প্রিয়_প্রাণ পর্ব-৪০+৪১

0
159

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪০

আরহামে’র মেজাজটা আজ একটু খারাপ হয়ে আছে। এই দুইদিন ধরে তোঁষা ভীষণ জ্বালাচ্ছে। এর কোন ধরাবাঁধা কারণ নেই। শুধু শুধু ই এটা ওটা নিয়ে জ্বালাচ্ছে। রাতে ঘুমে ঢলবে অথচ ঘুমাবে না। ওর চোখে ঘুম নেই মানে আরহামে’র চোখেও ঘুম নেই। ঘুমহীনা চোখে মুখে আরহামের শরীর ম্যাচম্যাচ করছে। এরমধ্যে তোঁষার আজগুবি কিছু বায়না ওকে আরো জ্বালিয়ে তুলছে।

— প্রাণ?

তোঁষার ডাকে আরহাম তাকালো। গায়ে ভেজা টিশার্ট টা লেপ্টে। গরমে কিচেনে তোঁষার ফরমায়েশ করা মাটন রান্না করতেই এই দশা। এর সাথে খাবে ছিদরুটি। আরহামে’র হাত এই রুটি বানাতে ভীষণ কাঁচা। পরপর রেসিপি দেখলেও সে বানাতে পারলো না। হচ্ছে ই না। শেষ মেষ না পেরে রুটিই বানালো। তোঁষার ফ্যাট খাওয়া নিষিদ্ধ অথচ মেয়েটা এখন ভাজাপোড়া খাচ্ছে ঠেসেঠুসে। সাথে দুই একটা আরহামে’র মুখেও ঠেসে দিবে। আজ সকালে ও বায়না ধরেছিলো আলু পরটা খাবে। ঘুমে ঢুলুঢুলু আরহাম ভাবলো কয়টা ই বা খাবে? দুটো বানাতে বানাতেই চুলা থেকেই শেষ করে দিলো তোঁষা। এতেও পেট ভরে নি তার। আরহাম কতো বললো একটু ফল খেতে। কে শুনে কার কথা? অন্য রুমে গিয়ে বালিশে মুখ গুজে বসে ছিলো তোঁষা। না পেরে আরো দুটো বানিয়ে তোঁষার সামনে দিতেই তোঁষা হাসি হাসি মুখে খেয়ে নিলো।
সারাটা দিন জ্বালিয়ে মে’রে এখন ডাকা হচ্ছে। আরহাম গায়ের ভেজা শার্ট’টা খুলে ওয়াশরুমে ছুঁড়ে দিয়ে বললো,

— গোসল করবি আয়।

— ডাকলাম না?

তপ্ত শ্বাস ফেলে আরহাম এগিয়ে এলো। তোঁষার চুলের বেণী খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলো,

— কি?

— আমাকে ভালোবাসো না তুুমি।

— সত্যি ই তো।

— কি সত্যি?

— যেটা তুই বললি?

— তাহলে কাকে ভালেবাসো? তোমার বাবু’কে?

— বাসিই তো।

নাকের পাটা সহসা ফুলে উঠলো তোঁষা’র। চোখ দুটো গরম করে তাকিয়ে বললো,

— তাহলে তোমার বাচ্চা তোমার পেটে নাও।

— এখন তো নেয়া যাবে না। কিছুদিন পরই আমি নিব।

— আবার আমাকে ব্যাথা দিক তোমার বাবু তখন আমি ও ওকে ব্যাথা দিব।

আরহাম তোয়াক্কা করলো না। তোঁষা’কে ধরে নিলো গোসল করাতে। ভিজতে ভিজতে মাত্র করা রাগটা ভুলে বসলো তোঁষা। এখন প্রচুর উৎফুল্ল মননে পানি দিয়ে আরহামকে ভেজাচ্ছে সে। গোসল করতে করতে তোঁষা’র মন একদম চাঙ্গা হয়ে গেলো।
নিজের ভেজা চুলের পানি আরহামে’র মুখে ঝেড়ে দিয়ে বললো,

— আজ ও কি আসবে ঐ আপুটা?

— না।

— কেন?

— গতকাল ই তো এলো।

— আজও আসবে।

— আচ্ছা দেখা যাবে। এদিক আয়।

তোঁষা এলো না। ভেজা পায়ে বারান্দায় হাটা দিতে গিয়েই পা পিছলে পরতে নিলো৷ আরহাম ভয় পেয়ে দৌড়ে এসে টেনে কোনমতে দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। বুকটা ফুলে উঠছে ওর। শব্দ করছে ধুকপুক করে। মাত্র ই তুঁষটা পড়ে যেতো তখন কি হতো? কথাটা ভাবতেই আরহামে’র বুকের উঠানামা বৃদ্ধি পেলো। তোঁষার এসবে হেলদুল নেই। ও আরহামে’র বুকের লোমগুলোতে নিজের গাল ঘষে আদর দিচ্ছে।
এই মুহুর্তে রাগ হলো আরহামে’র। চাইলো ধমকে দিতে। কিন্তু করলো না। নিয়ন্ত্রণ করলো নিজেকে।
তোঁষা’কে ধরে আস্তে করে বসিয়ে নিজে বসলো ওর পাশে।
তোঁষা পা নাচাতে নাচাতে বললো,

— খাব না এখন?

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আরহাম বললো,

— কথা শুন আমার প্রাণ।

— বলো।

— আর কখনো এভাবে দৌড়াদৌড়ি করবি না। তোর পেটে একটা বাবু আছে তুঁষ। ছোট্ট একটা প্রাণ৷ তুই দৌড়ে যদি এখন পরে যেতি তখন তোর সাথে এই ছোট্ট প্রাণটা ও তো ব্যাথা পেতো। বল পেতো না?

তোঁষা মাথা নাড়লো। আরহাম পেটে হাত বুলিয়ে দিলো। দীর্ঘ শ্বাস ছাড়া কিছুই করার নেই। তোঁষা ভুলে যাবে এই কথা। উঠে খাবার নিয়ে এসে যেই না রুমে ঢুকবে ওমনিই শুনতে পেলো তোঁষা বেশ জোরে জোরে ধমকাচ্ছে কাউকে। ভ্রু কুচকে রুমে ঢুকা মাত্র আরহাম হেসে ফেললো। পেট থেকে কাপড় সরিয়ে আঙুল তুলে রিতীমত শাসাচ্ছে তোঁষা। বাবু ওকে কিক মে’রেছে। কেন মা’রলো? এটাই অভিযোগ। তোঁষা কি করেছে? এখন যদি তোঁষা মা’রে তখন কি হবে?
এসব বলে বলে তোঁষা ধমকাচ্ছে৷ শেষে শুধু বললো,

— এখন মাফ করলাম। আর মা’রবি না তাহলে আমিও মা’রব।

কথাটা বলা মাত্র আবারও জোরে নিজের অস্তিত্বের জানান দিলো। আরহাম কিছু বুঝে উঠার আগেই তোঁষা হাত মুঠ করে পেটে এক আঘাত করলো। আঘাত করা মাত্র নিজেই ব্যাথায় কেঁদে উঠলো। পরপর আরেকবার আঘাত করার আগেই আরহাম দৌড়ে এসে তোঁষার গালে পরপর দুটো চড় বসিয়ে দিলো। আচমকা এমন হওয়াতে দুইজনই অবাক। বাকরুদ্ধ। তোঁষা ভীতু ভীতু চোখে তাকালো আর আরহাম তাকালো অনুতপ্তের চোখে। তোঁষা’র পেটে এক হাত বুলিয়ে দিয়ে আরেকহাত রাখলো ওর গালে। এমন না সে জোরে চড় মে’রেছে কিন্তু তোঁষার অভিমান জমা হলো। জমে একদম টাইটুম্বুর হলো তার চোখ। কথা বললো না তোঁষা। আরহাম কতবার সরি বললো লাভ হলো না। অভিমানীর অভিমান ভাঙানোর কাজটা মোটেও সহজ হলো না৷
.
বিকেল নাগাদ তথ্য আর তুষার হাজির হলো আরহামে’র ফ্ল্যাটে। তোঁষা তখন আরহামে’র বুকে ঘুম। তুষারের হাতে আরহাম একস্ট্রা চাবি দিয়ে রাখাতে ওদের ঢুকতে সমস্যা হলো না। তথ্য এসেই সোফায় গা এলিয়ে দিলো। বাইরে প্রচুর গরম। তুষার ফ্রিজ হাতালেও ঠান্ডা পানি পেলো না৷ আরহাম রাখে না৷ তোঁষা’র খাওয়া নিষেধ এমন কিছুই আরহাম খায় না৷
তুষার বরফের কয়েক টুকরো নিয়ে তা গ্লাসে পানি নিয়ে তাতে দিয়ে তথ্য’র জন্য আনলো। তথ্য মুচকি হেসে পুরোটা পানি শেষ করলো। এরপর উঠে হাটা দিলো কিচেনে। তুষার মানা করলো না৷ করেও লাভ নেই। তথ্য শুনবে না। এসেই ও রান্না করে এখানে। আরহাম তোঁষা’র কাহিনী শুনামাত্র তথ্য’র মনে আরহামে’র প্রতি সম্মান ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে। ভাই বোন না থাকায় তাকে বসিয়েছে ভাইয়ের আসনে।
তুষার ও সাহায্য করলো তথ্য’কে। ওদের রান্না প্রায় শেষ তখন কিচেনে এলো আরহাম৷ এসেই তুষারকে জড়িয়ে ধরে বললো,

— কেমন আছো ভাই?

— ভালো। একটা খুশির খবর আছে?

— তুমি বাবা হচ্ছো এর থেকেও খুশির?

তুষার হাসলো। জানালো,

— আদনানে’র বিয়ে ঠিক হয়েছে।

— বাহ৷ ভালো তো।

— যাবি না?

— না ভাই। তুঁষের সমস্যা হবে।

— আমরা আছি তো।

— আচ্ছা দেখা যাবে।

ঘুম থেকে উঠে তোঁষা তথ্য’কে দেখে খুশি হলো। তথ্য’কে আপু বলে ডাকে ও। তথ্য ও নিজের বোনের মতো আদর করাতে তোঁষা’র হয়তো তথ্য’র প্রতি টানটা বেশি।
রাত প্রায় আটটার দিকে ওরা বেরিয়ে গেলো। তুষারের বাহুতে মাথা এলিয়ে তথ্য ঢাকা শহরের ব্যাস্ত রাস্তা দেখে যাচ্ছে। তুষারের শক্ত হাতের মুঠোয় ওর হাতটা। তুষার সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,

— কিছু খাবে?

— খাব তো।

— কি খাবে?

তথ্য ঠোঁট কামড়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

— আপনাকে।

তুষার চোখ পাকিয়ে তাকালো। চোখের ইশারায় বুঝালো সামনে রিক্সাওয়ালা। তথ্য সেই দৃষ্টি দেখেও হেসে ফেললো। তুষার আর কথা বাড়ালো না। আজকাল তথ্য’টা বেহায়া হয়ে যাচ্ছে। কেমন বেহায়া বেহায়া চোখ করে তাকিয়ে থাকে।

________________

তোঁষা হেলান দিয়ে খাটে শুয়ে ছিলো। পাশে আরহাম। হঠাৎ তোঁষা মুখ চোখ খিচিয়ে নিলো। প্রথমে আরহাম খেয়াল না করলেও পরে দেখলো যখন তোঁষা শুয়ে পরলো অথচ মুখে শব্দ করলো না। আস্তে ধীরে খিঁচুনি বাড়লো। আরহাম ব্যাস্ত হলো। ভয় পেলো। তোঁষার গালে হাত দিয়ে ঝাকিয়ে ডাকলো,

— তুঁষ? এই তুঁষ? ব্যাথা হচ্ছে?

আরহাম খেয়াল করলো ওর পেটে। কাপড়টা উঠাতেই খেয়াল করলো পেটে’র চামড়ায় স্পষ্ট পায়ের ছাপ। বাবুটা আজ বেশ ছটফট করছে। এই ব্যাথায় ছটফট করছে তোঁষা অথচ কাঁদছে না। আরহাম তোঁষার পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বারকয়েক ডাকলো। তোঁষা উত্তর না দিয়ে খিঁচে রাখলো নিজের নাক, মুখ। আরহাম তখন ভয় পেয়ে গেলো,

— এই তুঁষ কাঁদ। কাঁদ না। কিছু বলব না আমি। সত্যি বলছি। কাঁদ তুই।

তোঁষা কাঁদলো না। তার জমাট হওয়া অভিমান ভুলে নি সে। আরহাম খেয়াল করলো বাচ্চাটা আজ বেশি পা ছুড়াছুড়িঁ করছে। এত এত আঘাত পেয়ে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেললো তোঁষা। আরহাম এতে যেন আরো বেশি ভয় পেয়ে গেলো। ভোঁতা অনুভূতি হলো ওর। তোঁষা আজ এত মাস পর কোন বিষয় মনে রাখতে পেরেছে এতে খুশি হবে নাকি এই দশায় কষ্ট পাবে তা ভেবে পেলো না ও।

#চলবে…..

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪১

হসপিটালে আরহাম তোঁষা’কে নিয়ে এসেছিলো মান্থলি চেকআপে’র জন্য কিন্তু এখানেই তোঁষা’র কিছুটা পেইন উঠে গেলো। ডক্টর জানিয়ে দিলো বেবি আজরাতেই ডেলিভারি করা হবে। আরহামে’র যেন মাথা ঘুরে উঠলো। আট মাস পঁচিশ দিনে যেই ভয় আরহাম পেলো না সেই ভয় ও পাচ্ছে এখন। কাঁধে কারো হাত টের পেতে মাথা তুললো আরহাম। এতক্ষণ মুখ দুই হাতে ঢেকে বসে ছিলো। ডক্টর আদিত্য তুষার’কে জানাতেই তথ্য আর তুষার হাজির এখানে। ওদের আসার পর পর ই শেখ বাড়ীর সকলে একে একে উপস্থিত হলো। তোঁষার মা আরহামে’র সামনে আসতে মাথা নিচু করে রাখলো আরহাম। কেন জানি চাচি’র সাথে চোখ মিলাতে পারে না। দোষ কার এটা বলা যায় না। পরিস্থিতি’র কবলে পরে সবাই দোষী আবার বলা যায় সবাই সময় আর হাল অনুযায়ী আচরণ করেছে। কেউ তাহলে দোষী না।
তোঁষা’র মা ধীরে ধীরে আরহামে’র বুকে মাথা রেখে ওকে জড়িয়ে ধরলো। ওনার নীরব কান্নায় আরহামে’র ভেতর দুমড়ে মুচড়ে গেলো। শান্ত ভাবে চাচি’কে জড়িয়ে ধরলো ও কিন্তু কথা বলতে পারলো না। হাজার চেষ্টা করে ও না।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আরহাম তোঁষা’র মাথায় সুন্দর করে হাত চালিয়ে আদর করে দিচ্ছে। তোঁষা তখনও অল্প স্বরে কাঁদছে। পাশেই তথ্য নানা কথা বলে বুঝাচ্ছে তোঁষা’কে। ও শুনছে বলে মনে হলো না। বারবার আরহামে’র হাতটা খামচে ধরে রাখছে। ঢোক গিলে গিলে বারবার যেন ব্যাথা কমানোর চেষ্টা করলো। একটু পরই তোঁষা’কে নিয়ে যাওয়া হবে। তুষার এসে তথ্য’কে পাশের সোফায় বসালো। হাতের প্যাকেট খুলে কাটা ফল আর কিছু শুকনো বাদাম ওর হাতে দিয়ে বললো,

— ফিনিস করো।

বলেই উঠে আরহামে’র পাশে বসলো। ও জানে আরহাম’কে বললেও এখন খাবে না তাই নিজেই পর মুখের সামনে খাবার তুলে দিয়ে বললো,

— কোন কথা শুনতে চাইছি না আপাতত।

আরহাম মাথা নামিয়ে মুখ খুলে খেয়ে নিলো। কোন এক সময়ে গর্জন করা আরহামে’র এহেন ভেজারুপ আচরণ সত্যি ই বিরল। কে জানতো পরিস্থিতি তাদের এহেন কাঠগোড়ায় দাঁড় করাবে?

সন্ধ্যার পর তোঁষাকে ওটিতে নেয়া হলে বাঁধলো বিপত্তি। আরহাম ছাড়া ও এখানে থাকবে না। এমন ভাবে নড়াচড়া শুরু করলো যে বাচ্চা’র অবস্থান উল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলো। অগত্যা আরহামকে’ও বিশেষ পোশাক পরিয়ে ভেতরে নেয়া হলো। এক পাশে বসে তোঁষার হাতটা শক্ত করে ধরলো ও। তোঁষা’র যখন এনেস্থিসিয়া’র প্রভাবে নিভু নিভু চোখ তখনও সে মৃদুস্বরে বলে গেলো,

— প্রাণ যেও না আর। আমি ভয় পাই৷ কাছে থাকো। হাত ছেড়ো না। তোমার বাবু আজ ও ব্যাথা দিচ্ছে কিন্তু থামছে না। ও অনেক পঁচা একটা বাবু প্রাণ। আমি ওকে কখনো আদর করব না। পঁচা বাবু

আরহামে’র লাল হওয়া চোখ জোড়া দিয়ে তখন অনবরত পানি পরছে। ওর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে করা কান্না’র দরুন বারবার ভাঙাচুরা দেহটা কেঁপে উঠছে।

বাইরে সকলে উত্তেজিত হয়ে বসে আছে। তোঁষার মা আর চাচি দুইজন কেঁদে অস্থির। তথ্য তাদের সামাল দিচ্ছে। তুরাগ শেখ ও এক জায়গায় মাথা নিচু করে বসা। তথ্য’র চোখটা ওটির দরজায়। বলিষ্ঠ এক সাবেক আর্মি ম্যান দাঁড়িয়ে সেখানে। নিজেকে যতটাই শক্ত দেখাক না কেন তথ্য জানে তুষার ভেতরে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে আছে। বোন’কে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসা দেয়া তুষার নিশ্চিত এই মুহুর্তে শান্ত নেই।
.
দীর্ঘ এক ঘন্টা পঁচিশ মিনিট বাইশ সেকেন্ড পর পৃথিবীর বুকে ছোট্ট এক প্রাণ পদার্পণ করলো। নিজের হাজিরি জাহির করতে সে কেঁদে উঠলো শব্দ করে। বাবা’র চোখে মুখের আতঙ্ক ভাবটা ঘুচিয়ে হাসি ফুটালো সেই প্রাণ। আশ্চর্য হয়ে আরহাম তাকিয়ে রইলো সেই ছোট্ট একটা প্রাণের দিকে। সবার আগে তার হাতেই তুলে দেয়া হলো। ভীতু চোখে তাকিয়ে হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে ছোট্ট প্রাণ’কে কোলে তুলে নিলো আরহাম। ছোট্ট প্রানটা বুঝি বুঝলো বাবা’র অস্তিত্ব। একদম চুপ করে রইলো সে। আরহাম অপলক তাকিয়ে রইলো সেদিকে। লাল ঠোঁট, গোল গোল চোখ, ঘন পাঁপড়ি’তে ঘেরা এক ফুটফুটে নরম বদনে’র প্রাণ। এ কিনা ছিলো আরহামে’র তুঁষে’র পেটে? ভাবা যায়? আরহাম তো ভাবতে পারে না৷ কিছুতেই না। পাগল পাগল লাগে নিজেকে।
অশ্রু চোখে আরহাম চুমু খেলো তার অস্তিত্ব’কে। ছোট্ট প্রাণটা বুঝি হাসলো। হামি তুলে একটা হাত মুখে পুরে দিলো।

নার্স এসে ওকে নিতে নিলেই আরহাম বাঁধ সাধলো। ও দিবে না। মন ভরে নি দেখে দেখে। এই রুপের সাগরে ডুবে থাকা রত্ন আজ উঠে এসেছে। একে দেখলেই কি মন ভরে নাকি?
নার্স বুঝানোর পর আরহাম ছাড়লো। তাকালো ওর তুঁষে’র দিকে। এখন ঘুম ওর তুঁষ। এগিয়ে এসে সকলের সম্মুখেই আরহাম তোঁষা’র ঠোঁটে চুমু খেয়ে কানে ফিসফিস করে বললো,

— এই ছোট্ট প্রাণ তোর ছোট্ট পেটে কিভাবে ছিলো প্রাণ? একদম তোর মতো নরম। তারাতাড়ি উঠে যা তুঁষ। আমরা ওকে একসাথে দেখব আবার। পালব। ভালোবাসব। তুই, আমি আর ছোট্ট একটা প্রাণ।

তোঁষা’কে নিয়ে যাওয়া হলো কেবিনে শিফট করতে। বাইরে থাকা শেখ বাড়ীর সকলে উল্লাসে মেতে উঠলো। তোঁষা’র ছেলে হয়েছে শুনেই সকলে খুশি। তুষার ও খুশি তবে সে খুব করে চাইছিলো আরহামে’র একটা মেয়ে হোক। বাবা’রা মেয়েদের অনেক নিকটের হয়। হয়তো আরহাম তাহলে বুঝতো নিজের করা ভুলগুলো। যদিও ভুল বুঝার বা স্বীকার করার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

________________

শেখ বাড়ীতে দুই দিন থেকে আরহাম বউ, বাচ্চা সহ নিজের ফ্লাটে ফেরত এলো। কারণ একমাত্র তোঁষা। কিছুতেই ওখানে থাকবে না। ওর ভালো লাগে না। অগত্যা তথ্য সহ তুষার ও এখানে এলো। আরহাম না করেছে বারকয়েক। তথ্য নিজেও প্রেগন্যান্ট। এই অবস্থায় তোঁষা সহ আবার বাচ্চা সালাম দেয়া ও ঝামেলা একা আরহামে’র হাতে।
এরমধ্যে মহাঝামেলা হচ্ছে তোঁষা’র মুড সুইং। প্রেগন্যান্সি চলাকালীন এই মেয়ের এত মুড সুইং হয় নি যা পোস্ট প্রেগন্যান্সিতে হচ্ছে। আরহাম তাই না পেরে রাজি হয়েছে। তথ্য’কে অবশ্য রান্নাঘরে যাওয়া থেকে নিষেধ করা হয়েছে। এই দিক সালাম দিতে আরহাম ই যথেষ্ট। এর মধ্যে আদনান হুটহাট করে হাজির হয় বাসার খাবার নিয়ে। নিয়ম করে দুপুর রাত শেখ বাড়ী থেকেই খাবার পাঠানো হচ্ছে। এদের না করলেও উপায় নেই।
আগামী মাসেই আদনানে’র বিয়ে। আরহাম তোঁষা’র ছোট্ট প্রাণটার এখন ছয়মাস বয়স।
এতে সকলেই খুশি। খালি শেখ বাড়ীর আঙিনায় এবার ফুলের সমাহার দেখা দিলো দিলো ভাব। তোঁষা’টা ফিরার অপেক্ষায় দিন প্রহর গুনছে সকলে। এক সাথে বাড়ীর দুটো ফুল বাড়ী ছাড়া এই শোক কি আদৌ ভুলা যায়?

নিশুতি রাতে কান্নার শব্দে তোঁষা’র ঘুম ভেঙে গেলো। আরহাম ছোট্ট প্রাণ’কে নিয়ে এদিক ওদিক পায়চারি করে যাচ্ছে। কিছুতেই থামছে না ও। তোঁষা বিরক্ত হয়ে গলা উঁচিয়ে দিলো এক ধমক। বাচ্চাটা সাথে সাথে থেমে গেলো। আরহাম নিজেও চমকে গেলো। বুকে থাকা প্রাণ’টাকে আরেকটু বুকে চেপে ধরে তোঁষা’র দিকে তাকাতেই দেখলো রাগে ফুঁসছে ও। আরহাম কিছু বলার আগেই বললো,

— ওকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে এসো।

— কে ওর মা?

তোঁষা ভাবলো। আসলেই কে ওর মা? সবাই বলে তোঁষা ওর মা। কথাটা মনে পরতেই মন খারাপ হয়ে গেল ওর। এই বাবু’র জন্য আরহাম ওকে ততটা ভালোবাসে না। রাতে তো তোঁষা বুকে ঘুমায় অথচ এখন থাকে এই বাবুটা।
আরহাম তোঁষা’র দিকে তাকিয়ে অসহায় চোখে। সব ঠিক থাকলেও তোঁষা রেগে যায় খাওয়াতে গেলে। কিছুতেই খাওয়াবে না। এখনও ফিডার খেতে চাইছে না ছোট্ট প্রাণ’টা। এতটুকুন বাচ্চাকে এমনিতেও ফিডার দেয়া উচিত না৷ না পেরে আরহাম ফিডার দিয়েছে।

হঠাৎ যেমন তোঁষা’র ঘুম ভেঙেছিলো তেমন ই হঠাৎ ই আবার ঘুমিয়ে গেলো। মানে এতক্ষণ ঘুমেই ছিলো। দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো আরহাম। তাকালো বুকে থাকা প্রাণটার দিকে। সে তার ঠোঁট কাঁপিয়ে টলমল চোখে তাকিয়ে বাবা’র দিকে। বুক কামড়ে উঠে আরহামে’র। ছেলের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,

— আর কাঁদে না বাবা’র প্রাণ। মা উঠলে বকবে না আমার প্রাণ’কে। আমার বাবা খাবে এখন। এখনই মা খাওয়াবে। কাঁদবি না কিন্তু।

বাবুটাও চোরা চোখে বাবা’কে দেখলো। কাঁদলো না ও। হয়তো ও জানে মা জেগে গেলে খেতে দিবে না৷ তাই চুপচাপ বাবা’র কথা মেনে নিলো।
আরহাম অতি সন্তপর্ণে ছেলেকে তোঁষা’র কাছে নিয়ে খাওয়ালো। ঘুমন্ত তোঁষা টের পেলো না। টের পেলে নিশ্চিত রেগে যেতো। ভাবতেই হাসলো আরহাম।

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে