#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৩
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
ঘরে আসবাবপত্র বলতে একটা খাট, ড্রেসিং টেবিল আর আলমারি ছাড়া অন্য কিছু নজরে এলো না মিষ্টির। লাল শাড়ির আঁচলে হাত-মুখ মুছে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ির খোঁজ করলো। বিছানার পাশের যেই দেয়ালে জানালা রয়েছে, সেই দেয়ালে সাদা রঙের ঘড়িতে কালো কাঁটার টিকটিক শব্দ শুনতে পেল। রাত সাড়ে বারোটা কিন্তু মিষ্টির পেটে ক্ষুধায় চৌদ্দটা বেজে গেছে। তখন যদিও বা নবাবকে বলেছিল, ক্ষিধে নেই কিন্তু এখন সেটা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
সবুজ পাতা আর হলুদে ফুলের নকশা সম্বলিত চাদর শোভা পাচ্ছে বিছানায়। পা ঝুলিয়ে বিছানায় বসে অহেতুক সেই চাদর তাকিয়ে বিড়বিড় করলো মিষ্টি, “একে তো অপরিচিত জায়গা আবার ক্ষিধায় পেট চোঁ-চোঁ করছে৷” হঠাৎ মিষ্টির কিচেনের কথা মনে পড়তে উঠে দাঁড়ালো।
পায়ে পায়ে দরজার কাছে এসে রুমের বাইরে চোখ বোলালো। বসবার ঘর তেমনই জনশূন্য আর নবাবের হদিস নেই। কিছুটা ভয় নিয়ে কিচেনে চলে এলো ধীর পায়ে। ফাঁকা কিচেনে মিষ্টি কেবল গোটা কয়েক তেলাপোকা দেখতে পেল। অন্য সব মেয়েদের মতো তেলাপোকা দেখে ভয় পায় না মিষ্টি। তাই পাশ কাটিয়ে কিচেনের কলের কাছে এসে দাঁড়ালো। হাতের সাহায্যে কয়েক ঢোক পানি পান করে ক্ষনিকের জন্য ক্ষুন্নিবারণ করলো। সোজা হয়ে যখন ভেজা হাত আঁচলে মুছতে শুরু করলো, তখন কিচেনের জানালায় ওর চোখ পড়লো।
মাকড়সার জালে জড়ানো জানালা অতি সাবধানে খুলে দিতে মেইন গেট নজরে এলো আবছা কৃত্রিম আলোর সাহায্যে। গেইটের পাশেই চুপচাপ দাঁড় করানো গাড়িটা দেখতে পেল, যেই গাড়ি দিয়ে নবাব তাকে বন্দী করে এনেছে। বারান্দার আলোয় মিষ্টি চারপাশ ভালো করে দেখে আনমনে বললো, “আশেপাশে কিচ্ছুটি নেই। আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও কোনো কাজ হবে না। আর এখান থেকে পালানো আমার মতো মেয়ের পক্ষে কস্মিনকালেও সম্ভব না।”
ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো মিষ্টি। নিজের রুমে প্রবেশ করার ঠিক আগ মূহুর্তে ওর নবাবের কথা মনে পড়লো। নবাবের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলো ভেজানো দরজা কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে আছে। কিছু না ভেবে ধীরে ধীরে নবাবের রুমের কাছে এসে দরজা ঠেলে দিতে সেটা নিঃশব্দে খুলে গেলো।
মাথার বালিশ আঁকড়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে নবাব। মৃদু আলো পড়ছে নবাবের মুখে, সেই আলোয় ঘুমন্ত নবাবের নিষ্পাপ মুখ দেখে মিষ্টি ভুলে গেল তার সাথে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনা। নবাবের খুব কাছে এসে মেঝেতে হাঁটু ঘেরে বসতে গিয়ে মিষ্টির মনে পড়লো নবাবের বলা সেই কথা, “ছোট তো কী হয়েছে? আমি তোমার ছোট বলে কী আপু বলতে হবে? আমি তো তোমার বন্ধু আর বন্ধুকে কেউ আপু বলে?”
হুট করে যখন নবাব মিষ্টিকে নাম ধরে সম্বোধন করতে শুরু করে, তখন মিষ্টি আপত্তি জানিয়ে ছিল কিন্তু নবাব বন্ধুত্ব টেনে সেই আপত্তি অগ্রাহ্য করেছিল। তখন বিষয়টা মিষ্টিকে কিঞ্চিৎ ভাবালেও সে স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছিল কিন্তু আজকে বিষয়টা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। পুরোনো কিছু কথা নতুন করে এখন মনে পড়তেই মিষ্টি এবার মায়া নয়, নবাবের প্রতি ক্ষোভ অনুভব করলো আর অতি দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলো। কিন্তু আচমকা পিছন থেকে শুনতে পেল, “আমাকে ফেলে যেও না মিষ্টি, যেও না মিষ্টি, যেও না।”
আঁতকে উঠে পিছন ফিরলো মিষ্টি। ওর মনে শঙ্কা ঘিরে ধরলো, “নবাব জেগে আছে?” ডান হাতে চাপা আঁচল এবার দুই হাতে চেপে ধরে নবাবকে পর্যবেক্ষণ করে মনে মনে বিড়বিড় করলো, “নাহ, ঘুমের ঘোরে উল্টো পাল্টা বকছে।”
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মাথা ঘুরানোর পূর্বে নবাবের হাতের তলায় কী যেন দেখতে পেল? জিনিসটা ভালো করে দেখার জন্য এবার নবাবের হাতের তলায় নজর দিলো। একটা হাসোজ্জ্বল মেয়ের ছবি নবাবের হাতের তলায় চাপা পড়ে আছে। ভালো করে ছবিটার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত মিষ্টি শব্দহীন মুখ নাড়ালো, “এটা তো আমার ছবি।”
.
জিপ গাড়ি থেকে নেমে কিছু পলিথিনের ব্যাগ হাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো নবাব। কাঠের দরজার কাছাকাছি এসে এক হাতে তালা খুলে ঘরে প্রবেশ করলো। সাতসকালে নবাব বেরিয়ে ছিল গাড়ি নিয়ে, খাবার আর কিছু জিনিসপত্র ব্যবস্থা করতে। দোকানপাট এতো সকালে খোলা নেই বিধায় তেমন কিছু জোগাড় করতে পারেনি। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে মিষ্টিকে একা ঘরে তালাবদ্ধ করে বেরিয়ে ছিল।
মিষ্টির দরজার কাছে এসে দাঁড়াতে এক প্রকার কষ্ট অনুভব করলো নবাব কিন্তু দীর্ঘশ্বাসে সেটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টায় দরজায় টোকা দিলো। কয়েক সেকেন্ড বাদে ভেতর থেকে জবাব এলো, “খোলা আছে।” অনুমতি পেয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে এলো নবাব।
বিছানা আধো শোয়া অবস্থায় দিয়ে হাঁটু ভাজ করে রেখেছে মিষ্টি। স্নিগ্ধ সকালে সাজ এবং অলংকার বিহীন মিষ্টিকে নবাবের কাছে একটু অন্য রকম লাগছে। মুখে বিষাদের ছায়া আর চোখে কষ্টের মায়া যেন চোখ ধাঁধাচ্ছে নবাবের। একদিনেই মিষ্টির মুখ শুকিয়ে চোখের তলায় কালি জমে গেছে। এমন মুখপানে তাকিয়ে নিজেকে অপরাধী মনে হলো তার।
বিছানার এক কোণে পলিথিনের ব্যাগ রেখে নবাব জানতে চাইলো, “ঘুমাওনি রাতে?”
খোলা জানালা ভেদ করে মিষ্টি বাইরে তাকিয়ে আছে। নবাবের উপস্থিতিতেও তার মাঝে কোনো নড়নচড়ন হয়নি এমনকি উত্তর দেওয়ার জন্যও বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করলো না।
মিষ্টির থেকে কোনও সাড়া পাইনি নবাব। ওর এমন করাটা অন্যায় নয় তাই প্রশ্ন না করে এবার বললো, “এখানে খাবার আছে, খেয়ে নাও।”
দৃষ্টি বাইরে স্থির রেখে মিষ্টি বলে উঠলো, “বাসায় যাবো আমি।”
মিষ্টির কথায় চোয়াল শক্ত হলো নবাবের, “যেসব কথার মূল্য নেই আমার কাছে, সেসব কথা বলে গায়ের শক্তি ব্যয় করো না।… ঘন্টাখানেক পরে কাজি আসবে বিয়ে পড়াতে, তৈরি থেকো।”
নড়ে উঠলো মিষ্টি। সোজা হয়ে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলো, “কীসের জন্য তৈরি থাকবো আমি? বউ হতে, খুন হতে না-কি বিধবা হতে?”
মিষ্টির প্রশ্নের উত্তর দিলো না নবাব কিন্তু মিষ্টি তাকিয়ে আছে উত্তরের জন্য। নত চোখে নবাব ছোট্ট করে অন্য জবাব দিলো, “খেয়ে নাও।”
কপট রাগ নিয়ে, “আমার পরিবারের সম্মান মাটিতে মিশিয়ে আমাকে খেতে বলছো?”
এবার গর্জে উঠলো নবাব, “সম্মান? কীসের সম্মান? সবকিছু জেনেও যেই পরিবার একটা মেয়ের মন নিয়ে খেলা করে চলেছে, তাদের সম্মানের কথা ভাবছো তুমি?” নবাবের প্রশ্নে নিশ্চুপ হয়ে গেল মিষ্টি কারণ এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো শব্দ কিংবা বাক্য ওর জানা নেই।
“তোমার খেতে ইচ্ছে না করলে অনাহারে থাকো কিন্তু আমাকে খেতে হবে। কারণ পরবর্তী ঝড় সামলানোর জন্য নিজেকে আমায় তৈরি করতে হবে।” এই বলে নবাব চলে গেল।
…চলবে কি?