প্রিয় প্রাণ পর্ব-৩২+৩৩

0
133

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩২

বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে আছে আরহাম। এই তো গত একমাস ধরে তার শরীর খারাপ করছে। মাত্রারিক্ত দূর্বল মনে হয় নিজেকে। এক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে রইলো ও। মেঘলা আকাশটার নিচে তার নিজের জীবনটাকে বড্ড অগোছালো মনে হলো। পরক্ষণেই মনে হয় না। এই অগোছালো জীবন যেটাতে তার তুঁষ আছে সেটাই সুন্দর। একটু হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে প্রোটিন শেইকটা হাতে তুলে ছিপি খুলে গটগট করে কয়েক ঢোক গিললো। ইদানীং শরীরচর্চা করা হচ্ছে না। নিজের যত্ন নিতে ইচ্ছে হয় না। তোঁষাটা কেমন কেমন করে। সারাক্ষণ লেগে লেগে থাকে। এই যে এখনও আরহামে’র বুকে শুয়ে আছে। আজ কিছুতেই ও বিছানায় শুবে না। বিছানা নাকি শক্ত। তাই আরহামে’র বুকে চরে শুয়ে আছে। আরহামের যদিও বুকে এখন ব্যাথা হচ্ছে তবুও সে তোঁষা’কে সরাবে না। থাকুক তার প্রাণ তার বুকে। এই বুক থেকে সরলেই উল্টো আরহামে’র কষ্ট হয়। সেদিনের কথা ভাবতেই আজ ও ওর বুক কেঁপে উঠে ভয়াবহ ভাবে।

ঐ দিন তোঁষা যখন পাগলামি শুরু করলো তখন লাফ দেয়ার আগেই জ্ঞান হারালো তোঁষা। উঁচু জায়গাটা থেকে পরলো কার্ণিশের কোণায়। আরহাম দৌড়ে গিয়ে তোঁষা’কে বুকে জড়িয়ে ধরে। একটুর জন্য। শুধু মাত্র একটুর জন্য তোঁষা বেঁচে গিয়েছিলো। তবে মাথায় আঘাত লেগেছিলো একটু বেশি। ড্রেসিং করে ব্লিডিং থামালেও তোঁষা’র আচরণে ভিন্ন পরিবর্তন লক্ষ করা গিয়েছিলো সেই সপ্তাহ থেকে। আরহাম বাদে কাউকেই চায় নি তোঁষা। তুহিনের নাম ও মুখে তুলে না।

ও কি চাচ্ছে আরহাম ঠাহর করতে পারছে না। সারাক্ষণ তার আরহামকেই লাগবে। ওকে ঘুম পারিয়ে বাসা থেকে যেতে হয়। ভয় তো আরহাম সেদিন পেলো যেদিন সিসি ক্যামেরায় দেখলো ঘুম থেকে উঠেই বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে তোঁষা কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে তার মুখে শুধু একটাই ডাক “প্রাণ”। তার প্রাণ’কে ডাকতে ডাকতে সে কেঁদে অস্থির। সব ফেলে ঘন্টায় মধ্যে ছুটে এলো আরহাম। রুমের লক খুলে তোঁষা’কে বুকে জড়িয়ে যখন মাথায় হাত বুলালো তার কত পর গিয়ে থামলো ওর তুঁষ। শাস্তি সরুপ সে ক্ষত বিক্ষত করে দিলো আরহামে’র বুকে।
ধারালো দাঁতে তোঁষা ইদানীং খুবই বাজে ব্যবহার করছে। আরহামে’র বুকে এখন প্রায়সময় ব্যাথা হচ্ছে। সেদিন কামড়ে যে ধরলো ছাড়তেই চাইলো না। ব্যাথার চোট সামলাতে না পেরে চোখ দিয়ে পানি পরে যখন তোঁষা’র মুখে পরলো তখন গিয়ে ছাড়লো পাঁজিটা। কাচুমাচু মুখে হাসি ফুটিয়ে কি সুন্দর করে বললো,

— চুমু দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।

অথচ আরহামে’র অবস্থা বেগতিক হয়ে গিয়েছিলো। বুকে হাজার বরফ ঘঁষেও কাজ হলো না। সেদিন রাতে যখন তোঁষা বুকে ঘুমাতে চাইলো তখন আরহাম ব্যাথায় মুখ খিঁচে যে চোখের পানি ছাড়লো তা কি তোঁষা দেখেছিলো? দেখলে ও কি তোঁষা’র অনুভূতি প্রবণতা জাগ্রত ছিলো? সে কি বুঝে তার প্রাণের কষ্ট?

তোঁষা নড়চড় করতেই আরহাম ধীরে ধীরে তোঁষা’কে বুকে আরেকটু চেপে ধরে কোলে তুললো। এভাবে কতক্ষণ থাকবে? ওকে নিয়ে বিছানায় শুলেও শান্তি মিললো না। তোঁষা আরহাম’কে আঁকড়ে ধরে বুকে মাথা রেখে ঘুমালো। ব্যাথা লাগলেও আরহাম সরালো না বরং কপালে গাঢ় চুমু খেলো।

____________________

তুষারের সাথে বরাবর বসা আরহাম। বড় ভাই’কে সে যথেষ্ট সমীহ করে তাই তো মাথাটা নীচু করে রাখা আরহামে’র। তুষার আরহামে’র হাতের উপর এক হাত রাখতেই চমকে তাকালো আরহাম। ওর চমকানিতে মৃদু হাসলো তুষার। সেই ভঙ্গি বজায় রেখেই প্রশ্ন করলো,

— তোর মন কি বলে আরু? কাজটা ঠিক করেছিস?

“আরু” এই ডাকটা আজ বহু বছর পর ডাকলো তুষার ওকে। বয়সে তুষার থেকে অনেকটাই ছোট ও। ছোট বেলায় এই তুষার নামক বড় ভাইটার পিঠে চড়ে অনেক ঘুরা হয়েছে। ভালোবেসে ওকে আরু ডাকতো তুষার পরে কি যেন একটা হলো। আরহাম ধীরে ধীরে একদম গুটিয়ে যেতে থাকলো।
এই মুহুর্তে মন চাইলো তুষারের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরে রাখতে। মন খুলে দুটো কথা বলতে। একটু কাঁদতে। অভিযোগ জানাতে। কিন্তু কোনটাই সম্ভব হলো না। ঐ যে দূরত্ব। সেটা আজ আরহাম’কে দূর করে রাখলো। গাঢ় কণ্ঠে তুষার আবার জিজ্ঞেস করলো,

— বল?

— না।

— স্বীকার করছিস কাজটা ঠিক হয় নি?

— উপায় ছিলো না ভাই।

— আমি বিয়েটা হতে দিতাম তোর মনে হয়?

— কিছু ঘন্টা আগে আমি তুঁষ’কে তুলে নিয়েছিলাম। একটু দেড়ী হলে বিয়েটা দিয়ে দিতে তোমরা। তখন?

— হতে দিতাম না আমি।

— বাঁধা দিতে তো শুনলাম না।

দীর্ঘ শ্বাস ফেললো তুষার। কাকে কি বুঝাবে? তবুও আরহামে’র দিকে তাকিয়ে বললো,

— পুতুল’কে কি করেছিস বল তো সত্যি করে।

— কি করেছি?

— ও এমন কেন ছিলো ঐদিন আরু? সত্যি টা বল।

আরহাম মাথাটা সহসা নীচু করে নিলো। তুষার উত্তরের অপেক্ষায়। খুবই নিচু গলায় আরহাম বললো,

— যারা আমাকে আমার প্রাণ থেকে দূর করতে চেয়েছিলো তাদের ভুলাতে চেয়েছি।

— কিহ!!

সহসা ধমকে উঠলো তুষার। আরহাম মাথা তুললো না। উঠে এসে কাঁধ চেপে ধরলো আরহামে’র। আরহাম মাথা তুলতেই তুষার ধমকে উঠলো,

— কি বললি? কি করেছিস? আরহাম!! কথা বল!

— মেমরি লস করার ট্রিটমেন্ট করেছিলাম কিন্তু পুরো সেশন শেষ করতে পারি নি তার আগেই তুঁষের আচরণ অন্য রকম হয়ে যাচ্ছিলো। সাইড ইফেক্ট কি না বুঝতে পারছি না….

বাকিটা বলার আগেই সজোরে চড় মা’রলো তুষার।আরহাম প্রতিক্রিয়া দেখালো না যেন এটার ই অপেক্ষায় ছিলো। তুষার পরপর এবার দুটো ঘুষি মা’রলো আরহামের গালে। চেয়ার থেকে ছিটকে ফ্লোরে পরলো আরহাম। ওর কলার ধরে টেনে তুলে তুষার নিজের শক্ত হাতের আঘাত করলো আরহাম’কে।
তুষার আঘাত দিতে দিতে হঠাৎ থেমে গেলো যখন আরহাম শব্দ করে কেঁদে উঠলো। হতভম্ব হয়ে গেল তুষার। এভাবে কবে কেঁদেছে আরহাম? আদৌ কখনো কেঁদেছে এভাবে? আরহামে’র ঠোঁটের কোণটা কেটে র*ক্ত গড়িয়ে চিবুক ছুঁয়ে গেলো। সেই মুখে এই সুপুরুষটার কান্না বড্ড বেমানান। কোন পুরুষ মানুষ এই আঘাতে এভাবে কাঁদে? অন্তত আরহামের এই প্রতিক্রিয়া ভাবে নি তুষার।
হাঁটু ভেঙে আরহামে’র কাছে বসে নিজের কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলো তুষার। ঠিক এক অসহায় বাচ্চার মতো আরহাম কাঁদলো। কেন কাঁদলো? কিসের জন্য কাঁদলো বুঝলো না তুষার।
আরহামে’র শার্টের বোতাম কয়েকটা ছিড়ে যাওয়াতে তুষার ওর বুকটা খেয়াল করলো। আরহাম’কে বুক থেকে তুলে বাকি বোতামগুলো খুলতেই থমকে গেলো। ভাইয়ের বুক হাত দিয়ে আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

— আরহাম? এই তোর বুকে এগুলো?

— তুঁষ করেছে ভাই। দেখো।

বলে পুরোটা বুক দেখালো ভাইকে। তুষার কথার খেই হারিয়ে ফেললো। এই ক্ষত বিক্ষত বুকে ও নিজেও মাত্র আঘাত করলো। তবে কি তীব্র থেকেও তীব্র ব্যাথায় কাঁদলো আরহাম?

আরহাম নিজ থেকে পুণরায় ভাইয়ের বুকে এলো। জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কাঁদছে সে। মাঝে শুধু বললো,

— আমাকে অনেক ব্যাথা দিয়েছে ও কিন্তু আমি তবুও ওকে ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি ভাই। ওকে ছিনিয়ে নিও না।

— নিব না। কিন্তু…

— কি?

তুষার আরহামে’র মাথায় হাত রাখলো। এই চাচাতো ভাইটা ও ওর অনেক প্রিয়। আরহাম অসহায় ভাবে তাকিয়ে ওর দিকে। তুষার আরহামে’র দিকে তাকিয়ে বললো,

— আমাকে একটাবার জানালে আজ এমন হতো না।

আরহাম মাথাটা নামিয়ে নিয়ে শুধু বললো,

— ওকে যখন আঘাত করতো চাচি তখন কেন থামাতে না ভাই?

— ছিলাম না তখন।

— আমি ওকে শুধু নিজের কাছে রাখতে চাই।

— তুই ওকে মে’রে ফেলবি আরু।

ফট করে চোখ তুলে তাকালো আরহাম। লাল হওয়া চোখে তুষার’কে দেখতে নিলেই তুষার বললো,

— কি মা’রবি আমাকে? চোখ নামা।

আরহাম সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিলো। তুষার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

— তোঁষা অসুস্থ আরহাম।

চোখ তুলে প্রশ্ন করে আরহাম,

— মানে?

— তুই যখন বিদেশে গেলি এর বছর কয়েক পর তোঁষার আচরণে আমি কিছুটা সন্দেহ পোষণ করি। এক জায়গায় টিকতে পারত না। ফাঁপর লাগতো। ওর নাকি দম বন্ধ হয়ে আসতো। একবার চট্টগ্রামে যখন পাগলামি করলো তখন শিওর হলাম। আদনান ও জানে এ বিষয়ে। পরে আমি ডক্টর দেখালাম ওকে। আমার বন্ধু। রিত্ত’কে চিনিস না? ও ছিলো। কিন্তু সত্যি অন্য কিছু ছিলো আরহাম। জেনেটিক ভাবে শুধু তুই একা না আমাদের বংশে তোঁষার ও কিছু সমস্যা আছে। তুই যেমন সেনসেটিভ তেমনিই তোঁষা। ভালোবাসা কি যেই মেয়ে বুঝতো ও না সেই মেয়ে শুধু তুই তুই করে পাগল হয়ে ছিলো। ওর রাগ, জেদ, হাত তুলা কোনটাই স্বাভাবিক ছিলো না। মাঝখানে ওর পাগলামি অনেক তীব্র হলো একবার। আম্মু বুঝে নি ততটা। ইচ্ছে মতো মে’রেছিলো আমার পুতুলটাকে। জানিস আমার পুতুলটার কপাল ফেটে গিয়েছিলো। এতে তোঁষা বিগড়ে গেলো আরো। আমি রিত্ত’র সাথে বলা বলে ওকে ডক্টর দেখালাম পরে সবটা জানতে পারি।

আরহাম হা করে শুনলো সবটা। ওর মাথা নিমিষেই যেন লন্ডভন্ড হয়ে গেল। ও তোঁষা’কে তাহলে যেই ট্রিটমেন্ট দিলো সেটা রিএক্ট কি এজন্যই এমন হলো? তোঁষা’র ইন্টারনালি ক্ষতি হলো না তো? তুষার ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

— এবার বল তোঁষার মেমোরি লস করার ট্রিটমেন্ট কতটা হার্ম করলো ওকে আরহাম। আমার পুতুলটাকে কি করলি তুই?

আরহাম কথা বললো না। হয়তো বা বলতে চাইলো কিন্তু পারলো না। আস্তে করে উঠলো সেখান থেকে। হাঁটতে হাঁটতে শার্টের বোতাম লাগালো কয়েকটা। বিরবির করতে করতে বললো,

— আমার তুঁষ ঠিক হয়ে যাবে। আমি ওকে কেন মা’রব? ভালোবাসাকে কেউ মা’রে?

তুষার থামালো না আরহামকে। নিজেও বেরিয়ে এলো সেখান থেকে।
.
আরহাম একা একাই হাঁটছে রাস্তায়। ওর গাড়ি গ্যারেজে। মনে শুধু একটাই ভাবনা তুঁষটার ক্ষতি হলো কতটা? এজন্য ই কি এমন করে? আরহাম নাকি ওকে মা’রবে। এটা কি সম্ভব? এলোমেলো পায়ে হাঁটছে আরহাম৷ কখন যে মেইন রোডে উঠলো খেয়াল হলো না। হঠাৎ এক গাড়ি এসে ধাক্কা মারতেই রাস্তার মধ্যে ছিটকে পরলো আরহাম। উঠে দাঁড়াতে চাইলেও পারলো না। দূর্বল শরীরটা চোখ বুজে নিলো সেই ব্যাস্ততম রাস্তায়।

তোঁষা’র প্রাণ পরে রইলো অবহেলায় রাস্তার মাঝে। অপর দিকে ঘুম ভাঙলো তোঁষা’র। এদিক ওদিক খুঁজে ও যখন তোঁষা’কে পেলো না তখনই মেয়েটা চিৎকার শুরু করলো অথচ এখন কেউ আে না। আসবে না তাকে থামাতে। আদৌ কি তার প্রাণ আসবে আর কখনো তোঁষা’কে থামাতে?

#চলবে…….

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৩

খুবই ধীর গতিতে চোখের ভেজা পাপড়িগুলো নড়াচড়া শুরু করলো। লাল হওয়া ঠোঁট দুটো কিঞ্চিৎ নড়লো বুঝি। জ্ঞান ফিরার সময় টুকু কিছুই মনে করতে পারলো না আরহাম। তবে হঠাৎ নিজের হাতটা শক্ত এক হাতের মুঠোয় আবিষ্কার করলো। মাথাটা কাত করে সেদিকে তাকাতেই দেখা মিললো তুষারের। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আদনান। আরহামে’র চোখ খোলা মাত্রই চেঁচিয়ে উঠলো কিছুটা আদনান,

— ভাই? ভাই চোখ খুলেছে।

তুষার চোখ বুজে ছিলো। আদনানে’র কথায় তাকাতেই দেখলো আরহাম তাকিয়েছে। ভেজা চোখে দেখে যাচ্ছে দুই ভাইকে। আরহামে’র মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ তখন কতটা কার্যকর জানা নেই অথচ তার মুখ দিয়ে নাম বের হলো,

–তুঁষ।

কথাটা এতই ধীরে ছিলো কেউ বুঝলো না। তুষার দাঁড়িয়ে আরহামে’র মাথায় হাত বুলিয়ে ধীরে ডাকলো,

— আরু।

আরহাম উত্তর করতে পারলো না। তুষার সময় দিলো। আদনান ডক্টরকে ডেকে আনতেই উনি চেক করলেন। জানালেন এখন ঠিক আছেন আরহাম কিন্তু পায়ে ফ্যাকচার হয়েছে। ঠিক কবে হাঁটতে পারবে বলা যাচ্ছে না। হয়তো মাস খানিক সময় লাগবে। হাটাচলা এখন একদম নিষিদ্ধ আরহামে’র জন্য। বেড রেস্ট মাস্ট। ডক্টর যাওয়ার ও প্রায় আধ ঘন্টা পর সম্পূর্ণ হুঁশে ফিরলো। এদিক ওদিক তাকিয়েই দেখলো একজন নার্স কিছু মেডিসিন গুছাচ্ছে আর কাউচটাতে আদনান মাথা এলিয়ে শুয়ে আছে। উঠে বসার চেষ্টা করলো আরহাম। নার্স ওকে উঠতে দেখেই এগিয়ে এসে বললো,

— স্যার প্লিজ নড়বেন না। আপনার পায়ে ফ্যাকচার হয়েছে। হাটতে পারবেন না এখন।

— ভাই? ভাই কোথায়?

— তুষার স্যার? উনি মাত্র ই বাইরে গেলেন?

— আমি কখন থেকে এখানে?

— গত দুই দিন ধরে স্যার। আপনার অ্যাকসিডেন্ট এর পর আজ ই জ্ঞান ফিরলো।

মাথায় বাজ পরলো যেন আরহামে’র। দুই দিন! তাহলে ওর তুঁষ? পাগলের মতো উঠতে নিলেই পরে যেতে নিলো। ততক্ষণে আদনান এসে ধরেছে ভাইকে। শান্ত স্বরে বলছে,

— ভাই, এমন করো না। হাটতে পারবে না তুমি।

— ছাড়!

— কথা শুনো।

— ছাড় বলছি!!

আরহামে’র ধমকে ছেড়ে দিলো আদনান তবুও ভাইকে শান্ত করতে চাইলো। এদিকে আরহাম তোঁষা’র চিন্তায় পাগলপ্রায় অবস্থা। এদিক ওদিক তাকিয়ে ক্র্যাচ দেখলো দুটো। আদনান জানে ভাইকে থামানো যাবে না তাই দুটো এগিয়ে দিতেই আরহাম সেটাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। যেটাতে ভর দিয়ে উঠে হাটা ই কষ্টসাধ্য সেটাতে ভর দিয়ে দৌড়ে যেতে নিতেই মুখ থুবড়ে পরলো আরহাম। নার্স ঘাবড়ে গেলো সাথে সাথে। আদনান দৌড়ে এসে ভাইকে ধরলো। আরহামে’র মুখে একটাই কথা,

— আমার তুঁষ।

বহু কষ্টে আরহামকে নিয়ে গাড়িতে তুলতেই আরহাম ঝাঁঝালো গলায় বললো,

— গাড়ি থেকে বের হ।

— ভাই শুনো। আমি তোমাকে দিয়ে আসি। কোথায় যাবে?

— বের হ আমার গাড়ি থেকে!

পুণরায় ধমাকালো আরহাম। গাড়িটা গ্যারেজ থেকে তুষার ই আনিয়েছিলো। অগত্যা মেডিসিনের প্যাকেটটা আরহামে’র কাছে দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল আদনান। আদনান নামতেই শোঁ শোঁ আওয়াজে চলে গেল আরহামে’র গাড়িটা। আদনান সেদিকটায় তাকিয়ে ই রইলো।

গতকাল তুষারের ফোনে ফোন আসে একটা। হসপিটাল থেকেই ছিলো সেটা। তখনই জানা যায় আরহামে’র খবর। রাস্তা থেকে মানুষ ধরে হসপিটালে নিয়েছিলো। ফোনে চার্জ না থাকায় পরিচিত কাউকে পায় নি। গতকাল ফোন অন হতেই সর্বশেষ নাম্বার পায় তুষারের তাই সেটাতেই কল করা হয়। তুষারের সাথেই ছিলো আদনান তাই দুই ভাই ছুটে আসে। জেনারেল ওয়ার্ড থেকে কেবিনে শিফট করে।

কাঁধে কারো হাত পেতেই আদনান তাকালো। তুষার দাঁড়িয়ে। আদনান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

— ভাই চলে গিয়েছে।
_______________________

এলোমেলো গাড়ি চালিয়ে আরহাম ফিরলো। দারোয়ান এগিয়ে এসে সাহায্য করলো নামতে। কোনমতে লিফট এ উঠে বাইশ তলায় গেলো ও। লক খুলে প্রবেশ করেই ডাকতে লাগলো,

— তুঁষ? প্রাণ আমার, কোথায় তুই?

বলতে বলতে রুমের লক খুলে ভেতরে এলো। লাইট অন করা কিন্তু তোঁষা নেই। আশেপাশে কোথাও নেই। ধুকপুক করা বুকে ভেতরে এসে ওয়াশরুমের খোলা দরজায় তাকাতেই অন্তরআত্না কেঁপে উঠলো। তোঁষা ফ্লোরে পরে আছে। দিকবিদিকশুন্য হয়ে পরলো আরহাম। ওয়াশরুমের ফ্লোরে গিয়ে বসে কোলে তুলে নিলো তোঁষা’র মাথাটা।

— তুঁষ? এই প্রাণ। চোখ খুল না? কি হয়েছে তোর? চোখ খুল না? ভয় পাই তো। এই যে এসেছি আমি। উঠ না। কষ্ট হচ্ছে আমার প্রাণ।

তোঁষা উঠলো না। আরহাম নিজেই হাটতে পারে না কিভাবে তুলবে এখন তোঁষা’কে। ট্যাবটা ছেড়ে পানি নিয়ে তোঁষার মুখে চোখে ছিটালো। টেনে যতটা পারলো বুকে তুললো। তোঁষা চোখ খুললো অনেক পর। আরহাম’কে দেখেই জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। অভিযোগ করলো রোজকার ন্যায়। জানালো সে ভয় পেয়েছে। জ্ঞান ফিরলেও যথেষ্ট দূর্বল দেখালো তোঁষা’কে। আরহাম চাইলেও কোলে তুলতে পারলো না। মানিয়ে তোঁষা’কে বললো,

— একটু দাঁড়া।

তোঁষা দাঁড়ানোর পর বহু কষ্টে দেয়াল ধরে দাঁড়ালো আরহাম। ভর দিয়ে কোনমতে গিয়ে বসলো বিছানায়। তোঁষাকে বলে বলে ইনসুলিন আনালো।
মূলত না খাওয়ার কারণেই হয়তো তখন মাথা ঘুরেছে।
তাকিয়ে দেখলো জগের ভেতর রুটি ভিজিয়ে রাখা কিছুটা। হয়তো তোঁষা খেয়েছে। আরহামে’র বুকটা চিনচিন করা শুরু করলো। তুঁষটা কি না খাওয়া ছিলো?
তোঁষা ইনসুলিন এনে আরহামে’র হাতে দিলো। আরহাম কোনমতে তোঁষা’র বাহুতে পুশ করলো। তোঁষা এসে সোজা আরহামে’র পাশ ঘেঁষে বসে পরলো। মুখটা ফুলিয়ে রেখে বললো,

— খাব।

আরহাম ওকে রেখেই ক্রেচে ভর দিয়ে কিচেনে গেলো। কোনমতে ব্রেডে কেচআপ লাগিয়ে ভেতরে সালাদের পুর দিয়ে নিয়ে নিয়ে এলো। তোঁষা’র সামনে রেখে ওকে খেতে বলতেই নাক মুখ কুঁচকালো তোঁষা। খাবে না ও এটা। আরহাম আহত চোখে তাকিয়ে রইলো। তবুও জোর করতেই তোঁষা হাতে তুলে ছুঁড়ে মা’রে ফ্লোরে। মুহুর্তে ই তা ছড়িয়ে গেলো। আরহাম কিচ্ছুটি বললো না। ফোন হাতে তুলে খাবার অর্ডার দিলো।
কাছাকাছি হওয়াতে খুব দ্রুত ই খাবার এলো। তোঁষা’র সামনে খাবার রেখে ফ্লোর থেকে কুড়িয়ে ব্রেডটা খেয়ে নিলো আরহাম। পায়ের ব্যাথায় টিকা যাচ্ছে না। মেডিসিন নিতেই হবে।
যেই খুঁতখুঁত স্বভাবের আরহাম কোনদিন রাস্তা ঘাটে খায় না সেই আরহাম আজ ফ্লোরে তোঁষা’র ছুঁড়ে ফেলা খাবারটা অনায়াসে খেয়ে নিলো।
তোঁষা আপনমনে খাচ্ছে বিছানায় বসে। আরহাম মেডিসিন খেয়ে তোঁষা’কে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো। তোঁষা ঘুমাবে না। আরহাম ক্লান্ত ভাবে শুধু বললো,

— অনেক কষ্ট হচ্ছে প্রাণ। একটু ঘুমাতে দে।

— আদর করো।

— এখন না।

— না এখনই করো।

— পাগলামি করে না প্রাণ।

তোঁষা কথা না বলে আরহামে’র বুকে উঠে গেলো। হয়তো আজ এই প্রথম তোঁষা’কে না চাইতেও সাড়া দিলো না আরহাম। তার শরীরে কুলাচ্ছে না। কিছুতেই না।
.
কান্নার শব্দে হঠাৎ ই ঘুম ভাঙলো আরহামে’র। টেনে চোখ খুলে তাকালো কোনমতে। ঘন্টা খানিক হলো ঘুমালো। কান্নার উৎস খুঁজে তাকালো এদিক ওদিক। আলমারির পাশে ফাঁকা জায়গাটায় বসে কাঁদছে তোঁষা। আরহাম উঠতে চাইলেও পারলো না। কোনমতে আধশোয়া হয়ে বসে ডাকলো তোঁষাকে। তোঁষা সাড়া দিলো না। দেখে মনে হলো হয়তো পরে গিয়ে এভাবে বেকায়দায় বসে আছে। একদম ছোট ছোট চুলে মনে হলো এক বাচ্চা মেয়ে কাঁদছে। আরহাম পুণরায় ডাকলো,

— তুঁষ? প্রাণ উঠে আয়। কোথায় ব্যাথা পেয়েছিস? আয় আমার কাছে।

— তুঁষ উঠবে না। তুঁষ ব্যাথা পেয়েছে। কোলে তুলে নাও।

আরহাম কত করে বললো কিন্তু তোঁষা উঠলো না। অগত্যা শরীরটা ঠেলে বিছানার কিণারায় আনলো ও। ওর ক্রেচ দুটো দরজায় পাশে পরে আছে। নিশ্চিত তোঁষা ফেলে রেখেছে ওখানে।
না পেরে এবার শরীরের উপরিভাগ ছেড়ে দিলো আরহাম। ওমনিই শরীরটা ওর ছিটকে পরলো ফ্লোরে। ব্যাথায় মুখ কুঁচকালো আরহাম। পায়ে একদমই বোঁধ পাচ্ছে না৷ কোনমতে শরীরটা টেনে সেচড়ে নিলো তোঁষা’র কাছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হাঁপিয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো,

— আয়।

তোঁষা এবারেও মানলো না। আরহাম হাত বাড়িয়ে তোঁষার হাতটা টেনে আনলো নিজের কাছে। তোঁষা এবার আরহামে’র কোলের উপরে ধপ করে বসলো। বসেই গলাটা জড়িয়ে ধরে মুখ গুজে দিলো কাঁধে। এভাবে তোঁষা পায়ে বসাতে ব্যাথায় জর্জরিত আরহামে’র মুখটা লাল হয়ে গেলো। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে তোঁষা’কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো শব্দ করে।

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে