প্রিয়_প্রাণ পর্ব-৪৬+৪৭

0
419

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪৬

ছেলে আর বউ নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে এসেছে আরহাম। কোন ভাবেই চাচির সামনে থাকার বা ওর স্ত্রী, সন্তান কে রাখার ইচ্ছে আর অবশিষ্ট নেই। থাকবার কথা ও না। তোঁষা এমনিতেও ওর মা’কে সহ্য করতে পারে না। কোন ভাবেই মা’কে দেখতে চায় না। এবার যখন ওরা আসলো তখন শুধু ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিলো ওর মা। তোঁষা ফিরেও তাকায় নি। আরহামে’র হাতটা শক্ত করে ধরে হেটে বেরিয়ে এসেছে।
পরনে থাকা বোরকা খুলে তোঁষা মুখে দিয়ে বেরিয়ে এলো। আরহাম তখন ছেলের প্যান্ট খুলে নরম প্যান্ট পরাচ্ছে। তোঁষা এক পলক দেখে কিচেনে গেলো। আরহাম রুম থেকেই ডাক দিলো,

— তুঁষ?

তোঁষা জবাব দিলো না। আরহাম পুণরায় ডাকলো,

— প্রাণ?

— উউউ বাব্বাহ।

চমকে তাকালো আরহাম। শুয়ে থাকা প্রাণ তার পা বাবা’র বুকে তুলে দিয়ে ডাকের উত্তর দিলো। আরহাম হেসে ছেলের পায়ে চুমু খেয়ে বললো,

— আপনার আম্মু’কে ডাকি বাবা। সে তো আমার প্রাণে’র টুকরো। এক টুকরো আপনি, এক টুকরো আপনার মা।

ছোট্ট প্রাণ বাবা’র দিকে হাত বাড়ালো। সে কোলে উঠতে চায়। তার শুয়ে থাকতে মোটেও ভালো লাগছে না।

তোঁষা’র কাছে গিয়ে ই কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে আরহাম বললো,

— ডাকছি না? জবাব দিস না কেন?

— কাজ করছি না? ডাকো কেন?

ভ্রু কুঁচকায় আরহাম। এই রোগ নতুন। প্রশ্নের উত্তরে তোঁষা প্রশ্ন ই করবে। আরহাম প্রাণের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে কিচেনে ঢুকে বললো,

— কি করছিস?

— দেখো।

আরহাম তাকালো। বক্সের খাবারগুলো গরম করছে তোঁষা। জোর করে আরহামে’র মা রাতের খাবার সাথে দিয়ে দিয়েছে। তোঁষা চুপচাপ খারাপ গরম করার মাঝেই ছেলের অস্পষ্ট কথা শুনতে পেলো,

— আআমমম্মু বব্বাহ আম।

তোঁষা ভাষা বুঝলো ছেলের আম বলতে সে খেতে চাচ্ছে তবে আপাতত তোঁষা খাওয়াতে চাইছে না৷ তোঁষা রেগে আছে অথচ যার সাথে রাগ তার কোন হেলদুল নেই। রাগে কান্না পেয়ে গেলো এই মুহূর্তে। আরহাম মুখে ও ও শব্দ করে ছেলেকে হাতে তুলে নাচাতে নাচাতে তোঁষাকে বললো,

— প্রাণে’র ক্ষুধা লেগেছে। রুমে চল। আমি দেখছি বাকিটা।

তোঁষা একপ্রকার ছোঁ মে’রে ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে যেতে যেতে বললো,

— সারাক্ষণ মহিলাদের কাজ ই করে যাও। আর কিছু করার দরকার নেই।

আরহাম চামচ নাড়তে নাড়তে বললো,

— কি বললি? তুঁষ? এই….

তোঁষা চলে গিয়েছে। আরহাম কথা না বলে গুনগুন করতে করতে বাকি কাজ করে রুমে এলো। এখনও তার মুখে গুনগুন শব্দ। তোঁষা’র মুখের সামনে এসে ফুঁ দিতেই তোঁষা বিরক্ত হয়ে বললো,

— সরো।

— ঘুমাচ্ছিস?

— যাও এখান থেকে।

— কি হয়েছে বল না প্রাণ।

— কিছুই হয় নি। ওহ্ আহ্ ছাড়ো। ব্যাথা পাচ্ছি। আরহাম ভাই!

আরহাম তারাতাড়ি নিডলটা তোঁষা’র পেট থেকে বের করে নিলো। এক ফোঁটা থেকেও কম র*ক্ত বেরিয়ে এসেছে পেট থেকে। কথার মাঝেই ইনসুলিনটা পুশ করে দিচ্ছিলো আরহাম। র*ক্ত দেখে নিজেই অবাক হলো। দক্ষ হাতে পুশ করেছে সে। তাহলে কি হলো? আরহাম জানে নিডলে মাঝেমধ্যে ই সমস্যা থাকে যার জন্য র*ক্ত বেরিয়ে যায়। তোঁষা’র ব্যাথাকাতুর শব্দ যেন আরহামে’র হৃদপিণ্ডেই সুচের হুল ফুটালো। তোঁষা’র বুকে থাকা প্রাণ পিটপিট করে তাকালো। মায়ের করা শব্দে তার ঘুম ভেঙে গিয়েছে।
আরহাম তোঁষা’র পেটে আঙুল ছুঁয়ে র*ক্তটুকু মুছে নিলো। তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে যাচ্ছে। এই লাল, রক্তলাল চোখ তোঁষা আজ নতুন দেখে নি। দুরুদুরু করছে ওর বুকটা। আরহাম মুচড়ে ধরেছে হাতে থাকা নিডলটা। যেই না উঠে যাবে ওমনিই তোঁষা বলে উঠলো,

— প্রাণ’কে কোলে নাও।

আরহাম কথা না বলে দ্রুত পায়ে চলে যেতে নিলেই তোঁষা কিছুটা জোড়েই বললো,

— ওকে নাও বলছি নাহলে কিন্তু ছুঁড়ে ফেলে দিব৷ বুকে ব্যাথা করছে আমার। সরাও!

দরজার বাইরে পা রাখা হলো না। আরহাম ভীতু চোখে তাকিয়ে দ্রুত ছেলেকে কোলে তুলে নিলো। তার লাল চোখটাতে এখন ভয় দেখা গেলো। যদি তোঁষা ফেলে দিতো।
প্রাণ ঘুমাবে। তাই বাবা’র বুকে মুখ গুজে দিয়ে উম উম শব্দ করছে। আরহাম ওকে নিয়ে বারান্দায় গেলো। চাঁদের আলোয় ওর ছোট্ট প্রাণটাকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে এই প্রাণটা। আরহাম ছেলের কপালে, গালে, চিবুকে চুমু খেয়ে বললো,

— বাবা তোমার জন্য সব ছেড়ে দিবে আব্বু। তুমি ভালো থাকো। তোমার আম্মু ভালো থাকুক। বাবা নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করছি। মেডিসিন নিচ্ছি। বাবা নিজেকে বদলে নিব প্রাণ। সত্যি বলছি।

দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তোঁষা শুনলো সবটা। তখন যদি এমন না করত তাহলে হয়তো আরহাম সেই নিডল দিয়ে নিজেকেই আঘাত করত। তোঁষা কোন ভাবে আঘাত পেলেই সেটা নিজের উপর ফলায় আরহাম৷ তার মতে তোঁষার দুঃখ অনুভব করতে পারে সে এর মাধ্যমে।

রুমে ঘুমন্ত ছেলেকে রেখে তোঁষাকে হুট করে পাজা কোলে তুললো আরহাম। ভরকে গেলেও নিজেকে সামাল দিলো তোঁষা। আরহাম হেসে ফেললো। তোঁষা ওর গলা জড়িয়ে ধরে বললো,

— খেতে নিয়ে চলো।

— ভিন্ন কিছু খেতে মন চাইছে।

— কি?

— তোকে।

— লুচু।

— জামাই লাগি তোর।

— আরহাম ভাই লাগো আমার।

— পাঁজি হচ্ছিস প্রাণ।

— আমার আরো কিছু প্রাণ চাই।

— একটাকে ই সামলাতে পারিস না।

তোঁষা চুপ করে গেলো। আরহাম ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,

— কথা বলিস না কেন?

— আর কতদিন এমন চলবে?

— কেমন?

— আমার স্বাভাবিক সংসার চাই।

— এটা কি স্বাভাবিক না?

— না।

— কি চাই?

— তুমি কাজে যাবে। আমি সংসার সামলাব। প্রাণ’কে সামলাবো। সন্ধ্যায় তুমি এক জংলী ফুল হাতে বাড়ী ফিরবে আমি দরজায় পিঠ লাগিয়ে অপেক্ষা করব। তুমি যখন ফুলটা আমার চুলে গুজে প্রাণ’কে কোলে তুলবে তখন আমি দুইজনকে ঝাড়ব। হসপিটালে যাও। প্লিজ।

— ঐ পেশায় কিভাবে যাই যার কুব্যবহার করেছে আমি।

— দোষ কারো একার নয়।

— দায় এড়াতে পারছি না।

— আমার কসম লাগে।

— মাইর খাবি তুঁষ। এসব শিরক কেন করিস?

— বলো যাবে।

— মন মানে না৷

— আমার জন্য। প্রাণের জন্য।

— যাব।

— সত্যি?

— হু।

তোঁষাকে কোলে নিয়েই আরহাম খাবার টেবিলে গেলো। আজ তোঁষা নিজ হাতে খাওয়ালো ওকে। আরহাম খেতে খেতেই ভাবলো এবার আর নয়। সে সুস্থ, স্বাভাবিক সংসার দিবে তোঁষাকে। ওদের সন্তান বড় হবে স্বাভাবিক ভাবে। কোন ত্রুটিতে নয়।

#চলবে…..

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪৭

— বাবা? বাবা?

বুজে থাকা চোখ দুটো খুলে তাকালো আরহাম। কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে দিলো ছেলের দিকে। প্রাণ বাবা’র পাশে বসে হাত ধরে তাতে চুমু খেলো। উচ্ছাসিত কণ্ঠে বললো,

— আমি বাবা হয়ে গেলাম বাবা।

আরহাম চোখ বুজে নিলো। চোখের কার্ণিশ বেয়ে পরলো জলধারা। প্রাণ সযত্নে তা মুছে দিলো। বাবা’র কপালে চুমু খেয়ে বললো,

— ছেলে হয়েছে বাবা। কি নাম রাখব? তুমি রেখে দিও তো।

আরহাম মুখ খুলে কিছু বলতে চাইলো তবে পারলো না। বাবা’র না বলা কথা প্রাণ বুঝে। তাই ঝটপট করে বলে উঠলো,

— প্রিয় ঠিক আছে বাবা। মাত্র হসপিটালে দেখে এলাম। ঘুমাচ্ছে।

আরহাম চোখ ঝাপটালো। সেদিকে লক্ষ্য করে প্রাণ এবার বললো,

— আম্মুকে বলতে যাচ্ছি এখনই। শুনে অনেক খুশি হবে।

আরহাম পুণরায় চোখ বুজে নিলো। প্রাণ বাবা’র মাথায় হাত বুলালো। ও জানে বাবা ও এখন মায়ের কাছে যেতে চাইছে কিন্তু প্রাণ কিছুতেই এখন বাবা’কে ছাড়বে না। তার বাবা’কে চাই। খুব করে চাই। এই বাবা তার ভীষণ প্রিয়। ভালোবাসার একজন। বাবা’র ঘুমন্ত মুখে তাকিয়ে রইলো প্রাণ৷ অতঃপর উঠে দাঁড়ালো। নিজের বলিষ্ঠ দেহটা আজ ক্লান্ত মনে হলো। গতরাতে প্রিয়মে’র পেইন উঠেছিলো। এরপর ওকে নিয়ে ছুটেছিলো হসপিটালে। হসপিটালে গিয়ে ও শান্তি নেই। ফিমেইল ডক্টর অত রাতে এভেইএবল ছিলো না৷ ম’রে গেলেও মেইল দিয়ে ডেলিভারি করাবে না প্রাণ। তুষার তো মেয়ের কষ্ট দেখে এক পায়ে রাজি হয়ে গিয়েছিলো। তার মেয়েকে সে মেইল ডক্টর দিয়েই ডেলিভারি করাবে। প্রাণের যে তখন কি ভয়ংকর রাগ লাগলো। মন চাইলো ধ্বংস করে দিতে সব। নিজেকে সামলে দাঁত চেপে শুধু ত্যাড়া ভাবে বলেছিলো,

— আমার বউ আমার সিদ্ধান্ত চাচ্চু।

তুষার ও দমবার পাত্র নয়। তার মেয়ে ম’রে ম’রে অবস্থা। একপ্রকার নীরব যুদ্ধ লেগে গেলো যেন। প্রিয়ম বাবা’র হাতটা চেপে ধরে বহু কষ্টে শুধু বলার চেষ্টা করলো,

— আমি মেইল ডক্টর দিয়ে করাব না আব্বু।

ব্যাস তুষার আর কথা বলে নি। নার্সরা সামাল দিতে দিতে ডক্টর হাজির হয়ে যায়। তুষার থেকে প্রিয়মের হাত ছাড়িয়ে প্রাণ ওটিতে চলে যায়। ছলছল চোখে তুষার তাকিয়ে রয়। তার ছোট্ট পরীটা কি না মা হচ্ছে। সময় গুলো কতই না তারাহুরো করলো চলে যাওয়ার জন্য।

_________________

অতীত~

কলিং বেল বাজতেই তোঁষা দরজা খুললো। আরহাম ভেজা শার্ট গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। গরমে চপচপা অবস্থা। তোঁষা হাসিমুখে ওকে ভেতরে ঢুকতে দিলো। পেছন থেকে দৌড়ে প্রাণ এসে এক ঝাপ দিলো বাবা’র কোলে। তোতলানো গলায় বললো,

— বাব্বাহ বাব্বাহ মজা তাও।

আরহাম ছেলের কপালে পরা চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে তোঁষা’কে বললো,

— দরজা লক করে দে তুঁষ।

বলেই ছেলেকে নিয়ে সোফায় বসে পরে। বাবা’র কোলে বসেই প্রাণ বাবা’র পকেট হাতালো এক এক করে। না কিছু নেই। ওয়ালেট আর ফোন পেয়েছে শুধু। শেষে হাত দিলো হ্যান্ড ব্যাগে। সোনালী মোরকে প্যাচালো ছোট্ট এক বক্স। তিনটা ফেরিও রোচার এটাতে। কুট্টি কুট্টু দাঁত বের করে হাসলো প্রাণ। বাবা’র বুকে মিশে গালে চুমু দিয়ে বললো,

— প্লান লাব বাব্বাহ।

— নিজের নামটা ও এখন পারে না।

তোঁষার কথায় প্রাণ তাকালো মায়ের দিকে। অতঃপর হাতে থাকা বক্সটা দেখালো হাসিমুখে। তোঁষা হাতের গ্লাসটা আরহামকে দিয়ে বললো,

— তোমার ছেলের এমনিতেই ইঁদুর দাঁত। চকলেট খেয়ে দাঁতে ক্যাবেটি হোক একদম ভালো হবে।

আরহাম জুসে চুমুক বসাতেই প্রাণ মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

— আমমমু বাব্বাহ’কে বতো তেন?

— বতি মতি তোর কি? সারাক্ষণ ত ত ত ত! এই ত ছাড়া আর কি পারিস?

— প্লান লাব না আমমমু। আমমু পঁতা।

বলেই বাবা’র বুকে মুখ দিয়ে রাখলো। মায়ের সাথে রাগ হয়েছে তার। সে কি করলো? মা কেন বকলো? আরহাম এতক্ষণ মা-ছেলের নোকঝোক দেখছিলো। এই পর্যায়ে সে মুখ খুললো,

— কি শান্তি পাস সারাটাক্ষন ওর পিছু লেগে?

— ওহহো। হ্যাঁ। এটাই শুনা বাকি ছিলো? আমি ওর পিছু লাগি? হ্যাঁ, বলবেই তো। আমি তো অশিক্ষিত। গন্ড মুর্খ। চালিয়ে যাও। তোঁষা এখন খারাপ। এসো আবার আমার কাছে তখন মজা দেখাব।

বলেই কিচেনে চলে গেল তোঁষা। প্রাণ ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মা বাবা’কে বকেছে। তার কান্না পায় কেউ তার বাবা’কে কিছু বললে। এদের কান্ডে আরহাম হাসছে। তোঁষা রেগে গেলেই ছেলে কাঁদে আর এটা হয় সর্বক্ষণ। কারণ তোঁষা রোজই রেগে যায়। প্রাণ’কে বুকে নিয়েই আরহাম উঠে দাঁড়ালো। পা বাড়ালো রুমের দিকে। ছেলেকে বিছানায় বসিয়ে ফুলা ফুলা গালে আদর দিতেই সে থামলো। আরহাম ওকে ফ্লোরে নামিয়ে দুটো খেলনা ও নামিয়ে ও দিলো। ছেলেকে বুঝিয়ে বলে গেলো,

— এখানেই খেলবে বাবা’র প্রাণ। ঠিক আছে?

— আত্তা।

আরহাম ঝটফট একটা টাওয়াল আর টাউজার নিয়ে ওয়াশরুম ঢুকে পরলো। এতক্ষণে তোঁষা দুইবার রুমে এসে গিয়েছে। ছেলেকে দেখে আবার চলে যায়। প্রাণ মা’কে এই দফায় দেখে ফেললো। তোঁষা চলে যেতে নিলেই উঠে দাঁড়িয়ে ডাকলো,

— আমম্মু।

তোঁষা পিছু ঘুরে মুখ ভেঙিয়ে নিজেও বললো,

— আমম্মু।

প্রাণের ছোট খাটো ঠোঁট দুটো তখন কাঁপছে। মা তাকে ভেঙাচ্ছে। কিন্তু কেন? প্রাণ তো দোষ করে নি। নাক টানতে টানতে মাথা নিচু করে আস্তে ধীরে মায়ের কাছে হাঁটু জড়িয়ে ধরলো। তোঁষা চোখ দুটো ছোট ছোট করে বললো,

— কি চাই?

— আম্মমু কোলে।

— কেন বাবা’র কোলে যা। আমার আদর তো সব তোর এখন। আমার কোলে কি? আমি শুধু প্রিয়ম’কে কোলে নিব।

এইবার মায়ের কোলে গাছের মতো বাইতে শুরু করলো প্রাণ। না পেরে তোঁষা ই ওকে কোলে তুললো। প্রাণ মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে গালে দুটো চুমু দিয়ে বললো,

— পিও আতে না কেন? প্লান লাব পিও।

— হ্যাঁ হ্যাঁ। তিন বছরের ছেলে আবার লাব পিও। এই বয়সেই বউ বউ করিস আর তো দিন পরেই আছে। মায়ের কোলে কি তাহলে? যা নাম।

দাঁত বের করে হাসতে হাসতে মায়ের কাঁধে মুখ লুকালো প্রাণ। সে তিন জন কেই লাব করে। তার মা,বাবা আর প্রিয়’কে।

আরহাম গোসল করে বের হওয়া মাত্র ই মুখ ঝামটা মে’রে চলে গেল তোঁষা। আরহাম ঠোঁট টিপে হাসলো একটু। কাঁধে থাকা টাওয়াল নিয়েই বউয়ের পিছনে গেলো ও। তোঁষা টেবিলে খাবার সব এনে রেখেছে। আরহাম টেবিলে বসতেই প্রাণ বাবা’র কোলে উঠলো। সারাদিন তার কাজ ই এটা৷ কোলে কোলে থাকা। জোকের মতো মায়ের বুকে নাহয় বাবার বুকে লেগে থাকবে।
তোঁষা মুখ কালো করেই খেতে বসেছে। আরহাম প্রথমে ছেলের মুখে ছোট্ট ছোট্ট লোকমা তুলে দিলো। প্রাণ ও কম না। সে নিজেও মায়ের প্লেট থেকে হাত দিয়ে নিয়ে বাবা’র মুখে দিচ্ছে।
নীরবতার চাদরে ঘেরা পরিবেশে শুধু প্রাণের কিছু ভাঙা ভাঙা কথাই শুনা গেলো।
.
প্রাণ ঘুমালো মিনিট পাঁচ হবে। আরহাম এবার বারান্দায় গেলো। তোঁষা দূর আকাশপানে তাকিয়ে। পিছন থেকে আরহাম ডাকলেও হয়তো শুনলো না। পাশে দাঁড়াতেই ধ্যান ভাঙলো ওর। আরহাম ওর হাতে হাত রেখে কিছুক্ষণ চুপ রইলো। জীবনে কতগুলো রাত তাদের চলে গেল। গুনে রেখেছে আরহাম। সামনেও গুনে রাখবে। তোঁষা হঠাৎ ফুপিয়ে উঠতেই আরহাম কিছুটা জোরেই হেসে ওকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

— ছেলের সাথে মা হিংসে করে। এ কথা জনগন শুনলে কি এক অবস্থা হবে বল তো?

— আমাকে কেন আদর করো না?

— করি না?

— একটুও না।

— তাহলে তোর পেটে আবার আবার বাবু ঢুকলো কিভাবে?

তোঁষা বড় বড় চোখ করে তাকালো। আরহাম জানলো কিভাবে? তোঁষা নিজেই তো জানে না শিওর হয়ে। আরহাম তোঁষার এহেন চাহনি দেখে এবার একদম কাছে টেনে নিলো। গালের পানি মুছে দিতে দিতে বললো,

— তোকে তোর থেকে হাজার গুন বেশি আমি জানি প্রাণ।

— কিন্তু…

আরহাম তোঁষাকে চুপ করে দিলো। নরম আদর দিয়ে জানালো,

— ফুল এনেছি তো।

তোঁষার ডান হাতের কবজিতে বেলী’র মালা পেঁচিয়ে দিতে দিতে আরহাম বললো,

— সারাদিন কি করলি?

— কি করলাম? সংসার করলাম তোমার।

— সংসারের স্বাদ মিটেছে?

— ইহকালে মিটবে না।

আরহাম তোঁষা’র হাতে চুমু খেলো। হাঁটু ভেঙে ওর সামনে বসে পেটটা জড়িয়ে ধরে বললো,

— এবার একটা মা আসবে আমার।

— যদি বাবা আসে?

— মন বলে মা আসছে।

— শুধু তোমাকেই বলে?

— হ্যাঁ।

আরহাম উঠে দাঁড়ালো। চাঁদটা আজ জ্বলজ্বল করছে। তোঁষা আহ্লাদী হয়ে আরহামে’র গলা জড়িয়ে ধরলো। আরহাম ওকে পাজা কোলে তুলে রুমে নিতে নিতে বললো,

— এমন আরো বহু বছর তোর সাথ চাই প্রাণ। তোর হাত দুটো ধরে বুড়ো হতে চাই।

— মনজুর।

— প্রমিস।

— পাক্কা প্রমিস।

বিছানায় শুয়ে সবার আগে ছেলের কপালে আদর দিলো তোঁষা। আরহাম গিয়েছে কিচেনে। প্রাণ রাতে ঘুমের মাঝেই ফিডার খায় একটু। তোঁষা’র ছোঁয়া পেতেই প্রাণ গুটালো মায়ের কাছে। তোঁষা হাসলো। ইচ্ছে করেই মা ছেলে সারাদিন ঝগড়া করে। একা একা তোঁষা আর কি ই বা করবে?
ফিডার হাতে মা-ছেলেকে দেখে আরহাম মুগ্ধ হলো। এই তো সাইডে একটু ফাঁকা থাকে। সেখানটার দখলদার ও হাজির হচ্ছে অতি শিঘ্রই।

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে