#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৮
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
মা চলে যেতে শরীরের আড়মোড়া ভেঙে হাই তুললো মিষ্টি। চোখের পাতায় লেগে থাকা ঘুম সরাতে চাইলেও ঘুম যেন সরতে চাইছে না। হঠাৎ টেবিলের ওপর নজর পড়তে কিঞ্চিৎ অবাক হলো মিষ্টি। ওর স্কুল ব্যাগের পাশে দুই প্যাকেট বিস্কুট, কিছু পাকা বরই, দু’টো জুসের প্যাকেট দেখে মুখ নাড়ালো, “এতকিছু আনিয়েছে মা বাবাকে দিয়ে?” এবার কপাল কুঁচকে বললো, “এসব না ভালো লাগে না। মা যে কেন বুঝে না? এতসব খাবার নিয়ে আমি সোনারগাঁও যাবো?… ধ্যাত!”
.
“সাবধানে থাকিস মা আর খাবারগুলো একটু পর পর খেয়ে নিবি।” মেয়ের মাথার হিজাব ঠিক করার ফাঁকে আদুরে গলায় বললেন নিঝুম। এদিকে মিষ্টির মুখ ভার হয়ে আছে এতসব খাবার জোরপূর্বক নিয়েছে বলে।
স্থুলকায় দেহের অধিকারী মিষ্টি ইদানীং খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে কিন্তু ওর মায়ের বক্তব্য, “এখন খাবি না তো কবে খাবি? আর তোকে কে বলে তুই মোটা?”
মিষ্টির প্রায় সব বান্ধবী লিকলিকে শরীর নিয়ে বেঁচে আছে, সেখানে নিজের স্থুলকায় দেহ দেখলে ওর মন ভার হয়ে আসে। মুখ ফুটে মাকে কিছু না বললেও সে ভেতরে ভেতরে কষ্ট পায়, “আমি এতো মোটা কেন?”
মাথায় হাত বুলিয়ে মায়ের ভালোবাসা কপালে ছুঁইয়ে নিঝুম বললেন, “যা, তোর বাবা নিচে অপেক্ষা করছেন।”
“হুম।” ছোট্ট জবাবে মিষ্টি হাঁটতে শুরু করলো। পায়ে পায়ে বাড়ি পার করে পিচঢালা পথে এসে দেখলো ওর বাবা রিকশা থামিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মেয়েকে দেখে হাত নাড়িয়ে ডাকলেন সোবহান, “তাড়াতাড়ি এসো।”
মিষ্টির মা ওকে ‘তুই’ সম্বোধন করলেও বাবা ওকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে। লোকে বলে বাবার সাথে মেয়ের আর মায়ের সাথে ছেলের ভালোবাসা বেশি থাকে। কিন্তু সেই ছেলেবেলা থেকে মিষ্টি ওর বাবাকে বড্ড ভয় পায়। তাই বাবার চেয়ে মায়ের সাথেই ওর বন্ধুত্ব বেশি।
রিকশার কাছাকাছি হতে সোবহান জিজ্ঞেস করলেন, “নাস্তা করেছো আম্মু?”
সামনে পিছনে মাথা নাড়িয়ে মিষ্টি জবাব দিলো, “হুম।”
“রিকশায় উঠো।” এবার শব্দহীন মাথা নাড়িয়ে রিকশায় চেপে বসলো মিষ্টি। সোবহান রিকশায় উঠতেই সেটা চলতে শুরু করলো।
প্রধান সড়কে রিকশা উঠবার আগে একটা বাঁশ বাগান পড়ে প্রতিবার। সে বাগান দেখলে মিষ্টি প্রতিবারই ভয়ে চুপসে যায়। কারণ সে শুনেছিল এই বাগানে ভূত এবং সাপ দু’টোই আছে। ভয় পেলেও চলাচলের পথে প্রতিবার বাগানে দৃষ্টি দিতে ভুল করে না মিষ্টি। আজকে তাকাতে গিয়ে দেখলো কোঁকড়া চুলের একটা ছেলে বাঁশ বাগানে কিছু বন্ধুদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এখন মিষ্টির উপর। এই ছেলেকে মিষ্টি চেনে। এর নাম কবির। চেয়ারম্যানের একমাত্র ছেলে কিন্তু উটকো স্বভাবের। তাই একে দেখলে ঘাবড়ে যায় মিষ্টি।
স্কুলে পৌঁছে মিষ্টি রিকশা থেকে নেমে দাঁড়াতেই সোবহান বললেন, “সাবধানে থেকো। আমি সন্ধ্যার আগেই স্কুলে এসে দাঁড়িয়ে থাকবো। তুমি চিন্তা করো না।”
“ঠিক আছে।”
স্কুলের মাঠের চেহারা আজকে অন্যরকম। বাস আর ছাত্রী দিয়ে ভরে আছে সবুজ মাঠ। সকল শিক্ষক এবং শিক্ষিকা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন ছাত্রীদের সামলাতে। শিশু শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রী থাকলেও শিক্ষা সফরে কেবল নবম দশম শ্রেণির ছাত্রীদেরকে নেওয়া হচ্ছে।
মিষ্টি গুটিগুটি পায়ে নিজের সঙ্গীদের খোঁজ করে চলেছে কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছে না, “ওরা কি এখনও আসেনি?” নিজেকে প্রশ্ন করবার মাঝেই মিষ্টি শুনতে পেল, “এই মিষ্টি?” পরিচিত কন্ঠে নিজের নাম শুনে অবাক হলো মিষ্টি। ডান দিকে ফিরে তাকিয়ে খুশি হলো। পা ফেলে হাঁটতে গিয়ে প্রশ্ন করলো খানিকটা জোরে, “কখন এসেছিস?”
ফর্সা মুখের মেয়েটা জবাব দিলো, “পনেরো মিনিট হবে।”
পাশের মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো, “মিষ্টি, তুই দেরি কেন করলি? সবসময় না আমাদের আগে স্কুলে আসিস?”
“আরে ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে দেরি হলো।”
“কথা কম বলে বাসে চল। দেরি করে গেলে আবার সিট পাবো না।” ফর্সা মেয়েটি নির্দেশের ভঙ্গিতে বলে উঠলো।
“মলি আমি কিন্তু তোর পাশে বসবো আর ফেরার সময় আমাকে জানালার পাশে বসতে দিতে হবে।” মিষ্টি বলে উঠলো।
মলির পাশের মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো, “তবে আমি কি বাসের ছাদে বসবো?”
মলি হেসে বললো, “এক কাজ কর তোরা। আমাকে দুই ভাগ কর। ডান ভাগে বসবো মিষ্টির সাথে আর বাম ভাগে বসবো পপির সাথে।” মলির কথা শুনে হো-হো করে হেসে উঠলো সবাই।
.
সূর্যের প্রখরতা চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো কিন্তু চলন্ত বাসে বসে বাতাসে সেটা তেমন টের পাচ্ছে না মিষ্টি। খুব একটা ঝামেলা না করেই মিষ্টির পাশে মলি বসেছে। তবে শর্ত অনুযায়ী জানালার পাশের সিট দখল করেছে মলি।
বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ বাস এসে থামলো সোনারগাঁও জাদুঘরে। সবাই বেশ উৎসুক হয়ে দেখতে লাগলো কিন্তু মাঝ বয়সী একজন মহিলা বলে উঠলেন, “সবাই নামো তাড়াতাড়ি। ভেতরে গিয়েই এবার দেখতে পারবে।” উনি রহিমা ম্যাডাম, মিষ্টির স্কুলের সমাজ বিষয়ক শিক্ষিকা। উনার কাছে মিষ্টি সোনারগাঁও সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছে। দুইদিন আগে ছোট্ট একটা সেমিনার হয়েছিল আর সেখানে বক্তব্য রেখেছিলেন রহিমা বেগম, “সোনারগাঁও যাওয়ার তো আমাদের উচিত জায়গাটা সম্পর্কে ধারণা নেওয়া, তাই না?”
“জি ম্যাডাম।” হলরুমে শোনা গেল সকল শিক্ষার্থীর সম্মিলিত সম্মতি।
“তাহলে এবার সংক্ষেপে বলছি আমি আর তোমরা মনোযোগ দিয়ে শোনো।” একটু থেমে রহিমা বেগম বলতে শুরু করলেন সোনারগাঁও নিয়ে, “সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর, রাজধানী ঢাকা থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলায় অবস্থিত। বাংলাদেশের লোকশিল্পের সংরক্ষণ, বিকাশ ও সর্বসাধারণের মধ্যে লোকশিল্পের গৌরবময় দিক তুলে ধরার জন্য ১৯৭৫ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকার বিশাল এলাকা নিয়ে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন। সোনারগাঁয়ের “বড় সর্দার বাড়ি” নামে পরিচিত একটি প্রাচীন জমিদার প্রাসাদে এই জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও এখানে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, কারুপল্লী ও একটি বিশাল লেক।
জাদুঘরে আমরা ইন শা আল্লাহ দেখতে পাবো বাংলার প্রাচীন সুলতানদের ব্যবহৃত অস্ত্র-শস্ত্র, তৈজসপত্র, পোশাক, বর্ম, অলংকার ইত্যাদি। বাংলার প্রাচীন ও মধ্য যুগের লোকশিল্পের অনেক নিদর্শন রয়েছে এখানে, রয়েছে বাংলার প্রাচীন মুদ্রা। কারুপল্লীতে বৈচিত্র্যময় দোচালা, চৌচালা ও উপজাতীয়দের আদলে তৈরি ঘরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অজানা, অচেনা, আর্থিকভাবে অবহেলিত অথচ দক্ষ কারুশিল্পীর তৈরি বাঁশ-বেত, কাঠ খোদাই, মাটি, জামদানি, নকশিকাঁথা, একতারা, পাট, শঙ্খ, মৃৎ শিল্প ও ঝিনুকের সামগ্রী ইত্যাদি কারুপণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে।
আমরা যেদিন যাবো, সেদিন গিয়ে লোকশিল্প মেলাও দেখতে পারবো। কারণ প্রতি বৈশাখ মাসে এখানে সাড়ম্বরে আয়োজিত হয় লোকশিল্প মেলা। এই মেলায় লোকসংগীত, যাত্রাপালা, কবিগান ইত্যাদি লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানমালা পরিবেশন করা হয়। মেলায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসেন লোকজ শিল্পী ও কারুশিল্পীরা। মাটি, শোলা, বাঁশ, বেত, কাপড়সহ বিভিন্ন হস্ত শিল্পজাত সামগ্রী বিক্রি হয় এই মেলায়। এছাড়াও জাদুঘরের সম্মুখে অবস্থিত লেকে নৌকাভ্রমণ ও শীত মৌসুমে টিকেট কেটে মাছ ধরার ব্যবস্থা আছে পাশাপাশি আমাদের খাওয়া-দাওয়ার জন্য রয়েছে ক্যান্টিন।”
বাস ছেড়ে সবাই নেমে দাঁড়ালো আর রহিমা ম্যাডামের কথা অনুযায়ী সেই “বড় সর্দার বাড়ি” চোখে পড়লো। তবে এর আগে কিছু পথ হেঁটে আসতে হলো এবং প্রবেশপথে টিকিট দেখাতে হলো।
…চলবে কি?