#প্রীতিকাহন❤️
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২০
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
নবাব সামনে তাকিয়ে সবুজের সমারোহে চোখ ভাসলো আর বাতাসে মন দুলিয়ে বলতে লাগলো, “বিছানাকান্দি মূলত একটি পাথর খনি। ভারতের খাসিয়া পর্বত থেকে পানির প্রবাহ এসে এখানে মিলিত হয়েছে এবং হ্রদের সৃষ্টি করেছে। এই হ্রদ পিয়াইন নদীর সাথে মিশেছে। এই হ্রদ নিয়ে আসে প্রচুর পাথর। বিছানাকান্দির এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে পাথর আর পাথর। দেখে মনে হবে যেন এক পাথরের বিছানা। নদীর স্বচ্ছ পানি, পাহাড় আর আকাশ মিলিয়ে এখানকার সৌন্দর্য অসাধারণ।”
.
“একটু বিশ্রাম নিয়ে গোসল করে নিবে। আজকে দুপুরের খাবার তাড়াতাড়ি সারতে হবে।”
সকালের নাস্তা শেষ করে সদ্য পা রেখেছে নবাব আর মিষ্টি তাদের রুমে। আর রুমে এসে দাঁড়াতেই নবাব এসব বলছে বলে মিষ্টি জানতে চাইলো, “কেন?”
“গোছগাছ করতে হবে।” জবাব দিয়ে বিছানায় বসলো নবাব। এদিকে মিষ্টি মুখের হিজাব খুলতে গিয়ে বললো, “গোছগাছ? কীসের জন্য?”
“আজকে হোটেল ছেড়ে দিবো। আমরা সিলেট ছেড়ে দিচ্ছি আজকে রাতে।”
মিষ্টির মুখের হিজাব সম্পূর্ণ খোলা হয়ে গেছে। কালো কাপড়টা এখন হাতের মুঠোয় বন্দী করে সে অবাক চোখে নবাবকে দেখলো, “সিলেট ছেড়ে দিচ্ছি মানে? তুমি তো গতকালকে বললে পরশুদিন যাবে মানে আগামীকাল।”
বিছানায় হেলান দিলো নবাব, “গতকালকে পরশুদিনের কথা বলেছিলাম আর এখন বলছি আজকে রাতের কথা। অসুবিধা আছে কোনও?” রাগী দৃষ্টিতে নবাব তাকালো মিষ্টির দিকে। মিষ্টি বুঝতে পারছে না নবাব হঠাৎ করে এমন ব্যবহার কেন করছে?
“নবাব, আমার অসুবিধা হলেও তোমাকে কখনও অসুবিধায় ফেলবার ইচ্ছে নেই আমার। কিন্তু আমাকে বলতে চাও না ঠিক আছে। তবে মিথ্যা বলে কেন…” মিষ্টির কথার মাঝে নবাব নির্বিকায় গলায় বললো, “মিথ্যা ভাবো আর সত্যি আমার আপত্তি নেই কিন্তু আমি কোনেও ঝামেলাকে নিমন্ত্রণ করতে চাই না।”
“তোমার সত্যিই মনে হয় আমি ঝামেলা ডাকতে পারি?” অবিশ্বাসের গলায় জানতে চাইলো মিষ্টি।
এক গাল হেসে নবাব তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, “মেয়েদের ওপর কোনও বিশ্বাস আছে? তারা কখন কী করে?” নবাবের এমন তিক্ত কথায় মিষ্টি আঘাত পেলেও ভয়ে ভেতরটা কেঁপে উঠলো। আনমনে সে নিজেকে প্রশ্ন করলো, “নবাব কি কিছু টের পেয়ে গেছে? সকাল থেকে খুব একটা কথা বলছে না আবার এখনও কীসের সব ইঙ্গিত দিচ্ছে?”
মিষ্টি নিজেকে যথেষ্ট সামলে মুখের চেহারায় নরম ভাব ফুটিয়ে বললো, “অবিশ্বাসী মনে হচ্ছে আমাকে তোমার?” নবাব জবাব দিলো না। মিষ্টিকে দেখে নিয়ে মোবাইলে ব্যস্ত হলো। মিষ্টি নিজে থেকে বললো, “যা খুশি ভাবতে পারো তবে বেঁচে থাকতে নিশ্চয়ই তোমার খারাপ চাইবো না।” এবারও নবাব নিশ্চুপ রইলো। এই মূহুর্তে নবাবের এমন গাম্ভীর্যে মিষ্টির হৃদয় যেন তপ্ত অনলে ছারখার হলো। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মিষ্টি এবার কাপড়-চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করলো।
ফোন নিয়ে ব্যস্ত হলেও নবাবের মাথায় নতুন একটা চিন্তা ঘুরছে পরশুদিন থেকে, “অর্ষা আমার ফোনের নতুন নাম্বারে কল দিলো কিন্তু নাম্বার কোথায় পেল?”
নবাবের মনে চিন্তা বিচরণ করলেও সে মিষ্টিকে কিছু বুঝতে দেয়নি৷ এমনকি নিজে থেকে কল করেও অর্ষার সাথে কথা বলেনি। অর্ষা মিষ্টির সাথে কথা বলার পর অনেকবার কল করেছিল। কিন্তু নবাব কল রিসিভ না করে ওর কল করবার পথ বন্ধ করে রেখেছে।
স্কুলে প্রথমদিন দেখেই অর্ষাকে নবাবের ভালো লেগেছিল। কিন্তু সেই ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা গভীর হওয়ার আগেই নবাব অনুধাবন করলো, সে অর্ষার প্রতি নয় মিষ্টির প্রতি দূর্বল। কিন্তু এই দূর্বলতার নাম যে ভালোবাসা, সেটা নবাবের জানা ছিল না।
ধীরে ধীরে অর্ষার সাথে নবাবের বন্ধুত্ব হয়েছিল। একদিন হুট করে ছুটির পর অর্ষা নবাবকে একটা ছোট্ট কাগজ ধরিয়ে বলেছিল, “এটা বাসায় গিয়ে পড়বে।”
“এখানে পড়লে কী হবে?”
মুচকি হেসে অর্ষা জবাব দিয়েছিল, “আমার লজ্জা করবে।” এই বলে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল অর্ষা আর নবাব কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে সেখানে দাঁড়িয়েই পড়েছিল,
“নবাব,
আমি এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে পারি না। উইল ইউ বি মাই বয়ফ্রেন্ড?” ছোট্ট এই লেখায় অর্ষা নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে মিষ্টিকে নবাব সেদিনই জানিয়ে ছিল, “আপু, ও তো আমাকে ভালোবাসে।”
“আর তুমি?”
“বুঝতে পারছি না। আসলে ওর অনেক ছেলের সাথেই বন্ধুত্ব আছে যা আমি জানতাম না। তবে ওর সাথে না আমার রোজ কথা হয়। ভালো লাগে অনেক ওর সাথে কথা বলতে। কিন্তু…”
“কিন্তু কী ভাই?”
“আমি দোটানায় আছি আপু।” নবাব সেদিন মিষ্টিকে এড়িয়ে গিয়েছিল। মিষ্টি অবশ্য নবাবকে বুঝিয়ে ছিল, “দেখো, এই বয়সে আমরা যা দেখি তা-ই আমাদের ভালো লাগে। এত ভালো লাগার মাঝে সঠিক ভালো লাগাটা খুঁজে বের করতে আমাদের নিজেকে সময় দিতে হবে। অনেক বিজ্ঞ লোকও এসব বিষয়ে ভুল করে সারাজীবন আফসোস করে কাটিয়ে দেন। আমি চাই না তুমি এমন কিছু করো যাতে তোমার আফসোস হয়।” মিষ্টির কথাগুলো তখন নবাবের কাছে অহেতুক জ্ঞান ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। কিন্তু নবাব কোনও প্রতিবাদ না করে মনোযোগ দিয়ে শুনেছিল। তবে অর্ষাকে সে মানা করতে পারেনি।
দীর্ঘ ছয়মাস অর্ষার সাথে নবাবের যেই যোগাযোগ ছিল, একদিন সেটার ইতি টেনেছিল নবাব। সেদিন সরাসরি সে অর্ষাকে বলেছিল, “তোমার মতো মেয়েরাই মেয়ে জাতিকে কলঙ্কিত করছে। তোমাদের কাছে ছেলেদের মন খেলনা হয়ে গেছে। ইচ্ছে হলো খেললে এরপর ছুঁড়ে ফেলে দিলে। তোমার দিকে তাকাতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে।… ভবিষ্যতে তোমার এই নোংরা চেহারা আমাকে দেখাতে এলে আমি এসিড ছুঁড়ে মারবো, মনে রেখো।” সেদিন এত কথা শোনানোর পরও অর্ষা হঠাৎ করে কেন কল করছে, সেই বিষয়টাই নবাব ধরতে পারছে না। সেদিনের পর অর্ষা নবাবের সামনেও আসেনি ফোনেও যোগাযোগ করেনি। মাঝখানে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে বিধায় নবাবের মনে সন্দেহের পোকা বাসা বাঁধছে।
মিষ্টি এখনও ওয়াশরুমে অবস্থান করছে আর এই সুযোগে নবাব নিলয়কে কল করলো। প্রথমবার কল রিসিভ না হওয়ায় নবাব হতাশ হলো কিন্তু দ্বিতীয়বারে নিলয়ের কন্ঠ শুনে স্বস্তি পেল, “নিলয়, কই তুই?”
“এই তো বাসার বাইরে। সব ঠিক আছে তো।”
অন্যমনস্ক গলায় নবাব জবাব দিলো, “তা আছে আর কী।… আচ্ছা, তোর সাথে অর্ষার যোগাযোগ আছে?”
“অর্ষা?” নিলয় চিনতে পারেনি এমন স্বরে অর্ষার নাম উচ্চারণ করলো।
“হ্যাঁ, আরে আমার সাথে স্কুলে পড়তো। তোকে বলেছিলাম না অনেক আগে। তোর সাথেও তো পরিচয় ছিল।”
“ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। কিন্তু আমার সাথে তো এখন কথা হয় না। কেন? কী হয়েছে?”
“পরশুদিন থেকে আমাকে লাগাতার কল করে যাচ্ছে। ওর নাম তো ফোনে সেভ করা ছিল। তাই আমার নতুন নাম্বার হলেও ওর নাম ভাসতে সমস্যা হয়নি।”
একটু ভেবে নিলয় জিজ্ঞেস করলো, “আরে তুই কি ভুলে গিয়েছিস? অর্ষা তো জিসানের চাচাতো বোনের বান্ধবী। এই শালা যেই হাবলা। আমার তো মনে হয় ওর থেকেই তোর নাম্বার ঝেড়েছে।”
রাগে চোখ বুজে এলো নবাবের। নিজেকে সামলে নিতে অনেকটা সময় লাগলো। নবাবকে নিশ্চুপ দেখে নিলয় জিজ্ঞেস করলো, “কোনও সমস্যা তৈরি করেছে?”
“নাহ।” নবাবের কন্ঠ যেন রাগে ভারী হয়ে গেল। নিজের কন্ঠকে ওর নিজেরই অপরিচিত মনে হলো।
“আমি জিসানকে কি জিজ্ঞেস করবো?”
“বাদ দেয়। আমি নতুন সীম তোলার চেষ্টা করবো।”
“আবার এসব ঝামেলা করতে যাবি? তার চেয়ে কথা বলে দেখ, কী বলতে চায়?”
“ওর মতো মেয়ের সাথে আমার কথা বলতে রুচিতে বাঁধে। তাছাড়া ওর সাথে আমার কোনও গভীর সম্পর্কও ছিল না। নতুন করে আর ঝামেলা টানতে চাই না। তুই বরং আমার বাড়ির হালচাল দেখে জানা আমায়।”
“ঠিক আছে, কিন্তু তুই সিলেট ছাড়ছিস কবে?”
“আজকে রাতে।”
নিলয় একটু অবাক হলো, “রাতে? রাত করে ভ্রমণ নিরাপদ হবে?”
হালকা হাসলো নবাব, “যেখানে জীবনের নিশ্চয়তাই নেই, সেখানে নিরাপত্তার কথা আর কী ভাববো?”
“তবুও…”
“সমস্যা হবে না। আমি খোঁজ নিয়েই যাচ্ছি। ট্রেনে গেলে কালকে সকালে পৌঁছে যাবো। আর…” হঠাৎ ওয়াশরুম থেকে দরজা খোলার শব্দ হতে নবাব বাঁধা প্রাপ্ত হলো। ফোন কানে ধরে দরজার দিকে দৃষ্টি দিতে দেখলো মিষ্টি দাঁড়িয়ে। ভেজা মুখ আর মুখের দুইপাশে খুচরো ভেজা চুল পড়ে আছে। মাথায় সেঁটে আছে সাদা তোয়ালে আর পরনে কালো রঙের থ্রি-পিস। এমন রূপে মিষ্টিকে আগে দেখেনি নবাব। একটা তরতাজা কালো গোলাপ জলে ডুবিয়ে ভাসালে যেমন অপূর্ব লাগে, তেমন মিষ্টিকেও লাগছে; অপূর্ব এক ভেজা কালো গোলাপ।
নবাব নিজের মাঝে হঠাৎ আসা অদ্ভুত এক অনুভূতির সাথে পরিচিত হলো এখন। এমন অনুভূতির দেখা আগে কখনও পায়নি সে। আচমকা তার হৃদয় থমকে গিয়ে হঠাৎ তড়িৎ গতিতে ছুটতে লাগলো। ফোনের ওপাশে থাকা নিলয় অনবরত হ্যালো হ্যালো করে চলেছে। কিন্তু সেসব উপেক্ষা করে নবাবের কানে কেবল নিজের হৃৎস্পন্দনের শব্দ ছন্দাকারে পৌঁছে যাচ্ছে। নবাবের সমস্ত মনোযোগ যেন মিষ্টির ওপর আঁচড়ে পড়ছে আর স্তম্ভিত হৃদয় জানতে চাইছে, “এই অজানা অনুভূতির নাম কী?”
মিষ্টিও পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নবাবের অবাক নয়নে। মিষ্টি ডান হাতে ভেজা কাপড় আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাম হাতের বৃদ্ধ আঙ্গুল একে একে দুই ভ্রুতে চালিয়ে লেগে থাকা পানি ঝেড়ে ফেললো। এরপর বাম হাতের উল্টো পিঠে চিবুকের পানি মোছবার চেষ্টায় বেলকনিতে পা বাড়ালো।
নবাব তাকিয়ে রইলো মিষ্টির চলে যাওয়ার পথে। আগে কখনও মিষ্টিকে নবাব এমন করে দেখেনি। কত-শত চিন্তা আর জীবন বাঁচানোর তাগিদে এই চারদিনেও সে এতো পর্যবেক্ষণ করেনি মিষ্টির অথচ দু’টো মানুষ একই ঘরে অবস্থান করছে।
মিষ্টি বেলকনিতে চলে যেতে এবার নবাবের কানে নিলয়ের কন্ঠ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে ওর চৈতন্য হলো, “হ্যাঁ, নিলয়।”
“শালা, কই হারায় গেছোস তুই?”
“আরে মিষ্টি…” এইটুকু বলতেই নিলয় দুষ্ট হেসে জিজ্ঞেস করলো, “কী কয় ভাবী?… বয়সে তো বড়। তোরে মাইর-টাইর দেয়?”
“ধুর শালা! খালি রসিকতা।” বিরক্ত হলো নবাব কিন্তু একটু আগে হৃদয়ে ভাসা অনুভূতিটা এখনও হৃদয়ে কিঞ্চিৎ বিরাজমান।
“যাহ বাব্বা! রাগ করছিস কেন? মারতেও তো পারে, তাই না? আমার বউ তো ছোট হয়েও আমাকে কোনও ছাড় দেয় না।”
একটু গম্ভীর হলো নবাব, “তুই কি আমার সমস্যা শুনবি না-কি নিজের সমস্যার কথা বলেই…” নবাবের কথার মাঝে নিলয় বললো, “আরে না, তুই বল।”
“তাহলে শোন।”
.
কালকে বৃষ্টির বিপরীতে কড়া রোদ্দুরে ঝকমক করছিল আকাশ। কিন্তু আজকে সকাল থেকে আকাশ মুখ ভার করে আছে যেন সূর্যের সাথে আকাশের তুমুল ঝগড়া হয়েছে। বেলকনির জানালা দিয়ে খোলা আকাশের অনেকটাই দেখতে পাচ্ছে মিষ্টি। ধূসররঙের মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে এখানে-সেখানে।
ভেজা কাপড় জানালার গ্রিলে মেলে দিয়েও অহেতুক নাড়াচাড়া করছে মিষ্টি। আর বারংবার উঁকি দিয়ে নবাবকে দেখছে, “এত কীসের কথা চলছে ফোনে? মুখ দেখে তো বুঝা যাচ্ছে ফূর্তিতে আছে।” হালকা হেসে আনমনে বললো মিষ্টি, “ছেলেরা অন্য সবার সাথে ঠিকই হাসিখুশিতে কথা বলতে পারে। কিন্তু মেয়েদের সামনে দাঁড়ালেই তাদের হাসিখুশি উবে গিয়ে হতাশা এনে দাঁড় করায়। আমাদের সামনে এলেই এদের মনে হয় জীবন কাল্পনিক নয়, বাস্তবিক। আর এসব যুক্তি দেখিয়ে এরা আমাদের মনে আঘাত দিতে কার্পণ্য করে না।” এসব ভাবতে গিয়ে মূহুর্তেই আকাশের কালো মেঘ এসে জমা হলো মিষ্টির মন আকাশে।
চলবে…
#প্রীতিকাহন❤️
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২১
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
নবাব ফোনে কথা বলার মাঝে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। এক হাতে ফোন ধরে রেখে অন্য হাতে তোয়ালে এবং কাপড়-চোপড় নিতে শুরু করলো। ওর হাবভাবে মিষ্টি বুঝতে পারছে নবাব এবার ওয়াশরুমে ঢুকবে আর সেই আশায় মিষ্টি অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
“নিলয়, আমি রাখছি। গোসল সেরে আবার খেতে যেতে হবে… হুম, তুইও সাবধানে থাকিস।” এই বলে নবাব ফোনটা বিছানার পাশে থাকা ছোট্ট টেবিলের উপর রেখে দিলো। বেলকনির পাশ দিয়ে ওয়াশরুমে যাবে নবাব– এমন ভাবনায় মিষ্টি উঁকিঝুঁকি দেওয়া বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
সাদা তোয়ালে গলায় ঝুলিয়ে কাপড়-চোপড় নিয়ে নবাব ওয়াশরুমে চলে এলো। তবে বেলকনির ঘা ঘেঁষে আসতে গিয়ে আঁড়চোখে মিষ্টিকে একবার দেখে নিলো। এখন সেই অজানা অনুভূতির রেশও নেই নবাবের মাঝে কিন্তু তাকাতে গিয়ে যেন ওর মনে হলো, “মানুষের সৌন্দর্য একটা অদ্ভুত জিনিস। হুটহাট করে কাউকে খুব বেশি সুন্দর লাগে অথচ এই সুন্দর লাগার পিছনে কোনও আহামরি কারণ থাকে না।”
শব্দ করে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ হতে বেলকনি ত্যাগ করলো মিষ্টি। অতি সাবধানে হাঁটতে গিয়েও নূপুরে সুর উঠলো। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে মিষ্টি আলতো হাতে নবাবের ফোন নিয়ে লক খোলার চেষ্টা করলো। কালকে মাঝরাতেও অনেকবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু বারংবার ব্যর্থ হওয়ার পর ফোন আধঘন্টার জন্য পাসওয়ার্ড অপশন দেখানো বন্ধ করে দিয়েছিল।
“কী এমন পাসওয়ার্ড এতে দেওয়া যে খুলছেই না? কালকে রাতে কত কী দিলাম কিন্তু হলো না। এদিকে নবাব হয়ত টের পেয়ে গেছে আমি ওর ফোন নাড়াচাড়া করার চেষ্টা করি ওর অজান্তে।” মনে মনে এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিষ্টি। এরপর বিড়বিড় করলো, “নবাব, এভাবে জীবন চলতে পারে না। তাছাড়া আমি মেয়ে হয়ে পরিবারের সর্বনাশ করে নিশ্চয়ই তোমার সাথে এভাবে ঘুরে বেড়াতে পারি না। আমাকে যে করে হোক জানতে হবে আমার পরিবারের এখনকার অবস্থা আর…” ফোনের লক খুলছে না বলে বিরক্ত হলো মিষ্টি, “ধ্যাত!”
আন্দাজের ওপর মিষ্টি পাসওয়ার্ড টাইপ করে যাচ্ছে কিন্তু কোনও কাজ হচ্ছে না। একাধিকবার ভুল পাসওয়ার্ড টাইপ করার কারণে আবারও আধঘন্টার জন্য পাসওয়ার্ড অপশন বন্ধ হয়ে গেল।
“হায় আল্লাহ! এটা কী করলাম আমি? এখন তো নবাব ফোন হাতে নিলেই বুঝে যাবে আমি ফোন আনলক করার চেষ্টা করেছি। তাছাড়া আধঘন্টা ধরে তো ও আর গোসল করবে না।” ভাবতে গিয়ে বাচ্চাদের মতো হাতের নখে দাঁত চাপলো মিষ্টি। সাত-পাঁচ না ভেবে ফোনটা আগের জায়গা রেখে সেখান থেকে সরে এলো।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথার তোয়ালে হাত দিতেই ওয়াশরুমের দরজা খুলে গেল। মিষ্টি ভয়ে যেন কাঁপতে শুরু করলো, “আল্লাহ, এই যাত্রায় আমাকে বাঁচিয়ে দিন।” আনমনে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে ভেজা চুল মেলে দিলো। অগোছালো চুলে তোয়ালে চালিয়ে যখন পিছন ফিরলো, তখন নবাবের মুখোমুখি হলো মিষ্টি। নবাব এতক্ষণ ওর পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু ভয়ের দরুন সে এটা টের পায়নি।
নবাবের চোখ রক্তবর্ণ হয়ে আছে। কারণ ঠাওর করতে না পারলেও ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে জানতে চাইলো, “কিছু বলবে?”
“সরে দাঁড়াও সামনে থেকে।” নবাবের কন্ঠ অনেক ভারী শোনালো আর এতে চমকে গিয়ে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কান্না করেছো?”
চোখ নামিয়ে নিলো নবাব কিন্তু পরক্ষণেই দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “তোমাকে আমি সরতে বলেছি।”
“কেন এমন করছো তুমি আমার সাথে? কী করেছি আমি?” মিষ্টির প্রশ্নে একটা কষ্ট ভেসে উঠলো কিন্তু সেসবে পাত্তা না দিয়ে নবাব বললো, “সেটা নিজেকে জিজ্ঞেস করো, কী করেছো তুমি?” এই বলে পাশ কাটিয়ে নবাব আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। মিষ্টি পিছন থেকে নবাবকে দেখলো অসহায়ের ভঙ্গিতে এরপর মনে মনে বললো, “জিজ্ঞেস করে আর কী হবে? আমার মন তো জানে আমি কোনও অন্যায় করিনি নবাব।”
.
সারাদিন মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও বিকালের পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। এখন রাত বাড়ছে আর রেলস্টেশন ধীরে ধীরে ফাঁকা হচ্ছে সাথে কোলাহলও অনেকটা কমে আসছে। একটা বেঞ্চে বসে পেটের ক্ষুধায় কাতর হচ্ছে মিষ্টি। এক-দুই বেলা না খেয়ে থাকার অভ্যাস আছে ওর। কিন্তু রাগের মাথায় না খেলে ক্ষুধা যেন প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে মাঠে নামে।
আজকে সকাল থেকেই নবাবের অদ্ভুত আচরণে মিষ্টি ব্যথিত হয়েছে বারংবার। মধ্যাহ্নভোজে যখন গেল, তখনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মুখোমুখি বসে যখন ওয়েটার আসার অপেক্ষা চলছিল, তখন গম্ভীর কন্ঠে নবাব জিজ্ঞেস করেছিল, “কী খাবে?”
গম্ভীর কন্ঠ আর রাগে ভরপুর চেহারার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি চট করে ভাবতে পারছে না, কী বলা উচিত? কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে সে জবাব দিলো, “তুমি যা খাবে।”
নবাব মুষ্টিবদ্ধ হাতের ওপর মুখ রেখে বসে ছিল। এখন জবাব পেতেই সোজা হয়ে পুনরায় ওয়েটারকে ডাকতে শুরু করলো। ওয়েটার আসার আগ পর্যন্ত সময়টুকুতে নবাব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিষ্টিকে দেখলো। নবাবের এমন চাহনিতে মিষ্টি চুপসে গিয়ে চোখের পাতা নামালো।
ওয়েটার এসে যখন জানতে চাইলো কী কী অর্ডার করবেন, তখন নবাব মিষ্টির দিকে তাকিয়ে ওয়েটারের কাছে জানতে চাইলো, “সবচেয়ে ঝাল জাতীয় খাবারে মধ্যে কী কী আছে?” এমন প্রশ্নে মিষ্টি আচম্বিতে তাকালো নবাবের দিকে। হিজাবের ফাঁকে তার দুই চোখের তারায় নবাব যেন প্রশ্ন খুঁজে পেল, “তুমি তো ঝাল খাও না নবাব। তাহলে এমনটা কেন জানতে চাইছো?” মিষ্টির চোখে ভাসমান প্রশ্নের মাঝেই ওয়েটার বেশ কয়েকটা খাবারের নাম বললো আর সেখান থেকে কিছু খাবার নবাব অর্ডার করলো।
ওয়েটার চলে যেতেই নবাব আগের মতো টেবিলের উপর কনুইয়ের ভরে হাতের ওপর মুখ রাখলো। স্থির দৃষ্টিতে যখন মিষ্টি দেখলো নবাবকে, তখন নবাবের চোখে রাগের রাজত্ব ভেসে উঠলো। হিংস্র হলো নবাবের চোখজোড়া, চোয়াল হলো টানটান আর এসবের মাঝে ভয়ে কেঁপে উঠলো যেন মিষ্টির মন।
ওয়েটার খাবার পরিবেশন করে যখন প্রস্থান করলো, তখন এক প্লেট খাবার মিষ্টির সামনে দিয়ে থমথমে গলায় নবাব বললো, “খাও।”
প্লেটে তাকিয়ে মিষ্টি বুঝতে পারলো এটা মুরগির মাংস দিয়ে তৈরি কোনও খাবার। কিন্তু এতে ঝালের পরিমাণ অনেক বেশি মনে হচ্ছে কারণ খাবারটা লাল হওয়ার পাশাপাশি কাঁচা মরিচের বাহার দেখা যাচ্ছে।
নবাব যেমন ঝাল খায় না, তেমনি মিষ্টিরও ঝাল সহ্য হয় না। অনেক আগে একবার শুঁটকির ভর্তা খেয়েছিল। এত পরিমাণ ঝাল ছিল যে, ওর মনে হয়েছিল শুঁটকির চেয়ে মরিচ বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। এরপর অতিরিক্ত ঝালে মিষ্টির পেটে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয় এবং ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়েছিল। কারণ মিষ্টির আলসারের সমস্যাও আছে কিঞ্চিৎ। ঐ ঘটনার পর থেকে অতিরিক্ত ঝাল খাওয়ার সাহস আর হয়নি মিষ্টির। সেটা মনে করেই এখন নিচু গলায় জবাব দিলো, “খাবো না।”
“কেন?”
“ক্ষিধে নেই।”
মিষ্টির সামনে থেকে খাবার প্লেট নিয়ে নিজের সামনে রাখলো নবাব। এরপর সোজা হয়ে বসে দুই হাতের তালু একে অপরের সাথে শব্দ করে ঘষে বললো, “আমি তো খাবো কারণ আমার প্রচুর ক্ষিধে পেয়েছে।” এই বলে নবাব খেতে শুরু করলো।
খাবারে হালকা ঝাল দিলেই নবাব তার মায়ের সাথে রাগারাগি করতো– এই বিষয়টা মিষ্টির জানা আছে বিধায় মিষ্টি বলার চেষ্টা করলো, “কিন্তু নবাব…” এইটুকু বলতেই নবাব দাঁতে দাঁত চাপলো, “ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।” নবাব বিদেশে থাকলেও হুটহাট ইংরেজি বলে না। তবে রেগে থাকলে ইংরেজির জাহাজ হয়ে যায় যা মিষ্টির অজানা নয়। কিন্তু এখন তিন শব্দের এই ইংরেজি বাক্য মিষ্টিকে দমিয়ে দিলো। ফলে মিষ্টির সাহস হলো নবাবকে আর কিছু বলবার।
নবাব খেয়ে চলেছে একে একে ঝালযুক্ত খাবার। খাবারগুলো একটু একটু করে মুখের ভেতর নড়ছে আর ওর চোখজোড়া টাটকা মরিচের মতো লাল হয়ে বিন্দু বিন্দু জল জমছে। নবাবের এমন চেহারায় মিষ্টি নিজের অন্তরে ব্যথা অনুভব করলো। তাই হুট করে নবাবের হাত ধরে বললো, “নবাব, থামো দয়া করে। হাতজোর করছি আমি তোমার কাছে। খেয়েও না আর।”
“হাত ছাড়ো।” দাঁত কিড়মিড় করলো নবাব।
মিষ্টির গলায় কান্না ভাসতে লাগলো, “দোহাই লাগে তোমার। বন্ধ করো নবাব। কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো? বলো না আমার অন্যায়টা কী?”
মুখের খাবারটুকু গিলতে গিয়ে চোখ-মুখ খিঁচে গেল নবাবের। গলা আর বুক যেন ঝালে জ্বলে যাচ্ছে। নবাবের এই মূহুর্তে ইচ্ছে করছে এক পুকুর পানি গোগ্রাসে গিলতে। কিন্তু রাগের বশে সে চোখের সামনে থাকা পানির গ্লাসও স্পর্শ করছে না।
নবাব বাম হাতে মিষ্টির হাত সরিয়ে দিলো। চাপা কষ্ট আর তীব্র ঝালে ফুঁসে উঠলো সে এবার, “অন্যায় তোমার কেন হবে? আমার অন্যায় হয়েছে… হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার অন্যায় হয়েছে তোমার কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়ার আশা করে।”
মিষ্টি চোখ নামিয়ে আশেপাশে নজর করতে নবাবের হুঁশ হলো সে একগাদা লোকের সামনে চেঁচামেচি করছে। তাই এবার গলার স্বর নামিয়ে কিন্তু রাগের তেজ দ্বিগুণ করে বললো, “একটু তো ভালোবাসাই চেয়েছিলাম আমি তোমার কাছে। কিন্তু তুমি আমার সাথে এমন বেইমানি কেন করছো?” নবাবের মুখ নিসৃত এমন বাক্যে অবাক চোখে তাকালো মিষ্টি নবাবের দিকে। এতক্ষণ ধরে যেই অশ্রু সে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, এখন সেটা বিনা বাধায় উপছে পড়লো। বিস্ময়ের পরিমাণ এতোটাই বেশি যে, মিষ্টি যেন সেটা নিজের মাঝে চেপে রাখতে গিয়ে কেঁপে উঠছে।
“আমি তোমার সাথে বেইমানি করছি?” অনেক কষ্ট নিজেকে স্থির করে মিষ্টি প্রশ্ন করলো নবাবকে। ওর প্রশ্নে ক্ষেপে গিয়ে নবাব বললো, “তুমি কী আমাকে বাচ্চা মনে করো মিষ্টি? হ্যাঁ? আমি দুই বছরের বাচ্চা। তাই আমাকে যা বুঝাবে, আমি তাই বুঝবো? তুমি কালকে রাত থেকে আমার ফোন নাড়াচাড়া করছো, সেটা কি আমার অজানা? আজকে যখন গোসল করছিলাম আমি একশো ভাগ নিশ্চিত তুমি আমার ফোন ধরেছো?… নিজের পরিবারের জন্য এত মায়া করছো অথচ সেই পরিবার তোমার জীবন নিয়ে খেলা করতে মত্ত। এদিকে যে তোমাকে জীবন দিয়ে ভালোবাসে, নিজের চাকচিক্যময় বিদেশের জীবন ফেলে, খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে; তার প্রতি তোমার মায়া হয় না মিষ্টি?”
নবাবের এত কথার ভিড়ে মিষ্টি যেন হারিয়ে গেল বিস্ময়ের দুনিয়ায়। সে ভেবেই পাচ্ছে না নবাবকে কী জবাব দিবে? তাই শুধু ছোট্ট একটা শব্দ তার মুখ থেকে নিসৃত হলো, “নবাব…”
এঁটো হাত দেখিয়েই মিষ্টিকে থামিয়ে দিলো নবাব। এরপর বলতে শুরু করলো, “বলেছিলে আমার মৃত্যু তুমি সহ্য করতে পারবে না। এটা যে মিথ্যা তার প্রমাণই দিলে। কারণ তুমি ভালো করেই জানো বাসায় যোগাযোগ করলেই আমরা ধরা পড়ে যাবো। কেন মিষ্টি? আমি কি এতটাই ঘৃণার পাত্র হয়ে গিয়েছি তোমার কাছে? যে আমাকে বিপদে ফেলবার এত বুদ্ধি খাটিয়ে বেড়াচ্ছো।”
একটু থামলো নবাব। কী যেন ভেবে বললো, “ওহ, তুমি তো আমাকে কখনও ভালোবাসোনি। আমি নিজেই বেহায়ার মতো তোমাকে ভালোবেসেছি আর এখনও বাসি। তাছাড়া জোর করে তোমায় বিয়ে করেছি।… ঠিক আছে, তুমি যখন চাইছো ঐ মানুষগুলোর হাতে আমার মরণ হোক, তোমার কাছে যখন তোমার পরিবারই বড় হয়ে গেছে। তাহলে আমি তোমাকে কথা দিলাম মিষ্টি। এই আমি তোমাকে নিজে বাসায় পৌঁছে দিতে যাবো কিন্তু তার আগে তোমার সাথে শেষ বোঝাপড়া করতে চাই। তবে সেটা সিলেট ছাড়ার পর।”
চলবে..