#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে কথা চৌধুরী❤️
#পর্ব_১০
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
চোখ কখন বুজে এসেছিল টের পাইনি নবাব। এখন হয়ত জেগে উঠার সম্ভাবনাও ছিল না কিন্তু বাসের ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল তার। ঘুম জড়ানো চোখে হাতের ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। রাত সাড়ে তিনটা। পাশে ফিরে দেখলো মিষ্টি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ওর মুখ বাম পাশে কাত হয়ে আছে তাই বোরকার আড়ালে দু’টো চোখও দেখতে পেল না নবাব।
পেট ডাক ছাড়ছে নবাবের। দুপুরে অনাহারে থেকে রাতেও কিছু পেটে পড়েনি। তাই খালি পেট খাবারের সন্ধানে হাঁক-ডাক করছে। মাথার ক্যাপ আর মুখের মাস্ক খুলে উঠে দাঁড়ালো নবাব। অন্ধকার বাসে আন্দাজে সে তার ব্যাগ হাতড়াতে লাগলো। ব্যাগটা মাথার উপরে জিনিসপত্র রাখবার সিটে অবস্থান করছে। কয়েক সেকেন্ড খোঁজাখুঁজির পর পানির বোতলের মতো কিছু একটা হাতে লাগতে স্বস্তি পেল নবাব। ক্যাপ আর মাস্ক আগেই কোনোমতে ব্যাগে পুড়ে ফেলেছিল। এখন কেবল পানির বোতল নিয়ে পুনরায় সিটে বসে পড়লো। খালি পেটে পানি ঢালতে গিয়ে পানির চলাচল সম্পূর্ণ অনুভব করলো। বোতল প্রায় অর্ধেক ফাঁকা করে পুনরায় ব্যাগে চালান করলো।
জানালার দিকে চোখ যেতে দেখলো সেটা বন্ধ আছে আর মিষ্টি সেখানেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। এসি বাস তাই জানালায় পর্দা ঝুলছে। হঠাৎ নবাবের ইচ্ছে হলো পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকানোর কিন্তু পর্দা সরাতে গিয়ে মিষ্টি নড়েচড়ে উঠলো। নবাব পর্দা সরিয়ে বাইরের দৃশ্য অবলোকন করতে পারেনি কারণ মিষ্টি এখন নবাবের বাহু আঁকড়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখেছে। নবাব বুঝতে পেরেছে মিষ্টি ঘুমের মাঝে নবাবের কাঁধে ঠাঁই নিয়েছে। প্রথমে নবাব যথেষ্ট অবাক হলেও এখন ঝুম বৃষ্টির মতো তার হৃদয়ে ছন্দপাত হচ্ছে। পূর্ণ দৃষ্টিতে ঘুমন্ত মিষ্টিকে দেখে সে মনে মনে প্রশ্ন করলো, “মিষ্টি, ঘুমের মাঝেও কি আমাকে নিয়ে ভাবো? আমি মরে যেতে পারি এই শঙ্কায় কি শক্ত হাতে আমার বাহু চেপে ধরেছো?” আনমনে হেসে উঠে সিটে হেলান দিলো নবাব। মিষ্টিকে ডাকলো না, সরালো না উল্টো নিজে এখন বাম দিকে ঘাড় কাত করে, মিষ্টির মাথার উপর নিজের মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে দিলো।
“মা, আমি না গেলে হয় না?” সতেরো বছর বয়সী ছেলের মুখে না যাওয়ার কথা শুনে মিনারা বেগম জানতে চাইলো, “কেন বাবা?”
মুখ কুঁচকে ছেলে জবাব দিলো, “ভালো লাগছে না যেতে।”
“নবাব, আমরা রোজ তো যাই না। সবাইকে দাওয়াত করেছে তাই যেতে হচ্ছে। দুপুরে খেয়ে বিকালেই আবার চলে আসবো।”
“ধুর! ঐ বাড়িতে একা একা আমার একদম ভালো লাগে না।”
ইস্ত্রি করা কাপড় আলমারিতে রাখতে গিয়ে ছেলের দিকে ফিরে তাকালেন, “কেন? মিষ্টির সাথে গল্প করবি।”
কাঠের ওয়ারড্রবে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নবাব। মলিন মুখে সে তার মাকে বললো, “মিষ্টি আপুর সাথে কী গল্প করবো? তাছাড়া আপুর সাথে কথা বলতে আমার সংকোচ লাগে।”
আলমারির দরজা লাগিয়ে বিছানায় এসে বসলেন মিনারা। শাড়ির আঁচলে মুখে জমে থাকা ঘাম মুছে বললেন, “শোনো ছেলের কথা! সংকোচের কী আছে? বোনের সাথে আড্ডা দিবি, লুডু খেলবি আর মিষ্টিও তো একা একাই থাকে। খেয়ে-দেয়ে ওর সাথে গিয়ে আড্ডা দিস তাও চল বাবা।”
কয়েক সেকেন্ড ভেবে একপ্রকার বাধ্য হয়ে রাজি হলো নবাব, “এইবারই শেষ। আমি কিন্তু আর যাবো না ঐ বাড়িতে।”
“সেটা পরে দেখবো। এখন জলদি কাপড় বদলে আয়।”
মিষ্টির বাবাকে ভাই সম্বোধন করা মিনারা হলো সোবহানের আপন চাচাতো বোন। দুই ভাই-বোনের বসবাস একই জেলায় হলেও দেখা-সাক্ষাৎ হয় কদাচিৎ। প্রায় প্রতিবছরই সোবহান ঈদের পর বোনকে বাসায় নিমন্ত্রণ করেন। এবারও যথাক্রমে নিমন্ত্রণ করেছেন আর সেই নিমন্ত্রণে যাওয়া নিয়েই গোছগাছ করছেন মিনারা।
দুপুর একটা নাগাদ মিনারা তার ছেলে নবাবকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন ভাইয়ের বাসার উদ্দেশ্যে। আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছেও গেলেন। রিকশা থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলেন দোতলা বাড়ির দিকে। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে কলিং বেল টিপে ছেলেকে বললেন, “নবাব?”
“বলো মা।” ছেলে কন্ঠে বিরক্তির সুর।
“মামা আর মামীর সামনে কিন্তু বাসায় যাওয়ার কথা একদম তুলবি না। উনারা শুনলে কষ্ট পাবেন।”
একরাশ বিরক্তি নিয়ে নবাব জবাব দিলো, “ঠিক আছে মা।”
ছিটকানির শব্দের সহিত কাঠের দরজা খুলে গেল। হাসোজ্জ্বল মুখ থেকে শব্দ এবার নিসৃত হলো, “কেমন আছো ফুপি?”
“ভালো আছি মা।”
“ফুপা আসেননি?”
“না রে। তোর ফুপার অন্যত্র দাওয়াত আছে, সেখানেই গেছেন।”
“ওহ, ভেতরে এসো।”
“হুম চল।” বলেই মিনারা ভেতরে চলে গেলেন। উনার যাওয়ার পথ অনুসরণ করে মিষ্টি সেদিকে তাকিয়ে রইলো। এদিকে বিরক্ত হওয়া নবাবের মুখ প্রসন্ন হলো মিষ্টিকে দেখে। এখানে আসার কথা জানবার পর থেকে ওর মাঝে যেই বিরক্তি কাজ করছিল, সেটা হঠাৎ করে উবে গেল।
এক কদম সামনে এগিয়ে এসে হাসির রেখা টেনে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছো মিষ্টি আপু?” নবাবের প্রশ্নে ফিরে তাকালো মিষ্টি। স্মিত হেসে জবাব দিলো, “ভালো, তুমি কেমন আছো?”
“এখানে দাঁড়িয়েই সব বলবো?”
হাসিটা দ্বিগুণ করে মিষ্টি বললো, “ভেতরে এসো।”
মিষ্টির রুমে পা রেখে চোখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো নবাব। ওকে এভাবে পর্যবেক্ষণ করতে দেখে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “দাঁড়িয়ে থাকবে না-কি বসবে?”
বিছানায় বসে নবাব বললো, “এগুলো কি তুমি বানিয়েছো?” হাতের ইশারায় দেয়ালে আটকানো কিছু কৃত্রিম প্রজাপতি দেখালো আর সেদিকে তাকিয়ে মিষ্টি জবাব দিলো, “হ্যাঁ।”
“খুব সুন্দর তো। কী দিয়ে বানালে?”
চেয়ারে বসে মিষ্টি বললো, “রঙিন কাগজ দিয়ে। হাতের কাজ করতে আমার খুব ভালো লাগে।”
পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নবাব হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, “আপু, তোমার কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই?” আচমকা এমন প্রশ্নে অবাক হলো মিষ্টি। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো, “বয়ফ্রেন্ড?”
“হ্যাঁ, নেই?”
মুখে হাসি বজায় রেখে নরম গলায় বললো, “নাহ, কারণ এসব তো সুন্দরী মেয়েদের থাকে, তাই না?”
“তুমি যে কী বলো না আপু? নিজেকে সবসময় তুমি এমন বলো।”
“আচ্ছা, আমার কথা বাদ দাও। তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে না-কি সেটা বলো। যদি না থাকে তবে ফুপিকে বলে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
“আরে ধুর! কী বলছো তুমি এসব? মাকে এসব বললে মা আমাকে উল্টো ঝুলিয়ে পেটাবে।”
“তাহলে আমাকে এমন প্রশ্ন করো কেন সবসময়? দেখা হলেই শুধু জিজ্ঞেস করো বয়ফ্রেন্ড আছে কি-না?” ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো মিষ্টি। কিঞ্চিৎ চুপসে গিয়ে নবাব বললো, “না মানে তুমি তো ভার্সিটিতে পড়ো।”
আরেকটু গম্ভীর হলো মিষ্টি, “ভার্সিটিতে পড়লেই কি আজব প্রাণী পুষতে হবে?”
কাঁধ নাচিয়ে নবাব জানতে চাইলো, “এই, এই তুমি কি আমার উপর রাগ করলে আপু?”
অল্প হেসে মিষ্টি বললো, “এমন ফাজিল ভাইয়ের ওপর রাগ করা যায় না। তা তোমার এসএসসি পরীক্ষা কবে?”
পা তুলে বিছানায় বসলো নবাব। খাটের পাশে থাকা ছোট্ট একটা বল নিয়ে নাড়াচাড়া করে জবাব দিলো, “কয়েকদিন পরেই।”
“পড়াশোনা কত দূর শেষ হলো?”
বল বারবার শূন্যে ছেড়ে হাতে নিচ্ছে নবাব। বল দেখতে গিয়ে যখন ঘাড় পিছন দিকে কাত করছে, তখন কপালের চুলগুলো সরে যাচ্ছে; বল মুঠোয় বন্দী করে যখন সোজা হচ্ছে, তখন চুলগুলো আবার কপাল দখল করছে। মিষ্টির সম্পূর্ণ মনোযোগ এখন নবাবের দিকে। উত্তরের প্রতীক্ষায় তাকিয়ে থেকে এবার বিরক্ত হলো মিষ্টি, “ওটা রাখো না। কথা বলার সময় তোমার হাত-পা এত নড়েচড়ে কেন?”
নিজের কাজে ব্যস্ত থেকেই নবাব জবাব দিলো, “হাত-পা না নড়াচড়া করলে তোমার সাথে কথা বলতে পারি না।”
“কেন?” বুঝতে না পেরে।
স্থির হয়ে বসে নবাব বললো, “কোনও কিছুতে ব্যস্ত না থেকে আমি তোমার সাথে কথা বলতে পারি না।”
“সেই কারণটাই তো জানতে চেয়েছি।”
“কারণ আমার সংকোচ লাগে।” বলেই বল ছোড়াছুড়ি খেলায় মত্ত হলো নবাব৷ এদিকে মিষ্টি অবাক আর রাগে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। এরপর নবাবের মাথায় চাটি মেরে বললো, “ফাজিল ছেলে, বোনের সাথে কথা বলতে সংকোচ হয়?”
খুব একটা ব্যথা লাগেনি তবুও মাথায় হাত বুলিয়ে নবাব বললো, “বোন বলেই সংকোচ লাগে। বন্ধু হলে তো আর এসব সংকোচের কথা বলতাম না।”
“এমন বাচ্চা ছেলেকে আমি বন্ধু বানাবো?” চেয়ারে ধপাস করে বসে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো।
নবাব কিঞ্চিৎ রাগ হয়ে বললো, “এই, তুমি বাচ্চা কাকে বলছো আপু? আই অ্যাম সেভেন্টি।”
“তো? দাদা নানা ডাকবো?… চার বছরের ছোট ছেলে আসছে আমার বন্ধু হতে।” মিষ্টির কথাগুলোতে এবার বেশ রেগে গেল নবাব, “ছোট ছোট আর বাচ্চা বাচ্চা করো না তো। তাছাড়া আমি তোমাকে বন্ধু হতে বলেছি, বউ হতে বলেছি কি?” মূলত রাগের বশে নবাব এমনটা জিজ্ঞেস করে ফেলেছে। কিন্তু বিষয়টা এখন বুঝতে পেরে অনেক বেশি লজ্জা অনুভব করছে। তাই মাথা নত করে বিছানা ছেড়ে দাঁড়ালো। টুঁশব্দ না করে মিষ্টির রুম ত্যাগ করলো গোমড়া মুখে। এদিকে মিষ্টি প্রথমে প্রশ্নটা শুনে অবাক হলেও এখন খিলখিল করে হাসছে, “পাগল একটা।”
চোখ পিটপিট করে তাকালো মিষ্টি। কোথায় আছে সে? মাথায় প্রশ্ন ঘুরছে কিন্তু বুঝতে পারছে না। একটু নড়তে গিয়ে টের পেল ওর মাথার ওপর ভারী কিছু একটা আছে। হাত নাড়াতে গিয়ে দেখলো সেটা নবাবের দুই বাহু আঁকড়ে রয়েছে। মূহুর্তেই লজ্জা নামক অদৃশ্য জাল আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো মিষ্টিকে। নিজেকে নবাবের কাছ থেকে সরাতে গিয়ে নবাবও এবার নড়ে-চড়ে উঠলো। মিষ্টি বাম দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো চুপটি করে যেন কিছুই হয়নি। এদিকে ঘুম ভাঙতে ডান হাতে চোখ কোচলে নবাব জিজ্ঞেস করলো, “কিছু হয়েছে মিষ্টি?”
বোরকা পড়া মিষ্টির মাথা নুইয়ে আছে। ঘুম জড়ানো দুইটি চোখের পাতা লজ্জায় প্রায় বুঁজে আছে। কোনোমতে সে ‘না’ সূচক মাথা নাড়ালো। নবাব শরীরের আড়মোড়া ভেঙে আবার জিজ্ঞেস করলো, “সত্যি কিছু হয়নি?”
“উঁহু।” মিষ্টির ছোট্ট জবাব।
“না হলেই ভালো। তা এখন কিছু খেয়ে নাও। কালকে থেকে অনাহারে আছো। এরপর অসুস্থ হলে অন্য ঝামেলা পোহাতে হবে।”
ধীরে ধীরে মিষ্টি বললো, “একেবারে পৌঁছে নাস্তা করবো।”
“বিছানাকান্দি যেতে এখনও অনেক দেরি।”
অবাক চোখে তাকালো মিষ্টি নবাবের দিকে, “বিছানাকান্দি মানে?”
…চলবে কি?
#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_১১
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
“বিছানাকান্দি মানে জানি না তবে এটা একটা জায়গার নাম।” সামনে তাকিয়ে নির্বিঘ্নে বলে গেল নবাব। এদিকে রাগে কন্ঠ গম্ভীর হলো মিষ্টির, “সাত-সকালে ফাজলামি করছো আমার সাথে? বিছানাকান্দি যে একটা জায়গার নাম সেটা কি আমি জানি না মনে করেছো?”
“যদি না জানো?” বাম দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মিষ্টির দিকে।
“আশ্চর্য! বিদেশে তুমি থাকো, আমি না।”
“কে থাকে, কে থাকে না? কে ছিল আর কে থাকবে? সেটা না হয় সময়ই বলে দিবে।”
“এমন ভনিতা করে কথাবার্তা বলা আমার একদম অসহ্য লাগে।”
“এখন তো যা বলবো আর করবো সবই তোমার অসহ্য লাগবে কারণ আমিই অসহ্যের পাহাড়, তাই নয় কি?”
চোখ-মুখ খিঁচে বললো মিষ্টি, “আমার না সকাল সকাল এসব একদম ভালো লাগছে না।”
“আমার তো এত ভালো লাগছে ইচ্ছে করছে বাসের ছাদে দাঁড়িয়ে এমন করি।… চুপ থাকতে পারো না? হুম? না খেয়েও এতো ঝগড়া করো কীভাবে?” প্রথম বাক্যে কন্ঠস্বর যতটা নরম ছিল, শেষ বাক্যে ততটাই গম্ভীর শোনালো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিষ্টিকে দেখলো নবাব মিষ্টিকে কিন্তু মিষ্টি চুপটি করে রইলো।
“খাবার বের করে দিচ্ছি চুপচাপ খেয়ে নাও। আর একটা টুঁশব্দ যদি কানে আসে তবে খাবার নয়, গুলি নামাবো তোমার গলা দিয়ে।” হিসহিসিয়ে বলে নবাব উঠে দাঁড়ালো। দুই মিনিট ধরে ব্যাগ হাতড়িয়ে পাউরুটি আর ঈষৎ মজে যাওয়া কলা নিয়ে ওর সিটে ওপর রাখলো। এরপর পানির বোতল নিয়ে ব্যাগ নাড়াচাড়া বন্ধ করলো। একহাতে পানির বোতল আর অন্য হাতে কলা রুটি নিয়ে সিটে বসে বললো, “খেয়ে নাও।”
নিশ্চুপ মিষ্টি গোমড়া মুখে বাইরে তাকিয়ে আছে চলন্ত বাসের জানালা দিয়ে। নবাব যখন উঠে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন সে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে নজর দিয়েছিল। আকাশে সূর্য এখনও তেমন করে ভেসে উঠেনি। ঝিলমিল করা রোদের পরিবর্তে হিমহিম বাতাস বইছে। এই বাতাসে মনের রাগ দূর হলেও অভিমান গাঢ় হয়। সেই গাঢ় অভিমান নিয়েই নিশ্চুপ মিষ্টি উপেক্ষা করছে নবাবের কথাগুলো।
“মিষ্টি?” এবারও মিষ্টি উপেক্ষা করলো নবাবকে। এতে নবাব বিরক্ত হলেও সেটা নিজের মাঝে চেপে রেখে জিজ্ঞেস করলো, “কালকে থেকে খাই না। তুমি জানো, তুমি যতক্ষণ না খাবে আমি খাবো না। জেনে-বুঝে কেন এমন করছো আমার সাথে?”
হুট করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মিষ্টি নবাবের দিকে। হিজাবে ওর চেহারার প্রতিক্রিয়া বোধগম্য না হলেও চোখ দু’টোতে ভাসছে বিস্ময় আর রাগ অভিমান। কন্ঠে কোনওরকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করেই মিষ্টি জানতে চাইলো, “তোমরা ছেলেরা কি নিজের দোষ চোখে দেখতে পাও না? এই যে একটা মেয়েকে জোর করে বিয়ে করলে– এটা কি দোষের নয়? তোমরা সাতখুন করলেও বুক উঁচিয়ে চলতে পারো আর আমরা সামান্য ভুল করলেও যেন মহাপাপী হয়ে যাই। আমরা সামান্য ভুলে অপরাধী হলে তোমরা বিরাট ভুলে কেন সাধু হও?”
“কথা বললেই কথা বাড়বে। লোককে শুনিয়ে আমি আর তর্ক করতে চাই না মিষ্টি। শেষবার জিজ্ঞেস করছি, খাবে কি না?”
মুখ ফিরিয়ে নিজের মাঝে গাম্ভীর্য এনে জবাব দিলো মিষ্টি, “নাহ।” এতে হঠাৎ ধপ করে জ্বেলে উঠা রাগের বাতিতে প্রজ্বলিত হলো নবাব। নিজের রাগ কোনওমতে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে দাঁতে দাঁত চাপলো। সাত-পাঁচ না ভেবে চলন্ত গাড়ি থেকে হাতের খাবারগুলো জানালা দিয়ে ফেলে দিলো। আচমকা নবাবের এমন কাণ্ডে আঁতকে উঠলো মিষ্টি, “এটা কী করলে? তুমি… তুমি খাবারগুলো ফেলে কেন দিলে?”
মাথার ক্যাপ খুলে চুলে হাত চালালো নবাব। এরপর পুনরায় ক্যাপ লাগিয়ে ফোনে মত্ত হলো। প্রতুত্তরে নবাবকে নিশ্চুপ দেখে মিষ্টি জানতে চাইলো, “কিছু বলছো না কেন নবাব? খাবারগুলো ফেলে দিলে কেন?”
ফোনে দৃষ্টি রেখে নবাব জবাব দিলো, “যখন খাবেই না, তখন অহেতুক বয়ে বেড়ানোর মানে কী?”
“কেন এমন করলে? আমি রাগ করে…”
ফুঁসে উঠলো নবাব, “রাগ? তো থাকো না সেটা নিয়ে। কে বলে তোমায় রাগ ভেঙে কথা বলতে? অনাহারে থাকবার খুব শখ, তাই না? এবার না খাইয়ে মারবো তোমায়।”
বিনা নিমন্ত্রণে কান্না চলে এলো মিষ্টির মাঝে কিন্তু সেটা অপ্রকাশিত রাখবার তোরজোর করছে সে, “বিশ্বাস করো নবাব আমি…” মিষ্টিকে থামিয়ে দিয়ে নবাব বলে উঠলো, “একটা কথাও বলবে না তুমি আমার সাথে। কালকে থেকে বলছি কিছু একটা মুখে দাও। নিজে না খেয়ে তোমায় সেধেছি আর তুমি আমার কথা ভাববে তো দূর, নিজেও খেলে না।”
মিষ্টির কান্না এবার প্রকাশ পেল সাচ্ছন্দ্যে, “সত্যি বলছি, আমি এমন কিছু চাইনি। বিশ্বাস করো।”
“বিশ্বাস করে আর কী হবে?” এমন একটা বাক্য মিষ্টি আশা করেনি। নবাব তাকে অবিশ্বাস করবে, ভুল বুঝবে সেটাও ভাবেনি সে। তাই হঠাৎ কান্না থামিয়ে নিজে শক্ত হয়ে বসলো, “ঠিক আছে, খাবার তো খাইনি। সামনে যেখানেই বাস দাঁড়াবে তুমি আমাকে এক বোতল বিষই কিনে দিও তাও তোমাকে বিশ্বাস করাতে আমি খাবো।”
তাচ্ছিল্যের সুরে, “বাহ! চমৎকার পরিকল্পনা তো তোমার। না, তুমি যা খাচ্ছো দুইদিন ধরে আমিও তাই খাচ্ছি। সেজন্য এখন পরিকল্পনা করে বিষ খেতে চাইছো যেন আমিও বিষ খেয়ে মরে যাই?”
“না, না, এসব তুমি কী বলছো নবাব?” সশব্দে কেঁদে উঠে মিষ্টি জানতে চাইলো। মিষ্টির কান্নায় নবাবের কন্ঠ নরম হলো, “কাঁদছো কেন সাত-সকাল?”
“তুমি এমন বললে তবে কী করবো?” কান্না মিশ্রিত কন্ঠ প্রশ্ন করে মাথা নুইয়ে নিলো মিষ্টি।
“বিষ খেতে হবে না। বিস্কুট আর কেক খেয়ে নাও।” নবাবের কথায় বিস্মিত মিষ্টির মুখ থেকে নিসৃত হলো ছোট্ট একটা শব্দ, “এ্যা!”
“এ্যা নয়, হ্যাঁ।… রাতের আর সকালের জন্য খাবার কিনেছিলাম কিন্তু রাতে তো খাওয়া হয়নি তাই রয়ে গেছে। তবে কেক বিস্কুট ফেলে দিলে আর খাবার নেই।” সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর আগে নবাব জানতে চাইলো, “বিস্কুট খাবে না-কি কেক?”
নাক টেনে মিষ্টি বললো, “পানি দাও।”
নবাব নিঃশব্দে পানির বোতল এগিয়ে দিতে মিষ্টি বোতল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নবাব যখন কেক আর বিস্কুট নিয়ে সিটে বসলো, তখন দেখলো মিষ্টি মুখের হিজাব তুলতে গিয়েও থেমে গেছে, “কী হলো?”
নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলো, “মুখ খুলবো?”
মৃদু হেসে, “না খুলে খাবে কীভাবে?”
“ঠিক আছে।” বলেই মুখের কালো হিজাব তুলে মাথার পিছনে চালান করলো মিষ্টি। ঘুম আর কান্নায় ফুলে-ফেঁপে ওঠা মিষ্টির মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকালো নবাব। কালকে দুপুরে শেষবারের মতো নবাব দেখেছিল মিষ্টির মুখখানা। পরপর ঘটে যাওয়া বিষয়ে মেয়েটার চেহারায় মলিনতা কেবল বেড়েই চলেছে। এসব ভাবতে গিয়ে বুকে চিনচিনে ব্যথায় কুঁকড়ে যেন উঠলো নবাব। নিজের মাঝে অপরাধী বোধ জাগ্রত হতে মাথা নুইয়ে নিলো সে। দৃষ্টি হাতের খাবারের ওপর কিন্তু এই দৃষ্টি শূন্য বলে খাবার ছেড়ে মিষ্টির মলিন মুখ ভেসে উঠছে। ভাসমান মিষ্টির মুখকে উদ্দেশ্য করে মনে মনে জিজ্ঞেস করলো নবাব, “মিষ্টি, পারবে কি কোনওদিন আমায় ক্ষমা করতে?”
.
বেশ কয়েক ঘন্টা অনাহারে থাকার পর নাস্তা করে এখন নিজেকে বেশ অসুস্থ বোধ করছে মিষ্টি। খাওয়া শেষ হতেই হিজাবে সে মুখ ঢেকে নিয়েছিল চটজলদি। এখন বাসের সিটে গা এলিয়ে দিয়ে ভাবছে, “জীবন এত দ্রুত দৌড়াচ্ছে কেন এই চলন্ত বাসের মতো?”
খাওয়ার সময় একটা বিষয় খেয়াল করেনি কিন্তু এখন সেটা মনে পড়তে মিষ্টি মুখ ঘুরালো নবাবের দিকে। সকালে ঘুম থেকে জেগে মিষ্টি নবাবের মুখে মাস্ক আর মাথায় ক্যাপ দেখেনি। পরে যদিও ক্যাপ লাগিয়ে নিয়েছিল কিন্তু মাস্ক ছিল না। তবে খাওয়া শেষ করে আবার সেগুলো লাগিয়ে নিয়েছে। মাথা বাসের সিটে লাগানো আর বুজে রাখা চোখ হয়ত কল্পনার রাজ্যে করছে বিচরণ। পূর্ণ দৃষ্টিতে নবাবকে দেখে ডাকলো মিষ্টি, “নবাব?”
মিষ্টির ডাকে অতিদ্রুত সোজা হয়ে বসে বললো, “খেয়েছো এবার বিশ্রাম নাও৷ ঝগড়াগুলো বিছানাকান্দির জন্য জমিয়ে রাখো।” হিজাবের মাঝে ভাসা ক্লান্ত চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিলো মিষ্টি নবাবের দিকে। ওর এমন চাহনিতে নবাব জানতে চাইলো, “এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আগে দেখোনি আমায়?”
তেমনই দৃষ্টি রেখে কাঠ গলায় মিষ্টি বললো, “এক হাতে তালি বাজে না। ঝগড়া আমি একা নিশ্চয়ই করি না। তুমি নিজেই ঝগড়া শুরু করো। এই যে এখন…এখন কি আমি ঝগড়া করার মতো কিছু বলেছি?”
কাঁধ নাচিয়ে বললো নবাব, “আহা! আমি কি সেটা বলেছি?”
“সুযোগে তো কিছু বলতে বাকি রাখো না।” বলেই সোজা হয়ে বসলো মিষ্টি।
“ঠিক আছে, আমিই ঝগড়া করি। এখন কী বলতে চেয়েছিলে, সেটাই বলো।”
“কিছু না।” অভিমান ভাসলো মিষ্টির কন্ঠে আর সেটা টের পেয়ে নবাব প্রতুত্তরে বললো, “এবার কিন্তু ঝগড়া শুরু করতে দেরি করবো না।”
হা-হুতাশ করে বলে উঠলো মিষ্টি, “নবাব, আমি ক্লান্ত। আমার শান্তির প্রয়োজন। জীবন নিয়ে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। ভাবিনি কোনওদিন আমার জীবন নামক নৌকা বৈঠা বিহীন যেখানে-সেখানে বয়ে বেড়াবে।”
“বৈঠা বিহীন কেন বলছো? আমাকে কি তোমার জীবন নৌকার মাঝি করতে পারো না?” নবাবের কন্ঠ মায়া জড়ানো।
“ঝড়ে ডুবতে যাওয়ার নৌকার মাঝি কেন হতে চাইছো? এখনও কেন নিজের ভালো-মন্দ বুঝতে পারছো না। তুমি তো বাচ্চা নও, পাগলও নও। তাহলে কেন এমন নির্বোধ হলে তুমি?”
মাথা নুইয়ে নিলো নবাব। মিষ্টি ওর চেয়ে বয়সে বড় সেক্ষেত্রে ওকে ছোট বলতে পারে। কিন্তু বাচ্চা বলবার কোনও যুক্তি নেই কারণ সে নিজের ভালো-মন্দ বুঝে শিখেছে বহুদিন আগেই, “হয়ত বাচ্চা নই কিন্তু পাগল তো হয়েছি সেই কবে থেকে।”
নবাবের মুখ নিসৃত বাক্যে মনে মনে হাসলো মিষ্টি কিন্তু সাধারণ গলায় বললো, “তোমার এই কথার ফাঁদেই সকলে পড়ে, না?”
চোখ তুলে নবাব খোশমেজাজে বললো, “সবাইকে দিয়ে কী হবে? তোমাকে ফাঁদে ফেলতে পারলেই বাজিমাত।”
কয়েক মূহুর্ত মিষ্টি নবাবকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলো। এরপর ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো, “কত-শত চিন্তার মাঝেও তুমি এমন হাসো কীভাবে? আমি তো পারি না হাসতে। বারংবার কেবল মরতে ইচ্ছে করে।”
“মৃত্যুকে ইচ্ছের মধ্যেই আবদ্ধ রাখো কারণ বাস্তবায়ন করতে গেলে কঠিন শাস্তিকে নিমন্ত্রণ জানালে।” এই প্রসঙ্গে চুপ থেকে মিষ্টি অন্য প্রসঙ্গ টানলো, যেই প্রসঙ্গে কথা বলতে মিষ্টি নবাবকে ডেকেছিল, “কেকটা কি কাকতালীয় ছিল না-কি জেনে-শুনে?”
“কী মনে হয়?” ভ্রু নাচিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো নবাব।
“মনে তো হয় জেনে-শুনে কিনেছো।… এতো আগের কথা এখনও মনে আছে?”
…চলবে কি?