#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
সূর্য ডুবে চাঁদকে পাঠিয়েছে আকাশের সঙ্গী হতে। বালুচরের চারপাশ আঁধারে ছেয়ে গেছে। আশে-পাশে প্রাণের অস্তিত্ব নেই শুধু গাছগুলো দানবের মতো মুখিয়ে আছে। আকাশের কালো রঙে নবাব অনুমান করে নিলো মাগরিবের সময় পেরিয়ে গিয়েছে। নিজেকে তার বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছে কিন্তু ক্লান্তিতে গাড়ি চালানো বন্ধ করতে চায় না সে। কারণ মিষ্টিকে নিয়ে যতদ্রুত সম্ভব নিরাপদ আশ্রয়ে স্থান নিতে হবে নয়ত হিতে বিপরীত হতে পারে।
স্টিয়ারিং ঘোরাতে ব্যস্ত হাত আর ক্লান্ত চোখের দৃষ্টি সম্মুখে তার। কিন্তু মনের রাজ্যে মিষ্টির আনাগোনায় ক্লান্ত চোখে সে তাকালো পাশে অবস্থানরত মিষ্টির দিকে। নির্জীব মিষ্টি ঘুমের সাগরে তলিয়ে আছে। গাড়ি এখন সড়ক ধরে ছুটছে। তাই বিপরীত গাড়ির হেডলাইটে ক্ষণে ক্ষণে মিষ্টির একরত্তি মুখ স্পষ্ট দেখতে পেল নবাব। হঠাৎ বুকের ভেতরে কষ্ট আর ভয় নেড়ে উঠতে নবাব আনমনে বললো, “মিষ্টি, তোমাকে পাবার জন্য শুধু তোমার চোখে নয়, পুরো দুনিয়ার সামনে আমি খারাপ হতে রাজি। আমি খারাপ হলে যদি তোমাকে পাই তবে এমন খারাপ আমি আজীবন হয়ে থাকতে চাই।” ভাবনার মাঝে নবাব সামনে তাকিয়ে বুক ভরে বাতাস রাতের বাতাস শুষে নিলো। গাড়ির গতি বাড়িয়ে দ্রুত হাতে স্টিয়ারিং ঘোরাতে মন দিলো।
.
“মিষ্টি, মিষ্টি?” নিজের নাম কারোর কন্ঠে শুনে জেগে উঠলো মিষ্টি। হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে সোজা হওয়ার সময়টুকু মিষ্টির মনে হয়েছিল, সে হয়ত স্বপ্ন দেখছিল। একটা অলীক স্বপ্নে সে বিভোর এতটা সময় বিভোর ছিল কিন্তু নিজেকে গাড়িতে দেখতে পেয়ে তার ভাবনা উবে গেল৷
মিষ্টি আশেপাশে চোখ বুলাতে শুরু করলো। গাছপালায় ঘেরা একটা বাড়ি ভয়ংকর নিরবতা আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে অন্য কোনও বাড়ি ঘরদোর দেখতে না পেয়ে মিষ্টি চট করে আন্দাজ করলো এই বাড়ি লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে। ভয়ে নিজের শিরদাঁড়ায় শীতল স্রোত অনুভব করার মাঝে মিষ্টি শুনতে পেল, নবাব তাকে বলছে, “নেমে এসো।”
মিষ্টি সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। ঘুম থেকে জেগে উঠে হয়ত গুলিয়ে ফেলছে। তাই তো টের পায়নি নবাব কখন জিপ থেকে নেমে এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে আর আসামির মতো হ্যান্ডক্যাপ পড়া তার হাত মুক্ত করেছে? ঘুমানোর পূর্বে যেই মিষ্টি নবাবের সাথে তর্কে মত্ত ছিল, এখন সেই মিষ্টি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলা মানুষ মতো আচরণ করছে। কোনওরূপ প্রতিক্রিয়া ছাড়াই সে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো কিন্তু মাটিতে পা রাখার সাথে সাথে তার মাথা ঘুরতে শুরু করলো। কিঞ্চিৎ বেসামাল হতে বাম হাতে গাড়ি আঁকড়ে ডান হাত মাথায় রেখে নিজেকে সামলে নিলো। ভবনের মতো বাড়ির বারান্দা থেকে ক্ষীণ আলো অন্ধকার সরিয়ে দিচ্ছে আর সেই আলোকে ধার করে নবাব দেখতে পেল মিষ্টির বেহাল অবস্থা। এতে কিঞ্চিৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলো সে, “কী হয়েছে মিষ্টি?”
মাথায় হাত রেখে কোনওরকম মুখ নাড়ালো, “হঠাৎ মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছে।”
“ভেতরে চলো, বিশ্রাম নিবে।”
মিষ্টি চোখ বুঁজে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির চাবি পকেটে চালান করে মিষ্টির কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো নবাব, “কী হলো? যেতে পারবে না? খুব বেশি কি খারাপ লাগছে?”
শক্ত চোয়ালে মিষ্টি জবাব দিলো, “নাহ, যেতে পারবো।”
“তবে চলো।”
নিঃশব্দে মিষ্টি পা বাড়ালো আর ওর পিছনে নবাব হাঁটতে শুরু করলো। বারান্দা পেরিয়ে কাঠের দরজার সামনে এসে থামলো দুইজনে। পকেটে হাত দিয়ে চাবির খোঁজ পেতে কিছু সময় নিলো নবাব। শক্ত হাতে দরজা খুলে আগে মিষ্টিকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিলো। বাধ্য মেয়ের মতো মিষ্টি আধো অন্ধকারে ঘেরা ঘরে প্রবেশ করতে নবাব ভেতরে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। বাইরে থেকে যেই আলোটুকু আসছিল সেটাও এবার মিলিয়ে গেল।
শব্দ করে সুইচ টিপে দিতে পুরো ঘর আলোকিত হয়ে উঠলো। অন্ধকার সরিয়ে হঠাৎ এতো আলোতে মিষ্টির চোখ ছোট হয়ে এলো। পিটপিট করে সে চারপাশে নজর দিয়ে দেখলো এখন মিষ্টি একটা বসবার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের ডান পাশে দু’টো দরজা দেখা যাচ্ছে হয়ত শোবার ঘর আর ওর ডান হাত বরাবর একটা ঘরের দরজা খোলা আছে। দূর থেকে চুলোর এক অংশ দেখতে পেয়ে মিষ্টি বুঝে নিলো এটা হেঁশেল। ঘর পর্যবেক্ষণের মাঝে নবাব ধীর গলায় ডাকলো মিষ্টিকে, “মিষ্টি?”
পিছন ঘুরে তাকাতে নবাব আবার বললো, “জিনিসপত্র তো কিছু আনা হয়নি সাথে। তুমি বরং ঐ ডান দিকের ঘরটায় গিয়ে বিশ্রাম নাও।”
গা ভর্তি গহনা আর মুখের হালকা সাজে মিষ্টির মুখের মলিনতা আড়ল হয়নি। নোলক পড়া মুখ প্রতিক্রিয়া ছাড়াই নড়ে উঠলো, “বাসায় যাবো আমি।”
মিষ্টির গায়ে শক্তি নেই তা ওর চোখে মুখে স্পষ্ট ভাসছে। তাই নবাব এমন বাক্যে বিরক্ত হলেও অতি শান্ত গলায় বললো, “এখন গিয়ে বিশ্রাম নাও। এমন রাতদুপুরে একলা বাড়িতে তর্কাতর্কি করতে চাই না।”
“আমিও চাই না। তাই বাসায় নিয়ে চলো নয়ত আমি একাই চলে যাবো।”
বাম হাতে চুল পিছনে ঠেলে দিয়ে প্যাকেট থেকে ফোন বের করলো নবাব। চটজলদি ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে তাকালো মিষ্টির দিকে। একগাল হেসে জানতে চাইলো, “কীভাবে যাবে?”
“যেভাবে পারবো।”
“রাত এগারোটা বাজে নিশ্চয়ই বাড়ির বাইরে পা রাখার সাহস হবে না তোমার। যেই মেয়ে অভিভাবক ছাড়া সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে কখনও পা রাখেনি, সে এখান থেকে পালিয়ে যাবে তাও রাত্তির এগারোটায়। বাহ!” বলেই হালকা তালি দিয়ে উঠলো নবাব।
“আমার সম্পর্কে সব জানা হয়ে গেছে?”
“এটা নতুন করে বলার কী আছে? তোমাকে আমি তোমার চেয়ে বেশি জানি। আর জানি বলেই বলছি, তুমি এখান থেকে এক পা-ও নড়বে না অযথা আমাকে এসব বলে বিভ্রান্ত করছো।”
“যদি পালাতে পারি?” মিষ্টির প্রশ্নের মাঝে নবাবের ফোন বেজে উঠলো। নবাব কল রিসিভ করে বললো, “হ্যাঁ নিলয়, বল।”
“কোথায় আছিস?”
“যেখানে আসার কথা ছিল সেখানেই।” মিষ্টির দিকে তাকিয়ে নিলয়কে জবাব দিলো।
“কোনও সমস্যা হয়েছে?”
চোখ নামিয়ে ধীর গলায় উত্তর দিলো, “এখন অবধি নয়।”
“সাবধানে থাকিস আর আমি কালকে সকালে আসছি জিসানকে নিয়ে।”
“হুম।” কল কেটে দিলো নবাব। মিষ্টি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল এতটা সময় কিন্তু নবাবের কথা ব্যতীত ফোনের ওপাশের মানুষটার কথা শুনতে পেল না সে। কথায় বাঁধা প্রাপ্ত হওয়ার দরুন বিষয়টা চাপা পড়তে মিষ্টি ডাব দিকের রুমের দিকে হাঁটতে শুরু করলো কিন্তু শুনতে পেল, “মিষ্টি?”
মিষ্টি ঘুরে দাঁড়ালো কিন্তু নবাব চুপ করে চোখ নামিয়ে রেখেছে। তাই মিষ্টিই জানতে চাইলো, “কিছু বলবে?”
ধীরে ধীরে নবাব জবাব দিলো, “এতো গন্ডগোলের ভিড়ে খাবারের ব্যবস্থা করতে পারিনি। রাতে…”
“আমার ক্ষিধে নেই।” গম্ভীর গলায় মিষ্টি জবাব দিয়ে পা ফেলে ভেতরে চলে গেল। একটা চাপা কষ্ট গলায় অনুভব করে নবাব ঢোক গিলে সেটা নামানোর চেষ্টা করলো।
.
টিমটিমে আলোয় গহনা খুলছে মিষ্টি। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে হাতের চুড়ি একে একে খুলতে গিয়ে অনুভব করছে তার জীবনে ঘটে যাওয়া এক একটা তিক্ত ঘটনা। একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনায় জীবন যেন বিষিয়ে উঠছে তার। শৈশব কৈশোরের সোনালি দিন এখনও চোখের সামনে ঝলমল করে কিন্তু যৌবনে পদার্পন করতে তার জীবন থেকে সুখপাখি হারিয়ে গেছে। বারবার সুখের সন্ধানে ব্যর্থ হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছিল সে কিন্তু সাহস হয়নি আত্মহরণের।
নাকের নোলক খোলার মাধ্যমে গায়ের সমস্ত গহনা খোলার কাজ সমাধা করলো মিষ্টি। বিয়ের ওড়না মাথা থেকে খুলে ওয়াশরুমে পা রাখলো সে। বেসিনের কল ছেড়ে পানির ঝাপটা মুখে পড়তে কাজল লেপ্টে বিভৎস আকার ধারণ করলো তার চেহারা। ধীরে ধীরে মুখ পরিষ্কার করে যখন মুখে শেষ ঝাপটা দিলো, তখন দুই হাতে বেসিন আঁকড়ে চাপা আতর্নাদে ফেটে পড়লো, “আল্লাহ, কেন হচ্ছে আমার সাথে এসব? কেন আপনি নবাবকে মৃত্যুর মুখে টানছেন। মানুষ মরণশীল তা আমার অজানা নয় মাবুদ কিন্তু আমার জন্য কারোর মৃত্যু আমি আর চাই না। অন্তত নবাবের ক্ষতি হলে আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না আল্লাহ, সামলাতে পারবো না।” বিড়বিড় করে কথাগুলো বললো মিষ্টি আয়নাতে নিজেকে দেখে। এরপর দ্রুত হাতে পানির ঝাপটা দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো।
…চলবে কি?