#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২
উষ্ণীয় আলিঙ্গনে ঘুমের জোড় বাড়লো তোঁষা’র। নাক,মুখ ডুবিয়ে শ্বাস টেনে নিলো সে। শীতের সকালে এহেন আলিঙ্গন তার নিকট নতুন। আরহাম জেগেছে ঘন্টা খানিক আগেই কিন্তু তোঁষা’কে এতটা আদুরে মুহূর্তে পেয়ে আর ছাড়তে পারে নি সে। এই মেয়েটা যে তার প্রাণে’র অনেকটা জুড়ে। এই প্রথম এতটা কাছে পেয়েছে তাকে আরহাম। না চাইতেও তার মনে হানা দেয় বিভিন্ন সংশয়। যদি কেউ ছিনিয়ে নেয় তার প্রাণ’কে? যদি কেউ টের পায়? আদনান কি টের পাবে এই লোকালয়ের বাইরে যে তার ভালোবাসা’কে লুকিয়েছে আরহাম? পরক্ষণেই সকল অযাচিত চিন্তাভাবনা বাদ দেয় আরহাম। কেউ টের পাবে না। কখনোই না। এই বাইশ তলার উপর কে ই বা টের পাবে যে আরহাম লুকিয়ে রেখেছে তার প্রাণ’কে? তবুও যেন আরহামের চিন্তার শেষ নেই। মাঝেমধ্যে ভীষণ রাগ উঠে ওর শুধুমাত্র তোঁষা’র উপর। কে বলেছিল এই মেয়ে’কে আরহাম’কে এতটা পাগল করতে? ছোট থেকেই সে দৌড়ে বেড়ায় আরহামে’র রন্ধ্রে রন্ধ্রে। শিরায় উপশিরায়। ইশ! কতটাই না জ্বালাময় সে অনুভূতি।
পিটপিট করে চোখ খুলার চেষ্টা করে তোঁষা। গালে এখনও টনটনে ব্যাথার উপস্থিতি তার ঘাড় সহ মাথায় ও উঠেছে যেন। অল্প সল্প খোলা চোখে অক্ষিপটে ভেসে উঠে আরহামে’র সুশ্রী মুখমন্ডল। প্রথমে অবাক হলেও ক্ষাণিকের মাঝেই ওর মুখটা হাসি হাসি হয়ে গেলো। লাল হওয়া গাল দুটো তখন গর্তে ঢুকেছে যেন। গালের পেশির মাঝে বড়বড় গর্ত এই রুপসীর রুপ যেন বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। আরহাম আলতো হাতে ছুঁয়ে দেয় ওর গাল। অল্প ব্যাথায় মুখে শব্দ করে তোঁষা,
— আহ!
তোঁষা’র ব্যাথাটা অল্প হলেও আরহাম উত্তেজিত হয়ে উঠে,
— ব্যাথা পেলি? তুঁষ! দেখি গালটা।
তোঁষা নাক, মুখ কুঁচকে উঠে বসে। আরহাম ও সাথে সাথেই এক লাফে উঠে বসতেই তোঁষা বোঁচা নাকটা ফুলিয়ে বললো,
— কিছুই হয় নি। আপনি শুধুই এমন করেন।
আরহাম চাচ্ছে না রাগ করতে। কিছুতেই এখন রাগ করা যাবে না। অন্তত পক্ষে ওর তুঁষে’র সামনে তো না ই। তোঁষা’র বাহুটা ছাড়তেই তোঁষা বিছানা থেকে নামতে যায়। যেই না এক পা এগুবে ওমনিই ধপ করে হুমড়ি খেয়ে পরলো ফ্লোরে। আরহাম তারাতাড়ি বিছানা ছেড়ে তোঁষা’কে ধরতে গেলেই তোঁষা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো। এতটা আহ্লাদী যদিও সে না তবে আরহামের নিকট সে বড্ড আহ্লাদী হয়ে উঠে। আরহাম টেনে তুলে ওকে বিছানায় বসিয়েই ব্যাস্ত হয়ে চোখ মুছে দেয়। তোঁষা’র পড়নের টাউজারটা রাতে গুটিয়ে দিলেও তা এখন ছুটে গিয়েছে ওটাতেই পা বেঝে আছারটা গেলো তোঁষা। বোঁচা নাকটা টানতে টানতে তোঁষা মুখ নাক লাল করে ফেললো। আরহাম ওর পা টা নিজের কোলে তুলে দেখতে দেখতে অস্থির হয়ে শুধালো,
— তুঁষ? ব্যাথা পেলি কোথায়? মোচকেছে? এই কথা বল!
অস্থির হয়ে প্রথমে বললেও পরে কিছুটা রেগে যায় আরহাম। তার এই রাগ যে কিছুতেই আয়ত্তে থাকে না। তোঁষা কিছুটা চমকে যায় হঠাৎ ধমক খেয়ে কিন্তু চমকানো টা বেশিক্ষণ টিকে না। আরহাম স্বাভাবিক করে নেয় নিজেকে। মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে। গত কাল থেকে আজ পর্যন্ত ওর তুঁষ’টা তো কম আঘাত পাচ্ছে না। তখন না হয় আরহাম কাছে ছিলো না। পাশে ছিলো না কিন্তু এখন? আরহামের এতটা কাছে থেকে কেন ওর তুঁষ আঘাত পাচ্ছে? এটা কোনভাবেই আরহাম মানবে না। মন’কে মানালেও মস্তিষ্ক তার কিছুতেই মানতে চায় না।
হঠাৎ করেই তোঁষা’কে জড়িয়ে ধরে আরহাম। ভ্রু কুঁচকায় তোঁষা। বিছানা থেকেই তো পরলো তাতে এতটা চিন্তিত হওয়ার কি আছে? আরহাম তোঁষা’কে ছেড়ে নিজের মুঠোয় তোঁষা’র নরম হাতটা পুরে নেয়। তোঁষা তাকায় আরহামের চোখের দিকে। বাদামী বর্ণের চোখের মনির দিকে তাকাতেই তোঁষা’র ভ্রু কুচকানো টান টান হয়ে যায়। আরহামের চোখে মুখে চিন্তার ভাজ। মুখভঙ্গি ও আদল বদলেছে। কেন? শুধু মাত্র তোঁষা এই অল্প ব্যাথা পেলো বলে? নরম হয়ে আসে তোঁষা,
— বেশি লাগে নি তো।
আরহাম কিছু বলে না। মাথা নিচু করে কিছু ভাবছে সে। তোঁষা শ্বাস ফেলে ডাকে,
— আরহাম ভাই?
আরহাম কোন কালেই তার তুঁষে’র এই ডাক উপেক্ষা করতে পারে নি। আজও পারলো না। অল্প হাসার চেষ্টা করে বললো,
— আয়।
আরহামের বাড়িয়ে দেয়া হাতে হাত রাখে তোঁষা। পায়ে যে একেবারে ব্যাথা পায় নি তা না। পেয়েছে কিন্তু অল্প। তোঁষা ওয়াসরুমের দরজা লাগাতেই এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের ফোনটা খুঁজে আরহাম। টেবিলের সাইডে রাখা সেটা। হাতে তুলে দ্রুত গতিতে বৃদ্ধাঙ্গুলি চালিয়ে কিছু টাইপ করলো। অতঃপর ছুঁড়ে মা’রলো তা কাউচে। ঘাড়টা এদিক ওদিক নাড়িয়ে হাত দুটো প্রসারিত করে অলসতা কাটানোর মতো করে আরহাম। লালচে গোলাপি রঙা ঠোঁটে তার বক্র এক হাসি। বড়ই অদ্ভুত সুন্দর সেই পুরুষের পুরো ঠোঁটের হাসিটা। তোঁষা দেখলেই বলত, “আরহাম ভাই, আপনি এভাবে হাসলে আমার কিছু হয়”।
কথাটা ভাবতেই খট করে দরজা খুলে কিছুটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বের হলো তোঁষা। আরহাম গিয়ে ধরে এনে কাউচে বসিয়েই রুমের বাইরে গেলো। তোঁষা গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলো ওর আরহাম ভাই নামক জামাই’টার দিকে। তোঁষা’র প্রাণে’র অস্তিত্ব সম্পূর্ণটা জুড়ে এই আরহাম ভাই। একে পেতেই তো এত সব পাগলামি তোঁষা’র। এই আরহাম ভাই এর টিশার্ট জড়িয়েই তো বুক ভরে শ্বাস টানতো তোঁষা। নিন্দ্রাহীন রজণী কেন কাটাতো? ফোনে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলে বুকের ভার কমাতো। রাত বিরাতে মনে মনে কান্না করতো তোঁষা। এই আরহাম ভাই’কে পেতে জীবনের সবচেয়ে বড় সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছে ও গত কয়েকটি দিন। যার শেষ ছিলো গতকাল। বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছে তোঁষা ওর আরহাম ভাইয়ের কাছে। একজনকে ভালোবেসে নিশ্চিত আরেকজনের সাথে সংসার করাটা সম্ভব ছিলো না তার জন্য? তোঁষা কি বাঁচতো ওর আরহাম ভাই ছাড়া? বাবা’কে কত বললো। যেই বাবা’কে জমে’র মতো ভয় পেত সেই বাবা’র সামনে দাঁড়িয়ে জাহির করেছিলো মনের কথা। তোঁষা ভাবুক হলো,
~বাবা’কে যথেষ্ট ভয় পেয়ে চলে তোঁষা। অথচ বাবা ছাড়া তার চলেও না। সারা বাড়ি টো টো করা ওর একমাত্র কাজ। সকলের আদুরে বাচ্চা কি না। পরিবারের সবচেয়ে কনিষ্ঠ মেয়ে তোঁষা। যাকে বড় চাচা সহ বাকিরা পুতুল নামে ডাকে। যার লাল, ফর্সা দুধের রঙের শরীরটা শীতের দিনে ঠিক তুষের ন্যায় লাগতো। তাই তো ওর আরহাম ভাই ওর নাম রেখেছিলো তুঁষ যা একসময় ঠিকঠাক করে সকলে রাখলো তোঁষা। তোঁষা’র নিকট তুঁষ নামটাই বেশি ভালোবাসার। ওর আরহাম ভাই ডাকে এই নামে। আরো একজন ডাকে তবে তাকে মনে করতে ইচ্ছুক নয় তোঁষা।
আরহাম’কে বিয়ে করার কথা বাবা’র সামনে বলতেই বাবা গম্ভীর কণ্ঠে না করে। তোঁষা তখন বাবা’র সামনে ঐ গতকাল প্রথম সাহস জুগিয়ে বলেছিলো,
— আরহাম ভাই ছাড়া বিয়ে করব না আমি।
ননীর পুতুলের ঠোঁট দিয়ে বের হওয়া কথা শুনেই রেগে যান তুহিন। উঠে এসে সজোরে থাপ্পড় বসান আদরের মেয়ের গালে। যেই গালে সবাই ঠেসে চুমু খেলেই লাল লাল দাগ পরতো সেই গালে ঐ থাপ্পড়টা ছিলো আবিরের ন্যায়। একদম রঙা করে দিয়েছিলো তোঁষা’র গাল। যার দাগ এখনও মিটে নি।
তোঁষা কিন্তু দমে নি। ভীতু মেয়েটা দৌড়ে গিয়ে বড় চাচা তুরাগে’র পা ধরে। অনুরোধ করে জানায়,
— চাচ্চু…চাচ্চু আব্বুকে বোঝাও না। আমি তো আরহাম ভাই’কে ভালোবাসি। তোমরা না বলেছিলে আরহাম ভাই আমার বর হবে তাহলে অন্য কারো সাথে কেন বিয়ে দিচ্ছো?
তুরাগ অপারগ। হাজার হোক তার ছেলে আরহাম। তিনি কখনোই তোঁষা’র বিয়ে দিবেন না আরহামের সাথে। তোঁষা’কে পা থেকে বহু কষ্টে টেনে তুলে চাচি। তোঁষা শুধু কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করে,
— মিথ্যা ওয়াদা কেন দিয়েছিলে? কেন বলেছিলো আরহাম ভাই আমার বর? আরহাম ভাই ফিরবে। নিশ্চিত ফিরবে।
কথাটা শেষ করতে না করতেই তুঁষার ওকে টেনে হিচরে নিয়ে যায় ওখান থেকে। তোঁষা তখন বড় ভাইয়ের কাছে নালিশ জানায়। লাভ হয় না। তুঁষার শুনে না। ওর টান হেচরিতেই তোঁষা আঘাত পায় কিছু জায়গায়।
হঠাৎ হাতে সূচ ফুটতেই মুখে “উফ” শব্দ করে অতীত থেকে বেরিয়ে আসে তোঁষা। আরহাম ততক্ষণে ওকে ইনসুলিন পুশ করেছে। তোঁষা হাসলো। আরহাম ওর মাথায় হাত দিয়ে বললো,
— পয়েন্ট কত যাচ্ছে ইদানীং?
তোঁষা’র হাসি মিলিয়ে গেলো নগদে। জন্মের কয়েক বছর পরই ওর মধ্যে ডায়বেটিস দেখা গিয়েছিলো। ইনসুলিন নিতে নিতে জীবন তেঁতো হয়ে আছে। আরহাম রেগুলার পয়েন্ট চেক রাখে। গত কয়েকমাস রাখা হয় নি। সুযোগ হয় নি বলা যায়। তোঁষা তো ইচ্ছে মতো খেয়েছে। পয়েন্টের হুস কি ছিলো?
ওর মুখের চোরা চোরা ভাবটা দেখেই আরহাম চেক করার জন্য ড্রয়ারে হাত দিলো। পয়েন্ট দেখেই যেন মাথায় হাত। খালি পেটে নয়। মোটেও কম কথা না। আরহাম রেগে তাকাতেই তোঁষা মুখ কালো করে। নীচু কন্ঠে বলে,
— ক্ষুধা লেগেছে আরহাম ভাই।
— কে তোর ভাই??
আরহামের ধমকে কাঁপে তোঁষা। আরহাম হুট করে ওর একবাহু চেপে ধরতেই তোঁষা ব্যাথায় মুখ কুঁচকায়। দাঁত পিষে আরহাম শুধু বললো,
— বলেছিলাম আমার জন্য তোর খেয়াল রাখিস।
— ব্যাথা পাই।
— পা।
— ছাড়ুন।
আরহাম ছাড়লো না বরং চাপ বাড়ালো। তোঁষা শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা মা’রতেই কদম দুই পেছালো আরহাম। চক্ষু ওর তখনও টকটকে লাল।
#চলবে….?
#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩
তোঁষা যেন একুল ওকুল দুই কুল হারিয়ে বসে আছে। একা একা কতক্ষণ ভালো লাগে? আরহাম সেই যে বেরুলো এখন ও ফিরে নি। যাওয়ার আগে শুধু গোমড়া মুখে তোঁষা’কে খায়িয়ে গিয়েছে। অবশ্য এটা বললেও ভুল হবে। শুধু রুটি আর ডিম ওর সামনে রেখেছে। তোঁষা নিজ হাতেই তো খেলো। ওর খাওয়া দেখা মাত্র হনহনিয়ে পকেটে ফোন আর মানি ব্যাগ ঢুকিয়েই আরহাম কোন প্রকার বাক্য ব্যায় না করে চলে গিয়েছে। তোঁষা এমন রাগের কারণ দাঁড় করাতে পারলো না। কারণ টা কি তোঁষা নিজের যত্ন করে নি এটা নাকি তোঁষা ওকে ধাক্কা মা’রলো ওটা?
ভাবলো তোঁষা, নিজের যত্ন নেয়ার মতো কাজটা কিভাবে করতো ও? গত মাস থেকে টানা দুই দিন ইচ্ছা করে ইনসুলিন নেয় নি। উদ্দেশ্য একটাই। বাবা-চাচ্চু সহ সবাইকে রাজি করানো। কিছুতেই অন্য কাউকে বিয়ে করতে রাজি না ও। ইহকালে তোঁষা’র দেহে প্রাণ থাকতে না। বিষাদে ঘেরা মনটা তেঁতো সময়গুলো মনে করে,
~ এই তো গত মাসে। সবাই’কে বারবার বলেও রাজি করাতে পারে না তোঁষা। বাবা কথা ও বলে না ঠিকঠাক ভাবে ওর সাথে। তোঁষা বেহারায় ন্যায় যাকে পায় তাকেই বলে,
— আরহাম ভাই এর খবর জানো?
ওর এই এক প্রশ্ন যেন তুহিন’কে রাগীয়েছিলো বহুগুণ। দুটো মাত্র সন্তান তার। তুষা’র হওয়ার কত বছর পর এই তোঁষা টার আগমন এই ধরণীর বুকে। ঠিক এক শীতের রাতে তাদের গৃহ আলোকিত করে ভোরের ঊষা হয়ে এসেছিলো তাদের পুতুল। তোঁষা’র মা তো ভরসাই ছেড়ে দিয়েছিলেন আরোকটা সন্তানের। মধ্যবয়সে এসে এই তোঁষা নামক প্রাণে’র আগমন। ঠিক যেন তুঁষে’র রাণী। শেখ বাড়ীর তুঁষে’র পুতুল।
এই পুতুলটার এহেন পাগলামী কে ই বা মেনে নিবে? কেন মেনে নিবে? মানার কি কোন অবকাশ ছিলো বা আছে?
মেয়ের তখনকার পাগলামো দেখে তুহিন রেগে যান ভয়াবহ ভাবে। সেই রাগ থেকেই তেড়ে আসেন তোঁষা’র দিকে। তোঁষা মায়ের পিছু লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে,
— আমার ফোন দিতে বলো আম্মু। আরহাম ভাই’কে কল করব।
তোঁষা’র মা নিতান্ত ভদ্রমহিলা। স্বামী’র কাছে তিনি নিজেই প্রচুর আদরের। তুহিন স্ত্রী’কে প্রচুর ভালোবেসে আগলে রাখেন। দুই সন্তান আর এই বউ নিয়েই তো তার ছোট্ট সংসার। যৌথ সংসারে একদম রমরমা ভাব। কিন্তু তোঁষা’র এহেন আচরণ সব যেন উল্টে দিলো। তোঁষা’র শেষোক্ত কথাটা শুনে রাগে তেড়েমেড়ে তুহিন বলে উঠেন,
— তোঁষা বেশি বারাবাড়ি করবে না। আরহামের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে খুব খারাপ হবে বলে রাখলাম।
তোঁষা ও যেন ফুঁসে উঠলো। তীব্র প্রতিবাদী স্বরে জানালো,
— কেন করব না? তোমরা কথা দিয়ে কথা কেন রাখছো না? আমি আরহাম ভাইকেই বিয়ে করব। ম’রে গেলেও অন্য কাউকে….
কথার মাঝেই চড়ের তীব্র শব্দ কানে আসে তোঁষা’র। চোখ বড়বড় করে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে বাবা’র পানে। তুহিন নিজেও হতভম্ব তখন। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন ওর মা। রাগ সামলাতে ব্যার্থ হয়ে স্ত্রীর গালে চড় বসিয়ে দিয়েছেন। তুহিন হতভম্ব ভাব কাটালো। ধমকের স্বরে বলার চেষ্টা করলো,
— মেয়ে সামলাও নাহলে এরচেয়ে ও খারাপ কিছু হবে।
তোঁষা কেঁদে ফেললো ততক্ষণাৎ। ওর মায়ের সাথে যে বাবা কখনো উচ্চবাক্য ব্যায় করে নি সে কিভাবে তার গায়ে হাত তুললো? দৌড়ে যেতে যেতে শুধু বললো,
— কেন আশা দিয়েছিলে? এখন কেন এসব? আমার আরহাম ভাই আসবে। তোমার ওয়াদা ভঙ্গকারী হলেও সে না।
দৌড়ে গিয়েও বেশিদূর এগোতে পারলো না তোঁষা। ইনসুলিন না নেয়াতে মাথা ঘুরে পরে যায় রুমের বাইরে। তুঁষা’র বাসায় ছিলো না। বোনকে দরজার সামনে পরে থাকতে দেখেই চিৎকার করে এগিয়ে আসে। বোনের মাথাটা কোলে তুলে একবার মা-বাবা’কে ডাকে তো পরক্ষণেই তোঁষা’র গালে চাপড় মে’রে ডাকতে থাকে,
— পুতুল? এই পুতুল? কি হয়েছে? এই!!
তোঁষা হাত পা ক্রমশ ঠান্ডা হওয়ার পথে। তুঁষা’র বোনকে নিয়ে বিছানায় শোয়াতে শোয়াতেই চাচা,চাচি, বাবা আর আদনান ও হাজির হয়। ওর চাচি কাঁদতে কাঁদতে হিচকি তুলে ফেললো। এই চিনির পুতুলটার এই অবস্থা কেন? আরহাম’কে কোনদিন যখন মেনেই নিবে না তাহলে কেন তাকে বছরের পর বছর ছেলে ছাড়া থাকতে হলো? যেই ছেলের সুখ এই তোঁষা সেই ছেলে কি মানবে এত বড় ধোঁকা?
তুষা’র বুদ্ধিমান। ও বুঝে তোঁষা ইনসুলিন নেয় নি। তাই ঝটপট সুগার চেক করলো। যা ভেবেছিলো তাই। ইনসুলিন পুশ করে সবাই’কে রুম থেকে বের হতে বলে। সবাই বের হলো। চাচি তখনও শিয়রের কাছে বসা। তুষা’র হাটু গেড়ে বসে চাচির কাছে। হাতটা মুঠোয় পুরে শুধু বলে,
— আমার অনেক আদরের বোন চাচি। আরহাম…
— আমার ও অনেক আদরের ছেলে আরহাম তুষার। কিন্তু দেখ বছরের পর বছর সে আমার কাছে নেই। যার জন্য এতকিছু তাকে নিয়েই ছিনিমিনি?
— সব ধ্বংস হয়ে যাবে চাচি।
— সেটা এমনিও হবে ওমনিও।
— তোঁষা’কে একটু বুঝাও।
— অনেক চেষ্টা করেছি।
তুষা’র দীর্ঘ নদীর মাঝে খেই হারা মাঝির মতো লক্ষ্যভ্রষ্ঠ হয়ে রইলো। চাচি উঠে গেলেন তোঁষা’র খাবার আনতে। তুষা’র তাকায় বোনটার মুখের দিকে। অনেকটা পার্থক্য ভাই-বোনের বয়সের। হাঁটুর বয়সী বোন। সময় মতো বিয়ে করলে তুষা’রের হয়তো তোঁষা থেকে বছর সাত আট ছোট্ট মেয়ে থাকত।
তুষা’রের নিকট বাচ্চা বৈ কিছুই না তোঁষা। তার কলিজার টুকরো এই বোন। বাড়ীতে তিনটা ছেলে। একটা মাত্র মেয়ে। সবার চোখের মণি অথচ সময় আর পরিস্থিতি সবটা বিগড়ে দিয়েছে। সবটা।
তুহিনের নজর যায় সোফার কিণারায়। তার স্ত্রী সেখানেই ঠান্ডা হয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। হ্যাঁ ঘন্টা খানিক হবে ওখানেই তো তাকে থাপ্পড়টা মা’রলো তুহিন। স্বামী’র দেয়া বিবাহিত জীবনের প্রথম আঘাতটা কি সে সহ্য করতে পারে নি? হয়তো। তাই তো দিকহারা হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টিতে শুধু শূন্যতা।
তুহিন এগিয়ে যান। আলতো করে হাত রাখেন স্ত্রী’র পিঠে। একসময় ধীরে জড়িয়ে নেন নিজের সাথে। ডান হাতটা বুলিয়ে দেন গালে। ফিসফিস করে শুধু ব্যাথিত গলায় শুনা যায়,
— দোষ খুঁজলাম আমার। অনেক খুঁজলাম। পেলাম না।
তুহিনের চোখ দিয়ে এক ফোটা অনুতাপ ঝড়লো। মনের ঝড় তার মন জানে। অপ্রকাশিত সকল অনুভূতি দগ্ধ করে চলছে তাদের।
.
খট করে শব্দ করে দরজাটা খুলে যায়। তোঁষা মুখ তুলে তাকায়। আরহাম এসেছে। যাওয়ার সময় ওকে রুমে রেখে দরজাটা বাইরে থেকে লাগিয়ে গিয়েছিলো। তোঁষা অশ্রু ভরা চোখে তাকালো। আরহাম ওর দিকে তাকাতেই দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তোঁষা তার বুকে। হাত থেকে আরহামের সকল ব্যাগ পরে গেলো ফ্লোরে। দুই হাতে তোঁষা’কে তুলে ধরে নিজের সাথে। তোঁষা কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলতে পারলো,
— অনেক কষ্টে আপনাকে পেয়েছি আরহাম ভাই। আপনি কেন চলে গিয়েছিলেন?
আরহাম বিষ্মিত হলেও পরক্ষণেই ঠোঁটের মাঝে খেলে উঠলো রহস্যময় এক হাসি। সন্তপর্ণে চুমু খেলো তোঁষা’র মাথায়। তোঁষা তখনও ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আরহাম’কে প্রথমে শক্ত করে ধরে রাখলেও এখন শরীর ছেড়ে দিয়েছে। আরহাম ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখলো। ওভাবেই হেঁটে গেলো বিছানার কাছে। আরহাম ডাকলো ওকে কিন্তু তোঁষা মুখ তুলে না। আরহাম দ্বিতীয় বার ডাকলো,
— তুঁষ?
— হু।
— কেন কাঁদছিস?
— কোথায় ছিলেন আপনি? রেগে কেন চলে গেলেন? আমি ভয় পেয়েছিলাম।
“ভয়” হ্যাঁ এই একটা মাত্র জিনিস ই আছে যা পারে তোঁষা। খুব ভয় পেতে পারে সে অথচ কিছু মাস ধরে সকল ভয় সে বিসর্জন দিয়েছিলো। ভালোবাসার মানুষটার জন্য গলা উঁচিয়ে কথা ও বলেছিলো।
আরহাম অভিযোগ শুনলো মনোযোগ দিয়ে। নিজের সাথে তোঁষা’কে নিয়ে বসলো বিছানায়। নিজের কালো কুচকুচে চাপ দাঁড়ি যুক্ত গালটা লাগিয়ে দিলো তোঁষা’র ফুলা গালটার সাথে। বাকি কাজটা তোঁষা নিজেই করে নিলো। ঘঁষে দিলো নিজের নাক,মুখ আরহামের গালে। টু শব্দ করলো না দু’জনের একজনও। আরহাম অনুভব করলো নিজের ভেজা গালটাকে। তুঁষে’র ফোঁটায় ফোঁটায় যেন সিক্ত তার গাল। তোঁষা আরহামের নাকটাকে ছুঁয়ে দিলো আঙুল দিয়ে। আরহাম তাকাতেই নাক টেনে টেনে বললো,
— আমার নাকটা বোঁচা অথচ আপনারটা কত খাড়া নাক আরহাম ভাই। একদম চাচ্চু’র মতো।
নিজের বাবা’র কথা শুনে হঠাৎ ই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আরহামের। তোঁষা’কে কাছে পেয়েছে চব্বিশ ঘণ্টা ও হয় নি অথচ রাগ উঠেছে কয়েকবার। নিয়ন্ত্রণ করাটা বড্ড কঠিন হয়ে যাচ্ছে আরহামের। বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি হওয়া উচিত। ভয়ংকর শাস্তি। জিহবা চোয়ালের নীচে পিঁষে আরহাম তাকায় তোঁষা’র পানে। ওভাবেই শুধু বলে,
— বিশ্বাসঘাতকদের কথা আর মনে করবি না তুঁষ।
তোঁষা ভরকে যায় কিছুটা পরক্ষণেই বলে উঠলো,
— আপনি এখনও রেগে আছেন?
— কেন মনে হলো রেগে আছি?
— তখন ধাক্কা দেয়াতে অথবা নিজের যত্ন না নেয়াতে।
— আমি কে হই তোর?
সরাসরি উত্তর তোঁষা’র,
— আরহাম ভাই।
— আর?
— আর কি?
— আর কিছু নই?
তোঁষা যেন লজ্জা পেলো মুহূর্তেই। কেন পাবে না আরহাম ভাই গত কাল থেকে ওর স্বামী। ওর একান্ত পুরুষ। তোঁষা’র প্রাণ। কত বছরের সাধের এই মানুষটা তোঁষা’র। সহাস্যে প্রকাশ করে তোঁষা,
— আমার স্বামী আপনি। আমার সবটুকু জীবনের গাঢ় রঙটা আপনি যে রাঙিয়ে দেয় আমাকে প্রতিনিয়ত। আপনি এমন এক অস্তিত্ব আমার যাকে ছাড়া বছরের পর বছর পাড়ি দিয়েছি আমি কিন্তু কখনো ভুলে থাকতে পারি নি। আমার প্রিয় প্রাণ আপনি আরহাম ভাই।
তোঁষা’র সহজ সরল স্বীকারোক্তি। আরহাম প্রলুব্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখে নিলো ওর বোকা তুঁষে’র মুখটা। নিজের খসখসে হাতের ঠান্ডা তালুর আজলায় তুলে নিলো তোঁষা’র মুখ। চোখে চোখ রেখে জানালো,
— তোর উপর রাগ করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা এই আরহাম শেখ’কে দেয় নি তুঁষ।
— তাহলে…
— তখন রাগ উঠেছে শেখ বাড়ীর সকলের প্রতি। আমার থেকে তোকে দূর করতে লোকগুলো এতটাই বেভুর ছিলো যে তাদের কলিজার টুকরো’র খেয়াল রাখতে পারলো না। তোর ডায়বেটিস এর পয়েন্ট কেন এত বেশি থাকলো তুঁষ? খালি পেটে নয়। বুঝিস কিছু?
— আপনি তো ছিলেন না তাই এমন হয়েছে।
তোঁষা’র চোখ মুখে দুষ্ট হাসি। আরহাম ও চাপা হাসলো। তোঁষা ততক্ষণে আরহাম থেকে সরে দরজার সামনে পড়ে থাকা ব্যাগগুলো তুলে। উৎসুক দৃষ্টি আরহামের দিকে। তোঁষা’র চোখে করা প্রশ্ন বুঝে আরহাম। অল্প হেসে জানায়,
— সব তোর।
তোঁষা’র খুশি আর দেখার কসুর রইলো না। একে একে ব্যাগ খুলে সব বিছানায় ছড়ালো। এত এত সুন্দর সুন্দর সব কি না তোঁষা’র সেখানে দাতা কি না ওর আরহাম ভাই! ভাবা যায়?
লাল নেটের শাড়ীটা হাতে তুলেই হাসোজ্জল চোখে তাকায় তোঁষা। আরহাম আপ্লূত চোখে তাকিয়ে রইলো। কতগুলো বছরের বিচ্ছেদ অতঃপর ই না আজ তারা এক। দুটো দেহ একটি প্রাণ।
তোঁষা হাতের শাড়ীটা উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে আনমনে প্রশ্ন করে,
— এই শাড়ীটা অনেক সুন্দর।
— সুন্দর একটা দিনের জন্যই তার আগমন।
তোঁষা বুঝে না কথার অর্থ। পুণরায় জিজ্ঞেস করতেই আরহাম বলে উঠলো,
— যেদিন আমার প্রাণে মিশতে চাইবি ঐ দিন এটা পড়বি তাহলেই আমি বুঝে নিব আমার প্রাণ ঐদিন আমার মাঝে নিহিত হবে।
কথাটা গভীর হলেও এর মর্মার্থ বুঝে তোঁষা। লজ্জায় গাল দুটো গরম হয়ে যাচ্ছে যেন। আরহাম নিজ থেকে কাছে আসে নি আজ পর্যন্ত। প্রতিটা বার তোঁষা গিয়েছে। এবারও যাবে। গতরাতের শুধু মাত্র তোঁষা’র অনুরোধে ই না আরহাম তার কাছে রইলো ফলে ই না তোঁষা প্রশান্তির ঘুম দিলো। লজ্জায় নেতিয়ে গেলেও তোঁষা মুখ নামালো না বরং এক হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো আরহাম’কে। ওর প্রিয় পুরুষটার দিকে।
#চলবে….?
[গল্পটা কাল্পনিক। বাস্তবতার সাথে মিল খুঁজবেন তো হতাশ হবেন। ]