প্রিয় প্রাণ পর্ব-৪+৫

0
155

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪

“বয়স আঠারো হয় নি। এখনই পুরুষ দরকার তোর?”

ঝাঁঝালো বাক্যটা শুনে তোঁষা থমকে যায়। এই কথার ইঙ্গিতটা ঠিক কতটা বাজে তা বুঝতে ওর বেশি মাথা খাটাতে হয় নি। তোঁষা যেন একদম থমকে আছে এহেন বাক্য শুনে। কি বললো এটা মা? তোঁষা’কে চুপ থাকতে দেখে ওর মা এবার ওর বাহু চেপে ধরে বললো,

— কথা বল তোঁষা!

তোঁষা কথা বলবে? কিন্তু কিভাবে? আজ ভাষা গুলো গোছানো যাচ্ছে না কিছুতেই। কোনদিন উচ্চবাক্য ব্যায় করে নি ওর মা। নিজের সতেরো বছরের জীবনে তোঁষা কখনো শুনে নি ওর মায়ের উঁচু গলা। সবসময়ের মিষ্টভাষী ওর মা। ভদ্রমহিলা স্বামী থেকে অনেকটাই ছোট। পার্থক্য না হলেও বছর বিশ তাদের। তুহিন তাকে সবসময় আদরে আদরে রেখেছে। এক মাত্র সন্তান কি না তার প্রিয়তমা নিজের মা-বাবার। হাজার রাগ উঠলেও কোনদিন তুহিন স্ত্রী’র সাথে মন্দ ব্যাবহার করেন নি কিন্তু পরিস্থিতির সাপেক্ষে গতকাল হাত তুলেছিলেন। কতটা অনুতপ্ত সে তা রাতেই টের পেয়েছেন তোঁষা’র মা। তুহিন তাকে ঘন্টার পর ঘন্টা বুকে জড়িয়ে ছিলেন। তার অনেক সখের নারী বলে কথা। তোঁষা’র মা সবটা সময় ধরে ছিলো নির্বাক। তার মুখ থেকে বের হয় নি কোনরূপ বাক্য। তুহিন যেন অস্থির হয়েছিলেন তাতেই।
পনেরো বছরের এক অপরিপক্ক কন্যা এনে দিয়েছেলেন তার মা তাকে। সেই কন্যা থেকে ভালোবেসে, আদর, যত্নে, পেলে পুষে তুহিন ই তো নারী করলো তাকে। কিভাবে যেন একটা ভুলে তুঁষা’র টা এসে পরলো। এতে ক্ষতি বলতে শুধু ছুটে গেল তোঁষা’র মায়ের পড়াশোনা। তুহিন অবশ্য অনেক কষ্টে এইচএসসি টা দেয়ালো বউ দিয়ে। সেই নিয়ে ও তো তার মা কম চিল্লান নি। তুহিন তখন একরোখা জেদ করে তার স্ত্রী’কে পড়াশোনা করিয়েছেন। তুঁষা’র ছিলো প্রচুর চটপটে তাই তো ইচ্ছে থাকলেও আর উপায় হলো না। তারপর? কতগুলো বসন্ত এলো। থাকলো। চলে গেল। যখন পরিপূর্ণ, পরিপক্ক এক রমণী তুহিনের সেই স্ত্রী তখন জন্ম তোঁষা’র। সারাটা বাড়ীতে তখন খুশির ঝলক। এর অবশ্য কারণ ও ছিলো। শেখ বাড়ীতে না হলেও এক যুগের বেশি পর নতুন কেউ আসতে চলেছিলো। তুহিনকে তখন পায় কে? তখনকার ঐ বয়সেই সে যেন পাগল হয়ে যাবে খুশিতে।
যখন খবর পেলো পরী আসবে তখন যেন পাগলামো বাড়লো বহুগুণ। তুঁষা’র তখন যথেষ্ট বুঝদার। ওর মা অবশ্য লজ্জা পাচ্ছিলো। কিন্তু জা, ভাসুর এদের এত এত ভালোবাসা আর তুহিনে’র আদরে সবটা যেন সহজ হয়ে গেলো। শাশুড়ী তখন বেশ বৃদ্ধ। তোঁষা’র জন্মের চারদিন পর ইহকাল ত্যাগ করেন তিনি।

শেখ বাড়ীর সদস্য সংখ্যা তোঁষা’র আগমনে হলো আটজন। তোঁষা’র বড় চাচ্চু তুরাগ শেখ। তার স্ত্রী এবং দুই ছেলে সন্তান আরহাম এবং আদনান। আর এদিকে তুহিন আর তার স্ত্রী দুই সন্তান। একই ছাদের নীচে তাদের বসবাস। প্রাণোচ্ছল পরিবারটাতে সাজানো এক পুতুল হয়ে এসেছিলো তোঁষা। একমাত্র মেয়ে হওয়ার দরুন যে থাকত সকলের চোখের পাতায়।

সেই তোঁষা’কে উপরিউক্ত কথাটি তার মা বলেছে। তোঁষা’র বাহু চেপে দ্বিতীয় বার তিনি বলে উঠেন,

— তোর বিয়ে তো আমিই দিবই তোঁষা। তোর যখন এতই পুরুষ প্রয়োজন সেখানে তোকে বিয়ে না দিয়ে আমি কেন পাপিষ্ঠ হব?

— আরহা….

তোঁষা’র চোয়াল চেপে ধরে ওর মা। শক্ত কন্ঠে বলেন,

— একদম চুপ!! কে আরহাম? হ্যাঁ! কে আরহাম? ওর নাম মুখে আনবি না। তোর বাপ তোর খাটিয়া কাঁধে তুলতে রাজি কিন্তু আরহামের সাথে তোর বিয়ে দিতে না।

তোঁষা বড়বড় চোখ দিয়ে ওর মা’কে দেখে নিলো। এতটা হিংস্রতা ওর মায়ের মাঝে কখনো দেখি নি ও। গালে ব্যাথা পেতেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শুধু বললো,

— আম্মু.. ব্যাথা পাচ্ছি।

ওর মা ঝট করে ছেড়ে দিলেন। অবিশ্বাস্য চোখে দেখলেন তার পুতুলের গালটা। তার দুই হাতের আঙুলগুলো ডেবে আছে গাল জুড়ে। তখনই আদনান রুমের বাইরে থেকে বলে,

— চাচি?

তোঁষা’র মা যেন চোর ধরা পড়ার ন্যায় পালিয়ে গেলো মেয়ের রুম থেকে। দুই হাতে মুখ চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো। গতরাতে স্বামী’র আদর পেয়ে তার সকল অপরাধ ভুলে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন তিনি। তুহিন শেষ আবদার করেছিলো তাকে,

— আমার পুতুলটাকে কিভাবে বাঁচাব প্রাণ? বলো তো?

তোঁষা’র মা শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন স্বামী’কে। আশ্বাস দেন সামলাবেন সবটা। কিন্তু এখন? তার পুতুলের গালে ঐ দাগটা তার হাতের করা। কথাটা ভাবতেই চোখ দিয়ে পানি পরে তার।

আদনান ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করতেই তোঁষা মুখ তুলে তাকায়। টলমলে চোখে অনুরোধ করে,

— আদনান ভাই, আরহাম ভাই’কে বলুন না আমার কথা।

আদনান মুখ চোখ শক্ত করে তাকায়। তোঁষা উঠে বিছানা ছাড়ে। আদনানের কাছে এসে পুণরায় অনুরোধ করে বলে,

— আপনার ফোনটা একটু দিন না আদনান ভাই। আমি শুধু একবার কথা বলব তার সাথে।

— তোর সাথে কথা আছে তুঁষ।

তোঁষা বিরস মুখে তাকায়। এই “তুঁষ” নামে এই দুই জন ব্যাক্তি ই ডাকে তাকে। নাক টানে তোঁষা। ভেজা গলায় বলে,

— সব কথা শুনব আমি। এই যে ওয়াদা করছি। আগে একবার কথা বলিয়ে দিন না।

আদনান তোঁষা’র মুখপানে তাকায়। ফুলা গাল দুটো লাল হয়ে গিয়েছে। মাত্রই চাচি এ কাজ করেছে তা ওর জানা। আদনান হাত বাড়াতেই তোঁষা দুই পা পিছিয়ে যায়। বাড়ানো হাতটা নিমিষেই গুটায় আদনান। গম্ভীর কণ্ঠে শুধু বলে,

— সবার কথা মেনে নে তুঁষ। আরহাম কোনদিন তোর হবে না।

তোঁষা যেন মুহূর্তেই রেগে যায়। নাকের ডগা লাল হয়ে আসে। কম্পমান গলায় অগ্নি চক্ষু দিয়ে তাকিয়ে বলে,

— কেন হবে না? একশত বার হবে। হাজার বার হবে। আরহাম ভাই আমার ই হবে। তোমারা সবাই মিথ্যুক। জঘণ্যতম মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তাকে দূর করেছো।

তোঁষা যেন রাগের মাথায় কাঁপতে থাকে অনবরত। ধৈর্য ধরে আদনান বোঝাতে চেষ্টা করে কিন্তু তোঁষা মানবে না কিছুতেই। অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে হাতের সামনে থাকা পেপার ওয়েটটা আদনানের দিকে ছুঁড়ে মা’রতেই আদনান ওর হাত চেপে ধরে। ধমকে উঠে বলে,

— পাগল হয়েছিস? কি করছিস? খু*ণ করবি আমাকে?

তোঁষা’র মুখ তখন লাল হয়ে আছে। অস্থির হয়ে নিজেকে ছাড়াতে আদনানের বুকে ধাক্কা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। আদনান হাজার চেষ্টা করেও লাভ হয় না। ততক্ষণে তুঁষা’র ও বোনের চেঁচামেচিতে রুমে আসে। তোঁষা’কে ওমন অবস্থায় দেখে দৌড়ে রুমে এসে বুকে জড়িয়ে লাল চোখ দিয়ে আদনান’কে দেখে। তোঁষা রাগে কষ্টে ফুঁপাতে থাকে ভাইয়ের বুকে। তুঁষা’র ওকে ঠান্ডা করতে মাথায় হাত বুলায়। তোঁষা বাবাসম ভাইয়ের বুকের দিকটা খামচে ধরে ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলে,

— তুমি যাবে না ভাই। বলো যাবে না। এরা কেউ ভালো না। কেউ না। আমাকে আরহাম ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাও। আমি থাকব না এখানে।

তুঁষা’র বোনকে আগলে রাখে। চোখের ইশারায় আদনান’কে রুম ছাড়তে বলতেই আদনান চলে যায়। তুঁষা’র বোনকে আগলে নিয়ে বিছানায় বসে। চোখ মুছিয়ে দিতেই তোঁষা কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগ জানায়,

— আমাকে সবাই মা’রে এখানে ভাইয়া। আমি থাকব না আর। দেখো গালে আম্মু মা’রলো এখন। তোমার সাথে নিয়ে চলো আমাকে।

তুঁষা’র যথেষ্ট সামর্থ্যবান একজন সুপুরুষ। বর্তমানে আর্মিকে আছে ট্রেইনার প্লাস অফিসার হিসেবে। এবার বাসায় আসার কারণটা তার ভিন্ন। তোঁষা’টার জন্যই আসা হলো এবার নাহলে এত তারাতাড়ি ফিরত না ও। বোনের গালে আলতো হাত ছুঁয়ে আদর করে তুঁষা’র। পুরুষনালী ভারী গলাটা বড্ড আদুরে শুনায়,

— বেশি ব্যাথা করছে পুতুল?
.
বড় ভাইয়ের কথা মনে পরতেই তোঁষা’র মনটা খারাপ হয়ে যায়। নজর দেয় ওয়াশরুমের দরজার দিকে। সাওয়ার দিয়ে পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। এরমানে আরহাম তখনও গোসল করছে। তোঁষা মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে রাখা। মাত্রই গোসল করেছে ও। ওর নিজের ঠান্ডা লাগছে কি না বুঝা যাচ্ছে না তবে আরহাম ভাই বলেছে,”তুঁষ অনেক ঠান্ডা। তারাতাড়ি আয় এদিকে”।
অতঃপর তোঁষা’কে কম্বলের নিচে ঢুকিয়ে ঢেকে ঢুকে নিজে ওয়াসরুমে গিয়েছে। তোঁষা এক পলক এদিক ওদিক তাকালো। গতরাতে এখানে আসা হলেও এখন পর্যন্ত রুমটাই ভালোভাবে দেখা হয় নি ওর। চোখ গোল গোল ঘুরিয়ে দেখে নিলো তোঁষা। সাদা রঙের দেয়াল কিন্তু বেড সাইডের দিকে আর্টিস্টিক ছোঁয়া। সম্মুখেও সুন্দর করে ডেকোরেট করা দেয়াল। প্রয়োজনীয় কাবার্ড সহ এই কাউচ আর একটা ভ্যানিটি। তোঁষা এখনও জানে না এই ফ্লাট বা রুম আরহামের কি না? তবে রুমের রুচিসম্মত আসবাবপত্র দেখে তোঁষা নিশ্চিত এটা ওর আরহাম ভাই এর ই রুম। বাসায় ও তার রুমটা এমন ঝকঝকা ফকফকা থাকতো। তোঁষা দৌড়ে যেয়ে তার নরম গদিতে ঝাঁপিয়ে পড়তো ছোট থাকতে। সবার জন্য আরহামের রুমে অনুমতি ব্যাতিত প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও তোঁষা’র ক্ষেত্রে ছিলো তা সম্পূর্ণ ব্যাতিক্রম।
কাঁচ দেয়া দেয়ালটার দিকে তাকালো তোঁষা। শীতের দিন বিধায় রোদ উঠেছে দেড়ীতে কিন্তু চলে যাচ্ছে তারাতাড়ি। আরহাম গোসল সেড়ে বের হতেই তোঁষা’র নজরে এলো তার আরহাম ভাই’কে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েই রইলো ও। কোন রোকঠোক নেই ওর দৃষ্টিতে। বেহায়া, বেপরোয়া চোখটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে যাচ্ছে যতটা দেখা যায়।
সাদা টাওয়াল কাঁধে ঝুঁলিয়ে নাভির নিচে টাউজার পড়ে বের হ’য়েছে আরহাম। তোঁষা নির্লজ্জ হয়ে তাকিয়ে রয়। দেখতে থাকে খুঁটিয়ে। লম্বা চওড়া পেটানো শরীরের পুরুষ আরহাম। চওড়া কাঁধ আর সুদর্শন মুখটা তোঁষা’কে যেন খুব করে টানে। বুকে লেপ্টে থাকা কুচকুচে কালো লোম গুচ্ছ ও যেন বাদ গেলো না। তারা ডাকছে তোঁষা’কে। বারবার বলছে, “দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পর এই বুকে তোঁষা। এই বুকটাতে নাক ডুবিয়ে শ্বাস টেনে নে। কম তো কষ্ট করিস নি”।
তোঁষা শুনে মনের কথা শুনলো৷ কেন শুনবে না? এতটা বছর অন্যর কথা শুনে কি লাভ হলো? ধোঁকা ছাড়া কি পেলো তোঁষা? কিছুই না।
আরহাম মাত্রই তাকালো তোঁষা’র দিকে ওমনিই তোঁষা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে আরহাম’কে। নাক, মুখ ডুবিয়ে দেয় বুকে। টেনে নেয় শ্বাস বুক ভরে।
আরহাম চোখ বুজে। ওর সার্বাঙ্গ যেন শিউরে উঠে প্রবলভাবে। জড়িয়ে নেয় তোঁষা’কে নিজের সাথে। তোঁষা ও চেষ্টা করে যতটুকু ধরা যায়। আরহামের ঠোঁটে হাসির ঝলক দেখা যায়। ওর চাওয়া গুলো পূরণ হচ্ছে একটু একটু করে। তুঁষ’টা ও তার হচ্ছে একটু একটু করে। আরহাম নিজের বাহু বন্ধনে আটকে থাকা রমণীর মুখটা তুলে। তোঁষা ধীমি স্বরে জানায়,

— আপনার শরীরের ঘ্রাণ এত মাতাল মতাল কেন আরহাম ভাই?

#চলবে…..

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৫

তোঁষা পুরো বাড়ীটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। আরহাম কিচেন থেকেই একবার গলা উঁচিয়ে বললো এদিক ওদিক না ছুটতে। তোঁষা বুঝি শুনে? নিজের মতো এদিক ওদিক দেখছে ও। বড় একটা ড্রয়িং রুম পুরোটা গোছালো। গতকাল আরহাম ওকে এখানে এনে বেডরুমে আটকে রেখেই কোথায় যেন চলে গিয়েছিলো। তোঁষা’র দেখা হয় নি কিছুই। ওদের বেড রুম ছাড়াও আরো রুম আছে। হঠাৎ তোঁষা চিৎকার করতেই হাতের কাজ ফেলে দৌড়ে বের হয় আরহাম। মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তোঁষা ব্যালকনিতে। আরহাম অস্থির হয়ে ওর হাত টেনে নিজের কাছে এনে প্রশ্ন করে,

— কি হয়েছে তুঁষ? চিৎকার করলি কেন?

তোঁষা’র বিষ্ময় যেন কাটছেই না। আরহাম ওর বাহু ঝাঁকাতেই তোঁষা মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করলো,

— আমরা কোথায়?

ঢোক গিললো আরহাম। কিছুতেই তোঁষা’কে বলা যাবে না ওরা কোথায় আছে এখন। তোঁষা পুণরায় জিজ্ঞেস করতেই আরহাম পাল্টা প্রশ্ন করে,

— কি হয়েছে? বল আমাকে।

— আমরা কত তলায় আছি?

— বাইশ।

তোঁষা যেন ধাক্কা খেলো একটা। বাইশ তলার উপরে কি না ওরা? বিস্ফোরিত চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— কার বাসা এটা?

— তোর।

— মানে?

— মানে আমার বউয়ের বাসা এটা।

তোঁষা চমকে তাকাতেই আরহাম ওর বোঁচা নাকটা টেনে বললো,

— আমার বুঁচি’র জন্য এটা। অনেক আগের কেনা।

— আমার তো হাইটে ফোবিয়া তাহলে এত উপরে কেন?

আরহাম একটু চুপ থেকে তোঁষা’র মুখটা দেখে নিলো যা বার্তমানে কৌতুহলে ভরপুর। কিঞ্চিৎ হেসে জানালো,

— তোকে আমার থেকে দূর করতে পুরো শেখ পরিবার লেগেছে প্রাণ। তাদের থেকে তোকে লুকাতেই এতকিছু।

তোঁষা’র প্রাণে জোয়ার বয়ে গেলো নিমিষেই। সেই জোয়ারের পানি মেটালো তার সকল জাগ্রত প্রশ্ন। আরহামের পানে তাকিয়ে চেষ্টা করলো নিজের চক্ষু তৃষ্ণা মেটানোর। এই সুন্দর আরহাম ভাইটা ওর অনেক প্রিয়।
পুড়ে যাওয়ার গন্ধ নাকে ঠেকতেই নিজের বোঁচা নাকটা কুঁচকে ফেলে তোঁষা। আরহাম তখন তাকিয়ে তোঁষা’র দিকে। গভীর দৃষ্টি ফেলে ভেবে যাচ্ছে অনেক কিছু।
তোঁষা নাক কুঁচকে আরহামের বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বললো,

— পুড়ে যাচ্ছে তো আপনার ফিশ!

আরহামের টনক নড়ে কিছুটা। ও ইটালিয়ান ফিশ ট্রাই করছিলো। এক হাতে এখনও স্পাচুলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরণে একটা চেইক ছাপার কিচেন এপ্রোণ। আরহাম ছুঁটে যেতে নিলেই তোঁষা ও পিছু নিলো তার। এতক্ষণ আরহাম তাকে যেতে দেয় নি। গ্যাস অফ করে আরহাম ফ্রাই প্যানটা নামিয়ে পাশে রাখতে রাখতে বললো,

— একটুর জন্য বেঁচে গেলো আমার ফিশ। বুঁচি’র বোঁচা নাক কাজে এসেছে।

কথাটা বলতে বলতে ওভেন থেকে ফ্রাইড রাইস বের করে আরহাম। সে খেয়াল করে নি তোঁষা’র মুখ ফুলানো। আরহাম প্লেট হাতে ঘুরতেই দেখা মিললো তার তুঁষে’র। মাথা নিচু করে কোণ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আরহাম হরবরালো৷ হকচকালো। প্লেট সাইডে রেখে তোঁষা’র হাত টেনে ধরে বলে উঠলো,

— কি হয়েছে? তুঁষ?

তোঁষা রা করে না। ছোট থেকেই ওর নাকটা নিয়ে সবাই রাগাতো ওকে। শেখ বাড়ীর একমাত্র তোঁষা’র নাকটাই বোঁচা বাকিদের কি সুন্দর খাঁড়া খাঁড়া নাক। সবচেয়ে সুন্দর নাক ওর আরহাম ভাই এর। আরহাম ভ্রু কুচকে কিছুসময় অবলোকন কর। ঠোঁটে ওর চাপা হাসি। ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে আটকে রেখেছে সে। তোঁষা’র মুখটা হাত দিয়ে তুলে বললো,

— অন্য কেউ বললে তার নাক ফাটিয়ে দিব কিন্তু আমি বলবই। আমার বুঁচি তুই। আমরণ থাকবি।

তোঁষা’র চোখের সামনে ভেসে উঠে বছর কয়েক আগের ঘটনা।

~এই তো ক্লাস সিক্সে পড়ে তখন তোঁষা। সারাদিন ছুটাছুটি ওর র*ক্তে মেশানো যেন। স্কুল থেকে বান্ধবী’র হাত ধরে গেট পর্যন্ত আসতেই দেখা মিলে তুহিনে’র। অন্যদের বাবা থেকে কিছুটা বয়স্ক তুহিন। হওয়াটাই স্বাভাবিক। মধ্যবয়সে দ্বিতীয় বার বাবা হয়েছে বলে কথা। তবে বুঝার কায়দা করা যায় না। বলা হয় “পুরুষ নব্বই তে ও জোয়ান কিন্তু নারী;সে কুড়িতেই বুড়ি”। বাবা’কে দেখেই তোঁষা ফড়িং এর উড়ে চলে আসে। মেয়ে’র কপালের ঘামে লেপ্টে থাকা চুলগুলো কানে গুজে ব্যাগটা নিজের কাঁধে তুলে এক হাতের মুঠোয় পুরে নেয় তোঁষা’র হাত। তোঁষা বুঝি থেমে থাকার মেয়ে? আদরের আহ্লাদী মেয়ে ফুডুং ফুডুং করে এটা ওটা বলেই যাচ্ছে। তুহিন কখনো বিরক্ত হন না বরং ভালো লাগে তার মেয়ের চঞ্চলতা। ঠিক যেন তার কিশোরী সেই স্ত্রী’র কার্বন কপি তোঁষা। বাবা’র হাত টেনে ধরে বায়না ধরে তোঁষা,

— আব্বু আব্বু আইসক্রিম খাব একটা।

তুহিন আবার মেয়ে পাগল বাপ। মেয়ে চাইবে সেটা না দিয়ে সে থাকবে তা কখনো হয়েছে? না কখনোই না। তবুও মুখটা অসহায় করে জানায়,

— পুতুল মা বকবে না বলো? গত সপ্তাহে ঠান্ডা ভালো হলো।

— তুহিন শেখে’র বউ’কে কে জানাবে আব্বু? আমার আব্বু তো জানাবে না এটা শিওর এর মানে কি তুমি জানাবে?

মেয়ে’র গোলগাল ছোট্ট মুখটার পানে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারে না তুহিন। এগিয়ে যায় আইসক্রিম ওয়ালার ভ্যানের দিকে। তোঁষা কোন ফ্লেভার খাবে জিজ্ঞেস করতেই ওর মুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। একে একে বলতে থাকলো,

— চকলেট, ম্যাংগো, ভ্যানিলা আর স্ট্রবেরি মিক্স করে কর্নেটো তে ভরে দিন। উপর দিয়ে চকলেট সিরাম দিবেন মামা। আর হু হু উমম, কয়েকটা চকো চিপ্স ছিটিয়ে দিয়েন।

বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসলো। তুহিন দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। এই মেয়ে সুযোগ পেলেই তার অসৎ ব্যবহার করবে। এই যে এখন আইসক্রিম খাবে তাতে তিন জনের টা একাই খেয়ে নিবে সে। বাহানার শেষ নেই। একস্ট্রা টাকা ছাড়া এভাবে কর্ণেটো ফিল ও করা হয় না। তোঁষা’র হাতে আইসক্রিম আসতেই ও খুঁটে খুঁটে আগে চকলেট খাওয়া শুরু করলো। বাবার মুখে দিতেও ভুলে নি।
তুহিনের কাঁধে তখনও তোঁষা’র ব্যাগ। পরিচিত একজনের সাথে দেখা হতেই তোঁষা’কে দাঁড় করিয়ে তিনি একটু সাইডে যান কথা বলতে।
কয় মিনিট হলো? এই তো দশ থেকে পনেরো মিনিট। এর বেশি তো না। তবে তুহিন ফিরতেই তার মনে হলো এখানে কয়েক ঘন্টা পর ফিরেছে সে। তার পুতুলের হাতের আধ খাওয়া আইসক্রিমটা রাস্তায় পড়ে গলে গিয়েছে কিছুটা। গাড়ির সাথে লেগে ফুঁপিয়ে কাঁদছে তোঁষা। না ভুল। তোঁষা মোটেও কাঁদছে না। সে রাগে ফুঁপাচ্ছে। রাগের চোটে তার ডাগর ডাগর আঁখিতে পানি জমেছে। কিন্তু তুহিনের এই ধারণা ও ভুল। তার মেয়ে কাঁদছে নিজের আইসক্রিমের জন্য আর রেগে আছে একটা ছেলের উপর। ছেলেটাকে চেনে তুহিন। তোঁষা থেকে দুই ক্লাস উপরে সে। বর্তামানে ছেলেটার অবস্থান আরহামের নিচে। তার কলার আরহামের হাতের মুঠোয়। তুহিন ছাড়াতে আসতে আসতে শক্ত করে দুটো চড় আরহাম ছেলেটার গালে দিয়ে দিলো। তুহিন দাঁড়িয়ে গেলেন। কি হবে এখন যেয়ে? তবুও পা ঠেলে গিয়ে আরহাম’কে ধমকে উঠে,

— আরহাম! আব্বু ছাড়ো ওকে। কি করছো? কত ছোট তোমার, ওর গায়ে হাত কেন তুলেছো?

— একদম ঠিক হয়েছে। বল এখন বল। এখন বলিস না ক্যান হ্যাঁ?

তুহিন তাকালো মেয়ের দিকে। ভীতুর ডিম তার মেয়ে আরহামের হয়ে কথা বলছে। সাহস অবশ্য সে আরহাম’কে দেখেই পায়। ছেলেটাকে তুলে তুহিন বুঝ দিতে দিতে আরহাম তোঁষা’র জন্য আরেকটা আইসক্রিম নিয়ে নেয়। মাথায় হাত রেখে শুধু বলে,

— আমার বুঁচি’কে একমাত্র আমিই বুঁচি ডাকব।

পরেই আবার বলে,

— এই সপ্তাহে আর মিষ্টি কিছু খাবি না। ডায়াবেটিসের পয়েন্ট বেড়ে যাবে।

তোঁষা জিহ্বা দিয়ে আগে আইসক্রিমটা চেটে নেয়। বলা যায় না এটাও যদি পড়ে যায়?

তুহিন পরে ঘটনা শুনে বাকরুদ্ধ। তোঁষা’কে ঐ ছেলে শুধু বলেছিলো, ” কি বুঁচি আইসক্রিম খাচ্ছো?”
ব্যাস তোঁষা রেগে আইসক্রিম ছুঁড়ে মা’রে ছেলেটার গায়ে। এত রাগ এই মেয়ের! তুহিন মাঝে মধ্যে ভয় পায়। কে সামাল দিবে এই রাগী পুতুল’কে। ঐ রাস্তা দিয়েই আরহাম ভার্সিটি যাচ্ছিলো। রাস্তায় এই ঘটনা দেখেই পরবর্তী ঘটনার সূচনা ঘটায় সে।
.
তোঁষা’র ভাবনায় ছেঁদ পড়ে আরহামের কথায়,

— খায়িয়ে দিব?

তোঁষা মাথা নাড়ায়। আরহাম রাইস সহ ভেজিটেবল নিলেই তোঁষা মুখ কুঁচকে বললো,

— সবজি ভালো লাগে না আরহাম ভাই। ফিশ দিন।

— চুপচাপ হা কর তুঁষ। শরীরের কি হাল তোর? শেখ বাড়ীর লোক কি ফকির হয়ে ছিলো যে সবজি কিনতে পারে নি?

তোঁষা বেজার মুখ করে লোকমাটা মুখে তুললো। আরহাম নিজেও খাচ্ছে। তোঁষা খেতে খেতে বললো,

— আপনি দেশে কবে ফিরেছেন?

আরহাম এক লোকমা ওর মুখে দিয়ে উত্তর করলো,

— একমাস।

তোঁষা চমকে তাকালো। অসহায় কন্ঠে শুধালো,

— আমাকে আগে কেন আপনার কাছে আনলেন না আরহাম ভাই? আপনি কি জানতেন না আপনার তুঁষে’র কষ্ট হচ্ছিলো।

আরহামের হাত থেমে গেল। সে জানতো কিন্তু করার কি ই বা ছিলো। তোঁষা’র মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

— তোকে তো বাসা থেকে বের হতে দিচ্ছিলো না প্রাণ। কিভাবে কি করতাম। গতকাল তুই পার্লারে যেতে বের হলি। সুযোগ পেলাম। তুলে নিয়ে আসলাম।

— আপনি জানতেন আমার বিয়ে….

— হু।

— কার সাথে..

— চুপ।

— জানেন?

— হু।

তোঁষা চুপ রইলো। আরহাম হাত ধুঁয়ে একটা মলম এনে তোঁষা’র ঘাড়ে লাগিয়ে, হাতের কনুইতেও লাগালো। তোঁষা’র দিকে তাকিয়ে বললো,

— পেটে লাগাতে পারবি?

সময় ব্যায় করে না তোঁষা। পরণের কুর্তি অল্প তুলে দেয়। আরহাম নিঃশব্দে আঁচড় আর কাটা জায়গাগুলোতে মলম লাগায়। দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। তোঁষা আরহামের হাতটা ধরে নিজের দুই হাত দিয়ে। নিজের গালে লাগিয়ে বলে,

— আমার সব ছেড়ে আপনার কাছে এসেছি। এই তুঁষ’টা ই আপনার। সংকোচ কোথা থেকে আসে হু?

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে