প্রিয় প্রাণ পর্ব-৬+৭

0
431

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৬

শেখ বাড়ীর ছোট ছেলে আদনান। শান্ত, ভদ্র এক ছেলে। ইন্জিনিয়ারিং শেষ করে ভালো এক পেশায় নিয়োজিত। লম্বা চওড়া সুন্দর ধাঁচের ছেলেটা। আরহামের মা তাকিয়ে আছেন আদনানে’র দিকে। এগিয়ে এসে একটু মাথায় ও হাত বুলিয়ে দিলেন। আদনান ফিচেল হাসলো। ও জানে এই আদরটা ওর মা ওকে করছে না। এই আদর টুকু হলো ওর বড় ভাই আরহামে’র। চেহারা এক হওয়াতে মা মাঝেমধ্যে ই আরহামের কথা মনে পরলে রাত বিরাতে আদনানে’র রুমে ছুটে আসেন। আদনান বুঝে মায়ের মন। কিছুই করার নেই তার। শুধু আদনান কেন কেউ ই কিছু করতে পারবে না। মায়ের হাতটা জড়িয়ে নিজের বুকে রাখে আদনান। অল্প অন্ধকারে দেখে নেয় মায়ের ক্রন্দনরত চেহারাটা। দুই ভাই এর ই জান তাদের মা। আদনানের মা ভাবে নি ছেলে সজাগ। আদনান মায়ের কোলে মাথাটা তুলে দিতেই হু হু করে কেঁদে উঠেন তিনি। আদনান মা’কে থামায় না। কাঁদতে দেয়। কাঁদুক। কাঁদা ভালো। কাঁদলে মন হাল্কা হয়। আদৌ কোনদিন ওর মায়ের মন হালকা হবে কি না জানা নেই। একজন মায়ের কাছে তার প্রথম সন্তান কি তা সেই মা ছাড়া কেউ জানে না। সৃষ্টিকর্তা’র দেয়া প্রথম নেয়ামত বলে কথা।
ধীরে সুস্থে মায়ের কোল থেকে মাথা তুলে আদনান। হাত বাড়িয়ে মুছে দেয় চোখের পানি। অল্প বিস্তর হেসে শুধায়,

— কেন কাঁদছো মা? ভাই ঠিক আছে।

সচকিত নয়নে তাকান তিনি। আদনান বুঝে মায়ের না করা প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর সরুপ ওষ্ঠ ছুঁয়ে দেয় তার ললাটে। চোখের পানি বাকিটুকু মুছে দিয়ে বলে,

— জানি না কোথায় আছে কিন্তু এতটুকু বিশ্বাস আছে তার নিজের প্রাণের টুকরো’কে নিয়ে সে খারাপ থাকবে না কখনোই।

দুই হাতে জাপ্টে ধরেন তিনি ছেলেকে। কাঁদতে কাঁদতে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলেন,

— ও..ওকে এনে দে না আদনান। আমার প্রথম সন্তান ও। আমার কলিজার টুকরো’টাকে দেখি না কতবছর।

আদনানে’র গলা ধরে আসে। কান্না পায় তারও কিন্তু কাঁদে না সে। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শুধু বলে,

— আরেকজনের কলিজার টুকরো নিয়ে গিয়েছে সে মা।

— ও পুতুলের খারাপ চায় না।

— চাইলেও কোনদিন ভালো করতে পারবে না মা। কবে না জানি তুঁষে’র লা*শ নিয়ে চৌকাঠে আসে।

ওর মা ঝট করে ছেড়ে দেন আদনান’কে। আদনানে’র ঠোঁটে তখন দেখা মিলছে দুর্বোধ্য হাসি। ওর মা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। আদনান মায়ের হাতের তালুতে চুমু খেয়ে বললো,

— যাও মা। ঘুমাও। ভাই ঠিক আছে। যাও।

নির্বোধের ন্যায় উঠে দাঁড়ায় ওর মা। দুই পা ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে ও যান। পরবর্তী পা ফেলা হলো না। আদনানে’র দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ও কি কখনো ভালো হবে না?

— চিকিৎসক নিজে অসুস্থ হলে তার রোগ সারাবে কে?

ওর মা আর অপেক্ষা করে না। রুম থেকে চলে যান। বালিশে মুখ গুজে দেয় আদনান। বলিষ্ঠ দেহটা কাঁপছে তার ক্ষণে ক্ষণে। কেন সে ভালোবাসা পেলো না? মানুষ তো সুরত দেখে ভালোবাসে। তাহলে তার তুঁষ কেন আটকালো না? আরহাম আর ওর মাঝে চেহারার পার্থক্য টা কোথায়? আদনানে’র মনটা যেন হঠাৎ ই উত্তর দিলো, “ভালোবাসা সুরত দেখে না”।
___________________

নিজের পিঠে ভারী কিছু অণুভব হতেই আরহামের ঘুম কিছুটা ছুটে যায়। তুলতুলে একটা র*ক্তে মাংসে গড়া অস্তিত্ব তার উপর টের পাচ্ছে সে। কোন নড়চড় নেই অস্তিত্বটার মাঝে। আরহাম নিজেই একটু নড়লো। তবুও ওর উপরে থাকা তুলার বস্তাটা নড়লো না। সে ঠাই মে’রে আরহামের পিঠে’র উপর শুয়ে আছে। আরহাম ঘুম জড়ানো কন্ঠে ডাকলো,

— তুঁষ?

ধ্বক করে উঠে তোঁষা’র ছোট্ট বুকটা। এই ডাকটা যেন তার হৃদয় এফারওফার করে দিচ্ছে। আরহাম তোঁষা’র জবাব না পেয়ে পুণরায় বললো,

— কি হয়েছে প্রাণ?

তোঁষা এবারের ও নিশ্চুপ। আরহাম এবার তোঁষা’কে এক হাতে পেঁচিয়ে পল্টি দিয়ে ঘুরলো। অবস্থান পেলো তোঁষা আরহামে’র বুকে। নিজের মুখটা আরহামের মুখের উপর নিয়ে বেজার মুখে বললো,

— বোর হচ্ছি আরহাম ভাই। চলুন না ঘুরতে যাই।

— ঘুরতে যাবি?

— হু।

— কোথায়?

তোঁষা ভাবছে কোথায় যাওয়া যায়। একুল ওকুল ভেবেও গতি যখন পেলো না তখন উৎফু্ল্ল চিত্তে বললো,

— আপনি যেখানে নিবেন সেখানেই যাব।

–যেখানে নিব সেখানেই।

— হ্যাঁ তো। উঠুন না। আমার একা ভালো লাগছে না।

আরহাম নিজের সরু দৃষ্টি ফেলে তোঁষা’কে দেখে যাচ্ছে। এক হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে তোঁষা’র আধ ভেজা চুল। মেয়েটার এই দীর্ঘ কেশ অনেক পছন্দ আরহামে’র। তোঁষা ও অনেক যত্ন করে চুল গুলোর। আরহামের উপর ঝুঁকে থাকাতে কিছু সংখ্যক চুল আরহামের মুখে চলে এলো। তোঁষা হাত দিয়ে তা আরহামে’র মুখ থেকে সরাতে নিলেই আরহাম থামিয়ে দিলো। তোঁষাটা’র চুল থেকেও কেমন একটা ঘ্রাণ আসে। এতবছর দূরে থাকলেও আরহাম ভুলে নি তার তুঁষে’র ঘ্রাণ। যেই ঘ্রাণ আগে লুকিয়ে চুপিয়ে নিতো সেই ঘ্রাণ এখন ও কাছ থেকে পাচ্ছে। এই তুঁষ’টার ঘ্রাণ ও কেমন একটা শীতলতা অনুভব করায় ওর প্রাণে।
তোঁষা পুণরায় তাড়া দিলো,

— এএই আরহাম ভাই?

— উউম।

— আর কতক্ষণ?

— আয় ঘুরাই তোকে।

বলেই আরহাম তোঁষা’কে কোলে তুলে উঠে দাঁড়ালো। তোঁষা হেসে আরহামে’র গলা জড়িয়ে ধরে। আরহাম ওকে নিয়ে পুরোটা ফ্লাট জুড়ে হাটলো। আনাচে কানাচে সব জানালো। প্রায় ঘন্টা খানিক যখন পার হবে তখন শেষ হলো ওদের ঘুরা। আরহাম এখানে খুব সুক্ষ্মভাবে এরিয়ে গিয়েছে তোঁষা’কে ঘুরতে নেয়ার ব্যাপারটা। তোঁষা অতশত খেয়াল করলো না। সে মজা পেয়েছে এভাবে আরহামের কোলে চড়ে ঘুরতে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতেই আরহাম তোঁষা’কে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসালো। তোঁষাটা’র হাটু সমান চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়ে দিতে দিতে তাকালো তোঁষা’র পানে। মেয়েটা সারাটাক্ষন আরহাম’কে দেখে। কি যে দেখে আল্লাহ মালুম। এই যে আজ দুটো দিন হতে চললো অথচ তোঁষা দেখেই যাচ্ছে আরহাম’কে। আরহাম যে ওকে আরো গভীর ভাবে দেখে তা কি তোঁষা জানে বা টের পায়? পায় না বোধহয়। পেলে নিশ্চিত লজ্জায় ম’রে যেতো।
তোঁষা হঠাৎ ই প্রশ্ন করলো,

— আরহাম ভাই, আপনি কি ডাক্তারি ছেড়ে দিয়েছেন?

— এটা কেন মনে হলো তোর?

— জিজ্ঞেস করলাম?

— কাজ ছেড়ে দিলে বউ খাওয়াব কি দিয়ে?

— দেশে জয়েন করেছেন?

— হু।

তোঁষা কথা বাড়ালো না।
আরহাম এদেশে থেকে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলো কিন্তু দুই বছর যেতেই দেশের বাইরে পারি জামায় সে। তোঁষা শুধু জানে ওর আরহাম ভাই ডক্টর হওয়ার সুযোগ পেয়েছে তাই গিয়েছে কিন্তু পুরো শেখ পরিবার জানে আসল ঘটনা। খুব সাবধানে তারা তোঁষা থেকে আড়াল করে রেখেছে এতগুলো বছর। আরহামের সাথে প্রথম প্রথম তোঁষা’কে যোগাযোগ করতে দিলেও পরে তা কমিয়ে দেয়া হয়। আরহাম জিজ্ঞেস করতেই তাকে জানানো হয়, তোঁষা’র পড়াশোনায় প্রভাব পড়বে এত বেশি কথা বললে। আরহাম মেনে নেয়। তার তুঁষ’টাকে পেতে সবটুকু কথা মেনে নেয় পরিবারের। টু শব্দ করে না। কিন্তু চঞ্চল প্রাণ তোঁষা’কে থামাতে পারে নি কেউ। নিজের ফোন না থাকায় রাতে বাবা, ভাইয়ের ফোন লুকিয়ে এনে আরহাম’কে কল দিয়ে কথা বলতো। কখনো প্রেমের আলাপ জমতো না তাদের মাঝে। যা ছিলো বা থাকতো সবটা ছিলো তোঁষা’র বাচ্চামো কথাবার্তা। আরহাম শুনতো। মাঝেমধ্যে হু হা যা বলা তা বলতো। তোঁষা’র তখন উঠতি বয়স। ভালো লাগতো সব কিছু।
শেখ বাড়ীর সবাই ভেবেছিলো সময়ের সাথে সাথে তোঁষা আরহাম’কে ভুলে যাবে কিন্তু না এমন কিছুই হয় নি বরং তোঁষা দিন কে দিন আরো গভীর ভাবে ডুবে থাকতো আরহামে’র ভাবনায়। যেটা কে সবাই তোঁষা’র আবেগ বলে আখ্যা দিয়েছিলো সেটা পরবর্তী’তে রুপ নিয়েছিলো ভালোবাসায়। একসময় পাগলামিতে।

#চলবে……

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৭

শেখ বাড়ীর সকলের চোখে মুখে বিষাদ লুকোচুরি খেলা করছে। বাড়ীটা যেন আস্ত এক ম’রা বাড়ী। বলা যায় গত কয়েক মাস ধরেই এটা ম’রা বাড়ী হয়ে ছিলো তবে এখন যেন মৃতপুরী’তে রুপান্তর হয়েছে। হাজার তোঁষা বিগত মাস কয়েক চুপচাপ থাকতো, হুটহাট সবার সামনে এসে আবদার করতো আরহামে’র জন্য, মাঝেমাঝে তেঁজী রুপ দেখা যেতো ওর। কিন্তু এখন? সবটা নিঃস্তব্ধতার চাদরে মুড়ানো। তাদের পুতুল নেই তাদের কাছে। সবাই জানে সে কোথায়, কার সাথে আছে কিন্তু তাদের হাত বাঁধা। তুহিন আর তুরাগ দুই ভাই গত দুই’টা দিন ধরে কম তো খুঁজলো না। পুলিশ জানিয়েও লাভ হয় নি। তারা জানে হবেও না। আরহাম প্রচন্ড ধুর্ত এক ছেলে। সে কোথায় লুকিয়েছে তা জানা মুশকিল। তবে এটা ভেবে তারা কিছুটা হলেও সস্তি’তে আছে যে আরহাম আর যা ই হোক এখন পর্যন্ত তোঁষা’কে কিছু করে নি। হঠাৎ কলিং বেল বাজতেই তুঁষা’রের মা দরজা খুলেন। পুলিশ অফিসা’র দেখেই স্বামী’কে ডাকতে চলে আসেন ভেতরে। ততক্ষণে আদনান এগিয়ে এসে তাদের ভেতরে আনলো।
বাড়ী’র পুরুষ’রা সকলে সোফায় বসা। তাদের সামনে টেবিলে ল্যাপটপে চলছে একটি ভিডিও যাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তোঁষা পার্লার থেকে পালিয়ে নিজে গিয়ে একটা গাড়ীতে চড়ে বসছে। তবে এর আগে আদনান পার্লারে ঢুকেছে। আদনান সেটা দেখেই চমকে উঠে বললো,

— ভাই।

পুলিশ অফিসার নিজেও ব্যাপারটা নিয়ে বিভ্রান্তি’তে ছিলেন৷ তিনি ভেবেছিলেন ওটা আদনান তবে না সেটা ছিলো আরহাম যে আদনান সেজে পার্লারে ঢুকেছিলো। হয়তো তখনই কোনভাবে তোঁষা’র সাথে যোগাযোগ করেছে যার দরুন তোঁষা পালাতে পেরেছে।
সবটা শুনে অফিসার তুরাগে’র দিকে তাকিয়ে বললেন,

— স্যার এখানে কিডন্যাপ এর মতো কিছুই নেই। তোঁষা নিজে পালিয়েছে। সবটা পরিষ্কার। কোন ক্লু এর ভিত্তিতে তোঁষা’র খোঁজ করব?

তুহিন চুপ করে গেলেন আর তুরাগ সে নিজের ছেলের কৃতকর্ম দেখে বাকহারা। তোঁষা’র মা দূর থেকেই মেয়ের পালানোর দৃশ্য দেখে মুখে আঁচল গুজে কাঁদছে। আরহামের মা দুই হাতে নিজের সাথে জাপ্টে ধরেন তাকে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি শুধু বললেন,

— ভাবী মেয়েটাকে বিয়ের সকালেও মে’রেছি আমি। ও ভাবী ও কি আর ফিরবে না? আমার বুকটা কেমন করছে ভাবী। আমার পুতুল।

তুঁষা’রের কানে যাচ্ছে মায়ের কান্না। তবে তার চতুর মস্তিষ্ক দেখছে অন্য কিছু। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেই সে প্রশ্ন করলো,

— তোঁষা’র নাকে, মুখে র*ক্ত কিসের?

হঠাৎ এহেন প্রশ্নে চমকে তাকান সকলে। হ্যাঁ তাই তো। কেউ কেন খেয়াল করলো না বিষয়টা না। পার্লার থেকে বের হলে কেন তোঁষা’র নাকে, মুখে র*ক্ত আর কেন ই বা এক হাতে পেটের দিকে চেপে রেখেছে? এত এত প্রশ্ন অথচ উত্তর শূন্য।

অফিসার বিদায় হতেই ধপ করে বসে পরে তুহিন। তুরাগে’র মুখে ভাষা নেই ছোট ভাই’কে কিছু বলার বা সান্ত্বনা দেয়ার। আরহাম’কে কিছুতেই সহজে নেয়া যাচ্ছে না। তবে এটাও ঠিক এখন পর্যন্ত সে হয়তো তোঁষা’র গায়ে মশার কামড় ও পরতে দেয় নি তবে সামনে কি হতে পারে তা ভাবতেই যেন গা শিওড়ে উঠছে। আদনান দুই হাতে মাথা চেপে ধরে কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দ্রুত পায়ে রুমে চলে গেল। এখানে টিকা যাচ্ছে না আর। কিছুতেই না।
তুঁষা’র এতক্ষণ চুপ থাকলেও হঠাৎ বললো,

— এই সপ্তাহে চলে যাচ্ছি চাচ্চু।

তুরাগের দৃষ্টিতে হতভম্বতা। আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

— চলে যাচ্ছো মানে?

— ক্যাম্পে যাচ্ছি।

তুহিন মাথা তুলে ছেলের দিকে অসহায় দৃষ্টি ফেলেন। তুঁষা’র সেটা দেখে নির্লিপ্ত গলায় বললো,

— এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই আব্বু। আমি বহু আগেই তোমাকে বলেছিলাম। শুনো নি। এখন ভুগো। আমার কথা শুনলে অন্তত আজ আমার পুতুল আমার বুকে থাকতো।

বলেই হনহনিয়ে রুমে চলে যায় তুঁষা’র। বোনের জন্য তার হৃদয়ে যে ভালোবাসা তা শুধু মাত্র ভাইয়ের না বরং তোঁষাটা’কে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে তুঁষা’র। না চাইতেও বারবার মনে হয় এই বুঝি মাস গড়াতেই আরহাম তার পুতুল’টার প্রাণহীন দেহ নিয়ে হাজির হয়। ভাবতেই তুঁষা’রের হাত-পা শীতল হয়ে আসে। মনকে বুঝ দেয় এখন পুতুল ভালো আছে। আরহাম যেমন তোঁষা’কে বুকে করে রাখবে ঠিক তেমনই ঐ বুকে তোঁষা’র সমাধি দিতেও পিছু পা হবে না।

________________

পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনা যাচ্ছে তবে দূর থেকে। ফুরফুরে বাতাস তেড়ে আসছে রুমে। আরহাম ঘুম জড়ানো চোখে একবার তাকালো। জানালা লাগানো তবে বারান্দার থাইটা একটু খোলা। তা দিয়ে ই এমন বাতাস আসছে। পাখির শব্দ এই বাইশ তলার উপর ঠিকঠাক শুনা যায় না তবে শীত হওয়াতে কিছুটা টের পাওয়া যাচ্ছে। ঠান্ডা বাতাস তোঁষা’র গায়ে লাগবে ভাবতেই আরহাম তাকালো। আরহামের বাহুর ভেতর ঢুকে বিড়াল ছানার ন্যায় গুটিয়ে তার বুকে মিশে আছে তোঁষা। ঘুম ঘুম মুখটাতে আরহামের হাসি। তৃপ্তিময় এক হাসি। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো তোঁষা’র ফুলা গালটা। আরহামের চোখটা হঠাৎ জ্বলে উঠলো যেন। বছরের পর বছর কিভাবে পার করেছে তা কেবল আরহাম জানে। এই তোঁষাটা’কে ছাড়া বহু কষ্টে দেশের বাইরে থেকেছিলো সে। মনে বিশ্বাস ছিলো সে সফল হয়ে ফিরার পর তোঁষা’কে পাবে। নিজের করে। কিন্তু না, ধোঁকা খেলো খুব বাজে ভাবে। একজন সফল, ক্ষ্যাতিমান সাইকিয়াট্রিস্ট হওয়ার পরও শেখ বাড়ীর সকলে মিলে কি ধোঁকাটাই না দিতে চাইলো।
চোখ গড়িয়ে এক ফোঁটা পানি পরতেই আরহাম তোঁষা’র মাথায় মুখ দিয়ে রাখলো। তোঁষা আরেকটু জড়িয়ে নিলো নিজেকে আরহামে’র সাথে। সায় পেয়ে আরহামের বন্ধনী দৃঢ় হলো আরো। তোঁষা তখন অল্প ব্যাথা পেলেও কিছু বললো না। হোক না মরণ, বুকটা তার প্রাণে’র হলেই শান্তি।
.
আরহাম’কে তৈরী হতে দেখেই তোঁষা’র মন খারাপ হয়ে এলো। এদিক ওদিক ঘুরঘুর করছে ও। আরহাম আড় চোখে সবটা দেখছে তবে চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে। তোঁষা উৎসুক দৃষ্টি ফেলে এবার আরহামে’র কাছে আসতেই আরহাম টাইটা বাড়িয়ে দিলো ওর দিকে। তোঁষা যদিও টাই বাঁধতে পারে না তবুও এতক্ষণে আরহামে’র মনোযোগ পেয়ে সে টাই’টা হাতে তুলে নিলো। আরহাম থেকে অনেকটা খাটো হওয়ার দরুন তোঁষা নাগাল পাচ্ছে না তাকে। আরহাম দেখলো তোঁষা’র চেষ্টা। পায়ের তালু উঁচু করে সে চেষ্টায় আছে আরহামের টাই বাঁধতে। আরহাম ব্যাপারটা সহজ করলো ওর তুঁষে’র জন্য। দুই হাতে কোমড় জড়িয়ে উঁচু করে নিজের বরাবর করে দিলো। তোঁষা তখনও চেষ্টায়। বেচারী এতশত চেষ্টার পর ও যখন পারলো না তখন মুখটা পেঁচার মতো করে বললো,

— পারি না তো।

— চেষ্টা কর।

— করলাম তো।

— আবার কর।

এবার আরহাম গাইড করলো আর তোঁষা বাঁধলো। পাঁচ মিনিট লাগিয়ে সুন্দর করে তোঁষা কাজটা সম্পূর্ন করেই বিজয়ের হাসি হাসলো। উঁচু হওয়ায় আরহামের গলা জড়িয়ে উচ্ছাসিত গলায় বললো,

— আরহাম ভাই! বেঁধেছি আমি।

— হু। তুই বেঁধেছিস।

এগিয়ে একটু কাছাকাছি হলো আরহাম। তোঁষা ও নিজের মুখটা এগিয়ে নিতেই আরহাম ওর বোঁচা নাকে একটা চুমু খেয়ে বললো,

— আমার বুঁচি।

তোঁষা আবার বিনিময়ে একদম পাকা। নিজেও ঠেসে এক চুমু খেলো আরহামে’র গালে। পরপর নাকে দিয়ে বললো,

— আমার খাঁড়া নাক ওয়ালা শেখ সাহেব।

আরহাম হেসে ফেললো এহেন সম্মোধন শুনে। তোঁষা মুখটা ভোঁতা করে আরহামে’র চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— কখন ফিরবেন?

— ফিরার জন্য তো আগে যেতে হবে।

তোঁষা মুখ গোমড়া করেই রাখলো। আরহাম নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো তোঁষা’র দেহটাকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

— শিঘ্রই ফিরব প্রাণ।

তোঁষা আরহাম’কে দরজা পর্যন্ত বিদায় দিতে চাইলেও তা সম্ভব হলো না। তোঁষা’কে ভেতরে রেখে বাইরে দিয়ে মেইন ডোর লক করে গিয়েছে আরহাম। বারবার তোঁষা’কে তোতাপাখি’র মতো বলেছে যাতে দরজা না খুলে, বারান্দায় না যায়, রান্না ঘরে না যায় সহ এত কথা। তোঁষা সবটা শুনেছে। তবে এখন আর ভালো লাগছে না ওর। কিছুতেই না। পরপর তিনটা ঘন্টা পার হতেই ওর মন মেজাজ খারাপ হওয়া শুরু করলো। পায়চারি করতে করতে এলো আলমারি’র সামনে। খুলে হাতে নিলো আরহামে’র শার্ট। আলগোছে সেটা নিয়ে বিছানায় যায় তোঁষা। শার্টে নাক ডুবিয়ে চেষ্টা করে ঘ্রাণ নেয়ার। হায়! এতটা মাদকীয় কোন পুরুষের ঘ্রাণ হয় নাকি?

#চলবে…..

[ গল্পটা কাল্পনিক তাই সেভাবেই ভাবুন ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে