#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৮
মোট আট ঘন্টা পার করলো তোঁষা একা একা। এরমধ্যে হয়তো ঘন্টা পাঁচ তার কেটেছে ঘুমে। ঘুম ভাঙতেই মনে হলো ওর ক্ষুধা লেগেছে। উঠে ওয়াসরুমে ঢুকে মুখে পানি দিয়ে বের হয়ে যেই না কিচেনে পা বাড়াবে ওমনই মনে পরলো আরহামে’র কথা। তোঁষা’কে কিচেনে যেতে না করেছে একা। ঠোঁট উল্টো করে এদিক ওদিক তাকায় তোঁষা। এটা কেমন কথা, তোষা একা থাকছে এখানে। কিচেনে
যেতে হলে তো তাকে একাই যেতে হবে। তাই না? এখন তোঁষা খাবে কি? দেনামোনা করতে করতে টেবিলে গিয়ে ধপ করে বসে পরলো তোঁষা। ক্ষুধায় মরণ হলেও তোঁষা কিচেনে যাবে না। যেখানে আরহাম ভাই নিষেধ করেছে তোঁষা কখনো সেখানে যায় না। এখনও তাই।
টেবিলের মাঝখানে তাকাতেই তোঁষা’র ভোঁতা মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেল। ফলের ঝুড়ি রাখা সেখানে। তোঁষা খেয়াল করে নি সেটা আগে। মনটা যেন নিমিষেই ভালো হয়ে গেল ওর। হাত বাড়িয়ে দুটো আপেল আর কমলা নিয়ে মুখে টপাটপ চর পাঁচটা আঙুল পুরে রুমে হাটা দিলো। মন চাইলো বারান্দায় যেতে কিন্তু সেটা ও তো করা যাচ্ছে না। মন খারাপ করে সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে পরলো তোঁষা। টিভিটা অন করে চ্যানেল পাল্টালেও কার্টুন বাদে কিছুই পেলো না। তোঁষা’র অবশ্য সমস্যা হলো না। কার্টুন ভালো লাগে ওর।
সেই ভালো লাগাটাও বেশিক্ষণ টিকলো না আজ তোঁষা’র। ছোট থেকে যৌথ পরিবারে থাকা মানুষটা এমন একা কতক্ষণ ই বা থাকবে। বাইরে ও বের হওয়া নিসিদ্ধ তার জন্য। জানালা দিয়ে দূর আকাশ পানে তাকালো তোঁষা। অভিযোগ করলো একা একা অনেক কিছু। খুব কি খারাপ হতো পরিবার যদি তাকে আরহাম’কে মেনে নিতো?
_________________
হঠাৎ দরজা খুলতেই হকচকিয়ে যায় আরহাম। ভেতরে ঢুকা মাত্রই দৌড়ে এসে তোঁষা ঝাঁপিয়েছে তার বুকে। দুই হাতে শক্ত করে ধরার দরুন আরহাম ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। হাতের ব্যাগটা ঢিল মে’রে কাউচে ছুঁড়ে দুই হাতে জড়িয়ে নিলো তোঁষা’র দেহটা। এক হাতে মাথায় আদর দিতেই তোঁষা’র নাক টানার শব্দ শুনা গেলো। আরহাম শক্ত হলো। দাঁত দিয়ে দাঁত পিষে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা চালালো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
— আর যাব না তোকে রেখে।
তোঁষা মুখ তুললো না। একজন মানুষ হয়ে এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা একা পার করাটা মোটেও সহজ কিছু ছিলো না। একদিন না হয় ঠিক আছে তাই বলে আরহাম রোজ রোজ বের হলে তখন কিভাবে থাকবে তোঁষা?
মুখ তুলে আরহামের দিকে তাকাতেই আরহাম তোঁষা’র গালে হাত দিলো। সযত্নে মুছে দিলো জমা পানিটুকু। তোঁষা এবার আরহামে’র বুকে মুখ গুজে বললো,
— মিসড ইউ।
— মি ঠু প্রাণ।
তোঁষা মুখটা ঘঁষে দিলো আরহামে’র বুকে। হাত ধরে রুমে নিতে নিতে বললো,
— কেমন ছিলো আপনার দিন? আচ্ছা মেয়ে পাগল কয়টা এলো? ও একটা কথা ছিলো তো আমার.. মেয়ে পাগলগুলো কি বয়স্ক থাকে না কি আমার বয়সের?
কথাগুলো সহজ গলায় জিজ্ঞেস করতে করতে আরহামে’র গায়ের কোট’টা খুলে টাই আলগা করে তোঁষা। আরহাম ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে আছে ওর তুঁষে’র মুখটা’র দিকে। তোঁষা উত্তর না পেয়ে আরহামে’র শার্টের বোতামে হাত রেখে চোখ দিলো আরহামে’র মুখে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পুণরায় জিজ্ঞেস করলো,
— কি বলুন। আর একটা প্রশ্ন আছে। আপনার সাথে কে থাকে? না মানে নার্স নাকি বয়? আপনি চাইলে আমাকে জবটা দিতে পারেন। এই যেমন আপনার কাছে আসা পাগলদের সিরিয়াল দেয়া বা আপনার খাবার দাবার খেয়াল রাখা। কখন কি লাগে আপনার বুঝা যায় না তাই না? আমি আপনার কেবিনেই একপাশে বসে থাকলাম৷ কি বলেন?
এক নাগারে কথাগুলো বলতে বলতে আরহামে’র শার্টের বোতাম গুলো খুলে দিলো তোঁষা। উত্তর না পেয়ে আরহামে’র দিকে তাকাতেই দেখা মিললো অসহায় আরহামে’র চোখ। তার চোখ থেকেও বেশি অসহায় শুনালো আরহামে’র কন্ঠ,
— তোর কি অনেক কষ্ট হয়েছে তুঁষ?
তোঁষা কথা বলে না। মাথা নিচু করে রাখে। আরহাম ওর হাত ধরে নিয়ে বিছানায় বসলো। ও জানে তোঁষা’র কষ্ট। দেখেছে ওর ছটফটানি। এই যে এখন একা থাকতে পারছে না বলে কত বাহানা ধরছে আরহামে’র সাথে যাওয়ার। তোঁষা’কে বিছানায় শুয়িয়ে কপালে চুমু দিয়ে আরহাম বললো,
— অপেক্ষা কর। সাওয়ার নিয়ে আসছি। এরপর একসাথে খাব।
আরহাম আলমারি থেকে নিজের একটা টাউজার নিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে যায়। তোঁষা শোয়া থেকে উঠে বসে। দুই হাতে চোখ ডলে নেমে যায় বিছানা থেকে। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসে কিচেনে। আরহাম এখন ক্লান্ত। তোঁষা তার বউ। সেই হিসেবে তোঁষা’র উচিত আরহামে’র খাবার রেডি করা। কিন্তু সমস্যা হলো রান্না। কেউ তো কখনো তাকে রান্না শেখায় নি। তবে কিছুটা শিখেছে আরহামে’র জন্য।
মন খারাপ করে ফ্রিজ খুলতেই প্লাস্টিক দিয়ে মোড়ানো কিছু খাবার পেলো তোঁষা। ঝটপট বের করে ওভেনে দিয়ে প্লেট রাখলো টেবিলে। আরহাম সকালেই রান্না করে সব গুছিয়ে গিয়েছে।
— কি করছিস তুঁষ?
হঠাৎ আওয়াজে ভয় পেয়ে যায় তোঁষা। আরহাম এগিয়ে এসে ভেজা চুলগুলো ঝাড়া দিলো তোঁষা’র মুখের উপর। চোখ বুজে নেয় তোঁষা। আরহামের চুলের পানি তখন ওর নাকে মুখে। নাকে ভেসে আসে কড়া পুরুষীয় ঘ্রাণ। তোঁষা’র ভালো লাগে শুঁকতে। আরহামে’র কন্ঠে ঘোর কাটে তোঁষা’র,
— বলি নি কিচেনে একা না আসতে?
থতমত খেলেও তোঁষা মুখ সামলে উত্তর দিলো,
— সেটা বলেছিলেন একা বাসায় থাকলে। যেহেতু আপনি এখন বাসায় তাই এই কথা প্রযোজ্য হবে না।
আরহাম তীক্ষ্ণ চোখে তোঁষা’কে দেখে নিয়ে কিচেনে হাটা দিলো। তোঁষা প্লেট হাতে টেবিলে বসতে বসতে বললো,
— আরহাম ভাই, কাল আমি রান্না করব হ্যাঁ? জানেন আপনার জন্য আম্মু’র থেকে রান্না শিখেছিলাম….
বাকিটা বলতে গিয়ে ও তোঁষা চুপ হয়ে গেল। বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো মা’য়ের জন্য। তবে সেই ব্যাথায় পাত্তা দেয় না তোঁষা। আরহাম শেখ বাড়ীর কারো কথা শুনা পছন্দ করে না তাই তোঁষা চুপ করে যায়। আরহাম হাতে ইনসুলিন নিয়ে এগিয়ে এসে তোঁষা’র বাহু টেনে নিলো নিজের কাছে। হাফ হাতা কুর্তি’টার হাতা আরেকটু উপর তুলে সযত্নে পুশ করে দিতেই তোঁষা মুখ কুঁচকে একটু শব্দ করে,
— উফ!
আরহাম ততক্ষণে পুশ করে দিয়েছে। তোঁষা’র মুখে তাকিয়ে ব্যাস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— এই তুঁষ? ব্যাথা পেলি?
তোঁষা মাথা ঝাঁকাতেই আরহাম উলোট পালোট হলো। কপালের শিরা ফুলতে শুরু করেছে কিছুটা। তোঁষা’র পুশ করা জায়গাটায় একটু লাল তরল বের হয়েছে কিন্তু কেন? এমন তো হওয়ার কথা না। আরহাম খেয়াল করলো নিডেলটা বাকা। কেন ও আগে খেয়াল করলো না? কেন ওর তুঁষে’র মুখে ব্যাথাকাতুর শব্দ? তাও আরহামে’র কাছে? আরহাম কি তা মানবে? এটা কি সম্ভব? তোঁষা নিজেই এক আঙুলে বাহু থেকে র*ক্ত মুছে হাত ধুতে যেতে যেতে বললো,
— মনে হচ্ছে নিডেলে সমস্যা।
তোঁষা খেয়াল করে নি আরহামে’র মুখভঙ্গি। পুড়া গন্ধ নাকে আসতেই কিচেনে যায় আরহাম। একসাথে খাওয়া শেষ করে শুয়ে পরে তোঁষা’কে নিয়ে। তোঁষা ঘুমাতেই বিছানা ছাড়ে আরহাম। এগিয়ে যায় অন্ধকারে কিচেনে। ডাস্টবিনে নিডেল ফেলা। তোঁষা ফেলেছে এটা। আরহাম সেটা হাতে তুলে চুপ করে বসলো ফ্লোরে। এক ধ্যানে দেখলো নিডল’টাকে। সোজা না হয়ে কেন বাঁকা এটা? আরহাম ভাবলো।
আরেকটু সময় অতিবাহিত হতেই ঘড়ির কাটায় শব্দ হলো সাথে ভিন্ন এক শব্দ। এই তো রাত বারোটা বাজে এখন। আরহাম কাত হয়ে ফ্লোরে শুয়ে পরলো। বা হাতের বাহু গড়িয়ে তখনও চুয়ে চুয়ে বের হচ্ছে লাল তরল। অগণিত সুচের আঘাত সেই শক্ত পেশি’র বাহুতে। ব্যাথাটা কি ওর তুঁষে’র ব্যাথার সমান হলো? নাকি হলো না? আরো কিছুক্ষণ কি আরহাম খোঁচাবে হাতটা? ভাবতে ভাবতে সুন্দর করে উঠে ফ্লোর পরিষ্কার করে আরহাম অতঃপর একদম শান্ত ভাবে এগিয়ে এসে তোঁষা’র পাশে বসলো। পুশ করা স্থানে ঠোঁট লাগিয়ে ভেজা চুমু খেয়ে ফিসফিস করে আরহাম জানালো,
— সমান সমান তুঁষ। তোর যতটুকু ব্যাথা আমারও ততটুকু ব্যাথা।
#চলবে….
#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৯
রোদ্দুরে ঝকমক করছে ধরণী। আমানিশা কেটেছে কিছুক্ষণ আগে। বেভুর ঘুমে থাকা তোঁষা আরহামের টিশার্টের বুকের দিকে খাঁমচে ধরে আছে। আরহামে’র একটা হাত তোঁষা’র মাথায়। বা হাতটা সাইডে ফেলে কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে সে। আস্তে ধীরে ঘুম ভাঙে তোঁষা’র। এদিক ওদিক মুচড়ে চোখ খুলে ধীরেসুস্থে। সম্মুখে নজর তাক করতেই দিদার মিলে আরহামে’র। ঘুমের রেশ লাগা মুখটায় দেখা মিলে হাসির। যতটুকু দূরত্ব আছে তোঁষা ঘুচিয়ে দেয় তা। একদম আরহাম’কে ছুঁই ছুঁই করে এগিয়ে আনে নিজের শরীর’টাকে। কাত হয়ে দেখতে থাকে আরহামে’র সুশ্রী সুদর্শন চেহারাটা’কে। সুন্দর আরহাম ভাই তোঁষা’র। ঠিক যেন ঘোর আমাবস্যা’র রাতে পূর্ণিমার চাঁদ। তোঁষা দুই আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিলো আরহামে’র গালটা। খোঁচা খোঁচা লাগলো আঙুলে। তোঁষা ভাবলো আরহাম’কে বলবে যাতে একটু দাড়ি রাখে। চাপ দাঁড়িতে নিশ্চিত তাকে আরো মানানসই লাগবে।
আরহামে’র চোখের মনি নড়ছে কিছুটা। ঠাহর করতে পেরে তোঁষা চোখ বুজে নিলো কিন্তু চোখ মেললো আরহাম। তোঁষা’কে নিজের এতটা কাছাকাছি দেখে মুহুর্তে চমকালেও সামলে নিলো নিজেকে। ওর দুষ্ট প্রাণ যে সজাগ তা ও জানে আরহাম। না জেনে উপায় আছে? এই যে দুষ্ট পাখিটা ঘুমের ভান ধরেছে বলে এমন শক্ত হয়ে সোজা শুয়ে আছে অথচ তার ঘুম হলো এলোমেলো। শরীর ছেড়ে ঘুমায়। আরহাম নিজেও দুষ্ট কম না। ঠিক তোঁষা’র মতোই তোঁষা’র গালে দুই আঙুল বুলিয়ে দিলো। প্রচন্ড স্পর্শকাতর মেয়ে তোঁষা। আরহাম যখনই ওর গাল থেকে থুঁতনিতে আঙুল চালালো ওমনিই শরীর মুচড়ে মুখে “উমম” উচ্চারণ করলো।
অল্প হেসে আরহাম তোঁষা’র হাত টেনে নিজের কাছে আনতেই তোঁষা তাকালো। তাকালো আরহাম নিজেও। দু’জনের গভীর দৃষ্টি দু’জনে চোখে। তোঁষা সম্মোহীন হয়ে দেখে যাচ্ছে আরহাম’কে আর আরহামের দৃষ্টিতে উত্তাপ।
মনোবিজ্ঞানী’রা বলেন, “একজন প্রাপ্তবয়স্ক নর ও নারী পরস্পরের চোখের দিকে টানা এক মিনিট তাকিয়ে থাকলে হয় তারা পরস্পর’কে খু*ন করতে চাইবে অথবা পরস্পরের সানিধ্য চাইবে”।
তোঁষা’র ক্ষেত্রে বোধহয় সেটাই হলো। হঠাৎ করে আরহামে’র মুখোমুখি মুখ আনতেই আরহাম আটকে দিলো। তোঁষা মানলো না। আরহামে’র বাঁধা উপক্রম করতে নিলেই শক্ত হাতে আরহাম জড়িয়ে ধরে তাকে। জোরে জোরে শ্বাস টানে আরহাম। নিজেকে কি সে সামলাতে পারছে বা পারে? মোটেও পারে না। এই যে গত তিন চারটা দিন ধরে তুঁষটা’কে নিয়ে নিস্তব্ধতায় ঘেরা এই ফ্ল্যাটে থাকে। প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ হিসেবে আরহাম কি দাঁত কামড়ে পরে রইছে না? সে কি নিয়ন্ত্রণ করছে না? হুটহাট তোঁষা’র আলিঙ্গনে বেসামাল কি আরহাম হয় নি? হেয়েছে। একবার না বারবার আরহাম বেকায়দায় পড়েছে অতঃপর নিজেকে সামলেছে।
তোঁষা’র এই ভালোবাসা টাইটুম্বুর থাকে আবেগে। আরহাম চাইছে তোঁষা আগে নিজেকে সামলে উঠুক। এমন ভাবে আচানক কিছু না ঘটুক যাতে তোঁষা’র স্ব্যাস্থে তার প্রভাব পড়ে। এমনিতেই তোঁষা’র শরীর ততটা ভালো থাকে না। অনেকটা সমস্যা নিয়েই সে ভূমিষ্ট হয়েছিলো ধরণীতে।
আরহামের ভাবনার মাঝেই তোঁষা নড়াচড়া শুরু করলো। প্রচন্ড জেদী এই তুঁষ। আরহাম ছাড়া কাউকে মানতে ও চায় না। শক্তপোক্ত আরহামে’র সাথে পেরে উঠবে না জেনেও শক্তি ক্ষয় করে যাচ্ছে। আরহাম শক্ত করে তোঁষা’কে বুকে পিষলো। তোঁষা বুঝি এতটাই বুঝার মেয়ে? ছটফট করে ছুটতে চাইছে সে। নীরব যুদ্ধ চলছে এই ভোর সকালে। এসময় আরহাম “উফ” শব্দ করতেই তোঁষা শান্ত হলো। এ কি যেই সেই শান্ত? একদম ঠান্ডা পানি যাকে বলে। যেন ঘাসের উপর লেপ্টে থাকা তুঁষা’র।
আরহাম গালে হাত ডলতে ডলতে বললো,
— দেখ তো প্রাণ র*ক্ত বের হলো নাকি?
তোঁষা দেখা তো দূর নড়লোই না। আরহাম হেসে ফেললো। কাত হয়ে তোঁষা’র নাক টেনে দিয়ে বললো,
— বুঁচি’র আবার লজ্জা লাগে?
— হু।
— তাহলে কামড় দিলি কেন?
………….
— কি? এখন চুপ কেন? কথা বল।
— তোমার দোষ। কথা বলবে না।
আরহাম অল্প বিস্তৃত ভ্রু কুঁচকে হাসছে। প্রচন্ড আদুরে ভাবে আছে তার তুঁষ। এই “তুমি” ডাকটা বছরে এক দুই বার শুনা যায় তার মুখে। আরহাম মুখ এগিয়ে এনে চুমু খেল তোঁষা’র মাথায়। নিজে উঠতে উঠতে বললো,
— আরেকটু ঘুমা।
___________________
আরহামে’র সাথে তোঁষা’র বিয়ে কেউই দিবে না। তোঁষা’র হাজার পাগলামি কাজে লাগে না। একা ছোট্ট তোঁষা কত লড়বে? কত মা’র খাবে? কতই বা মায়ের বকা, বাবা’র সেই অসন্তুষ্ট দৃষ্টি দেখবে? আরহামে’র সাথে তোঁষা যে লুকিয়ে কথা বলতো তা ধরা খেয়েছিলো আদনানে’র কাছে। পরিক্ষা’র জন্য রাতে পড়ার জন্য জেগে থেকে তুঁষা’রের ফোনটা লুকিয়ে এনে কথা বলে তোঁষা যা আদনান দেখে ফেলে কোনভাবে। তখন তোঁষা’কে কিছু না বলে তোঁষা’র জন্য আনা দুধ’টা নিয়ে ফেরত চলে যায় ও। আদনান সারাটা রাত জেগে ছিলো তোঁষা সজাগ বলে। তুঁষ’টা পড়ছে আদনান কিভাবে ঘুমাবে? সারাদিন কাজ শেষে রাত জাগাটা মোটেও সহজ কিছু না। তবুও আদনান জেগে থাকে তোঁষা’র জন্য। মনের ভেতরে লুকায়িত ভালোবাসা সে কোনদিন প্রকাশ করে নি। করার সুযোগটাও হলো না। সেদিন ই ছিলো তোঁষা আরহামে’র শেষ কথা। এরপর থেকে আর কারো ফোন লুকায় নি তোঁষা। সুযোগ ও হয় নি। মা তাকে সকালে ঘুম থেকে তুলে রাবারের স্কেল দিয়ে পিটিয়েছে। সারারাত জেগে থাকা তোঁষা হঠাৎ হামলায় ঘুমের মধ্যেই চিৎকার করে কেঁদে উঠে। ওর ভয়ানক এই আর্তনাদে ছুটে আসে বাড়ী’র সকলে কিন্তু দরজা লক থাকায় কেউ ঢুকতে পারে না। তোঁষা’র একেকটা আত্মচিৎকারে ভারী হয়ে আসে শেখবাড়ী।
— আম্মু….আম্মু মে’রো না। মে’রো না আম্মু। আম্মু ব্যাথা পাই। আব্বু? আব্বু? ভাইয়া! ভাইয়া ব্যাথা পাচ্ছি।
অপরপাশে পাগল হয়ে যায় তুঁষা’র। শক্ত হাতের থাবা বাসায় দরজায়। শক্ত দেহটা কাঁপছে তখন রাগে। বোনের চিৎকারে। বাঁচাতে না পারার অক্ষমতায়। দরজা যেন ভাঙার উপক্রম তুঁষা’রের,
— মা মা দরজা খুলো। পুতুল’কে ছাড়ো মা। ভালো হবে না মা! ছাড়ো পুতুল’কে। দাও ওকে। মা!!
ওর মা কথা শুনে না। তোঁষা তখনও চিৎকার করে কাঁদছে।
আদনান গিয়েছিলো মর্নিং ওয়াকে। সারারাত ঘুম হয় নি তাই সকালে ও আর ঘুমায় নি সে। বাসায় ফিরে তোঁষা’র চিৎকার শুনে দৌড়ে আসতেই পরিস্থিতি বুঝে যায় ও। দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে তুঁষা’রকে বলে,
— ভাই ধাক্কা দাও।
এদিকে তুরাগ আর তুহিন ও থেমে নেই। তোঁষা’কে হাজার রাগ দেখালেও তোঁষা’র ঐ দিনের কান্নায় পাষাণ হৃদয় ও বুঝি কাঁদতো। ছোট্ট একটা প্রাণ, ভালোবাসার দায়ে কতটাই না আঘাত পেলো।
তুঁষা’রের মতো আর্মি ম্যান ও যেন হঠাৎ থমকে যায়। তোঁষা’র কান্না বন্ধ তখন। তুহিন দুই পা পিছিয়ে যান। নাজুক তার কলিজার টুকরো’টার কিছু হলো কি? তুরাগ তাড়া দিলেন দরজা ভাঙতে। ততক্ষণে বিলাপ জুড়েছেন তার স্ত্রী।
তুঁষা’র শেষ বারের মতো সজোরে ধাক্কা দেয়ার আগেই খট করে দরজাটা খুলে গেলো। ওর দাদা এই দরজাগুলো জার্মান থেকে আনিয়েছিলেন। প্রচুর মজবুদ ধাঁচের। তুঁষা’র দেখলো ক্লান্ত মা’কে। মধ্যবয়স্ক সুশ্রী নারীটি ক্লান্ত। তুঁষা’রের পুতুল মে’রে ক্লান্ত, ভাঙা শরীর নিয়ে হেলেদুলে বেরিয়ে যান তিনি। তুঁষা’র ঠাই দাঁড়িয়ে রয়। আদনান ততক্ষণে চিৎকার করে ডাকে,
— তুঁষ!
র*ক্তাক্ত জ্ঞান হারা তোঁষা তখন ফ্লোরে পড়া। পরণে থাকা টিশা’র গলার দিকে র*ক্ত। কোথায় কাটলো? কোথায় ফাটলো? তুঁষা’রের মতো আর্মি বুঝে না সেটা। বিচক্ষণতা’র যেন মুহুর্তে ই বিলুপ্তি ঘটলো। তুঁষা’র দৌড়ে এসে তোঁষা’কে ধরে। তুহিন এগিয়ে এলো না। বৃদ্ধ শরীর তার শক্তি পায় না। তুরাগ তাড়া দিলেন হাসপাতালে নিতে। ওর চাচি তোঁষা’র মুখে পানি দিচ্ছে। তুঁষা’র এগিয়ে এসে বোনকে আগলে নিলো। কে বলে পুরুষ বাবা স্বাদ পায় নিজের অস্তিত্বের আসছে এই খবর পাওয়ার পর? তুঁষা’র তো এই পুতুল’টাকে দেখেই পিতৃ স্বাদ পায়। যেন তুঁষা’রের অবিচ্ছেদ্য দেহটা। একই র*ক্তের টান আছে না।
আদনান হতভম্ব হয়ে যায়। চাচি এমন কাজ করবে ও ভাবেনি।
তোঁষা’র দেহটা যেন ভারী লাগে তুঁষা’রের নিকট। বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে ফোন হাতে কল লাগায় পরিচিত ডক্টর’কে। হাসপাতালে নিলে যখন পুলিশ আসবে তখন কাকে দোষারোপ করবে আর্মি ম্যান? মা’কে নাকি ভাগ্য’কে?
তোঁষা’র সেদিনের কম্পমান র*ক্তাক্ত দেহটা ভেসে উঠে চোখের পর্দায়। তিনটা ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরতেই কাকে ডাকলো তোঁষা? ক্লান্ত তার মুখটা শুধু অভিযোগ জানালো,
— ভাইয়া, আব্বু, আম্মু মে’রেছে। আরহাম ভাই আসুক। বলে দিব সব।
ফট করে চোখ খুলে তুহিন। দরদর করে ঘামছে সে। এই তো মাস কয়েক আগের ঘটনাটা আজও স্বপ্নে দেখলো সে। তোঁষাটা কি বেঁচে আছে?
নিজের প্রশ্নে অবাক তুহিন। পাশেই প্রায় অচেতনের মতো ঘুমাচ্ছে তার স্ত্রী। কুঁচকানো চামড়ার হাতটা বাড়িয়ে স্ত্রী’র কাপালে রাখেন তুহিন। জ্বরটা কেন যে থামছেই না।
#চলবে….
[গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক তাই সেভাবেই ভাবুন।]