প্রিয়_প্রাণ পর্ব-১৮+১৯

0
138

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৮

রাত এখন ততটাও গভীর নয় তবে ঘুমন্ত পুরিতে পরিণত হয়েছে রাজশাহী শহর। যেদিকটায় ক্যাম্প সাজানো সেদিকটা’কে শহর বলা চলে না। নিতান্তই বাস্তব এক জঙ্গল এটা। তথ্য একদফা ভাবলো এসব জঙ্গলেই কেন বেশিরভাগ ক্যাম্প গাঁথা হয়?
কি হয় শহরের দিকে থাকতে দিলে? একা মনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সামনে পা বাড়ালো তথ্য। নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দিতে বললো,

— শহরে কি এত জায়গা আছে যে ট্রেইন করবে এত এত ষাঁড়গুলো’কে?

— ষাঁড়’কে একবার ডেকেই দেখো টুকটুকি তোমার পিছু পিছু জাহান্নামে চলে আসব।

হঠাৎ চিকন গলায় উক্ত বাক্য শুনেই ভ্রু কুঁচকায় তথ্য। পিছনে ঘুরতেই দেখলো চ্যাংড়া দুই চারটা ছেলে দাঁড়িয়ে। এক দেখায় তথ্য চিনে ফেললো এগুলো সব গাঁজাখোড়। চোখের চাহনি আর শরীরে’র ঢুলনি তাই প্রমাণ করছে। যে কিনা দুই ছটাক শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে সে কিনা তথ্য’র মতো মেয়ে’কে তাকে টুকটুকি? আশ্চর্য! ডাকবি শালা ডাক তাই বলে টুকটুকি কেমন শব্দ? কেমন মনে হয় কেউ বুঝি ওকে টিকটিকি ডাকলো। ভাবতেই তথ্য’র গা গিজগিজ করে উঠলো।
নতুন কালে যখন ট্রেনিং এ গেলো তখন সিনিয়র আপা’রা ওকে টিকটিকি’র সাথে বাথরুমে আটকে দিয়েছিলো। সেগুলো কি আদৌ টিকটিকি ছিলো? ইয়া বড় বড় একেকটার সাইজ৷ ওখানকার স্থানীয় লেকগুলো কিছু একটা নামে ডাকতো সেগুলো’কে। তথ্য’র মনে হয়েছিলো সেগুলো ছোট্ট বেলায় দেখা নাভিসাপ। ঐ সাপ দেখলেই সবাই প্যান্ট উপরে টেনে নাভি ঢেকে রাখতো। ধারণা ছিলো ঐ সাপ নাভি দেখলেই নাড়িতে কামড় দিবে।
সেদিন বাথরুমে কি ভয়টাই না পেলো তথ্য। আহা আজও মনে পরলে গা কেঁপে উঠে কেমন। চিৎকার করে ডাকলেও কেউ দরজা খুলে নি।
তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে পরদিন তথ্য ঐ বড় টিকটিকি হাতে নিয়ে এক সিনিয়র আপা’র গায়ে ছুঁড়ে দিয়েছিলো। সবাই অবাক হয়েছিলো সেদিন। একরাতে কি না এই মেয়ে’র টিকটিকির ভয় কেটে গেলো? তবে আসল রহস্য আজও কেউ জানে না। সেটা তথ্য’র রহস্য। একান্তই নিজের।

— কি টুকটুকি, কি ভাবো? আমার কাছে আসো। আমার লাল টুকটুকি…..

সজোরে এক থাপ্পড় মার*তেই চ্যাংড়া ছেলেটা ছিটকে পড়লো সাইডে’র ঝোঁপে। তথ্য চোখ রাঙিয়ে ধমকালো,

— আরকবার টিকটিক ডেকে দেখ শালা। তোর চাপার দাঁত খুলে ফেলব আমি।

সেই যে ছেলেটা ঝোঁপে পরলো আর উঠার শক্তি পেলো না। ওখানেই কাত। তথ্য অবাক হলো। এক থাপ্পড়েই এমন। এতো এমন হলো যেখানেই রাত ওখানেই কাত। হাউ রিডিকুলাস।
বাকি তিনটা ছেলে কটমট করে তাকিয়ে বললো,

— তোর তো ত্যাঁজ অনেক ছেমড়ি। তোরে তো আজ….

ব্যাস মাথা গেলো খারাপ হয়ে তথ্য’র। দুই হাত দুই পা এর সঠিক ব্যাবহার করতেই তিনটা ছেলেও নড়বড়ে হয়ে গেল। তথ্য হাত ঝাড়তে ঝাড়তে সামনে পা বাড়ালো। মাত্র ঘটা ঘটনাটায় বিরক্ত হলো বটে। মেয়ে হয়ে শান্তি নেই। এই যে ও আর্মি গার্ল তবুও কি না এই সব এংড়া চ্যাংড়া ওকে টিজ করে। এই ছিলো কপালে? পুড়া কপাল। ঐ এক তুষা’রের প্রেমে পড়ে জীবনটাই ফাঁতা ফাঁতা। ব্যাটা পাত্তা দেয় না।

শুকনো পাতায় পা ফেলার ন্যায় শব্দ কানে বাজতেই তথ্য পিছু ঘুরলো। তুঁষা’র দাঁড়িয়ে হাতে কফির মগ নিয়ে। তথ্য এগিয়ে এলো ওর দিকে। পিছু উঁকি দিয়ে বললো,

— একাই এসেছো?

— হু।

— কফি খাচ্ছো?

তুষা’র কথা না বলে হাতে থাকা খালি মগটা দেখিয়ে বললো,

— শেষ।

তথ্য সামনে যেতে যেতে বলতে লাগলো,

— যাবেন আমার সাথে?

— কোথায়?

— প্রেম নগরীতে।

তুষা’র হেসে ফেললো। বললো,

— তোমার মতো মেয়ের সাথে প্রেম হবে না। মাত্র ই গু*ন্ডামী করলে।

তথ্য চোখ বড় বড় করে তাকালো। আশ্চর্য হওয়া কণ্ঠে বলে উঠলো,

— গু*ন্ডামী?

— মাত্র ই কে মা*রলো ছেলেগুলোকে?

— আমাকে টিকটিকি ডেকেছে।

— টুকটুকি হবে।

— হ্যাঁ হ্যাঁ। বোত সাউন্ডস সেইম।

— এখনও ভয় কাটলো না টিকটিকি’র।

তথ্য চাপা হাসলো। ঐ দিন বড্ড সাহস জুগিয়ে টিকটিকি হাতে তুলেছিলো ও যাতে সিনিয়র আপা’রা আর তাকে ভয় না দেখায়। বুদ্ধিটা যদিও ছিলো তুষা’রের। তথ্য যখন নালিশ জানাতে যায় তখনই তুঁষা’র তাকে এহেন বুদ্ধি দেয়।
হঠাৎ ঝোঁপে’র মাঝে শব্দ হলো। তথ্য তাকাতেই দেখা মিললো সেই সাপে’র। সাথে সাথেই নিজের অজান্তে তথ্য’র হাত চলে গেল পেটে। পরণে থাকা টাউজারটা টেনে তুলতেই হো হো শব্দে মুখরিত হলো চারপাশ। তুঁষা’র বহু কষ্টে হাসতে হাসতে বললো,

— এখনও তুমি প্যান্ট টানো সাপ দেখলে? নাও প্লিজ ডোন্ট সে নাভিসাপ তোমার নাভি দেখলে কামড়ে দিবে।

লজ্জা পেলো তথ্য। ছোট বেলার এই অভ্যাস’টা ত্যাগ করা যাচ্ছে না। গুইসাপ দেখলেই এমন ভয় লাগে।

______________________

— বই এনে দিবেন আজ।

— দিব।

— দিব মানে? আগেও বলেছেন দিবেন। কোই দিলেন?

বলেই ফুলা গাল দুটো আরেকটু ফুলালো তোঁষা। আরহাম হাতের ব্যাগটা গোছাতো গোছাতে বললো,

— আগে আমাকে পড়ে শেষ কর।

তোঁষা এবার টলমলে চোখে তাকালো। আরহাম তাকাতেই হকচকিয়ে গেল। এই তুঁষ’টাকে বশে আনা বহুত কঠিন কাজ। গভীর তাপস্যা’র বিষয়। এগিয়ে এসে তোঁষা’র গাল ছুঁয়ে দিতেই তোঁষা মাথা নামায়। প্রচুর জেদী এই মেয়েটা চাইলেও রাগ দেখাতে পারে না আরহামে’র কাছে। আরহাম হাত বাড়িয়ে তোঁষা’কে নিজের কাছে টানতে নিলেই তোঁষা উঠে গেলো। আরহামে’র সামনে দিয়ে হেটে রুম থেকে বাইরেও চলে গেলো।
দীর্ঘ দৃষ্টিতে এতটুকুই দেখলো আরহাম। এতক্ষণ দুটো বালিশ এক করে তার উপর উঠে বসে ছিলো তোঁষা। ছোট থেকেই এই বদঅভ্যেস। এতবছর ওকে এভাবে বসতে দেখলেই মা বকতো কিন্তু আরহাম বকে না। উল্টো নিজে বালিশ দিয়ে উঁচু করে দিবে। নিজের তুঁষে’র কোন আবদার বাকি রাখবে না আরহাম। তবে এই পড়াশোনার ব্যাপার’টা ভালো লাগছে ওর কাছে। বিগত কয়েকদিন ধরে তোঁষা বই বই করে পাগল করে দিচ্ছে ওকে। ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলো ততক্ষণাৎ।

তোঁষা’র কাছে যেতেই তোঁষা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। হাসলো আরহাম। লম্বা চুলের গোছা ধরতেই তোঁষা ছাড়িয়ে নিলো তা। উঠে যেতে নিলেই এবার আটকালো আরহাম। তোঁষা’কে ধরে রাখে নিজের সাথে। তোঁষা মোচড়ালো। ছাড়াতে চাইলো। লাভ হলো না। আরহাম ওকে কোলে নিয়েই খাটে বসে। তোঁষা’র কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে নরম হয়ে আরহাম বললো,

— আজ এনে দিব সত্যি।

— তিন সত্যি?

— তিন সত্যি।

— যদি না আনো?

— তাহলে সব শাস্তি মেনে নিব।

তোঁষা ঠোঁট উল্টে বললো,

— আমি তো আপনাকে শাস্তি দিতে পারি না।

আরহাম হাসলো শব্দহীন। কন্ঠে তপ্ততা এনে বললো,

— যখন তুই এভাবে রেগে যাস আমার সাথে। কথা বলিস না তখন আমার বুকের ভেতর মনে হয় কেউ পাথর দিয়ে আঘাত করছে। এর থেকে বড় শাস্তি আর কি দিবি?

তোঁষা ঝট করে ঘুরে জড়িয়ে ধরে আরহাম’কে। অপরাধী’র স্বরে বলে,

— আ’ম সরি।
.

আরহাম আজ তার কথা রেখেছে। মোটা মোটা বইগুলো সব টেনে এনে বড্ড ক্লান্ত সে। তোঁষা দৌড়ে আগে ঠান্ডা পানি এনে দিলো ওকে। আরহামে’র ভালো লাগলো তোঁষা’র এতটুকু আদর। আরহাম’কে পানি দিয়েই তোঁষা বইগুলো খুলে বসলো। নতুন কাগজের ঘ্রাণে মনে হলো তোঁষা বুঝি নতুন ইন্টারে ভর্তি হয়েছে অথচ এই বছরই তার পরিক্ষা। তোঁষা বইগুলো হাতাতে হাতাতে বলতে লাগলো,

— আগের বইগুলো দাগানো ছিলো। সমস্যা নেই আমি শেষ করে ফেলব। পরিক্ষা’র পর তো এডমিশন কোচিং এ ভর্তি হতে হবে। তাই না? শুনুন আমি কিন্তু বুয়েট এ পড়ব। আপনার পকেট খালি হয়ে যাবে। তখন কিন্তু কিছু বলতে পারবে না।

আরহাম মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তবে প্রতিত্তোরে কিছু বললো না। তোঁষা নিজের মতো বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো কিছুক্ষণ। উঠে দাঁড়াতেই আরহাম বললো,

— আমার টাওয়াল দে তো তুঁষ। শাওয়ার নিব।

তোঁষা একপল তাকায় পরপরই আলমারি থেকে টাওয়াল বের করে দেয়। আরহাম কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে যায়। তোঁষা’র মনে হলো এই প্রথম আরহাম ভাই ওকে এভাবে আদেশ ভাঙ্গিতে কিছু বলেছে। ততটা না ভেবে নিজের বইগুলো রাখার যথাযথ জায়গা খুঁজতে ব্যাস্ত হয় তোঁষা। এদিক ওদিক তাকাতেই যেন হতাশা ভর করে ওর মাঝে। পড়ার টেবিল নেই রুমটাতে। অগত্যা আলমারি খুলে আরহামে’র আর ওর কাপড়ের মাঝে বই গুছিয়ে রাখে ও। বোটানি’টা নিজের কাছেই রাখলো। বায়ো মাথায় থাকে না তোঁষা’র। মুখস্থ বিদ্যা বড়ই খারাপ ওর। একদম যা তা অবস্থা। অন্য ফিজিক্স হোক বা হায়ার ম্যাথ তোঁষা বরাবরই ভালো একজন ছাত্রী।
বইটা নিয়ে বিছানায় গোল হয়ে বসে তোঁষা। প্রথম অধ্যায়টা জটিল মনে হতেই তোঁষা তৃতীয় অধ্যায় খুললো। কোষ বিভাজন কিছুটা সহজ তবে ঝামেলা বাঁধে এগুলোর ধাপগুলো মনে রাখতে। বিরক্ত তোঁষা হার মানে না। বিরবির করে পড়ে যায়।

আজ প্রায় ঘন্টা খানিক লাগিয়ে আরহাম গোসল শেষ করে। টাওয়াল পেঁচিয়ে অর্ধভেজা শরীরে বেরিয়ে এসেই নজরে পরে তোঁষা বিরক্ত মুখখানা। ভ্রু কুঁচকায় আরহাম পরক্ষণেই দেখে তোঁষা’র হাতে বায়োলজি। যার বর ডক্টর সেই বউ কি না বায়ো মনে রাখতে পারে না। আফসোসের বিষয় এটা। আরহাম গলা ঝেড়ে ডাকে,

— তুঁষ?

— উ।

— এদিকে আয়।

তোঁষা একবাক্যে উঠে এলো। আরহাম ওকে টেনে নিলো নিজের কাছে। ওর ভেজা বুকে তোঁষা হাত রেখেই বললো,

— ভেজা কেন আপনি? টাওয়াল কোথায়?

আরহাম ইশারায় দেখালো। তোঁষা লাল হওয়া মুখে বললো,

— ওটা পেঁচানো’র আগেই শরীর মুছা উচিত ছিলো।

— এখন মুছে দে।

— নিজে মুছো।

— বউ আছে না আমার?

— কোথায় তোমার বউ?

তোঁষা’র নাকে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে আরহাম জানালো,

— এই তো।

তোঁষা সরে গিয়ে শুকনো টাওয়াল এনে মুছে দিলো আরহামে’র পেটানো শরীর। সবটা সময় আরহাম দেখলো ওর তুঁষ’কে।

খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই তোঁষা বই হাতে নিলো তখনই ওর কোলে মাথা রাখলো আরহাম। আবদার জানালো,

— টিপে দে।

তোঁষা দম ফেলে হাত রাখলো আরহামে’র চওড়া কপালে। তুলতুলে হাত দিয়ে টিপতে লাগলো কপাল। আরহাম দ্বিতীয় আবদার ছুঁড়লো,

— চুল টেনে দে।

ঘন চুলের ভাজে হাত ডুবালো তোঁষা। টানতে টানতে কখন যে মেয়েটা ঘুমালো টের পেলো না। এদিকে তোঁষা ঘুমাতেই আরহাম ঘড়ি দেখলো। রাত ততটা নয়। দুই ঘন্টা পর তোঁষা’কে ডাকবে খেতে। এরপর আর পড়ার সুযোগ হবে না তোঁষা’র। ভাইব্রেট শব্দ হতে আরহাম বালিশের নীচ থেকে ফোনটা বের করলো। তোঁষা’র আশেপাশে ফোন রাখে না ও।

#চলবে……

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৯

ফ্লোরে বইগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবহেলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে যেন। কয়েকটা’র আবার পাতা নড়ছে কৃত্রিম পাখা’র বাতাসে। তোঁষা এক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে সেই পাতার নড়চড়। নজর যেন টলতে চাইছে না। টলমলে লাল চোখদুটো ছিটকে পানি বের হওয়ার পালা এখন অথচ কি আশ্চর্য তোঁষা’র চোখে পানি নেই। কিছু সময় গড়াতেই তোঁষা দুই এক পা করে এগিয়ে এলো। ঝুঁকে হাতে তুলে নিলো ফিজিক্স প্রথম পত্র বইটা। বইটা’র দুটো পৃষ্ঠা ছিঁড়ে গিয়েছে। তোঁষা সেটা নিয়েই বসে পরলো ফ্লোরে। দুই হাত দিয়ে ঘোচানো পৃষ্ঠাগুলো সোজা করার চেষ্টা চালালো। লাল চক্ষুদ্বয় আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। স্বেচ্ছায় টপটপ করে ঝড়তে লাগলো। একে একে বইগুলো নিজের কাছে নিয়ে গোছগাছ করার চেষ্টা করছে তোঁষা তবে সবটা নীরবে শুধু মাঝে মধ্যে নাক টানার শব্দ শুনা যাচ্ছে আর একটু পর পর চোখ ডলছে বাহুতে।

আরহামের ঘুম ভাঙলো মাত্রই। বিকেলে তোঁষা’র সাথে এই রুমে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। চোখ বন্ধ অথচ ভ্রু কুঁচকে গেলো ওর আশেপাশে তোঁষা’র উপস্থিতি টের পাচ্ছে না বলে। চোখ খুলে ঢুলুঢুলু উঠে বসে আরহাম। এদিক ওদিক তাকালেও তোঁষা’কে দেখা গেলো না। বিছানা থেকে নেমে চপ্পল পায়ে এগিয়ে যায় আরহাম। নিজেদের বেডরুমে’র সামনে যেতেই থমকে গেলো আরহাম। ঘুমের রেশ না কাটা চেহারাটায় ভীত একটা আলোড়নের দেখা মিললো। গলাটা হঠাৎ ই যেন পিপাসিত অনুভব করছে। শুকনো ঢোক গিলে আরহাম। এদিক ওদিক নজর ঘোরায় একবার।
তোঁষা নিজের বইগুলো একত্রে করছে। আরহাম ভেবেছিলো এসব গুছিয়ে নিবে তবে তোঁষা’র কাছে যেতেই কখন জানি ঘুমিয়ে গেলো। সুন্দর পুরুষ’টার ওষ্ঠাধর হঠাৎ ই কাঁপছে যেন। তোঁষা’কে কি বলবে এখন? তোঁষা যদি প্রশ্ন করে? আচমকাই যেন আজ ভয় পাচ্ছে আরহাম। এত তারাতাড়ি তোঁষা’কে আয়ত্ত্বে আনা যাবে না।
ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে এগিয়ে এসে আরহাম হাত লাগালো তোঁষা’র বইতে। তোঁষা শব্দ করলো না। নিজের মতো বইগুলো সব একত্রে করে ফ্লোরেই সাইড করে রাখলো।
তোঁষা যেই না উঠে যাবে ওমনিই ওর হাত টেনে নিলো আরহাম। তোঁষা মাথা নিচু করে বসে রইলো। সামনা সামনি দুজন বসে অথচ রা করছে না কেউ।
একটা ফাঁকা ঢোক গিলে আরহাম ক্ষুদ্র থেকেও ক্ষুদ্র শ্বাস ফেললো অতি গোপনে। এক হাতে যদিও তোঁষা’র ধরা তবুও সে আরেকহাত দিয়ে তোঁষা’র হাতটা মুঠোয় পুরে নিলো। কৈফিয়ত দেয়ার মতো বলতে চাইলেও কিছুটা অস্থিরতা কাজ করলো আরহামে’র মাঝে,

— তঁ…তুঁষ, আমি তখন টিশার্ট.. হ্যাঁ টিশার্ট খুঁজছিলাম। বইগুলো ছড়ানো ছিলো আলমারি’তে। শুন… শুন তাকা আমার দিকে। এদিকে আয়! তুঁষ, প্রাণ আমার, মাথা তুল। হ্যাঁ তাকা আমার দিকে।
তো টিশার্ট না পেয়ে যখন খুঁজছিলাম তখন এলোমেলো থাকায় বই কয়েকটা পরে যায়। আমার কথা বুঝছিস তুই? আমি বুঝাতে চাইছি…

— বইগুলো ছড়ালো কিভাবে?

আরহামে’র কথার মাঝেই প্রশ্ন করলো তোঁষা। আরহাম সত্যিটা স্বীকার করলো,

— রা…রাগ উঠেছিলো আমার। সত্যি বলছি আমিই গুছাতাম কিন্তু তোর কাছে যেতেই ঘুমিয়ে গেলাম। বিশ্বাস কর না প্রাণ। মিথ্যা বলছি না।

কথাগুলো বলার সময় অসম্ভব ভাবে ধ্বক ধ্বক করে যাচ্ছে আরহামে’র বুক। তোঁষা’র মনোভাব ঠিক ঠাওর করা যাচ্ছে না। আরহাম ব্যাস্ত হলো। তোঁষা’র মুখটা ধরলো আজলায় তুলে। চোখ চোখ রাখতেই তোঁষা’র চোখে দেখা মিললো এক অসহায় চোখের। তোঁষা শান্ত স্বরে জানালো,

— ফিজিক্স বইয়ের দুটো পাতা ছিঁড়ে গিয়েছে।

— আমি আঠা লাগিয়ে দিব।

একদম সাথে সাথেই বলে উঠলো আরহাম। তোঁষা কথা বাড়ালো না শুধু পলকহীন ভাবে পর্যবেক্ষণ করলো আরহাম’কে। আরহাম উঠে দাঁড়িয়ে তোঁষা’কেও তুললো। ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে তোঁষা’র হাতে দিতেই তোঁষা মুখ তুলে তাকায়। এডমিট কার্ড সাথে পিন করা রেজিস্ট্রেশন কার্ড। গত পনেরো দিন ধরে আরহামে’র কাছে তোঁষা বলেই যাচ্ছিলো এডমিট তোলার জন্য কিন্তু আরহাম পাত্তা দেয় নি। আজ নিয়ে আসাতে তোঁষা’র খুশি লাগছে তবে সে প্রকাশ করতে পারছে না। শুধু মুখ তুলে আরহামে’র পানে তাকাতেই চোখ গলিয়ে পানি পরে। আরহাম হাত বাড়িয়ে তা মুছে দিলো। তোঁষা’র মাথাটা বুকে চেপে ধরে বললো,

— মাফ করে দে প্রাণ।

— দিলাম।

_________________

ঘোর আমানিশা’য় আছন্ন চারিপাশ। বুনো কোন কিছু একটা ডেকে যাচ্ছে তীক্ষ্ণস্বরে। ঝিঁঝি পোকা’র শব্দ এমন না। নাম না জানা প্রাণী’টাকে দেখার বড্ড ইচ্ছে জাগ্রত হলো তথ্য’র মনে। টেবিলে এতক্ষণ কিছু কাজ করে মাত্রই মায়ের সাথে কথা বলছিলো ও। সেই পুরানো প্যাঁচাল ভালো লাগলো না তথ্য’র। বিয়ে বিয়ে করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। ফোনটা মাত্র ই কেটেছিলো তথ্য। ইচ্ছে ছিলো বাইরে বের হবে অথচ তখনই পুণরায় ফোনটা বেজে উঠে। ছোট একটা শ্বাস ফেলে ফোন তুললো তথ্য। অপর পাশ থেকে পুরুষনালী এক কণ্ঠস্বর শুনে মুহুর্তেই নিজের ভেতর থাকা গোছালো শব্দগুচ্ছ’কে অগোছালো করে দিলো। তথ্য’কে কথা বলতে না শুনেই পুণরায় ওর বাবা বললেন,

— আছো? তথ্য কথা শুনছো তুমি।

— জ্বি আব্বু।

— তো কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো?

— এখনও কিছু ভাবি নি এ বিষয়ে।

— তোমাকে ভাবার জন্য যথেষ্ট সময় দেয়া হয়েছে তথ্য। লাইফে যা চেয়েছো দিয়েছি এজ এ ফাদার। তোমার মা না করা সত্বেও তোমাকে আর্মিতে দিয়েছি। এখন যখন বিয়ের জন্য সময় চেয়েছো তা ও দিলাম। প্রায় তিন বছর। কি দেই নি?

— জ্বি আব্বু।

— তোমার নিজের পছন্দ থাকলে ও ফ্রী ভাবে বলার অধিকার দেয়া হয়েছিলো অথচ ইউ মিসড ইট তথ্য। নাও আই ওয়ান্ট ইউ টু কাম ব্যাক হোম এন্ড গেট ম্যারিড তথ্য।

— আ..

— নো মোর ওয়ার্ড তথ্য। আমি মেজর’ ইসহাক’কে কল দিচ্ছি।

বলেই বাবা কল কেটে দেন। তথ্য টলমল হওয়া চোখ মেলে নিজেকে দেখলো আয়নায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একদম গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলো নিজেকে। সে কি সুন্দর নয়? চুলগুলো কাঁধ সমান, একটু কি লম্বা হওয়া উচিত ছিলো নাকি খাড়া নাকটা বোঁচা হওয়া উচিত ছিলো। চেহারার উজ্জ্বলতা যতটুকু কম দেখায় তা পুরোটায় রোদের কারণে। তাহলে কেন তুষা’র তাকে পছন্দ করছে না?
বাবা যে কিছুতেই আর দমবার পাত্র নয় তা জানা আছে তথ্য’র। বাবা’কে সবসময় ইউনিফর্ম এ দেখে তথ্য’র সখ জেগেছিলো সেই ছোট্ট বেলায় যে সেও আর্মি হবে। হয়তো বাবার মতো অতবড় পদ নয় তার তবুও তথ্য চেষ্টা করছে। এরমধ্যে কিভাবে যে মনটা তুষা’র নামক পাষাণ্ড’তে আটকে গেলো ভেবে পায় না তথ্য। বাসায় চাইলেও কিছু বলা যাচ্ছে না তুষা’র সম্পর্কে। দেখা গেলো তথ্য’র বাসায় রাজি এদিকে রুঠে হুয়ে মেহবুব সেজে বসে থাকত তুষা’র। বড়ই অপমানের বিষয়। মেয়ে রাজি বিয়েতে এক ঠ্যাং তুলে অথচ ছেলে দুই ঠ্যাং তুলে দায়সারা ভাব দেখায়।
কোথায় যাবে এখন তথ্য? ভাবতেই অসহায় লাগলো ওর নিজেকে। জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করে তথ্য। ভাবলো আগামী কাল কথা বলবে তুষারে’র সাথে। সে কি আদৌ তথ্য’কে পছন্দ করে কি না। যদিও তুষা’র কোনদিন তাকে বলে নি সে পছন্দ করে।

টুং শব্দ শুনতেই তথ্য ফোনটা হাতে তুললো। হাসোজ্জ্বল একজন পুরুষের ছবি। ড্রেস কোর্ড পাইলটদের। ফাঁকা ঢোক গিললো তথ্য। বাবা কি এবার তাহলে কোমড় বেঁধে নামলো তথ্য’র বিয়ে দিতে?

_______________

তোঁষা সারাদিন পড়ে পড়ে সব শেষ করছে। আরহাম যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণ তোঁষা বই ধরার সুযোগ পায় না তাই তো একা একা থাকাকালীন সময়টাকে কাজে লাগায়। আজ আরহাম বাসায় ই আছে। বাইরে যায় নি একবারও। তোঁষা আরহামে’র গালে হাত রাখলো। হালকা গরম গালটা। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলাতে বেশ ভালো লাগলো তোঁষা’র। আরহাম ঘুমের মাঝেই যেন শান্তি পাচ্ছে, মুখভঙ্গি দেখে বুঝলো তোঁষা। মুখ এগিয়ে নিয়ে চুমু খেলো ওর কপালে। কপালটাও গরম তবে অল্প। তাহলে কি অসুস্থ তোঁষা’র আরহাম ভাই?
কথাটা ভাবতেই তোঁষা’র খারাপ লাগলো। আরহামে’র হাতটা নিজের দুই হাতের মুঠোয় পুরে চুমু খেলো আঙুলে আঙুলে। ঘুমের মাঝেই নড়লো আরহাম। তোঁষা চোরের মতো চুপ করে সরে গেলো। আরহাম ভাই’কে বুঝতে দেয়া যাবে না তোঁষা এখন রেগে নেই। প্রিয় পুরুষের তখনকার মলিন চেহারা দেখেই তোঁষা’র সকল রাগ, অভিমান পালিয়েছে।
উঠে কিচেনে এলো তোঁষা। ভাবলো নিজে আজ কিছু আরহামে’র জন্য বানাবে। আরহামে’র জন্য কি বানাবে ভাবতে ভাবতে তোঁষা ফ্রীজ ঘুটে সব এলোমেলো করলো। সবজি বাদে ভালো কিছু নেই তাতে। তোঁষা খেয়াল করলো আরহাম ওকে সবজি খাওয়ায় অনেক যা বাসায় কারো সাধ্য ছিলো না। বাসার কথা ভাবতেই মন খারাপ হয় তোঁষা’র। কতগুলো গাজর বের করে গ্রিন্ড করা শুরু করে। হালুয়া বানাবে আজ আরহাম ভাই এর জন্য। যদিও তোঁষা রান্নাবান্না পারে না কিন্তু আরহামে’র জন্য টুকটাক সে শিখেছে চাচি থেকে। গাজরের হালুয়া পছন্দ ওর আরহাম ভাই এর। অথচ তোঁষা’র একটুও পছন্দ না এই হালুয়া কিন্তু এখন তোঁষা শিখে গিয়েছে এটা খাওয়া।
আরহাম যখন দেশের বাইরে গেলো তখন ই তো চাচি থেকে টুকটাক রান্না শিখে একা একাই খেতো তোঁষা। ভালোবাসা মানুষ’কে ঠিক যতটা অসহায় করে তুলে তোঁষা’র অসহায়ত্ব ছিলো তার বহুগুণ।
অপছন্দের খাবার গুলো কতটাই না স্বাচ্ছন্দ্যে পছন্দের তালিকায় তুলেছে ও।
ঘি দিতেই কিছুটা অসাবধানতার জন্য তোঁষা’র হাতে ছিঁটে পরে। ট্যাবের নিচে হাত ধরে পরপরই মনোযোগী হয় হালুয়াতে।

আরহামে’র চোখ খুললো মাত্র। শরীর আজ ম্যাচম্যাচ করছে ওর। টুংটাং শব্দ কানে আসতেই ভ্রু কুঁচকায় আপনাআপনি। উঠে হাঁটা দিলো শব্দের উৎসের দিকে। তোঁষা’কে রান্না করে দেখেই যেন চোয়াল ফাঁক হলো আরহামে’র। এই তুঁষ রান্না শিখলো কবে? হালুয়ার ঘ্রাণটা যেন একদম নাসারন্ধ্র বারি খাচ্ছে। আরহাম ধীর পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো তোঁষা’র পিছনে। পেছন থেকেই তোঁষা’র হাতের উপর হাত দিয়ে খুন্তিটা ধরে। চমকায় না তোঁষা। ওর প্রাণে’র অস্তিত্ব ও টের পেয়েছে আরো আগে তবে প্রতিক্রিয়া দেখায় নি এমনকি এখনো দেখাচ্ছে না। আরহাম তোঁষা’র কাঁধে মুখ ঘঁষে ডাকলো,

— তুঁষ?

…………

তোঁষা’র উত্তর মেলে না দেখে আরহাম ওকে নিজের দিকে ঘুরালো। কপালে চুমু খেয়ে পরপর নরম গাল দুটোতে দাবিয়ে চুমু খেলো। তোঁষা চুপ করে দাঁড়িয়ে। আরহাম ও থামলো না বরং থুতনি এবং চোখে চুমু খেতে খেতে বললো,

— কিচেনে আসতে না করেছিলাম না। কথা কেন শুনিস না?

— কথা শুনেছি। বলেছিলেন আপনি বাসায় না থাকলে এখানে না আসতে।

আরহাম হেসে ফেলে গাল টেনে দিলো তোঁষা’র। তোঁষা ও হেসে দিলো। কপালে হাত দিয়ে বললো,

— মনে হচ্ছে জ্বর।

— তোর উত্তাপে আমি ইদানীং উষ্ণ থাকি প্রাণ।

— পঁচা লোক।

বলে তোঁষা গ্যাস অফ করে। আরহাম নিজেই বাটিতে বেড়ে নিলো। তোঁষা আবদার জানালো,

— চা খাব।

— এখনই বানাচ্ছি।

আরহাম চুলায় পানি বসিয়ে চামচ দিয়ে মুখে হালুয়া পুরে নিলো। নিমিষেই চোখ বন্ধ হয়ে এলো ওর। ঠিক যেন মায়ের হাতের হালুয়া। একই স্বাদ। আরহাম তৃপ্তি সহকারে একবাটি খেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— কবে শিখলি?

— যখন আমার দেহে প্রাণ ছিলো না।

আরহাম তোঁষা’র মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আজ মায়ের কথা বেশিই মনে পরছে।
চা নিয়ে দুজন বসেছে বারান্দায়। ফুরফুরে বাতাসে মিশতে মন চায় তোঁষা’র। চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললো,

— আর কতদিন থাকব এখানে?

— কেন? ভালো লাগে না আমার সাথে?

— এটা বলিনি তো।

— এটাই তো বললি।

— বলেছি বাসায় যাব না?

— না।

— কেন?

আরহাম উত্তর করলো না। তোঁষা’কে টেনে নিলো নিজের কাছে। তোঁষা ওর বুকে মুখ গুজতেই আরহাম বললো,

— ওরা ছিনিয়ে নিবে তোকে আমার কাছ থেকে। কিভাবে বাঁচব তোকে ছাড়া প্রাণ। তুই চাস আমি ম’রে যাই? বল চাস? কথা বল প্রাণ।

কথাগুলো বলতে বলতেই ওর নজর গেলো তোঁষা’র লাল হওয়া হাতে।

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে