#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৬
জ্বর ছেড়ে ছিলো তোঁষা’র গতরাতে। সেই যে সন্ধ্যা রাতে জ্বর উঠলো কমার নাম গন্ধ নেই। সারাটা রাত আরহাম জেগেই ছিলো। ঘুমাবে কিভাবে তার তুঁষ’টা যে জ্বরে হুশহীন। শেষ রাতে তোঁষা’র জ্বর ছাড়তেই ঘেমে-নেয়ে উঠে তোঁষা। আরহাম যেন সস্তি’র শ্বাস ফেলে। মেডিসিনগুলো কাজ করতে বেশ সময় নিয়েছে। আরহাম তোঁষা’র মুখপানে তাকালো। সবেই সূর্য উঠা শুরু করেছে হয় তো পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, না সূর্য এখন উঠবে না। ফজরের আজান হলো সবে। আরহাম তোঁষা’র ঘামে ভেজা শরীরটা নিজের বুক থেকে সরিয়ে পাশে বালিশটাতে রাখলো অতি যত্নে। তুঁষ’টা অসুস্থ হলেই কেমন করে জানি কাঁদে। আরহামে’র বুকে কম্পন ধরে সেই কান্না শুনে। সহ্য হয় না। অসুস্থ এক কান্না। ঘুমের মাঝেই কাঁদে। তোঁষা কি জানে সেই কান্না কারো হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করতে সক্ষম?
ধীর পায়ে বিছানা ছাড়ে আরহাম। বুকের দিক ভেজা তার৷ টিশার্ট টা একটানে খুলে তা দুই হাতের মাঝে ভাজ করে ওয়াশরুমে’র ঝুড়ি’তে রাখলো। নতুন একটা টিশার্ট গায়ে গলিয়ে দিয়ে উত্তম রুপে ওযু করে নিলো।
একপলক তোঁষা’কে দেখে নিতেও ভুল হলো না তার।
.
টুংটাং শব্দ করে আরহাম রান্নাঘরে কাজ করছে। ওর তুঁষরাণী’র আবদার অথবা হুকুম যেটাই হোক তা হলো সে সকাল সকাল ঝাল খাবে অথচ আরহাম জানে এই তু্ঁষ ঝাল খেলেই কুপোতকাত হয়ে যায়। আরহাম যথেষ্ট মাথা খাটিয়ে রান্না বসিয়েছে। তোঁষা খেতে চেয়েছে খিচুড়ি, আরহাম বানাচ্ছে ওটস খিচুড়ি। এটা হেলদি ফুড। তোঁষা’র খাবারের দিকটা উলোট পালোট হলেই যত সমস্যা দেখা যায়। রান্নার মাঝে আরহাম একবার ডাকলো,
— তুঁষ?
— কিইইই।
আরহাম থতমত খেলো। এত উচ্চ গলায় কেন উত্তর এলো। পা বাড়াতে নিলেই পানির শব্দ এলো। তোঁষা কি গোসল করছে তাহলে? এই সকালে? গ্যাসটা কমিয়ে আরহাম দ্রুত রুমে ঢুকলো। যা ভেবেছিলো তাই। তোঁষা ওয়াশরুমে। আরহাম ঠক ঠক শব্দ করে দরজায়,
— তুঁষ? তুঁষ?
— কি?
— কি মানে কি? কি করছিস তুই?
— গোসল করছি তো।
— এই দরজা খোল তুই। তুঁষ দরজা খোল। বেরিয়ে আয়।
— এমন করো কেন?
“তুমি” ডাক? আরহাম জানে এই আদুরে কথায় আরহাম’কে গলাতেই এই মেয়ে “তুমি” শব্দটা ব্যবহার করছে। একটু দমে গিয়ে আরহাম পুণরায় বললো,
— এক মিনিটে বের হ তুঁষ নাহয় দরজা খুল।
অগত্যা এক মিনিটেই তোঁষা দরজা খুললো। কালো একটা টাওয়াল পেঁচিয়ে ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে আছে তোঁষা। ফর্সা নাদুসনুদুস তোঁষা’র পরণে কালো এই টাওয়াল বড়ই আকর্ষণীয় দেখালো। আরহাম নজর ভরে দেখেও নিলো। দেখতে মানা নেই। কেন থাকবে? তুঁষ’টা কার? তারই তো।
আরহামে’র মুখের সামনে ঠান্ডা এক হাঁচি দিয়ে পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকে তোঁষা। আরহাম ফিরে তাকালো। তোঁষা’টা তার একদম ভিন্ন। এই যে এমন এক ভেজা মুহুর্তে যে কোন মেয়ে লজ্জা পাবে, নিজেকে লুকাতে চাইবে, লালিমা’র দেখা মিলবে ফর্সা গালে সেখানে তুঁষ তার ভিন্ন। গাল তারও লাল তবে ঠান্ডা’র জন্য। তোঁষা মাথার টাওয়াল খুলে চুল মুছতে মুছতে অভিযোগ জানায়,
— এত ডাকছিলেন কেন? গোসল করছিলাম না?
— এই সকাল সকাল কে বলেছে গোসল করতে তোকে? বলেছি আমি? বল বলেছি?
— ঘেমে ছিলাম তো।
— থাকতি। আমি মুছিয়ে দিতাম না গরম পানি দিয়ে? এখন হাঁচি আসছে কার…..
দ্বিতীয় দফায় আরহামে’র মুখে হাঁচি পরলো। তোঁষা নাক টেনে বললো,
— ঠিকমতো গোসল হলো না।
তোঁষা’র হাতে থাকা টাওয়ালে মুখ মুছলো আরহাম। ভালোভাবে তোঁষা’র চুলমুছে দিতে দিতে বললো,
— এমন আর করবি না ঠিক আছে?
— হু।
— তোর জন্য খিচুড়ি করেছি প্রাণ। বস এখানে ইনসুলিন নিয়ে আসি।
আরহাম যেতেই তোঁষা নিজের চুলগুলো একপাশে কাঁধে রাখলো। এতো গোঁছা আর বড় চুল সামলানোটা বড্ড কঠিন।
আলমারি খুলে তোঁষা নিজের পোশাক বের করছে তখনই কানে এলো আরহামে’র কণ্ঠে,
— তুঁষ!!
চমকে উঠে তোঁষা’র ছোট্ট শরীরটা। আরহাম দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে তোঁষা’কে ঘুরিয়ে দিলো। অসংখ্য কালো কালো ছোপ দাগ পিঠে। কালসিটে দাগগুলো দেখেই বুঝা যাচ্ছে কিছুটা মাস খানিক পুরাতন কিছুটা বা কয়েক সপ্তাহ আগের। লম্বা লম্বা কালো দাগগুলো স্কেল অথবা বেত দিয়ে মে’রেছে। আরহাম ভেজা চোখে তাকিয়ে রইলো। তোঁষা’র ধবধবে ফর্সা পিঠে এরূপ দাগ বড্ড বেমানান। একদমই মানা যায় না। আরহাম নিজের হাত বাড়ালো। ধীর হাতে ছুঁয়ে দিলো তার তুঁষে’র আঘাতপ্রাপ্ত নরম পিঠ’টা। তোঁষা’র শরীর শিউরে উঠে তাতে। তোঁষা’র নাকের পাটা ফুলে উঠলো ততক্ষণে। ঘুরে দাঁড়িয়ে আরহামে’র হাতটা ধরতেই হঠাৎ যেন হুসে এলো। তোঁষা’কে ঘুরিয়ে ওর পিঠের দিকে অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— তুঁষ?? এই তুঁষ, তোর পিঠে… প্রাণ আমার, তোর পিঠে কি…. এই তোকে মে’রেছে না? আমাকে কেন বলিস নি?
দুই হাতে অস্থির আরহাম’কে জড়িয়ে ধরে তোঁষা। ওকে শান্ত করতে বলে,
— কিচ্ছু হয় নি। সত্যি বলছি।
— অনেক ব্যাথা পেয়েছিস প্রাণ? তোকে এত কষ্ট দিলো? আমার জন্য?
— কষ্ট নেই এখন। আপনি এমন করছেন কেন?
আরহাম’কে আজ প্রথম এমন দশায় দেখলো তোঁষা। কেমন অস্থির হয়ে দম আটকে আটকে শ্বাস ফেলছে। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। রাগ নাকি অসহায়ত্ব? বুঝে এলো না তোঁষা’র। শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো তোঁষা। আরহাম শান্ত হতে চাইলো। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও তেমন একটা সুবিধা করতে পারলো না ও কিন্তু তোঁষা’র কাছে অস্বাভাবিক হওয়া যাবে না। কিছুতেই না। খুব সুক্ষ্ম ভাবে নিজেকে সামাল দিলো আরহাম। তোঁষা’কে নিজেও জড়িয়ে ধরতেই তোঁষা জিজ্ঞেস করলো মৃদু শব্দে,
— ঠিক আছেন?
— হু।
তোঁষা অতঃপর আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। আরহাম নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলো,
— কে মে’রেছে?
…………
তোঁষা’র জাবাব এলো না। আরহাম নিজেই বললো,
— চাচি?
উত্তরে তোঁষা হাতের বন্ধনী দৃঢ় করলো। আরহাম ওর মাথায় চুমু খেয়ে আস্তে করে নিজের থেকে ছাড়ালো। তোঁষা’র পিঠ এখন আরহামে’র সম্মুখে। একদম সামনে। আরহামে’র চোখ টাইটুম্বুর অথচ লাল। খুব ধীরে সে মুখ নামিয়ে চুমু খেলো কালসিটে দাগে। তোঁষা’র এখন মনে হচ্ছে তার ব্যাথা নেই আর। সবটা তো উসুল সেই কবেই হলো যবে সে আরহাম ভাই’কে পেলো। আরহাম পুণরায় চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— এখনও ব্যাথা প্রাণ?
— উহু।
_________________
তুষা’র আজ যাচ্ছে রাজশাহী। তাদের কোন একটা মিটিং আছে সেখানে। কিছু সৈন্য পাঠানো হচ্ছে আফ্রিকায়। সেটার জন্যই মূলত এই মিটিং। চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহী পথটা কম না৷ এই মিটিং এ সব সিনিয়র অফিসার’রা ই যাচ্ছে। কোন জুনিয়র নেই।
তথ্য এদিক ওদিক তাকালো একবার। মাত্রই দেখলো অফিসার রিদ নিজের রুমে ঢুকেছে। নিজের কথা মনে গুছিয়ে তথ্য দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে শুনা গেলো,
— কাম ইন।
তথ্য ঢুকেই সজোরে বা পা মাটিতে আঘাত করে সটান দেহে স্যালুট করলো। রিদ সালামের জবাব নিয়ে বললো,
— ইজ এনি থিং রং মিস.তথ্য?
— নো স্যার।
— দ্যান?
তথ্য কিছু বলার আগেই অফিসার রিদ পুণরায় বললো,
— বসুন আগে।
তথ্য বসতেই অফিসার রিদ বললো,
— এবার বলুন।
— স্যার আই থিং….
তথ্য’কে সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই রিদ বললো,
— ইউ থিংক?
— স্যার আসলে…
— ক্যাম্পে যেতে চাইছেন রাজশাহী।
তথ্য চোরা হাসলো। রিদ এবার শব্দ করে হেসে বললো,
— কারণ?
তথ্য’কে এবারও উত্তর দিতে দিলো না রিদ। নিজেই বললো,
— কারণ যেটাই বলেন না কেন মেইন রিজন তো অফিসার তুষার শেখ।
তথ্য এবার লাজুক হাসলো যা অদ্ভুত দেখায়। অদ্ভুত সুন্দর। আর্মির গেটাপে থাকা মেয়েদের ফর্মাল ড্রেসে মুখে লাজুক হাসি বড়ই অদ্ভুত। এই সৌন্দর্য বর্ননা করা মুশকিল।
তথ্য বেরিয়ে এক দৌড়ে চলে গেল তুষা’রের কটেজে। এখন বানিয়ে ছানিয়ে কাহিনি করবে ও একটা। এই কাহিনী করে করেই তো তুষারের পিছু নেয় বারংবার।
________________
তোঁষা আজ পাংশুটে মুখে বসে আছে বারান্দায়। সামনে ওর পরিক্ষা। বই-খাতা নেই কিছুই। ভাবলো আজ আরহাম এলেই তাকে বলবে বই খাতা এনে দিতে নাহলে পরিক্ষায় লাড্ডা শিওর। আরো কিছু লাগবে তোঁষা’র। ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে। বাবা’কে দেখতে হবে। মায়ের সাথে তোঁষা’র রাগ তবে মায়ের কথা ওর মনে পরে। চাচি’র কথা মনে পরছে। চাচি না থাকলে তোঁষা শেষ মুহুর্তে হয়তো ম’রে যেতো।
ওর ভাবনার মাঝেই আরহামে’র আগমন হলো। তোঁষা’র মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বারান্দা থেকে দৌড়ে দরজা অবদি গিয়েই আরহাম’কে জড়িয়ে ধরে তোঁষা ওমনিই ওকে পাঁজা কোলে তুলে আরহাম। তোঁষা হাসি মুখে গলা জড়িয়ে ধরে কিছু আবদার করে যাচ্ছে। আরহাম আদৌ শুনছে কি না জানা নেই। তবে সে এক ধ্যানে তোঁষা’কে দেখে যাচ্ছে। বিছানায় তোষা’কে রাখতেই তোঁষা উঠে বসতে চাইলো তবে বাঁধা দিলো আরহাম। তোঁষা’কে বিছানায় রেখেই সাইড টেবিলে কিছু খুটুর খুটুর করে যাচ্ছে ও। এদিকে তোঁষাও প্রশ্নের ঝুড়ি খুললো,
— কি করছেন আরহাম ভাই?
— তেমন কিছু না প্রাণ।
— ভাইয়ার সাথে কথা বলব আজ।
–একটু কাজ আছে প্রাণ। অপেক্ষা কর।
তোঁষা দেখলো আরহামে’র হাতে একটা সিরিঞ্জ ভর্তি। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আরহাম ওকে উল্টো করে শুয়ে দিলো। তোঁষা ইনজেকশন ভয় পায় না তবে বড্ড কৌতুহলী সে। তাই জিজ্ঞেস করলো,
— এটা কিসের?
আরহাম উত্তর না দিয়ে বললো,
— ব্যাথা দিব না প্রাণ। দেখি দিতে দে।
বলেই তোঁষা’র পরণে থাকা পোশাক তুললো আরহাম। দৃশ্যমান হলো কোমড়ের দিক। ঠিক মেরুদণ্ড বরাবর পুশ করে আরহাম। মিনিট খানিক কি গেলো? না মিনিট গেলো না তবে গগন বিদারি চিৎকার করে উঠলো তোঁষা। ছটফট করতে করতে বলতে লাগলো,
— ক..কি দিচ্ছো? কি দিচ্ছো? ব্যাথা পাচ্ছি। জ্ব…জ্বলছে আমার। ছাড়ো। ছাড়ো আমাকে৷ আরহাম ভাই অনেক জ্বলছে।
আরহাম ছাড়লো না। পুরোটা পুশ করে তোঁষা’কে ঝাপ্টে ধরে ও। তোঁষা’র অবস্থা তখন খারাপ। ও ছটফট করে কেঁদে যাচ্ছে,
— আম্মু…. আম্মু….জ্বলছে আমার। আব্বু। ছাড়ো আমাকে। ছাড়ো। জ্বলছে।
— ব্যাথা নেই। ব্যাথা নেই প্রাণ। তোকে যে ব্যাথা দিয়েছে তার থেকে তোকে মুক্তি দিব আমি প্রাণ। একটু ধৈর্য ধর।
কাঁপা কাঁপা গলায় বলে গেলো আরহাম। বহু কষ্টে তোঁষা’কে চেপে রেখেছে সে। হাই ডোজটা সহ্য করতে পারলো না তোঁষা’র দেহ। একসময় কয়েকটা ঝাঁকি দিয়ে থেমে গেলো ওর ছটফট করা দেহটা।
আরহাম নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো তোঁষা’র জ্ঞানহীন দেহটাকে। মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অসহায় গলায় বললো,
— তোর সব ব্যাথা আমি মুছে দিব প্রাণ৷ একটা বার তুই আমার হ, পুরো দুনিয়া আমি পর করে দিব।
#চলবে…..
#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৭
রাজশাহী ট্রিপে তথ্য’কে দেখে বিন্দুমাত্র চমকালো না তুষা’র। না ই তেমন কোন আগ্রহ দেখালো। ও চমকাতো যদি তথ্য এখানে না থাকত। ডিউটি পড়ুক আর না পড়ুক এই মেয়ে ওর পিছু নিবেই। এই যে চাইলেই এখন ক্যাম্পে থেকে নিজের কাজ করতে পারত অথচ সে এসেছে রাজশাহী। এই মেয়ে ক্লান্ত হয় না। পরক্ষণেই তুষা’রের মনে হলো আর্মিদের আবার ক্লান্তি?
বাইরে ঝলমলে সূর্যের প্রখর রোদ আজ। রাজশাহী শহরটা কি তবে গরম? চট্টগ্রামে যথেষ্ট ঠান্ডা লাগে তুষারের। সেই ঠাণ্ডাটা অবশ্য আরামদায়ক। শরীরে সহনীয়। যদিও এখন শরীর মন কিছুই তার ভালো থাকে না। পরিস্থিতি থেকে পালানো কি এতই সহজ? মোটেও সেটা সহজ না৷ তোঁষা ওর বোন হলেও বয়সের বিরাট বড় ফারাকের কারণে তাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে তুষা’র। এই যে পালিয়ে এলো পরিস্থিতি থেকে। পরিবারের উপর রাগ করে শান্তি কি মিলছে? উহু মোটেও না৷ কোন শান্তি নেই এখানে। আগের মতো রুচি জাগে না কিছুতেই। কানে বারংবার বাজে এই বুঝি পুতুল’টা ভাই বলে ডেকে উঠলো।
আরহামের হয়তো সমস্যা আছে তবে তাদের দূরে রাখাটা কতটা যুক্তিযত হলো? এখন কেমন আছে ওর পুতুলটা। গোপনে এখানে এসে খোঁজ চালাচ্ছে তুষা’র যা বাসায় থাকাকালীন করা সম্ভব ছিলো না। এখান থেকে তোঁষা’র খোঁজ চালাচ্ছে ও। আরহাম যথেষ্ট মান্য করে তুষা’রকে। তুষার বুঝাবে আরহাম’কে। ও জানে আরহাম ভালোবাসে তবে সেই ভালোবাসাটা অসুস্থ। হয়তো পৃথিবীর শুদ্ধতম ভালোবাসা তবে বি*ষা*ক্ত বাঁধনে ঘেরা।
ঠকঠক শব্দে ঘাড় ঘুরালো তুঁষা’র। তথ্য দাঁড়িয়ে। তুষা’রের লাল মুখটা দেখেই তথ্য’র হাসিখুশি মুখটায় আঁধার নেমে এলো। তুষারের হাসি পেলো। সে হাসলো ও। মনের মধ্যে থাকা বিধ্বস্ততা সে দেখাতে চায় না কাউকে। সবাই উপরটা ই দেখুক। ভেতরটা নিজের থাকুক। একদম একান্ত নিজের।
তবে তা হলো না। তথ্য মিথ্যা হাসি চিনে ফেললো। ঘাড় নামিয়ে ফেলে ধীরি শব্দে ডাকলো,
— তুঁষা’র?
তুষা’রের হাসি মিলে গেলো মুহুর্তেই। এদিক ওদিক তাকিয়ে কথা বলার জন্য কিছু খুঁজলো। তথ্য ওর আচরণে অবাক হয় কিছুটা। শক্তপোক্ত একজন মানুষ কিভাবে এতটা ভেঙে পরলো? তথ্য জানে তুষা’রের জন্য তোঁষা কি। আগে যখন আলাপ হতো তখন পাঁচ লাইন কথায় তার তিনবার পুতুল’কে মনে হতো। কতটা ভালোবাসে তাও জানে তথ্য। এগিয়ে এসে সাহস জুগিয়ে তুষা’রের হাত ধরলো ও। তুষা’র হয়তো এমনি সময় রেগে যেতো তবে আজ রাগলো না। তার ভীষণ ভাবে মনে হলো একজন দরকার তার হাতটা ধরার জন্য। একজন মানুষ প্রয়োজন মনটাকে তার সম্মুখে মেলে ধরার জন্য। সেই কেউ টা তথ্য হলে মন্দ কি? তুষার দৃষ্টিপাত করলো তথ্য’র দিকে। সুন্দর এক রমণী দাঁড়িয়ে তার সম্মুখে যার চোখে, মুখে লেপ্টে থাকা ভয়। তুষা’রের জন্য ই সেটা। হাত বাড়িয়ে এই প্রথম তথ্য’র গাল স্পর্শ করে তুষা’র। শিউরে উঠে তথ্য। আতঙ্কিত গলায় ডাকে,
— তুষা’র?
— হু।
— তু…তুমি।
— তথ্য?
____________________________
তোঁষা সেই যে ঘুমালো এখনও উঠে নি। আরহাম ল্যাপটপে আঙুল চালনা করলেও ফাঁকে ফাঁকে তোঁষা’কে দেখে যাচ্ছে। আজ বাসা থেকেই দুটো কেস হ্যান্ডেল করছে ও। এখন তোঁষা উঠবে না জানা সত্বেও কেন জানি তোঁষা’কে একা ছাড়তে মন চাইলো না। ঘুমন্ত নিষ্পাপ একখানা মুখ। কেমন ফুলাফুলা দেখতে গালগুলো। মনে হয় আকাশের মেঘ যেন এগুলো। কাজের ফাঁকে এক ধ্যানে তোঁষা’কে দেখলো আরহাম। মন ভরে না তার। কিছুতেই না। মন চায় শুধু দেখেই যাক।
হাতের কাজটুকু শেষ করে আড়মোড়া ভেঙে উঠে আরহাম। বিছানায় বসে হাত রাখে তোঁষা’র কপালে। মেডিসিন এর এফেক্টে অল্প জ্বর চলে এসেছে। উঠলে নিশ্চিত শরীর ও ব্যাথা থাকবে। তখন আরহাম নিজে মলম লাগিয়ে দিবে। যদিও উচিত না তাও ভাবলো একটা পেইন কিলার খায়িয়ে দিবে। তুঁষটা’কে কষ্টে রাখা যাবে না। ঠিক যতটা না দিলেই নয় ততটুকু ব্যাথা তোঁষা’কে সহ্য করতেই হবে। আরহাম কিছুতেই তাকে নিজের থেকে আলাদা করার ফাঁকফোকর রাখবে না কারো জন্য।
গতকাল যখন তোঁষা’র পিঠে ওর মায়ের দেয়া আঘাতগুলো দেখলো তখন আরহামে’র অনুভূতি দি মুখী ছিলো। প্রথমত তার রাগে শরীর কাঁপছিলো। মন চাইছিলো নিজ হাতে একটা প্রাণ কেড়ে নিতে। যে ওর তুঁষে’র নরম দেহে আঘাত হানলো তার দেহ’টাকে ছিন্ন করে দিতে কিন্তু ওর দ্বিতীয় অনুভূতিটা ছিলো ভিন্ন। ভালোবাসা পূর্ণ এক আদুরে অনুভূতি। তোঁষা’টা তাকে ভুলে নি, ছাড়ে নি এতটা বাজে আঘাত পাওয়ার পরেও।
তাই তো আরহাম এতদিন যেই কাজ ধীরে ধীরে করছিলো তা গতকাল ডোজ বাড়িয়ে দিলো। তোঁষা’কে সে নিজের করে রাখবে। তোঁষা’র চিন্তা, ভাবনা সবটা হবে তাকে জুড়ে।
কথাগুলো ভাবতেই আরহাম ঝুঁকে চুমু খেলো তোঁষা’র মুখে। আজ ঘুমের মধ্যে শব্দ করছে তোঁষা। প্রথম ডোজটা শরীরে সইতে সময় নিচ্ছে। আস্তে ধীরে সহ্য হয়ে যাবে। তখন এত কষ্ট হবে না নিশ্চিত। আস্তে করে কাঁথার নিচে ঢুকে আরহাম। তুলে নিলো তার প্রাণ’কে। বুকে শান্তি লাগে তার। কেমন একটা ভালোলাগা কাজ করে। মন চায় বুকটা খুঁড়ে এখানে দাফন করে রাখুক তার প্রাণ’টাকে।
.
টলতে টলতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। ঘুমের রেশ যেন এখনও কাটতে চাইছে না। কাউচে ধপ করে বসে মাথা এলিয়ে দিলো তোঁষা। একটু ঘুম দরকার আবারও তবে সেটা আপাতত সম্ভব হলো না। আরহাম এসে টেনে তুললো ওকে। তোঁষা টেনেটুনে চোখ খুলতেই দেখা মিললো আরহামে’র। হাত বাড়িয়ে দেয় তোঁষা ওর প্রাণে’র পানে। আরহাম তোঁষা’র হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিতে নিতে বললো,
— তুঁষ? খাবি এখন প্রাণ।
— ঘুম পায় তো।
বলেই গলা জড়িয়ে ধরে আরহামে’র। আরহাম ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলো। ডোজ বেশি ছিলো সেটা ও জানে তাই বলে তোঁষা’র এতটা ঘুম পাওয়ার তো কথা না। অল্প বিস্তর চিন্তা দেখা দিলো আরহামে’র চেহারায়। তোঁষা ততক্ষণে ওর বুকে হেলান দিয়ে চোখ বুজে নিলো। আরহাম ওকে নিয়ে পা বাড়ালো বাইরে। তোঁষা’র হাতে এক মগ ভর্তি ধোঁয়া উড়া কফি দিয়ে বললো,
— শেষ কর।
— ঘুমাই?
— না।
— খাব না এটা।
— আমি বানিয়েছি তোর জন্য।
তোঁষা মুখ বানালো। আরহামে’র কিছুই সে ফিরিয়ে দিতে পারে না। টেনে চোখ খুলে একপলক দেখে বললো,
— তোমারটা খাব।
আরহাম বিনাবাক্যে মেনে নিলো ওর প্রাণে’র আবদার। নিজের মগে ঠোঁট গোল করে ফুঁ দিয়ে ধরলো তোঁষা’র ঠোঁটে। তোঁষা এক চুমুক দিয়ে ঘাড় দুলালো। ভালো লেগেছে ওর। বাকিটুকু পুরোটা খেলো ও আরহামে’র। আরহাম খাওয়ালো নিজ হাতে। তোঁষা’র ছোট ছোট চুমুক বসিয়ে কফি শেষ সময় লাগলো বটে। ততক্ষণে ওর হাতের কফি ঠান্ডা হয়ে শরবত। তোঁষা জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁটের আশপাশে চেটে বললো,
— আপনার টা তো শেষ।
— হু।
— তাহলে আমারটা খাও।
উচ্ছাসিত গলায় বলে নিজের মগের কফিটা নিজ হাতে খাওয়াতে উদ্ধত হয় তোঁষা। সব সময় গরম ধোঁয়া উড়া কফি খাওয়া আরহাম আজ তৃপ্তি সহকারে চুমুক বসালো ঠান্ডা কফিতে। তার প্রাণে’র হাতের সবকিছুই তার নিকট প্রিয়। এই প্রাণ’টা ই তার প্রিয়।
.
–দুধ ভালো লাগে না আরহাম ভাই।
কথাটা বলেই কাঁথার নিচে মুখ লুকালো তোঁষা। আরহাম একবার গ্লাসটা দেখলো। কিছু মেডিসিন মেশানো এটাতে। তোঁষা’কে খাওয়াতেই হবে। এই মেডিসিন কোর্স কম্পিলিট করতেই হবে। গ্যাপ দেয়া যাবে না।
আরহাম গ্লাসটা সাইডে রেখে কাঁথা সরাতে চাইলো। তোঁষা ছাড়বে না। জোর করেই ঠ্যাটামি করে পরে রইলো। আরহাম কাঁথা টেনে পুরোটা সরিয়ে দিতেই তোঁষা’র দিকে তাকালো। আরহামে’রই ছাই রঙা টিশার্ট’টা ওর পরণে। তোঁষা’র গলায় হাত ছুঁয়ে দিলো আরহাম। কেঁপে উঠল ওর কণ্ঠনালী। চোখ মেলতেই আরহাম বললো,
— খেয়ে নে না তুঁষ।
কি অসহায় আবদার অথচ একটু আগেও মিউ মিউ করে তোঁষা’র কাছে সমর্পণ করেছিলো এই আরহাম ভাই।
তোঁষা অর্ধ চোখ খুলে বললো,
— আগে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
— কর।
— গতকাল কিসের ইনজেকশন ছিলো ওটা? অনেক জ্বলেছিলো। ব্যাথাও ছিলো। এখনও আছে।
আরহাম তোঁষা’র নরম হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নেয়। এক হাত ওর চুলের ভাজে গলিয়ে দিয়ে শান্ত স্বরে উত্তর করে,
— তোর কষ্ট লাঘবের দায়িত্ব আমার না প্রাণ? সেটাই পূরণ করছি।
— কষ্ট তো বেশি পেয়েছি। ওটা দেয়াতেই ঘুম পায় আমার।
— ঘুমালে ব্যাথা কমে যাবে। উঠ দুধ শেষ কর।
তোঁষা উঠলো। আরহামে’র কানের কাছে কিছু সময় ঘ্যানঘ্যান করে দুধটুকু শেষ করে ও। তোঁষা বায়না ধরে,
— চলুন না বারান্দায় যাই।
— এখন?
— হু।
তোঁষা’কে বিছানা ছাড়তে হলো না। আরহাম কোলে তুলে হাটা দিলো বড় বারান্দায়। কাপল গোল দোলনাটাতে এই বাইশ তলার উপর থেকে বসে চন্দ্র বিলাস ভিন্ন এক অনুভূতির জোয়ারে ভাসালো দু’জনকে। একসময় তোঁষা নিজেকে দিলো ওর সবচাইতে ভরসার মানুষটার বুকে।
আরহাম এক ধ্যানে তোঁষা’কে দেখে ওর শরীরটা নিজের মাঝে আটকে ধরলো। ফিসফিস করে জানালো,
— তোর অতীত থাকবে না কোন প্রাণ। সব ভুলিয়ে দিব আমি। সব মুছে দিব। অতীতহীনা তুই আমার। তোর বর্তমান হব আমি। ভবিষ্যৎ ও আমি।
#চলবে….
[ এটা একটা কাল্পনিক গল্প।]