি তবে আমি আজকে রাতে খাবো না।” এতেই মিষ্টি ঘাবড়ে গিয়ে চুপটি করে আছে। ভাবনার দিঘির গভীর হচ্ছে তার। অতিরিক্ত ভাবনায় মত্ত হলে আপনার থেকে মিষ্টির ডান হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল মুখে চলে যায়। নখ আর দাঁতের মিলন হতেই সে চোখ চঞ্চল করে আর সমাধান খুঁজতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে৷
“তুমি কি চলে গেছো?” মিষ্টি অনেকক্ষণ যাবত ম্যাসেজ পাঠায়নি বলে নবাব জানতে চাইলো। মুখ থেকে হাত সরিয়ে মিষ্টি টাইপ করতে শুরু করলো, “তুমি না খেলে শরীর অসুস্থ হবে সেটা তোমার অজানা নয় তবুও এমন জেদি আর আপসহীন কেন হচ্ছো আজ?” এবার নবাবের ম্যাসেজ আসতে দেরি হলো।
“তোমাকে তো বলছি না আমার জেদ দেখতে৷ গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো তুমি।” এমন ম্যাসেজে মিষ্টির বেশ রাগ হচ্ছে। তাই চোখ-মুখ খিঁচে বাতাস টেনে নিশ্বাস ছাড়লো। নিজেকে মানানোর চেষ্টায় কিছু সময় চোখ বুজে পার করলো।
“নবাব, তুমি না খেলে কতটা অসুস্থ হবে জানি না কিন্তু আমার যে কষ্ট হবে সেটা বুঝেও এমন করছো। ঠিক আছে, মেনে নিলাম তোমার আবদার।” জোরপূর্বক রাজি হলো মিষ্টি।
“সত্যি?”
“হুম, সত্যি।” ম্যাসেজটা টাইপ করতে গিয়ে ভীষণ রাগ হলো মিষ্টির কিন্তু জেদি এবং আপসহীন নবাবের কাছে হার স্বীকার করলো।
“এই মিষ্টি, তুমি না সত্যিই মিষ্টি।”
আজ চলন্ত ট্রেনে বসে খেতে গিয়ে সেদিনের কথা মনে পড়লো নবাবের। নত দৃষ্টিতে খাবার দেখে হালকা এসে উঠতেই সেটা নজরে এলো মিষ্টির, “কী হলো? হাসছো কেন হঠাৎ?”
মুখের হাসি আরও ঝলমলে উঠলো নবাবের আর সেটা বহাল রেখে জবাব দিলো, “কিছু মিষ্টি অতীত আচম্বিতে হৃদয় নাড়িয়ে দিলো বলে।”
.
ভোর ছয়টা নাগাদ উদয়ন এক্সপ্রেস সমস্ত চঞ্চলতা থামিয়ে নিশ্চুপ হলো চট্টগ্রামে। স্টেশনের পরিবেশে থমথমে হিম হাওয়া বইছে। লোকজনের চলাচল অতি অল্প কেবল উদয়ন এক্সপ্রেস বয়ে যাদের নিয়ে এসেছে, তারাই স্টেশনের হাওয়া গরম করছে।
সারারাত ঘুম হয়নি কিন্তু ঠিক সময়ে জেগে উঠেছিল নবাব। তবে বিপত্তি ঘটেছে মিষ্টিকে নিয়ে। ওকে ডেকে তুলতে গেলেই মিষ্টি নবাবের বাহু আঁকড়ে ধরে। হিজাব পড়া সত্ত্বেও ঘুমের ঘোরে নবাবের বাহুতে নাক ঘষে বলে, “ঘুমাবো আমি।”
নবাব হালকা হেসে বলেছিল, “ঘুমাবে, কিন্তু ট্রেন এবার ছাড়তে হবে মিষ্টি। দেরি করলে তো কোনও কিছু পাওয়া না-ও যেতে পারে।” মিষ্টি কোনও জবাব দেয়নি। হতাশ হলেও ঘুমন্ত মিষ্টির উপর নবাব ক্রোধিত হয়নি। শেষমেষ ঘুম পরিহার করে নবাবের সঙ্গ নিয়ে ট্রেন ছাড়লো মিষ্টি।
ট্রেন থেকে নেমেই নবাবের মনে প্রথম যে প্রশ্ন এলো, “এতও সকালে কি সিএনজি পাওয়া যাবে?” ভাবনার সাথে তাল মিলিয়ে রেখে বেশ দ্রুত পায়ে স্টেশনের বাইরে চলে এলো তারা। বাইরের পরিবেশ দেখে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “এখানে তো বাসের ব-ও নেই। যাবে কীভাবে?”
মিষ্টির ঘুম এখনও কাটেনি ওর হেলদোল শরীর তারই প্রমাণ বহন করছে। সেটা বুঝতে পেরে নবাব মাস্কের আড়ালে হেসে নিয়ে জবাব দিলো, “কখনও শুনেছো স্টেশনের বাইরে বাস পাওয়া যায়?” নবাবের প্রশ্নে মিষ্টির চৈতন্য হলো কিন্তু সে কিছু বলবার আগেই নবাব একটা সিএনজির দিকে ছুটে গেল। মিষ্টিও নবাবের পিছু নিলো আর সব ঠিকঠাক হতে সিএনজির সিটে গা এলিয়ে দিলো।
সশব্দে ছুটে চলেছে সিএনজি। চট্টগ্রামের রাস্তায় এখন ভিড় নেই তবে ফাঁকা বললেও ভুল বলা হবে। কর্মের সন্ধানে বেরিয়ে পড়া মানুষের পদভারে রাস্তাঘাট ধীরে ধীরে গিজগিজ করে উঠছে।
“এটা চট্টগ্রাম, না?” হঠাৎ সিএনজির শব্দ ভেদ করে মিষ্টির গলা শুনতে পেল নবাব। সে অন্যমনস্ক হয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। এখন জবাব দিতে তাকালো মিষ্টির পানে, “হ্যাঁ, এটা চট্টগ্রাম।”
“এখানে থাকবে?”
“নাহ।” জবাব দিয়ে সোজা হয়ে বসলো নবাব।
মিষ্টির ইচ্ছে করছে নবাবের কাছ থেকে জানার জন্য, তারা এখন কোথায় যাবে? কিন্তু নবাব যে বলবে না সেটা মিষ্টি জানে। তাই সে কথা না বাড়িয়ে নিরবতাকে আঁকড়ে ধরলো। সিএনজির বাইরে থাকা আস্ত এই চট্টগ্রাম শহরের দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে জানতে চাইলো, “এবার আমার গন্তব্য কোথায়?”
“ফয়েজ লেক।” মিষ্টি নিজেকে প্রশ্ন করেছিল কিন্তু ওর মনের প্রশ্নের উত্তর দিলো নবাব। অবাক চাহনিতে তাই জানতে চাইলো, “মানে?” তাকালো নবাব আর মাথার ক্যাপ খুলে দিতেই প্রয়োজনের চেয়ে বড় হওয়া চুল বাতাসের তোরে এলোমেলো হয়ে গেল।
“আমরা এখন চট্টগ্রামের ফয়েজ লেকে যাচ্ছি।”
“তারমানে চট্টগ্রামেই থাকছো?” দ্বিধান্বিত হচ্ছে মিষ্টি।
চুলে হাত বুলিয়ে নবাব পুনরায় ক্যাপ বসিয়ে দিলো মাথায়, চুল সামলাতে। কন্ঠে একটু গাম্ভীর্য টেনে জবাব দিলো, “হয়ত।”
“সকালবেলা এমন ভণিতা না করলেই পারো। তুমি না বলতে চাইলে তো আমি জোর করি না, তাই না?”
হঠাৎ শরীর দুলিয়ে হেসে উঠলো নবাব আর এমন হাসি দেখে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “আশ্চর্য! এমন করে হাসছো কেন? আমি কি হাসার মতো কিছু জিজ্ঞেস করেছি?”
স্বাভাবিক গলায় জবাব দিলো নবাব, “নাহ।”
“তাহলে?”
“আসলে তুমি না অল্পতেই রেগে যাও। তোমাকে রাগানো খুব সহজ তাই।” মিষ্টির এবার সত্যি খুব রাগ হচ্ছে কিন্তু এই সাত-সকালে রাগ দেখানোর কোনও ইচ্ছে নেই ওর। তাই আবার মন ভাসালো অচেনা শহরের অজানা বাতাসে। কিন্তু এবারও নবাবের কন্ঠ ভেসে এলো, “হয়েছে। আর বাইরে তাকিয়ে মন খারাপ করতে হবে না।”
ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো মিষ্টি, “তো কী করবো শুনি?”
“আমি তোমাকে ফয়েজ লেক সম্পর্কে বলছি, সেটাই মন দিয়ে শোনো।”
“তুমি কি ইতিহাসবেত্তা?” কন্ঠ গম্ভীর শোনালো মিষ্টির।
“এইসব কেন হতে যাবো?”
“তো যেখানে নিয়ে যাও, সেখানের ইতিহাস শোনাতে বসে যাও কেন?”
“কী অবাক কান্ড! একটা জায়গায় যাবে আর সেখানের ইতিহাস জানবে না?” কিঞ্চিৎ অবাক হলো যেন নবাব।
“নাহ, জানবো না। কারণ ইচ্ছে নেই আমার।”
“তো ফয়েজ লেক সম্পর্কে শুনবে না তুমি?”
“আমি বারণ করলে কি তুমি থামবে?”
“অবশ্যই না।”
“তো আমার মাথায় বসে ডুগডুগি বাজিয়ে ইতিহাসবেত্তা হয়ে যাও।” বিরক্তিতে মুখ ঘুরিয়ে নিলো মিষ্টি আর এতে হেসে কুটিকুটি হয়ে নবাব বললো, “সকাল সকাল আমার ডায়াবেটিস বাড়িয়ে দিও না তো যদিও ডায়াবেটিস হয়নি। কিন্তু তোমার জন্য হয়ত এবার হয়ে যাবে।” নবাবের কথা শুনে আঁড়চোখে তাকালো মিষ্টি। ওর চাহনিতে নবাব রোমাঞ্চিত হওয়ার ভঙ্গিতে বলে উঠলো, “হায়!” এরপর ডান হাতে মাথার ক্যাপ ধরে হেসে উঠলো।
সিএনজির ড্রাইভার শুরু থেকেই সবকিছু লক্ষ্য করছে কিন্তু মাঝ বয়সী এই লোকের ভাড়া নিয়ে কথা। তাই এসব বিষয়ে ধ্যান দেওয়ার চেয়ে সিএনজি চালাতে মনোযোগ বেশি। তবে আঁড়চোখে মিষ্টি আর নবাবকে দেখে আনমনে বলে উঠেছিল, “আজকালকার ছেলেমেয়েদের লজ্জা-শরমের বালাই নাই।”
মিষ্টি ভেবেছিল নবাব হয়ত ফয়েজ লেক নিয়ে আর কোনও কথা বাড়াবে না। তাই সে নিজের মতো করে চট্টগ্রামের হাওয়া খেয়ে মন ভরাচ্ছে। কিন্তু হাসি থামিয়ে নবাব নিজের মতো করে বলতে শুরু করলো, “তো যা বলছিলাম।”
মিষ্টির খুব বিরক্ত লাগছে এসব শুনতে কারণ তার এখন ঘুমের প্রয়োজন। কিন্তু সে নবাবকে সেটা না বুঝিয়ে এবং কোনওরূপ বাঁধা প্রয়োগ না করে কেবল শুনে গেল। এদিকে নবাব বলে চলেছে, “ফয়েজ লেক চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলস্টেশনের অদূরে খুলশি এলাকায় অবস্থিত একটি কৃত্রিম হ্রদ। চট্টগ্রামের জিরো পয়েন্ট থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখান থেকে কতদূর তা আমার অজানা। এটি ১৯২৪ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কতৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে খনন করা হয় এবং সে সময় পাহারতলী লেক হিসেবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে লেকটি ব্রিটিশ প্রকৌশলীর নামে নামকরণ করা হয় যিনি এটির নকশা তৈরিতে সহায়ক ছিলেন। বেশ বড় মাপের (৩৩৬ একর জমি) এই লেকটি পাহাড়ের এক শীর্ষ থেকে আরেক শীর্ষের মধ্যবর্তী একটি সংকীর্ণ উপত্যকায় আড়াআড়ি ভাবে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে সৃষ্ট। আড়াআড়ি ভাবে নির্মিত বাঁধটি চট্টগ্রাম শহরের উত্তর দিকের পাহাড় শ্রেণী থেকে নেমে আসা পানির প্রবাহের দিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এই লেকটিকে সৃষ্টি করেছে। ফয়েজ লেকের পাশেই আছে চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় বাটালি হিল। লেকের আশেপাশের মনোরম পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে প্রতি বছর দেশি বিদেশি বহু পর্যটক ছুটে আসেন। যেমন আমরাও ছুটে এলাম।”
এবার আর চুপ করে রইলো না মিষ্টি, “সৌন্দর্যের টানে আমরা আসিনি। তবে তুমি টানের চটে আসতেই পারো কিন্তু আমাকে টেনেহিঁচড়ে আনা হয়েছে। সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই তোমার এসব কথা কচুপাতার চেয়ে খুব বেশি দামী হবে না।”
মিষ্টির কথায় আবারও হেসে উঠলো নবাব। সে নিজেও বুঝতে পারছে না সকাল সকাল তার এমন হাসি পাওয়ার কারণ কী? অথচ মিষ্টির কথা তেমন হাস্যকর নয় বোধহয় নাইট্রাস অক্সাইড শরীরে কোনও উপায়ে প্রবেশ করেছে তাই এমনটা হচ্ছে। নবাবকে খুব বেশি হাসতে দেখে এবার আর মিষ্টির মাঝে রাগ এলো না বরং আচম্বিতে বিস্ময় এসে ঝাপটে ধরলো, “কী হয়েছে তোমার বলো তো? এমন পাগলের মতো হাসছো কেন?”
একটু সময় নিয়ে হাসি থামিয়ে বললো, “আমি নিজেও অবাক এত হাসছি কেন? বোধহয় নাইট্রাস অক্সাইড শরীরে ঢুকেছে।”
“মানে?” বুঝতে না পেরে।
“আরে লাফিং গ্যাস। যেটা শরীরে প্রবেশ করলে মানুষ শুধু হাসতেই থাকে। হাজারও দুঃখ কষ্টেও পাগলের মতো হাসে।” হঠাৎ কন্ঠ নরম করে নবাব আবার বললো, “হয়ত তুমি আমার নাইট্রাস অক্সাইড, যাকে অনুভব করলেও আমার হৃদয় হেসে উঠে।”
.
অচেনা শহরের পথঘাট পেরিয়ে মিষ্টি আর নবাবকে সিএনজি এসে নামিয়ে দিয়ে গেল ফয়েজ লেকে। সিএনজি থেকে নেমেও মিষ্টির কৌতূহলের অন্ত নেই। সে আগে কখনও ফয়েজ লেকের নাম শুনেনি। তাই ধারণাও নেই এই জায়গা সম্পর্কে কিন্তু জোরপূর্বক হলেও নবাবের কাছ থেকে ফয়েজ লেক সম্পর্কে জানতে পেরে মোটামুটি একটা ধারণার সৃষ্টি হয়ে গেছে মস্তিষ্কে।
থাকার জন্য নবাব হানিমুন কটেজ পছন্দ করেছে তবে ফয়েজ লেকে রিসোর্টও আছে। কিন্তু তারা যেহেতু নবদম্পতি এবং একপ্রকার হানিমুনেই আছে। তাই রিসিপশনের লোকটা জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথেই হানিমুন কটেজের কথা জানিয়েছে নবাব। পাশে থাকা মিষ্টি অবশ্য ভ্রু সংকুচিত করেছিল হানিমুন শব্দ শুনে কিন্তু সেটা সবার আড়ালে।
রুমে এসেই মিষ্টি বিছানায় বসে পড়লো। ওর চোখ বড্ড জ্বলছে হয়ত ঘুম কম হওয়ার কারণে। ওকে ঝিম মেরে বসে থাকতে দেখে নবাব জিজ্ঞেস করলো, “কী হলো? বসে পড়লে কেন?”
“ঘুম পাচ্ছে খুব।”
…চলবে।