প্রিয় প্রাণ পর্ব-৩৮+৩৯

0
385

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৮

একই সাথে দুটো বড় বড় খবর এবার যেন আরহামে’র সত্তা পর্যন্ত নাড়িয়ে দিলো। তোঁষা’র দিকে তাকানোর মুখটা পর্যন্ত ওর নেই। শেখ বাড়ীতো রীতিমতো কান্নার রোল পরে গেলো। তোঁষাকে নিয়ে আরহাম সোজা ওর ফ্লাটে চলে এসেছে তখন। পিছুপিছু তুষার ও এলো। তবে তোঁষার সামনে যায় নি। রুমের থেকে প্রায় ঘন্টা খানিক পর বেরুলো আরহাম। তুষার ড্রয়িং রুমে মাথা নিচু করে বসে আছে। আরহাম এগিয়ে এসে ধপ করে তুষারের পাশে বসে পরলো। মাথা নিচু করে বললো,

— আমি আমার ওয়াদা রাখতে পারলাম না ভাই। তুঁষ’কে ঐ অবস্থায়….

তুষার সহসা থামিয়ে দিলো আরহাম’কে। নিজের হাতের রিপোর্টগুলো দিলো আরহামে’র হাতে। ভ্রু কুঁচকে তা হাতে নিলো আরহাম। পাতা গুলো উল্টে হঠাৎ চোখ আটকে গেলো “পজেটিফ” লিখা জায়গাটায়। শূন্য চোখে মাথা তুলে তাকালো তুষারের দিকে অতঃপর আবার সেই লিখাটার দিকে। তুষার আরহামে’র পিঠে হাত রাখতেই চমকে উঠলো ও। চোখে ওকে তুষার চাইলো ভরসা দিতে কিন্তু পারলো না। উঠে দৌড়ে রুমে চলে গেলো এদিকে আরেকটা রিপোর্ট পরে রইলো ফ্লোরে। এক ধ্যানে ঐ রিপোর্টটার দিকে তাকিয়ে রইলো তুষার। তোঁষাকে বাঁচানোর চেষ্টায় ব্যার্থ এক ভাই ঠাই বসে রইলো। নড়লো না। শক্তি পেলো না।

আরহাম তোঁষা’র উপর এক প্রাকার ঝাপিয়ে পরলো। সারা মুখে চুমু খেতে খেতে আবেগী গলায় ডাকলো,

— এই প্রাণ? আমার প্রাণের টুকরো। আমার তুঁষ। জানিস কি হলো? আমি আবার বাবা হব। উঠ। আর কত ঘুমাবি? এই তুঁষ? উঠ না।

ঢুলুমুলু তোঁষা নড়েচড়ে শুয়ে পরলো আবার। আরহাম ওর পেটটা উন্মুক্ত করে নজর দিলো সেখানে। উঁচু হওয়া একটা থলথলে পেট। তুঁষটা অনেকটাই গুলুমুলু হয়েছে আগের থেকে। আগে যতটা ছিলো তার থেকেও অনেকটা বেশি মোটা হয়েছে। তাই বোধহয় বুঝা যায় নি। আরহাম নাক, মুখ ডুবিয়ে দিলো তলপেটে। একে একে দিতে শুরু করলো ওর ভালোবাসা। বুনে ফেললো এক ঝুড়ি স্বপ্ন। ভুলে গেলো বাস্তবতা।
আদৌ তার বুনন কতটা ভুল। তার তুঁষ কি স্বাভাবিক যে স্বপ্নগুলো স্বাভাবিক হবে?
.
আরহামে’র সেই স্বপ্ন স্বপ্ন ই রয়ে গেলো বোঁধহয়। ডক্টর সোজা বলে দিলো তোঁষার বর্তমান শরীর বেবি ক্যারী করার ক্ষমতা রাখে না। এটা আরহাম জানে। তাই তো পাগল হয়ে ছুটে এসেছে তোঁষাকে নিয়ে। নিজের সবটুকু বিসর্জন দিয়ে আরহাম বলে উঠলো,

— এবোর্শন। এবোর্শন করব আমরা। ও..ওকে আজই এবোর্শন করুন। আমার শুধু তুঁষ’কে চাই আর কিছু না।

ডক্টর আদিত্য’র মায়া হলো খুব। আরহামের আগাগোড়া তার জানা। কোন এক সময় কাছের বন্ধু ছিলো তারা। আজ আরহামকে দেখলেই তার দীর্ঘশ্বাস বেরুয়। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আরহামে’র পাশে বসলো ডক্টর আদিত্য। ওর হাতে হাত রেখে বললো,

— এবোর্শন সম্ভব না আরহাম। তুই নিজেও ডক্টর। বুঝিস এসব। চার মাসের বেবিটাকে কিভাবে মা’রব? আর তোঁষার বডি এখন এসব নিতে পারবে না। এটা সম্ভব না।

আরহাম অসহায় চোখে তাকালো। তুষারের দিকে তাকিয়ে শুধু বললো,

— ভাই আমার পাপ কি এতই বেশি? এর প্রায়শ্চিত্ত আমি আর কতদিন করব?

তুষার কথা বললো না। ডক্টর আদিত্য আরহামে’র কাঁধে হাত দিয়ে বললো,

— ওর চিকিৎসা চালিয়ে যা। দেখ কি হয় সামনে। সবটা ছেড়ে দে উপর ওয়ালার কাছে। আমি দোয়া করি আরহাম। তুই সুখী হ।

আরহাম কথা বললো না। মানুষের মন ম’রে গেলে যেমন হয় আরহাম’কে তেমনই দেখালো। ছেলেটা আস্তে ধীরে হেটে তোঁষার কেবিনে চলে গেল। ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে তোঁষার মাথার কাছে গিয়ে বসলো।
ইলেকট্রিক শক দেয়ার ফলে কিছুটা প্রভাব পরেছে বেবির উপর। আরহামে’র নিজেকে অসহায় লাগলো। বড্ড অসহায়। আজ তার মনে হচ্ছে সে ম’রে যাক শুধু তার তুঁষ আর ছোট্ট প্রাণটা সুখে থাকুক।

____________________

রজনীর পর রজনী একা কাটিয়ে তথ্য এখন একাকীত্ব’কে ভয় পায় না৷ ঢাকা এসেছে আজ দুই দিন। ছুটিতে আসার কোন ইচ্ছেই ছিলো না। বাবা’র জোরাজোরিতে বাধ্য হলো আসতে। খেতে বসেছে এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠলো। তথ্য’র মা উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই কেউ একজন ওনাকে সালাম দিলো। তথ্য’র হৃদপিণ্ড থেমে গেলো মুহুর্তের জন্য। কার কণ্ঠ শুনলো এটা? ভাবলো একবার হয়তো এটা ওর ভ্রম কিন্তু না। ভ্রম না এটা। ওর মা তুষারের হাতটা ধরে তুষারকে খাবারের টেবিলে বসিয়ে দিলো। তুষার ওর বাবা’কেও সালাম দিলো। তিনজন এতটাই হেসেখেলে কথা বলছে যেন তারা অতি পরিচিত। তথ্য সবে খেয়লা করলো টেবিলে জামাই আদরের খাবার সাজানো। ঢোক গিললো তথ্য। তুষারের চেহারাটা এমন কেন? এমন ভাঙা চাপা ওর তুষারের না। এই বিষন্ন মুখ ওর তুষারের না। একটা শক্তপোক্ত মানুষের হঠাৎ এহেন দশা কেন?
আজ কতটা মাস পর দেখছে তুষারকে? তুষার ওর দিকে তাকালো না। তথ্য’র মা ওকেও খেতে তাগাদা দিলো। খেয়ে দেয়ে তথ্য নিজের রুমে চলে আসলো। তুষার শশুর শাশুড়ী’কে সময় দিচ্ছে।

রাত একটা নাগাদ তুষার তথ্য’র রুমে ঢুকলো। না অনুমতি, না নক। সোজা ঢুকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তথ্য’কে জড়িয়ে ধরলো নিজের সাথে। কেঁপে উঠলো তথ্য। আজ কত মাস পর ছোঁয়াটা পেলো? আপন পুরুষটার আরো তীব্রকর ছোঁয়া পেতে চাইলো তথ্য। ঘুরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জানান দিলো নিজের আবদার।
তুষার এতমাস পর অন্তত তথ্য’র মন ভাঙতে চাইলো না। মেনে নিলো সবটুকু আবদার। দিয়ে দিলো নিজের দেহ, মনে জমিয়ে রাখা সবটুকু ভালোবাসা। সুখের সাগরে ভাসলো দুটি দেহ৷ একটি প্রাণ। দীর্ঘ থেকেও দীর্ঘ রজনী পার হলো। প্রেমময়। ভালোবাসাময় এক রজনী।
তথ্য’র জীবনের অপেক্ষা শেষ হলো। শেষ রাতে তথ্য মাথা রাখলো তুষারের উন্মুক্ত বুকে। বিরবির করে বললো,

— অপেক্ষা যদি এত সুখ বয়ে নিয়ে আসে তাহলে আমি রাজি অপেক্ষা করতে। আজ সকল অপেক্ষা সার্থক তুষার। সব সার্থক।

তুষার তথ্য’র কপালে চুমু খেলো। চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

— বেকার জামাই’কে পেয়ে নিজেকে স্বার্থক বলছো?

তথ্য আলতো কিল মা’রলো তুষারের বাহুতে।

— ভুলেও আমার জামাই’কে বেকার বলবেন না।

— অফিশিয়ালি ছেড়ে দিয়েছি।

— আমিও দিব।

— মে’রে ফেলব বোকামি করলে।

— আমি সংসার করতে চাই তুষার। আপনার ছানাপোনার মা হতে চাই। হোক না ছোট্ট একটা সংসার। শুধু সুখ থাকলেই হলো। আপনি ছোট্ট একটা কাজ করবেন আর আমি কোমড়ে শাড়ী গুজে সংসার করব।

— তোমার মতো স্বাধীনচেতা মেয়ের মুখে এসব মানায়?

— এতসব জানি না আমি। প্লিজ তুষার। আমি আপনার কাছে আর কিছুই চাইলাম না শুধু এতটুকু চাই। দিবেন না?

তুষার শব্দ করে তথ্য’ট ঠোঁটে চুমু খেলো। জানান দিলো তার সম্মতি। একে একে জানালো এতমাসের ঘটনা। তথ্য দেখা করতে চাইলো তোঁষার সাথে। তুষার ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,

— নিব। নিব ওর কাছে।

#চলবে…

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৯

আকাশ জুড়ে হেসে খেলে উড়ে যাচ্ছে এক গুচ্ছ মেঘ। ধূসর নয় বরং সাদা ঘন ফুলা ফুলা মেঘরাশি দৌড়ে বেড়াচ্ছে আকাশময়। রোদের ঝলকে মানুষ কমই বের হচ্ছে। এই তীব্রতা সহ্য করার মতো নয়। আরহামে’র রুমে’র বারান্দায় প্রচুর রোদ আসার কথা থাকলেও ততটা আসছে না। মূলত আসার সুযোগ পাচ্ছে না। তোঁষা যেদিন বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়তে চেয়েছিলো তার কিছুদিন পরই নেট দিয়ে ঘেরাও করে দিয়েছিলো আরহাম। সারা বারান্দাময় এখন সবুজের ছড়াছড়ি। তোঁষা কখনোই গাছপালার সখ করে না। তাই তার পছন্দ অপছন্দ বলে কিছু নেই। আরহাম নিজের ইচ্ছে মতো অসংখ্য ছোট ছোট চারা লাগিয়েছে এখানে। সুন্দর সুন্দর গ্রীষ্মকালীন ফুল ফুটেছে এখানে। দুপুর হতেই তারা নেতিয়ে যায়। আবার সন্ধ্যা হতেই গোলাপি রঙের সকাল সন্ধ্যা ফুলগুলো ঘ্রাণে বারান্দা মাতিয়ে রাখে। দরজা খোলা থাকলে সেই ঘ্রাণ রুমে ও পাওয়া যায়। তোঁষার আবার এটা পছন্দ অথচ এই গাছ আরহাম কিনে আনে নি। কোন চারার সাথে হয়তো এসেছে। বলে না আসল থেকে মানুষ সুদ বেশি ভালোবাসে এখানেও তেমনটাই। তোঁষার ভালোলাগে এই সন্ধ্যা মালতি ফুল। নাক ডুবিয়ে সে ঘ্রাণ শুকে সে।

সন্ধ্যা নামবে নামবে বলে। এখনও আকাশে লালিমার দেখা মিললো না। বিকেলের দিকে রোদটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাওয়া ধরে। তোঁষা’র কথা রাখতে আরহাম বারান্দায় নিয়ে এসে ফ্লোরে করা আর্টিফিশিয়াল ঘাসের উপর অতি সাবধানে বসিয়ে দিলো ওকে। পিছনে দুইটা কুশন দিয়ে বললো,

— ঠিক আছে?

— হু।

তোঁষা হু বললেও আরহাম পুণরায় চেক করলো। নিজে আবার একটা কুশন তোঁষার পিঠে দিয়ে একটা দিলো ওর মেলে রাখা পায়ের নিচে। তোঁষা মিষ্টি করে হাসলো। ওর এই গোল মুখটাতে চাঁদমুখো হাসির ফালি ঝরাঝরা সুখের ছিটে দিলো আরহামে’র বক্ষপিঞ্জরে। ঠিক যেন তপতপে দুপুরে এক ফালি ভেজা মেঘের বর্ষণ। লোভাতুর আরহাম লোভ সামলাতে ব্যার্থ। এগিয়ে এসে তোঁষা’র গালে চুমু খেলো সময় নিয়ে। গাল গাল লাগিয়ে ঘষা দিতেই তোঁষা “উফ” শব্দ করলো। আরহাম সরে এসে হাত রাখলো তোঁষার সাতমাসের পেটে। আদুরে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

— ব্যাথা লাগছে এখানে?

— উহু। গালে।

বলেই নিজের গালে হাত ঘষলো তোঁষা। আরহাম বোকা বোকা চোখে তাকালো ওর তুঁষে’র দিকে। নিজের অল্প বড় হওয়া দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললো,

— দাড়ি বড় রাখব ভাবলাম৷ আর কাটব না। সুন্দর লাগবে না? কি বলিস প্রাণ?

— তুমি তো সুন্দর ই।

আরহাম হাসলো। তোঁষার কাছে ঝুঁকে আবারও শুনতে চাইলো সে আসলেই সুন্দর কি না। তোঁষা আরহামে’র গালে হাত রেখে বললো,

— এই যে তুমি সুন্দর। অনেক সুন্দর। আমার প্রাণ, অনেক সুন্দর তুমি।

আরহামে’র ভালো লাগে ওর প্রাণের করা প্রশংসা। আরহাম নিজেও জানে সে এখন পূর্বের ন্যায় সুন্দর নয়। পেটানো শরীরটা আগের মতো নেই। চোখদুটো গর্তে ঢুকে কেমন কালো দেখায়। নির্ঘুম রাত্রী তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় কিন্তু আফসোস নেই এ নিয়ে। তোঁষাটার চোখে সুন্দর থাকলেই তো হলো।
আরহাম উঠতে উঠতে বললো,

— একটুও নড়বি না। আমি আসছি এখনই।

তোঁষা মাথা নাড়লো। আরহাম এলো মিনিট পাঁচ পর। তোঁষাকে এখন খাওয়াতে হবে। এই সময় ক্ষুধা লাগে ওর। আরহাম এসে খাবার রেখে তোঁষার দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল। দ্রততার সাথে ওর গালে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— ক…কি হয়েছে? তুঁষ তাকা। বল কি হলো? কেন কাঁদিস? বাবু কিক করেছে? কথা বল। প্রাণ।

তোঁষা চোখের ইশারায় নিজের পা দেখালো। বুড়ো আঙুলে একটা বড় জাতের পিঁপড়ে। কামড়ে ধরে র’ক্ত বের করে ফেলেছে। মূলত এটা পিঁপড়া না। ভিন্ন জাতের কিছু৷ নিশ্চিত কোন গাছে ছিলো। আরহাম হাত দিয়ে ফেলে চেপে ধরে সে আঙুল। ব্যাথায় মুখ কুঁচকে রইলো তোঁষা। পানি দিলেও জ্বলা কমলো না। উঠে গিয়ে তারাতাড়ি একটু পেয়াজ কেটে সেখানে ডললো আরহাম। মুখে দুই একবার “জ্বলে জ্বলে” বলে চুপসে গেলো তোঁষা। আরহাম শান্ত হলো। তোঁষার ভেজা গাল মুছে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো,

— পায়ে ছিলো ফেলিস নি কেন?

— তুমি না বললে, নড়বি না এখান থেকে?

কথাটা বলে নাক টানে তোঁষা। আরহাম কিছু বললো না। তোঁষা’র রিকোভারি হচ্ছে। বলা যায় অনেক দ্রুত ই হচ্ছে কিন্তু এখনও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারে নি। সবটা বুঝে উঠতে এখনও সময় লাগে মেয়েটার। মাঝেমধ্যে ঠিক আগের মতো জেদ ধরে। সব কথা মনে রাখতে না পারলেও কিছু কিছু বিষয়ে যখন জেদ ধরে, রেগে যায় তখন বুকে প্রশান্তি পায় আরহাম। ওর মা বাদে সবার সাথে ই টুকটাক কথা বলে। শুধু রাগী দৃষ্টিতে দেখে মা’কে যেন কোন একটা চাপা রাগ কাজ করছে ওর মাঝে। হাজার কাঁদে ওর মা তোঁষা মানে না৷ জানা নেই কারো এর কারণ।
শেখ বাড়ীতে নিতে চাইলে আরহাম মানা করে নি কিন্তু তোঁষা এখান ছাড়া রাতে থাকে না। কেঁদে অস্থির হয়ে উঠে ঠিক যেমন বিয়ের আগে সাফোকেশন হতো তা এখনও হয় কিন্তু জায়গা ভেদে।
এতে অবশ্য সবাই খুশি। প্রেগ্ন্যাসির কারণে জটিলতা যতটা হওয়ার কথা ততটা হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে বাবুর কিক খেয়ে তোঁষা ভ্যাঁ ভ্যাঁ কাঁদলেও পরে ভুলে যায়। আরহাম তাকে সাহায্য করছে। আমৃত্যু করবে।

তোঁষার মুখে শেষ খাবারটুকু দিয়ে আরহাম উঠতে নিলে তোঁষা ওর হাত টেনে ধরে বললো,

— তুমি খাবে না?

— দুপুরে খেলাম না?

— তাহলে আমি কেন খেলাম?

— তোর ভেতরে যে বাবু?

— আমার ভেতরে?

— হু।

— কিভাবে গেলো?

আরহাম এই দফায় ফিক করে হেসে ফেললো। ওর হাসিতে তোঁষা ও হাসলো তবে কারণ ছাড়া। তার হাসতে কারণ লাগে না। আরহাম নামক প্রাণটা হাসলেই তোঁষা হাসতে পারে।

_______________

তথ্য’র চাওয়া সেই ছোট্ট সুখের সংসারটা গুছাতে বড্ড ব্যাস্ত ও। রিজাইন নিয়ে এই পর্যন্ত কয় দফা যে ঝগরা হলো হিসেব নেই। তুষার কিছুতেই রাজি নয় আর এদিকে তথ্য রাজি না কাজ করতে। যদি তুষারও থাকতো তাহলে নাহয় তথ্য কোয়াটারে থাকতো। সংসার করত। কিন্তু এখন এই মেয়ে কিছুর বিনিময়ে ই রাজি না। ওর এই নাদানিপনাতেে ওর মা-বাবা ওকে ফুল সাপোর্ট দিচ্ছে এটা দেখে রীতিমতো অবাক তুষার।
তথ্য’র বাবা নিজেও অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। ওর মা গৃহিণী হলেও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। এদের মুখে মানায় এসব?
তাদের একই কথা, একটামাত্র মেয়ে। নিজের সখ পূরণ করেছে এখন তার যদি স্বাদ হয় সংসার করার তারা বাঁধা দিবেন না৷
তথ্য’কে বুঝাতে বুঝাতে অনেকটা সময় গেলেও যখন তথ্য মানলো না তখন তুষার তীক্ষ্ণ গলায় বলেছিলো,

— এই রংচং তোমার কতদিন থাকে আমি দেখব তথ্য। যখন আমার সংসারে তোমার অবহেলা দেখব তখন দেখাব এই তুষার কি করতে পারে। সারাজীবন পরে আছে সংসার করার জন্য। এখন ক্যারিয়ার এ ফোকাস করো। আমার কাছাকাছি ই থাকতে হবে এমন তো কোন কথা নেই। দূরে থেকে কি বিগত এক বছরে ভালোবাসা কমে গিয়েছিলো? যায় নি তো। তাহলে? এখন এসব কেন? চুপচাপ কথা শুনো নয়তো বউ ধরে পিটানোর অভিযোগ শুনবে আমার নামে দুইদিন পর। চাকরি যাওয়ার টেনশন নেই সেটা এমনিতেও নেই।

তথ্য এই দফায় এগিয়ে এসে তুষারের বুকে নিজের দুই হাত রাখলো। একটু ঝুঁকে মাথাটা ও সেখানেই রাখলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে তুষারও জড়িয়ে ধরলো ওকে। তথ্য তুষারের পিঠটাতে হাত বুলাতে বুলাতে মনের কথা জানান দিলো,

— আপনি বললেন সারাজীবন পরে আছে সংসার করার জন্য। আমি তো দেখি না তুষার। কোথায় সময়? সময় কি হাতের মুঠোয় আটকানো যায়? যায় না তো। এই দেখুন আপনার বয়স। আমার বয়স। এই বয়সে আমার দুটো করে বাচ্চা স্কুলে থাকার কথা আর আপনার বাচ্চাকাচ্চা কলেজে থাকার কথা। নাকি ভুল বললাম? পুতুলের কত বছরের বড় আপনি জানি না আমি?
আমাকে কেন বাধ্য করছেন কাজের জন্য? বললাম না কিচ্ছু চাই না। শুধু আপনাকে চাই। মলিন শাড়ীতেও আমি সুখ খুঁজে নিব তুষার। সুযোগ দিয়েই দেখুন। তথ্য নিরাশ করবে না।

তথ্য’র কথাতে দীর্ঘ শ্বাস ফেলা ছাড়া কিছুই করার ছিলো না তুষারের। মেনে নিয়েছিলো সবটা। কিন্তু তথ্য বিশ্বাস করতে পারে নি তুষারকে। এই লোকের কোন ঠিকঠিকানা নেই। রিজাইন লেটার পাঠিয়েছে আজ চারমাস। এরমধ্যে ও বারকয়েক তথ্য’কে যেতে হয়েছে। ভ্যালিড রিজন দেখাতে হয়েছে। এখানে সবচাইতে বড় চাল তো তথ্য চেলেছে তুষারের বিরুদ্ধে।

— তথ্য!!

হঠাৎ তুষারের ডাকে অল্প কেঁপে উঠলো তথ্য। শাশুড়ী’র কাছে বসে ছিলো এতক্ষণ। তোঁষার চিন্তায় চিন্তায় খাওয়া নাওয়া ছেড়েছেন উনি। শাসন ভালো। অবশ্য ই ভালো কিন্তু অতিরিক্ত শাসন একজন সন্তানকে তার মা-বাবা ঠিক কতটা দূর করতে পারে তা তোঁষাকে না দেখলে বুঝা যায় না। তথ্য উঠলো না। ঠাই বসে রইলো। তুষার ডাকলো আরো দুই বার। ওর মা তথ্য’র মাথায় হাত দিয়ে বললেন,

— আম্মু তুষার ডাকছে। যাও।

— পরে যাই?

— আমি ঠিক আছি আম্মু। যাও। হয়তো কিছু লাগবে।

আড়ষ্টতার সাথে উঠে পা টিপেটিপে রুমের দিকে হাটা দিলো তথ্য। তুষার গরম চোখ করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। হাতে তার পিলের পাতা। ঢোক গিললো তথ্য। তুষার কোনমতেই এখন বাচ্চাকাচ্চা চাইছে না। তথ্য’কে বলেছিলো সাবধান থাকতে। তারা প্ল্যান করবে কিন্তু ঐ যে তথ্য বিশ্বাস করে উঠতে পারে নি তুষারকে। না জানি কখন তথ্য’কে ফেলে চলে যায়। যেই লোক এক রাতের বউ রেখে চলে যায় তাকে কতটা বিশ্বাস করবে তথ্য?

ধাম করে দরজাটা লাগতেই তথ্য কেঁপে উঠলো। তুষার পিলের পাতা ওর চোখের সামনে তুলে গম্ভীর কণ্ঠে কিছুটা ঝাড়ি দিয়ে বললো,

— পাতা খালি না কেন?

— এটা তো নতুন পাতা।

— এক থাপ্পড়ে মুখ ভেঙে ফেলব তথ্য। ইয়ার্কি করা হচ্ছে? বেয়াদব মেয়ে! কথা শুনো না তুমি?? বেশি বার বেড়েছে তোমার। আমাকে শিখাও তুমি! নতুন পাতা এটা? গতমাসে তিনপাতা এনেছি। কোথায় একপাতা ও তো শেষ হয় নি। ছুঁয়েও দেখোনি।

তথ্য তড়িৎ বেগে মাথা তুললো। ও তো লুকিয়ে রেখেছিলো। তুষার ওর চাহনি দেখে আরো তেঁতেঁ উঠে বললো,

— ড্রয়ারে পিল ফেলে রাখতে তুমি। কি ভেবেছো আমি টের পাব না। আজ ড্রয়ার না হাতালে তো আমি জানতাম ই না৷ চোখের সামনে থেকে যাও তথ্য। জাস্ট গেইট আউট।

বলেই মাথা চেপে খাটে উবুড় হয়ে শুয়ে পরলো তুষার। প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে ওর। তথ্য দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বিছানায় উঠে তুষারের চুলে হাত রাখলো। সময় নিয়ে টেনেটুনে দিলো। অতঃপর আরো টেনে নিজের কাছে নিয়ে কপাল চেপে দিলো। এই লোক ভালো হলো না। হবেও না। এখন তথ্য’র পেটের কাছে টিটিংটিটিং করছে। তথ্য’র হাসি পেলেও এই মুহুর্তে হাসা বারণ। তার বর মহাশয় কিছু পরখ করছে। করুক। দেখুক কি পায়। তুষার জহুরি চোখে পেট দেখেদুখে বলদের মতো প্রশ্ন করলো,

— বাবু কি আছে?

— কি জানি।

হাসি চেপে উত্তর দিলো তথ্য।

— বুঝো না?

— আপনি বুঝেন না?

— আমার পেটে যে বুঝব?

— তো আমার একার ঠ্যাকা যে বুঝব?

— মানে?

— বাবু তো দু’জনের হবে তাই না? তাহলে আপনার ও তো ফিল হওয়ার কথা।

— মে’রে তক্তা বানাবো তোমাকে। দিনদিন ইতর হচ্ছো। টেস্ট করেছিলে?

— বেকার বরে’র টাকাপয়সা থাকলেই না টেস্ট করব।

— খোঁটা দিচ্ছো।

— দিলাম। তাতে কি?

— সত্যি বলো না।

— বললাম না৷ বেকার পর কিট এনে দিলেই টেস্ট করব।

তুষার প্রায় ঝড়ের বেগে উঠে গায়ে টিশার্ট জড়িয়ে বেরিয়ে গেলো। হাতে তিনতিনটা কিট নিয়ে ফিরলো সে। তথ্য জিজ্ঞেস করতেই ও বললো,

— একদম শিওর হতে হবে। তিন কম্পানির তিনটা।

তথ্য তিনটাই হাতে নিলো। ওয়াশরুম ঢুকে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। পাঁচ মিনিটে সাতবার ডাক পরলো তুষারের। মুচকি হেসে বেরুলো তথ্য। তিনটা কিটই দিলো তুষারের হাতে।
তুষার কিট হাতে ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে ই রইলো। তথ্য মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরলো ওকে। হাসতে হাসতে ই বললো,

— নতুন প্রাণের খবর শুনে তথ্য’র প্রাণ পাগল হয়ে গেলো।

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে