#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৯
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
বড় সর্দার বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে মিষ্টি দেখতে পেল প্রাচীন স্থাপত্য ভাস্কর্যের দুইটি ঘোড়া। জাদুঘরে প্রবেশ করেই আরও দেখতে পেল শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের তৈরি গরুর গাড়ির ভার্স্কয, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবক্ষ ভার্স্কয ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আবক্ষ ভার্স্কয।
বড় সরদার বাড়ি গ্যালারি ও জয়নুল আবেদীন স্মৃতি জাদুঘরের গ্যালারিতে অনেক কিছু ঘুরে ঘুরে দেখতে পেল। গ্যালারিগুলোতে কাঠ খোদাই, কারুশিল্প, পটচিত্র ও মুখোশ, আদিবাসী জীবনভিত্তিক নিদর্শন, গ্রামীণ লোক জীবনের পরিবেশ, তামা কাসা পিতলের নিদর্শনে লোকজ বাদ্যযন্ত্র ও পোড়ামাটির নিদর্শন, লোকজ অলংকারসহ অনেক কিছুই রয়েছে।
চোখ ঘুরিয়ে দেখছে মিষ্টি সবকিছু খুব মনোযোগ দিয়ে। হঠাৎ মলি আর পপিকে দেখতে পেল খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হাসছে। কারণ জানবার আগ্রহে দুই কদম এগিয়ে এসে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “এত হাসছিস কেন তোরা?”
মলি মুখে হাত চেপে খানিকটা হেসে নিলো। হাতের ইশারায় মিষ্টিকে কাছে ডেকে বললো, “সাদ্দাম স্যার আছে না?”
“থাকবে না কেন?”
“আরে আমাকে বলতে দেয়।” বিরক্ত হলো মলি।
“তো বল।”
“সাদ্দাম স্যার না-কি সাদিয়ার ফোন নম্বর চেয়েছিলেন।”
দায়সারা ভাব নিয়ে, “তো? এতে এত হাসাহাসির কী আছে?”
হালকা চাটি মেরে মলি বললো, “বুদ্ধু কোথাকার। তুই সারাজীবন এমনই থাকবি, নিরামিষ।” মিষ্টি কোনও জবাব দিলো না কেবল ঠোঁট উল্টে চুপটি করে রইলো।
.
সারাদিন ঘোরাঘুরি আর খাওয়াদাওয়া পর সবাই এখন উদ্যোগ নিয়েছে বাসায় ফেরার জন্য। ফিরতি পথে এবার জানালার পাশের সিটে বসলো মিষ্টি। এত হাঁটাহাঁটির পর সবাই ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়েছে বাসের সিটে।
বাসের ভেতর আলো জ্বলছে কিন্তু সে আলোর চেয়ে চাঁদের আলো মিষ্টিকে বেশি বিমোহিত করছে। খোলা জানালা দিয়ে তীব্র বাতাস প্রবেশ করে তার হিজাব এলোমেলো করার পাশাপাশি মনকেও এলোমেলো করে দিচ্ছে।
কাজল কালো আকাশে একটুখানি শুভ্র চাঁদের আলো উপভোগ করতে গিয়ে মিষ্টি কারোর সম্বোধনে আঁতকে উঠলো, “মিষ্টি?”
নবাবের ডাকে সে সোনারগাঁওয়ের রাত্রির ভাবনা থেকে সরে এলো। নিঃশব্দে চোখাচোখি করলো বিধায় নবাব নিজেই প্রশ্ন করলো, “এখন খাবে?”
তৃপ্তিদায়ক সময় পার করছিল মিষ্টি এতক্ষণ ধরে। হঠাৎ নবাবের প্রশ্নে গম্ভীর হয়ে পড়লো। চোখ সরিয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলো, “নাহ।”
ফোন থেকে ইয়ারফোন খুলে সেটা পকেটে রাখার ফাঁকে নবাব বললো, “আমার উপর রাগ করো সমস্যা নেই কিন্তু সেই রাগ আমাকে না দেখিয়ে খাবারের ওপর দেখানোর মানে কী?” প্রশ্নের জবাব দিলো না মিষ্টি।
“চুপ করে আছো কেন?”
তীক্ষ্ণ চাহনিতে মিষ্টি এবার জানতে চাইলো, “দুই মিনিট পরপর তোমার কি আমার সাথে ঝগড়া না করলে ভালো লাগে না?”
“কারোর যত্ন-আত্তি করা আর ঝগড়া করা কি একই জিনিস?”
খেঁকিয়ে উঠলো মিষ্টি, “আমার লাগবে না তোমার যত্ন-আত্তি। আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো আগে এরপর তোমার যত্ন-আত্তি দেখিও।”
হালকা হেসে, “আমি নিয়ে যেতে চাইলেও এখন তুমিই আর যেতে চাইবে না।”
“কে… কেন?” কথা আটকে এলো মিষ্টির।
মিষ্টির মুখপানে তাকিয়ে কন্ঠ নরম করলো নবাব, “কে চাইবে নিজের স্বামীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে?” নবাবের এমন বাক্যে মাথা নুইয়ে নিলো মিষ্টি। সে জানে না হঠাৎ তার গাম্ভীর্য কোথায় উধাও হয়ে গেল? একটা চিনচিনে ব্যথায় হৃদয় কুঁকড়ে উঠলো আর চোখে কিঞ্চিৎ বৃষ্টির আগমন হলো। এই বৃষ্টির দেখা নবাব পেল না কারণ তীব্র কষ্টে চোখের জল স্বল্প হয় কখনও কখনও। তবে আচমকা নত হওয়া মিষ্টির চোখ দেখে কিছু একটা ঠাওর করে বললো, “তোমাকে তো আমি বলেছি মিষ্টি, এই আমি তোমাকে তোমার চেয়েও বেশি জানি। যতই বোঝাও আমাকে তুমি অপছন্দ করো, কিন্তু আমি তো জানি তুমি আমার প্রতি কতটা দূর্বল?”
নিজেকে স্বাভাবিক করে আঁড়চোখে তাকালো মিষ্টি নবাবের দিকে। গাম্ভীর্য ফিরিয়ে আনবার ব্যর্থ চেষ্টায় জিজ্ঞেস করলো, “রাত কি পার করবো তোমার কাব্য শুনে?”
সোজা হয়ে বসে সিটে হেলান দিলো নবাব। হা-হুতাশ করে বললো, “চলন্ত বাসে বসে আর কী করবো?”
“রাতে খাওয়ার ইচ্ছে নেই?” প্রশ্ন করে তাকিয়ে রইলো আর নবাব বাসের ছাদে দৃষ্টি রেখে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “থাকবে না কেন?”
বিরক্ত হলো মিষ্টি, “আহা! পাল্টা প্রশ্ন করো কেন? ক্ষিধে নেই তোমার?”
চোখ বুঁজে জবাব দিলো, “খাবো না রাতে।”
“প্রতি বেলায় নাটক করো না তো।… ঠিক আছে, আমি খাবো। খাবার বের করো।”
মিষ্টির দিকে ফিরে কাঠ গলায় নবাব বলে উঠলো, “তুমি খেলেও আমার খাওয়ার ইচ্ছে নেই। কথা শুনিয়েই পেট ভরিয়ে দিয়েছো।”
“সব দোষ তো আমার, তাই না? তো এটা বললেই পারো। আমারই তো ভুল ছিল। সত্যি আমারই ভুল ছিল। যদি তোমার সাথে এতটা খোলা মনে কথা না বলতাম তাহলে আজকে এতসব দেখতে হতো না।” শরীর বাঁকিয়ে বসলো মিষ্টি। বাসের বাইরে দৃষ্টি রেখে বললো, “ছোট্ট বেলা থেকে ভাইয়ের নজরে দেখেছি। তোমার কথায় আমি বন্ধু ভাবতে শুরু করেছিলাম আর সেই তুমি কি-না আজ আমার…” থেমে গেল মিষ্টি। ওকে থামতে দেখে নবাব মুখ এগিয়ে বললো, “থামলে কেন? বলো, বলো কী করেছি তোমায়? বাসের ভেতরে চুপ থাকতে পারছো না তুমি?”
“নাহ, পারছি না। আমার চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। সব ছেড়ে ছুঁড়ে পালাতে ইচ্ছে করছে আর…”
দাঁতে দাঁত চেপে জানতে চাইলো নবাব, “হুম, আর? প্রতিবার থামো কেন?… বলো কথাটা।… ঠিক আছে, আমিই বলছি। তোমার এখন হয় আমাকে নয়ত নিজেকে শেষ করতে ইচ্ছে করছে। তো মেরে দাও আমায় কিন্তু ভুলেও নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না।”
“কেন করবো না? এটা আমার জীবন। তাই আমার যা খুশি আমি তাই করবো।”
ধীর গলায় নবাব বললো, “মিষ্টি, এটা তোমার জীবন কখনওই ছিল না। তোমার অজান্তেই তোমার জীবন অন্য কারোর হয়েছে। বিয়ে করার পূর্বেই সে ভালোবাসার বিনিময়ে তোমার জীবন কিনে নিয়েছে আর এখন তো তুমি তার পত্নী। তাহলে কীভাবে ভাবলে সে বেঁচে থাকতে তুমি তোমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে?”
শান্ত গলা কিন্তু বাঁকা চাহনীতে মিষ্টি প্রশ্ন করলো, “এমন জাদুকরী শব্দের প্রয়োগ করে মানুষের মন ভোলাও তুমি, তাই না?”
আবারও সোজা হয়ে বসলো নবাব, “এটা পারলে ভালো হতো। এখন অযথা তোমার সাথে কথা কাটাকাটি করতে হতো না।”
“তারমানে এটা অস্বীকার করছো?”
“আচ্ছা, এমন ঠুনকো বিষয় নিয়ে কেন ঝগড়া করছো?”
মেজাজ বিগড়ে গেল মিষ্টির, “হ্যাঁ, আমিই তো ঝগড়া করি। ঝগড়ুটে মেয়ে আমি আর তুমি ভালোর মহারাজ।”
চোখমুখ কুঁচকে কোনোমতে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করলো নবাব, “মিষ্টি, দিনকে দিন এত বদলে কেন যাচ্ছো তুমি? আগে যখন স্বাস্থ্যবতী ছিলে, তখন মনটাও স্বাস্থ্যবতী ছিল ভালোবাসায়। এখন শরীরের সাথে সাথে তোমার মনও শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।” কিছু বলার ইচ্ছায় শব্দহীন মুখ কাঁপলো মিষ্টির কিন্তু এমন তিক্ত সত্য কথা হজম করতে না পেরে চুপ করে গেল।
রাত গভীর হচ্ছে। এতে বাইরের পরিবেশ যেন রহস্যের জালে বাঁধা পড়ছে। বাসের সিটে পাশাপাশি বিরাজমান দু’টো প্রাণের অস্তিত্ব অথচ রাগ অভিমানের পালায় মুখ ফিরিয়ে রেখেছে উভয়ে। অনেকক্ষণ ধরে দু’জনের মাঝে কোনও কথা হচ্ছে না। একটা অপরাধ বোধ কাজ করছে বলে মিষ্টিও নবাবকে ফিরে দেখছে না। নবাবের কথা ভুল নয়। কারণ সতেরো বছর বয়সে মিষ্টি অনেক স্বাস্থ্যবতী ছিল। ওর দেহের ওজন প্রায় ৭৪ কেজি ছিল। কিন্তু বান্ধবীরা মানানসই দেহের ছিল বলে ওর মনে ক্ষোভের জন্ম হয়। সেই থেকে অনাহারে থাকার অভ্যাস গড়ে তুলে। বছরের পর বছর মেদ কমানোর চেষ্টায় মিষ্টি এখন ৪৯ কেজিতে এসে ঠেকেছে।
“দেহের সাথে আমার মন কি সত্যিই বদলে গেছে?” নিজের মনকে প্রশ্ন করলো মিষ্টি কিন্তু জবাব পেল না। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে চোখ বুঁজে পড়ে রইলো বাসের সিটে।
…চলবে কি?