প্রিয় প্রাণ পর্ব-২২+২৩

0
439

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২২

আরহামে’র আজ সত্যি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিলো তাই কিছুটা সময় ব্যাস্ততায় কেটেছে তার ফলাফলস্বরূপ ফোন হাতে তোলার সময় পায় নি। নাহলে সে তার তুঁষে’র মিনিটের খবর ও রাখার চেষ্টা করে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো একটা বাজে। মিটিং সবে শেষ হলো। আরহাম ফোনটা হাতে তুলে প্রথমের সিসিটিভি ফুটেজ অন করে। নিশ্চিত তুঁষ’টা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। ভাবতেই মৃদু হাসে আরহাম যা মুহুর্তেই পরিবর্তীত হয়ে আতঙ্কিত রুপ ধারণ করলো। বিগত তিন ঘন্টায় তোঁষা’র করা আচরণ কোনমতে দেখে যেই না ভিডিও টানলো ওমনি আরহাম পাগল হয়ে গেলো। অসম্ভব ভাবে বুকে উঠানামা করছে তার। বিরবির করে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে স্ক্রিনে। অতঃপর পাগলের মতো দৌঁড়ে ছুটলো আরহাম।
কোনমতে গাড়িতে উঠেই স্টেরিং এ হাত রাখে ও। চোখে এখনও আটকে আছে তোঁষা। প্রচন্ড বেগে হাত কাঁপছে আরহামে’র। বিরবির করে বারংবার বলে যাচ্ছে,

— ত….তুঁষ, আমার তুঁ…ষ। তুই ক…কি করলি?

জোরে জোরে শ্বাস টানে আরহাম। কোনমতে স্টেরিং ঘুরালো। একসময় দিকবিদিক হারিয়ে ড্রাইভিং করলো। আগে পিছে কিছু না দেখে আরহাম শুধু গাড়ি চালালো। গাড়িটা বাসার সামনে পৌঁছাতেই দৌড়ে নেমে গেলো লিফটের কাছে। বাইশতলায় যাবে সে অথচ লিফট এটা এগারোতে আটকে। বা সাইডের লিফটেও ভিড়। পা চলছে না আরহামে’র। কোনমতে সে দৌড়ে লাগালো সিঁড়ি দিয়ে। বাইশ তলা! ঠিক বাইশ তলা সে দৌড়ে উঠতে উঠতে আর কিছু যেন মনে পরে না। দরজায় হাত থাপড়া দিয়ে ডাকতে লাগে,

— তুঁষ!! এই দরজা খোল! দরজা খোল প্রাণ। এই যে আমি। তুঁষ?

দরজা খুললো না কেউ। আরহামের মস্তিষ্ক হঠাৎ কিছুটা সজাগ হলো। তুঁষ কিভাবে দরজা খুলবে? চাবি কোথায়? নিজের বুক পকেটে হাতরায় ও। নাহ। নেই চাবি। কার্ড ও নেই। প্যান্টের পকেটে হাত দিতেই মিললো কাঙ্ক্ষিত জিনিস। হাত কাঁপার দরুন বারকয়েক চেষ্টা করে দরজা খুলে ও। অতঃপর এক দৌড়ে রুমের সামনে এসে ছিটকিনি খুলে দিলো। সম্মুখে তাকিয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পরলো আরহাম। মাথায় হাত দিয়ে আস্তে করে বললো,

— কি করলি এটা তুঁষ?

সারা রুম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তোঁষা’র বইগুলো। কোনটাই অক্ষত নেই। তোঁষা’র জেদ, রাগ সব তারা সহ্য করেছে। আরহাম এবার উঠে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে তোঁষা’র কাছে বসলো। হেলে পড়া তোঁষা’র দেহটা নিজের কম্পমান দেহের ভাজে তুলে নিতেই নজর গেলো তোঁষা’র বা হাতে। চুয়ে চুয়ে র*ক্ত বের হচ্ছে সেখান থেকে। আরহাম শব্দ করে না। ঘার কাত করে দেখে তোঁষা’র র*ক্ত। সাদা চামড়া ভেদ করে ঝরা র*ক্ত। সাদার মাঝে লাল। বেশ মানালো আরহামে’র নজরে। পাশ থেকে তোঁষা’র ওরনা তুলে র*ক্তাক্ত হাতটা পেঁচিয়ে ধরে বুকে চেপে ধরে তোঁষা’র দেহটাকে। কানে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে অভিযোগ জানায় অভিমানে টাইটুম্বুর কণ্ঠে,

— এটা কেন করলি প্রাণ? কি করলি এটা?
তুই আমার প্রাণের হেফাজত কেন করতে পারিস না?

ক্রমে ঠান্ডা হচ্ছে তোঁষা’র পাখিসম দেখটা অথচ হেলদোল নেই আরহামে’র। সে তার প্রাণ’কে বুকে নিয়ে বসে আছে। মাঝেমধ্যে কথা বলছে। অভিযোগ জানাচ্ছে নিজ স্বরে। সময় কাটলো। প্রায় সাত আট মিনিট। হঠাৎ ই পকেটে কিছু ভাইব্রেট হলো। আরহাম চোখ বড় বড় করে তাকালো। প্রচন্ড জোরে যেন ধাক্কা খেলো। নিজের বুকে তাকাতে নিজেই আঁতকে উঠল যেন। অগোছালো, নিঃস্প্রাণ তোঁষা তার বুকে। কখন, কিভাবে আরহাম যেন ভুলেই গেলো। সে ঠিক কতক্ষণ এভাবে তোঁষা’কে নিয়ে বসে ছিলো? না ভাবতে পারলো না ওর মস্তিষ্ক। বুক থেকে তোঁষা’র মুখটা সরিয়ে অস্থির হয়ে চিৎকার করে আরহাম,

— তুঁষ? এই তুঁষ? কি হয়েছে আমার প্রাণে’র? প্রাণ? তুই এভাবে কেন? উঠ!! উঠ না তুঁষ।

তোঁষা উঠে না। আরহাম উত্তেজিত হলো বহুগুণে। গুনগুন করে তার কান্নার শব্দ ও এলো। তোঁষা’কে বুকে তুলে একসময় শব্দ করে কেঁদে ফেললো সে,

— আ….আমার তুঁষ। আমার প্রাণ, তু…ই কি চলে গেলি? কথা…কথা বল না তুঁষ? এ…এই….

নিঃস্তব্ধতার ঘিরা ফ্লাট’টাতে পুরুষটার কান্না বিকট শুনালো। আরহামে’র মস্তিষ্ক তার সাথ দিচ্ছে না ঠিকঠাক। তোঁষা’র বা হাতটা চেপে ধরে সে উঠে দাঁড়ালো। টলমলে পায়ে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে।
________________

তুহিন পানির গ্লাসটা নিতে গিয়ে ভেঙে ফেললো। গলা শুকিয়ে গিয়েছে আজ বেশি। দৌড়ে রুমে ঢুকেন তোঁষা’র মা। স্বামী’কে বসে হাশফাশ করতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে তারাতাড়ি সামনে আসেন। তুহিন কাঁপা গলায় পানি চাইতেই তারাতাড়ি স্বামী’কে ধরে পানি পান করান তিনি। তুহিনের কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ওরনা’র কোণা দিয়ে তা মুছে দিলো তোঁষা’র মা। অল্প বিস্তর কুঁচকানো চামড়ার হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিতেই তুহিন দম ছাড়লেন। স্ত্রী’র মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিয়ংকাল। মায়াময় এক নারী অবয়ব। ছোট্ট সেই কিশোরী বউটা তার কবে যে এতটা বড় হলো? তুহিন উত্তর পান না। নিজের একটা হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলেন স্ত্রী’র গাল। আজও বড্ড নরম। অস্থির কণ্ঠে তোঁষা’র মা জিজ্ঞেস করলো,

— বেশি খারাপ লাগছে?

তুহিনের চোখে পানির ছলকানির দেখা মিললো। মানুষটা কাঁদে কেন? আর কত কাঁদবে? কেন ভাবে না তাদের কোন মেয়ে নেই? এটা কি আদৌ ভাবা যায়? এত সখের একটা শেষ বয়সের নাড়ী ঝাড়া সন্তান। কিভাবে ভুলবে? তুহিন ভাঙা গলায় বললো,

— পুতুলটা’র পরিক্ষা গেলো। সকাল থেকে কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাবলাম আসবে। এলো না। দেখ.. আমাকে দেখ। কত ক্লান্ত আমি। পুতুল কি ওর বাবা’কে ভুলে গেলো? আমি না অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। একে একে কত মানুষ এলো আবার চলেও গেলো কিন্তু আমার পুতুলটা এলো না। আচ্ছা ও কি ম’রে গেলো? মে’রে ফেলেনি তো? এতদিন তো কোথাও থাকতে পারে না। দেখ না কেমন ছটফট করে। কোথায় যে আছে পুতুলটা?

তোঁষা’র মা শক্ত করে স্বামী’র হাতটা ধরে। তুহিন নিজেই আবার বললো,

— ম’রে নি বোধহয়। আমার বিশ্বাস আরহাম লা’শ আনবে শেখ বাড়ীতে। বলো? আনবে না? নাকি লা*শটাও দেখাবে না আমাকে?

বলেই হু হু করে কেঁদে ফেললেন তিনি। তোঁষা’র মা শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নেন স্বামী’কে। চোখ উপচে পানি ঝড়ছে তারও।
দরজায় বাইরে দাঁড়িয়ে চোখ মুছেন তুরাগ। পাশেই তার স্ত্রী আর আদনান। সত্যি ই পুতুলটা বেঁচে নেই।
আজ তুহিন রাস্তায় পরে ছিলো। তুরাগ কল পেতেই ছুঁটে যান। কেন্দ্রের বাইরে গরমে জ্ঞান হারায় তুহিন। এক বাবা’র তৃষ্ণার্ত চোখ তার মেয়ের অপেক্ষায়। শেষ বয়সে পাওয়া এক অমূল্য রতন তার পুতুল। কোথায় যে হারালো?

_______________

সুবহে সাদিক সেরে সূর্য উঁকি দিলো ধরণীর বুকে। এক ধ্যানে তোঁষা’কে দেখছে আরহাম। ডান হাতে স্যালাইন চলছে ওর। হাতের উপরের চামড়া কেটে ফেলেছে তুঁষ’টা। বড্ড জেদী কি না? পরিক্ষা’র জন্য এমন করলো? কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আরহাম না এই পরিক্ষা?

তোঁষা চোখ খুললো দুপুর দিকে। চোখ খুলে প্রথমেই নজরে এলো আরহামে’র মুখটা। প্রতিক্রিয়া দেখালে না তোঁষা। তার মস্তিষ্ক তখনো ধরতে পারে নি। ঝাপসা চোখে দেখে যাচ্ছে তোঁষা। মনে পরে না কিছু। আরহাম হাত রাখলো তোঁষা’র মাথায়। আস্তে করে ডাকলো,

— তুঁষ?

— কে?

— আমি।

— আমি?

— চোখ বন্ধ কর তুঁষ।

তোঁষা চোখ বুজলো। মিনিটের ব্যাবধানে চোখ খুলে দেখলো। হ্যাঁ এবার চিনলো তোঁষা৷ আরহাম ওর সামনে। কথা বললো না তোঁষা। চুপচাপ দেখে গেলো আরহাম’কে। আরহাম ঢোক গিলে তোঁষা’র হাতটা ধরে। কপালে চুমু খেয়ে আদুরে ভাবে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। অভিমান ভর্তি গলায় বললো,

— এমনটা কেন করলি প্রাণ?

#চলবে…..

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৩

সকাল সকাল মর্নিং ওয়াকে বেরুলো তুষার। রাজশাহী যতটা গরম মনে হলো তার নিকট ঠিক ততটাও না। রাত থেকে ভোর পর্যন্ত বেশ ঠান্ডা লাগলো তার। এই যে এখন রানে যাচ্ছে তাতে কিছুটা র*ক্ত উষ্ণ হচ্ছে। এক রান দিয়ে থামলো না তুষার পরপর চার পাঁচটা রান দিলো একসাথে। সাথে থাকা বাকিরা সাথ ছেড়েছে সেই কখন অথচ তুষার তার দেহ ঝাঁকিয়ে দৌড়ে চলছে। কর্ণেল তাহের তার রান শেষ করে দেখে যাচ্ছে তুষা’রকে। কেন জানি তার বেশ লাগে ছেলেটাকে। গম্ভীর, স্বল্পভাষী এক পুরুষ। সুপুরুষের সকল লক্ষণ বিদ্যমান অথচ দোষে দোষী সে এক জায়গায় ই। বিয়ে করছে না। বিয়ে করলে এতদিনে মেয়ে ছেলে তার চু চু করতো অথচ এই ছেলে গোঁ ধরে বসে আছে। এবার তিনি ভাবলেন তার মেয়ের জন্য বলবে তুষার’কে। ফেরাতে পারবে না তুষার। তার কোনকথা না শুনে এমন হয়নি কখনো এবারেও তা হবে না এটা বিশ্বাস তার।

রান শেষ হতেই পানির বোতলটা হাতে তুললো তুষার। দুই ঢোক গিলতেই নজর গেলো পাশে। তথ্য জুনিয়র একজনের সাথে হেসে খেলে কথা বলছে। সচরাচর এই দৃশ্য চোখে পরবার নয়৷ তবে আজ যথেষ্ট সুযোগ নিয়ে কথা বলছে তথ্য। তুষার ততটা ঘাটলো না। হেটে নিজ গন্তব্যে চলে গেল সে দায়সারাভাবে। এদিকে তথ্য তখনও কথা বলে যাচ্ছে। হঠাৎ কেউ ডাক পাঠাতেই মুচকি হেসে চলে গেল ও। আশেপাশের অনেকেই কিছুটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তুষার বাদে এই প্রথম হয়তো কাজের বাইরে কারো সাথে এতটা কথা বললো তথ্য। ভাববার বিষয় এটা। গভীর ভাবনার বিষয়।

_______________

তোঁষা মুখ ফিরিয়ে পাশে তাকাতেই আরহামের চেহারাটা নজরে এলো। এক দৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে রইলো ও। সকাল থেকে কোন কথা বলা হয় নি এই পর্যন্ত। আরহাম চেষ্টা করে নি এমন না। করেছে তবে তোঁষা চোখ বন্ধ করে রেখেছিলো। এমনটা তোঁষা অনুভব করে নি বা শুনেছে কারো নাক টেনে কান্না’র শব্দ। শুনেছে। তবে না শুনার ভান ধরে পরে ছিলো বিছানায়। আরহাম যখন খাবার আনলো তখন চুপচাপ নিজ হাতে খেয়ে নিয়ে পুণরায় চোখ বুজে রইলো। আরহাম ডাকলেও উত্তর দেয় নি তোঁষা। হাতের দিকে তাকালো তোঁষা। স্যালাইন খোলা হয়েছে একটু আগে। আরহাম এবার তোঁষা’র কাছ ঘেঁষলো। তোঁষা একপলক দেখলেও কথা বললো না। যেই না আরহাম ওর হাতটা ধরলো ওমনি তা ঝামটা মে’রে ফেললো তোঁষা। আহত চোখে তাকালো আরহাম। ঢোক গিলে পুণরায় হাতটা ধরার চেষ্টা করলো। তোঁষা সুযোগ দিলো না বরং উঠে যেতে নিলো। আরহাম আটকে ধরলো নিজের সাথে। অসম্ভব ভাবে বুক কাঁপছে তার৷ তুঁষ’টা কথা বলছে না কতঘন্টা ধরে। মন যে আর মানছে না। শ্রবণ অঙ্গ দুটি পিপাসিত হয়ে আছে প্রাণে’র মুখ নিঃসৃত বাক্য শুনতে অথচ সে কথা বলছে না। কম্পমান স্বরেই আরহাম বললো,

— কথা বল না তুঁষ।

তোঁষা কথা বললো না বরং নিজেকে ছাড়াতে চাইলো। আরহাম ছাড়তে না চাইলেই সজোরে কামড় পরলো বুকের বা পাশে। “উফ” শব্দ করে ছাড়লো আরহাম। নিজের দিকে না তাকিয়ে তোঁষা’র পানে তাকায় ও। আকুল আবেদন জানায়,

— দয়াকর আমার উপর। কথা বল না তুঁষ।

— বাসায় দিয়ে আসুন আমাকে।

— ত…তুই…

— বলেছি বাসায় যাব। আমার প্রশ্নের উত্তর আপনি দিবেন না আরহাম ভাই। তাই বাসায় চলুন। ওখানে কথা হবে। কেন করলেন এমনটা?

শেষে চিৎকার করে উঠলো তোঁষা। নাকের পাটা ফুলে উঠলো আরহামে’র। তোঁষা পুণরায় চিৎকার করে জানতে চাইলো,

— কেন কেন? আমিই কেন? পরিক্ষা কেন দিতে দিলি না? বাসায় দিয়ে আসবি। এখনই দিয়ে আসবি। ধোঁকা!! আমাকে ধোঁকা দিলো? দিলো না পরিক্ষা দিতে।

চিৎকার গুলো কান্নায় রুপ ধারণ করলো। অল্প কাঁপলো আরহাম। তুঁষটা এভাবে কেন কাঁদে? আর “তুই”? এভাবে তো কখনো সম্বোধন করে নি আরহাম’কে। তাহলে আজ কেন?
আরহাম এগিয়ে এলো তোঁষা’র কাছে। ওর বা হাতটা আলতো করে ধরতে চাইলো তবে আজ হঠাৎ যেন তেঁতে উঠে তোঁষা। হাত পা ছুঁড়ে যখন কান্নায় ভেঙে পরলো তখন আরহাম এক দৃষ্টিতে দেখে গেলো। একা একাই আস্তে আস্তে বলতে লাগলো,

— এমন করিস না তুঁষ। ব্যাথা পাবি তুই। পরে কাঁদবি আবার। জেদ করে এত কেউ? আমার কাছে আয়। এদিকে আয়। তুঁষ? কথা শুন আমার।

তোঁষা’র কানে ও গেলো না কথাগুলো। রাগে মাথা ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম ওর। এদিকে আরহাম ঘাড় কাত করে ওকে দেখে যাচ্ছে। অনেকদিন পর এভাবে কাঁদতে দেখলো তোঁষা’কে। একবার হাসলো আরহাম। কান্না করে কত সুন্দর ভাবে। ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে হাসলো কিছুক্ষণ। তোঁষা ভীতু চোখে তাকালো ওর দিকে। অস্বাভাবিক লাগলো আরহাম’কে ওর নিকট। এমন করে কেন হাসছে? বিছানা থেকে নামতে চাইলেই আরহাম এক টানে নিজের বুকে নিলো তোঁষা’কে। হাসি নেই এখন মুখে। তোঁষা নিজেকে ছাড়াতে চাইলেই হঠাৎ নজর গেলো আরহামে’র হাতে। বড়সড় একটা ধাক্কা যেন ও এখানেই খেলো। তোঁষা’র মনে হচ্ছে ওর শরীর কাঁপছে। ঝাপসা চোখে তাকিয়ে রইলো সেখানটায়। ডান হাতটা বাড়াতে ও সঙ্কোচ লাগলো যেন। আরহামে’র হাতটা বুকে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ও। আরহাম এবার তোঁষা’কে ছাড়লো।
ওকে নিয়েই শুয়ে পরলো বিছানায়। আদর করে দিলো ওর তুঁষ’কে। ওর প্রাণ’কে। কত কাঁদে প্রাণটা ওর।
.
তোঁষা কাঁদছে। বরাবর মুখ করে শুয়ে আছে আরহাম। ওর বাহুর মাঝেই ওর প্রাণের ক্রন্দন সহ্য হয় না ওর। একহাত গালে ছুঁয়ে দিয়ে আরহাম তপ্ত গলায় বললো,

— আর কাঁদিস না প্রাণ।

— আমার কষ্ট হচ্ছে আরহাম ভাই। আপনি কেন এমন করলেন? উত্তর দিন আমাকে। আম্মু আমাকে বলতো আপনি আমাকে মে’রে ফেলবেন। আজ আমার মনে হচ্ছে আমার ভেতর কিছু একটা ম’রে গেলো। কে মা’রলো? আপনি।

তড়িঘড়ি করে তোঁষা’কে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বললো,

— তোকে মা’রার আগে আমার নিজের প্রাণ নিয়ে নিব আমি তুঁষ। ভুল ভাবিস না আমাকে।

— হাতে এসব কেন করেছেন বলুন? কিসের পাগলামি এসব?

আরহাম তোঁষা’র কানে চুমু খেলো৷ তোঁষা দমলো না। তার উত্তর চাই। আরহাম কেন নিজের হাতে এভাবে কেটেছে। কাটাছিটা গুলো পুরো তাজা। এসবের কারণ কি? তোঁষা ভেবে কুল পাচ্ছে না। যতই ভাবছে ততই আতলে হারাচ্ছে যেন। আরহাম ওর গলায় দিকে আগাতে নিলেই তোঁষা আটকালো৷ শক্ত গলায় বলে উঠলো,

— উত্তর দিন আমার। হাত কেন কেটেছেন এভাবে? আর কেনই বা আজ এমন করলেন? হয় উত্তর দিবেন নাহয় আজ আমি……

আরহাম বলতে দিলো না ওর তুঁষ’কে। আলতো চুমু দিলো ঠোঁটে। গরম শ্বাস পরলো তোঁষা’র চোখেমুখে। ঘন পল্লবগুলো কাঁপলো বুঝি। আরহাম কথা গুছালো। তোঁষা’কে গলাতে আগে আদর লাগিয়ে কথা বলতে হবে। মাইন্ড গেইম কে ভালো পারবে আরহাম থেকে। যেখানে পুরো তুঁষ’টাকে ওর চেনা সেখানে ওকে ম্যানুপুলেট করা সহজ বটে।
আরহাম তোঁষা’র কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,

— তোর হাতে যেমন ব্যাথা, আমার হাতেও তেমন ব্যাথা। তুই কষ্টে তো আমিও কষ্টে। তুই সুখী তো আমিও সুখী। তোর দেহ থেকে যদি র*ক্ত ঝড়ে তাহলে আমার দেহ থেকে ও ঝরবে।

ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে তোঁষা। ডান হাতে আরহামে’র গলা জড়িয়ে ধরা হাতটা ধরে বলে,

— আমার হাতে তো একটা কাটা। আপনি কেন এভাবে কেটেছেন? অনেক র*ক্ত বের হয়েছে না?

— উহু। একটু কষ্ট হয় নি এটাতে যতটা কষ্ট হয়েছিলো বাইশ তলা দৌড়ে উঠতে। যতটা কষ্ট হয়েছিলো তোকে ঐ অবস্থায় দেখে। যতটা কষ্ট হয়েছিলো তুই যখন আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইলি। যতটা কষ্ট হয়েছিলো তুই যখন কথা বললি না। যতটা কষ্ট হয়েছিলো তুই যখন তোকে ছুঁতে দিলি না। আরো হচ্ছে কষ্ট। এখনও হচ্ছে। কারণ তুই আমাকে বিশ্বাস করে উঠতে পারছিস না।

তোঁষা কথা বললো না। আরহাম ওর কপালে চুমু খেয়ে একটু ঝুঁকে বললো,

— আজ যদি তোকে নিয়ে বের হতাম কোনদিন ফেরত পেতাম না তুঁষ। তোর বাপ-চাচারা সব কেন্দ্রের আশেপাশে ছিলো। আমি একা কিভাবে তোকে নিয়ে ফিরতাম। তারা দিত না তোকে। আমার প্রাণ, তোকে পাওয়ার জন্য আজ স্বার্থপর হয়ে গেলাম৷ তুই কি এই স্বার্থপরকে ছেড়ে যাবি? আমি তো যেতে দিব না। আমার প্রাণ’কে পেতে আমি পাগলের খেতাম পেয়েছি। আমি নাহয় তোকে পেতে পাগল ই রইলাম।

তোঁষা তাকিয়ে রইলো আরহামে’র দিকে। ঠিকঠাক ভাবে বুঝে উঠতে পারে না আরহাম’কে। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো ওর গাল। মনমরা কণ্ঠে বললো,

— তারা তোমাকেও ভালোবাসে।

— বাসে না।

— সত্যি বলছি। চাচ্চু’কে কাঁদতে দেখেছি তোমার জন্য। একা ছাদে কাঁদে। কেউ দেখে না।

— ওসব ভুল দেখেছিস। তারা সবাই শুধু ছিনিয়ে নিতে চায় তোকে আমার থেকে। ধোঁকা দিয়েছে আমাকে। আদনানের সাথে তোকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। আমি ভুলি নি তুঁষ। ভুলব না কোনদিন।

— ভুলতে পারছি না।

— আমি ভুলিয়ে দিব সব। আমার হয়ে থেকে যা না প্রাণ। প্লিজ। তোকে ছাড়া আমি আরহাম কিভাবে বাঁচব?

তোঁষা ঝট করে আরহামে’র বুকে ঢুকলো। টিশার্ট’টা খাঁমচে ধরে গুনগুন করে বললো,

— মাফ করে দিন৷ রাগ করে বলেছি। কোথাও যাবে না তোঁষা। এখানেই থাকবে তার প্রাণে’র বুকে। আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি আরহাম ভাই। আপনার দেয়া কষ্টগুলো তাই সহ্য হয় না।

— বল শুধু আমার থাকবি?

— থাকব।

আরহামে’র কপাল কুঁচকে এলো কিছুটা। তোঁষা’র মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পরছে সাথে কেমন কেমন ঢোক গিলছে। ডান হাতটা দিয়ে খামচে ধরা হাতটা তীব্র হলো। আরহাম অস্থির হয়ে ডাকলো,

— তুঁষ? এই কি হয়েছে? কথা বল।

বিছানায় কাতরায় তোঁষা। মুখটা তুলে আরহামে’র গলার কাছে গুজে কেঁদে উঠলো শব্দ করে। কোনমতে বুঝা গেলো ওর মাথা ব্যাথা করছে। আরহাম ভয় পেয়ে যায় সাথে সাথে। এমনটা হওয়ার কথা তবে এত তারাতাড়ি না। পরক্ষণেই মনে হয় আজ তোঁষা’কে ইনজেক্ট করা হয় নি। উঠতে নিবে এমন সময় ই সেজোরে নিজের ব্যাথা কমাতে কামড়ে ধরে তোঁষা আরহামে’র ঘাড়ে। ঠোঁট কামড়ে ধরলো আরহাম৷ মুখটা ব্যাথায় যেন নীল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। তোঁষা’কে ছাড়াতে ছাড়াতে বলতে লাগলো অস্থির হয়ে আসা গলায়,

— ব্যাথা কমিয়ে দিব তুঁষ। এখনই কমিয়ে দিব। একটু ছাড়। এখনই কমে যাবে।

— আ…ম্মু আমার ম…মাথা ব্যাথা করে। আ…আরহাম ভা..আই। আমার মাথা….

কাতরাতে কাতরাতে এতটুকুই বললো তোঁষা।তোঁষা’কে ছাড়িয়ে উঠে যেতে যেতেই ধাম করে একটা শব্দ হলো। পিছু ঘুরতে ঘুরতেই আরহামের চোখ বড় বড় হয়ে এলো। এসব কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে?

#চলবে……

]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে