প্রিয় প্রাণ পর্ব-২০+২১

0
370

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২০

তোঁষা আরহামে’র বুকেই কেঁদে যাচ্ছে। কেন আরহাম ম’রার কথা বললো? আরহাম নিজেও বুঝে নি তোঁষা এতটা অস্থির হবে। বুকে প্রশান্তি অনুভব করে আরহাম। ওর তুঁষের ভালোবাসা কতটা গাঢ় তা আরহামে’র জানা। তোঁষা’র মাথাটা বুক থেকে সরাতে চাইলেই কান্নার বেগ বাড়লো। আরহাম থাকতে দিলো বুকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কোমল স্বরে বললো,

— কাঁদে না তুঁষ।

তোঁষা শুনলো না। সে কেঁদেই যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,

— কেন বললেন ম’রে যাবেন? কার জন্য আমি এত কষ্ট সহ্য করলাম। আমাকে আপনি ভালোবাসেন না। একটুও না।

শেষের কথাটা শুনতেই আরহামে’র বুকে জ্বালা ধরলো যেন। ও নাকি ওর তুঁষ’কে ভালোবাসে না? এটা কি ইহকালে সম্ভব?
তোঁষা’র দেহটাকে শক্ত করে নিজের মাঝে জড়িয়ে ধরে আরহাম। কানে আলতো চুমু খেয়ে জানায়,

— এই পৃথিবীতে আমার অস্তিত্ব যতটা সত্যি ঠিক ততটা সত্যি আমার ভালোবাসা তুঁষ। আমার ভালোবাসায় প্রশ্ন তুলিস না প্রাণ।

— আর বলবে?

— উহু।
___________________

সবে মাত্র টিম মেম্বারদের সাথে মিটিং শেষ করলো তুষা’র। আফ্রিকা’তে এই সপ্তাহেই ফোর্স পাঠানো হবে। দায়িত্ব অনেকটা তুষা’রের উপর পরাতে কিছুটা ব্যাস্ত সময় পার করছে ও। আপাতত ফ্রী নেই সে। তথ্য গত দুই দিন ধরে যদিও বারকয়েক এসেছিলো তবে তুষারের সময় হয় নি তার সাথে কথা বলার। গতকাল কর্নেল তাহের এসেছিলেন৷ তার সাথে কথা বলতে বলতে রাত দুটো বাজলো। তুষার বিরক্ত ছিলো বটে। আর্মি ম্যানরা সবাই যথেষ্ট সময়নিষ্ঠ সেখানে কর্নেল তাহের পুরোট উলটো। রাত দিনের কোন খেয়াল থাকে না তার। হৈ চৈ লাগিয়ে রাখেন ফোর্সের। দেখলে বুঝা দায় যে এই মধ্যবয়স্ক পুরুষটার বয়স বায়ান্ন। তারমাধ্যে তুষারের সাথে যেন ভাব তার জমে দই। তুষার আবার অতটা আড্ডা প্রেমী মানুষ না। এরমধ্যে এখনে থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করতে ও। আজ রাতে তার ব্যাঘাত ঘটলো। বিরক্তি ধরে গিয়েছে তুষা’রের। রাতের খাবার এখন কপালে জুটে নি। নিশ্চিত এতক্ষণে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।
টেন্ট ছেড়ে নিজের কামরায় যেতেই গরম ইলিশের ঘ্রাণ পায় তুষার। সরিষা ইলিশ? আনমনেই ভাবলো তুষার। এই আধ রাতে গরম ইলিশ তাও কি না সরিষার কোথা থেকে আসবে?
তুষার অতশত পাত্তা না দিয়ে ওয়াসরুমে চলে গেল। ফ্রেশ হওয়া দরকার।

এদিকে কিচেনে তথ্য তুষা’রের খাবার গরম করে সার্ভ করেছে টেবিলে। আজ কথা বলেই যাবে। বাবা আজ ধমকেছে তথ্য’কে। বিয়ে করিয়েই দম নিবেন তিনি। বাবা হিসেবে নিজের জায়গায় সে ঠিক তা জানে তথ্য কিন্তু অনিশ্চিত তুষার আর ভবিষ্যৎ নিয়ে কি ই বা জানাবে বাবা’কে?

তুষা’র টেবিলের সামনে অন্যমনস্ক তথ্য’কে দেখে চমকালো না। এই মেয়ের ঠিক ঠিকানা নেই। একদিন ধমক দেয়া দরকার। ভাবলো তুষার। তবে কেমন ভাবে ধমকটা সেটা ভাবতে পারলো না। গরম ভাত আর ইলিশ তাকে টানছে। সেই টানের মায়ায় পড়ে তথ্য’কে অগ্রাহ্য করে সোজা টেবিলে খেতে বসে ও। মুখে বড় বড় দুটো লোকমা পুরে একপলক তথ্য’কে দেখলো। মেয়েটা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ওর দিকে। কিছু কি বলতে চায় তাহলে? এতটা শান্ত থাকার মেয়ে আবার তথ্য না। তবুও তুষার আগে খাওয়া শেষ করলো। অতঃপর হাত মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলো,

— কিছু কি বলবে?

— জ্বি।

চোখে চোখ রেখে বললো তথ্য। সোজা হয়ে দাঁড়ালো তুষার। এত গম্ভীর মুখে কেন মেয়েটা?

— বলো? আচ্ছা আগে বসো। কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছো। আর হ্যাঁ খাবার গরম করার জন্য ধন্যবাদ তোমাকে তবে এসব আর করতে যেও না তথ্য অভ্যাস নষ্ট হয় আমার।

কথা বলতে বলতে তুষার সোফায় বসে। তথ্য ও এগিয়ে এলো তবে বসলো না বরং সম্মুখে দাঁড়িয়ে জানালো,

— বাবা ছেলে দেখেছে?

ভ্রু কুঁচকায় তুষার। ছেলে দেখেছে মানে? ওর বাবা ছেলে দেখুক বা মেয়ে দেখুক তাতে তুষারের কি? তবুও প্রশ্ন করলো,

— ছেলে দেখেছে বলতে?

— বিয়ের জন্য।

— হোয়াট!!!

আচমকা তুষা’রের চিৎকারে ছিটলে সরলো তথ্য। তুষার হতভম্ব মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। তথ্য ভাবলো তাহলে কি তুষা’রের মন গললো? সে ও কি ভালোবাসে তথ্য’কে? বাসেই তো নাহলে এভাবে রিএক্ট কেন করলো?
তবে এই ভাবনা বেশিক্ষণ টিকলো না তুষা’রের প্রশ্নে,

— তোমার বাবা ছেলে বিয়ে করবে?

— কিহ!!!

তথ্য ও এবার চিৎকার করে উঠলো। এত মাথামোটা কবে থেকে হলো তুষার? তথ্য চওড়া গলায় জানালো,

— পাগল হলেন? কি সব বলেন?

তুষার হেসে ফেললো ফিক করে। সোফাতে গা এলিয়ে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললো,

— ছেলে কি করে?

— পাইটল।

— হু বেশ মানাবে। পাইলটের বউ আর্মি৷ নট ব্যাড তথ্য। গো এহেইড।

তথ্য টলমলে চোখে তাকিয়ে রইলো। এতটা নির্বিকার কেন তুষার?

__________________

— আমার কলেজ ড্রেস কবে আনবেন?

আরহাম তোঁষা’র ইনসুলিনটা পেটের চামড়ায় পুশ করে উঠে দাঁড়ালে তোঁষা প্রশ্নটা আবার করলো। শ্বাস ফেলে আরহাম জানালো,

— আজ এনে দিব।

— কাল সকালে পরিক্ষা শুরু অথচ এখনও ড্রেস আনছেন না কেন? কবে থেকে বলছি আরহাম ভাই?

আরহাম তোঁষা’কে টেনে নিলো নিজের কাছে। ফোলা ফোলা গাল দুটো নিজের আজলায় নিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,

— আর কত আরহাম ভাই ডাকবি? কাজিন থেকে প্রেমিক হলাম। বর হলাম এরপর তো….

তোঁষা ডান হাত চেপে ধরে আরহামে’র ঠোঁটে। মুহুর্তে লজ্জায় রাঙা হলো ওর মুখটা। আরহাম হাসলো। লজ্জায় পড়া তুঁষটা তার পছন্দের।
.
খাওয়া শেষ হতে যেই না তোঁষা বই হাত তুলবে ওমনি আরহাম তোঁষা’র কাঁধে মাথা রাখলো। শুধু মাথা রেখেই ক্ষ্যান্ত হলো না তোঁষা’র চুলগুলো নিজের মতো নাড়াচাড়া করতে ব্যাস্ত হলো। তোঁষা অসহায় চোখ করে তাকায়। এমন করলে ওর সুরসুরি লাগে পড়বে কিভাবে? রিভাইস দেয়া তো বাকি। চাইলেও তোঁষা আটকাতে পারলো না আরহাম’কে। নিজের প্রাণ’কে কিভাবে আটকাবে তার প্রেম জাহির করা থেকে?
দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলো তোঁষা অথচ পারলো না। হার মানলো আরহামে’র কাছে। তার প্রেমের কাছে। নিজের অবাধ্য অনুভূতির কাছে। এসময় পুরোটা হারালো তোঁষা।
তার প্রেমিক পুরুষ তাকে মাতিয়ে নিলো নিজের মাঝে। বইটা অবহেলার রইলো বিছানার কিণারে যেটা বা হাতে নিচে ফেললো আরহাম।
অবহেলায় তা স্থান নিলো ফ্লোরে আর তোঁষা স্থান পেলো তার প্রাণে’র মাঝে অথচ মেয়েটার আগামী কাল সকালে এইচএসসি পরীক্ষা।

#চলবে…

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২১

তুষার থেকে কোন রুপ প্রতিক্রিয়া না পেয়ে মনঃক্ষুণ্ন হলেও তা প্রকাশ করতে চাইলো না তথ্য। তুষা’কে কোনদিন বলা হয় নি নিজের অনুভূতির কথা। ভালোবাসা বা পছন্দের কথা। তাই বলে কি তুষার বুঝে না? পুরুষ কি আর এতটা মাথামোটা হয়? এই যে তথ্য ওর পিছু পিছু ঘুরে বেড়ায়। এদিক ওদিক যেদিক ই যাক তথ্য ও চলে আসে। এসব সে কেন করে? ভালোবাসে বলেই তো। তাহলে তুষার নামক পুরুষটা এতটা নির্বিকার কেন? তথ্য জানে তুষা’র পরিবার নিয়ে আপাতত টেনসড তাই বলে কি তথ্য’কে একটুও আগলে রাখা যাচ্ছে না। একটা বার মুখে বলুক তাহলেই তো তথ্য বাবা’কে নয় ছয়ে দশ বুঝ দিতে পারে। তথ্য হাটতে হাটতে পাশের টেন্ট গুলোতে তাকালো। একটা টেন্ট এ লাইট অন দেখে পা বাড়ালো সেখানে। এতরাতে কারো জেগে থাকার কথা না। এরা সবাই ই সাধারণ সৈনিক পদে আছে।
তথ্য টেন্টে’র বাইরে থেকে নক করতেই রাফি নামক ছেলেটা বের হলো। ছোট ছোট জিরো সাইজ চুল করা, মোটামুটি হ্যাংলা একটা ছেলে অথচ লম্বা যেন তার আকাশ ছুঁয়ে দিবে এমন ভাব। তথ্য’কে দেখেই সে স্বাভাব বশত স্যালুট করলো। তথ্য সালামের উত্তর করেই বললো,

— এত রাতে জেগে আছো যে? ফজরের পর ট্রেনিং না? তখন ভুল হলে কর্নেল তাহের কিন্তু রেগে যাবেন।

রাফি শুকনো মুখে জানালো,

— সরি ম্যাম।

— ইটস ফাইন রাফি। গো।

রাফি দাঁড়িয়ে রইলো তথ্য না যাওয়া পর্যন্ত। তথ্য এক পা ঘুরেও ফিরে তাকালো। রাফি’র দিকে তাকিয়ে বললো,

— এনি প্রবলেম রাফি?

— নো ম্যাম।

— শিওর?

— ইয়েস ম্যাম।

— একটা কাজ করতে পারবে?

— ইয়েস ম্যাম।

তথ্য রহস্য হাসলো। ও জানে রাফি’র কোন একটা সমস্যা আছে। তথ্য এখন একটা সাধারণ ডিল করবে। এক রাফিকে হেল্প করবে বিনিময়ে নিজের কাজ করিয়ে নিবে।

__________________

তোঁষা আজ কিছুতেই ঘুমাচ্ছে না। আরহাম সেই কখন থেকে চেষ্টা করছে ওকে ঘুম পাড়াতে অথচ ওর নাকি ঘুম আসছে না। এত বলেও কাজ হচ্ছে না তবে আরহাম বিরক্ত হচ্ছে না। মোটেও না। ওর ভালেবাসে ওর তুঁষে’র এই ছোট ছোট জেদগুলো। তোঁষা’র অল্প ভেজা চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আরহাম বললো,

— একটু ঘুমা?

— টেনশনে ঘুম আসে না তো। জানেন না আপনি?

আরহাম জানে। তবে আজ যে তোঁষা’কে ঘুমাতেই হবে। লাস্ট তোঁষা’র পিএসসি পরিক্ষা তে আরহাম পাশে ছিলো বোর্ড পরিক্ষার মধ্যে। সেবায় কত কি ই না করলো আরহাম। সারাটা বাড়ী জাগিয়ে রেখেছিলো এই তুঁষ। মনে করলো আরহাম সেদিনকার কথাগুলো,

জেএসসি পরীক্ষা বলে টেনশনে তোঁষা কেঁদেছে একঘন্টা। সন্ধ্যা হতেই থেমে থেমে কাঁদছে। এই মেয়ে কষ্টে দুঃখে কাঁদে না সহজে। ও কাঁদে রাগে, জেদ করে অথবা টেনশনে। তুহিন মেয়েকে কোলে করে বিকেলে হেটে এলো। বাসায় রেখে আবার একটু বাইরে গিয়েছিলো এরমধ্যেই তুরাগ হাত ভর্তি জিনিস আনলো ভাতিজী’র জন্য। তোঁষা একটু ঘেটেঘুটে রেখে দিলো। বই হাতে নিয়েও বেশিক্ষণ রাখে না। সব পারে। কত রিভাইস দিবে। তুঁষা’র বোনকে আগলে কতকিছু বুঝালো। যখন বুঝালো তখন তোঁষা শান্ত অথচ এরপর ই ওর মাথা খারাপ হয়ে যায়। আদনান সন্ধ্যা হতেই তোঁষা’র পছন্দের খাবার নিয়ে বাসায় ঢুকে। দুই প্লেট ফুচকা এনেছে সে। টাকা পয়সা ছিলো না ততটা। তোঁষা নাক টেনে টেনে সবটা খেলো কিন্তু এরপর ও যখন কান্না থামে না তখন ওর মা রেগে গেলো। এগিয়ে আসতে নিলেই ওর চাচি কোলে তুলে নিজের কাছে নিয়ে গেলো। চাচির কাছেই রাগে ফুঁসেছে তোঁষা৷
এদিকে আরহাম বাড়ী ফিরে রাত নয়টার দিকে। হাতে দুটো ব্যাগ।
তোঁষাকে তখন রাতের খাবার খাওয়াতে চেষ্টা করছিলো ওর চাচি অথচ তোঁষা খাবে না। আদনান, তুরাগ ও কত চেষ্টা করলো লাভ হলো না।
আরহাম’কে দেখতেই তোঁষা দৌড়ে ওর কাছে আসে। হাঁটু ভেঙে ওর সামনে বসে আরহাম। গোল ফ্রক পরা তুঁষ’টা কেঁদে মুখ লাল করে আছে। আরহাম হাতের ব্যাগগুলো তোঁষা’কে দিয়ে বললো,

— কাঁধে আসবি?

— হু।

বলেই ব্যাগ হাতে আরহামে’র কাঁধে উঠে সে। কোথায় গেলো কান্না? কোথায় গেলো জেদ? দিব্যি নেচে কুঁদে আরহামে’র কাঁধে চড়ে বাড়ির চক্কর দিলো। ক্লান্ত আরহাম ওকে নিয়ে সোফায় বসতেই ব্যাগ হাতড়ে সব বের করে তোঁষা। পছন্দের পেন্সিল বক্স সহ স্কেল, রাবার, ব্যাগ সব বেগুনি রঙের। এটাই চেয়েছিলো তোঁষা তবে বাবা আনে নি। সে গোলাপি এনেছিলো বেগুনি পায় নি বলে।
খুশিতে চাচির হাতে খেয়েছিলো তোঁষা।

তুরাগ যখন খাবার টেবিলে আরহাম’কে জিজ্ঞেস করলো,

— এত টাকা কোথায় পেয়েছো?

— মার্কেটে দশ বস্তা টেনে দিয়েছি। পাঁচশত টাকা দিয়েছে।

সবার মুখ হা হয়ে যায় আরহামে’র কথায়। মাসে পকেট মানি দেয়া হয় দুই ছেলেকে। হয়তো শেষ করে ফেলেছে তাই বলে বাবা’র কাছে না চেয়ে তার ছেলে কি না বোঁঝা টানলো? পকেট মানি ও বেশিদিন টিকে না ওর। এটা ওটা এনে মা অথবা তোঁষা’কে দিবে।
ওর মা তারাতাড়ি ছেলের হাত দেখলেন। ফর্সা হাতের তালু দুটো লাল টুকটুকে হয়ে আছে। ছলছল চোখে দেখেন তিনি ছেলেকে। আরহাম তত কথা না বলে তোঁষা’র কাছে যায়। সেদিন সারাটা রাত তোঁষা’র কাছে বসে পড়া রিভাইস করালো আরহাম অথচ পিঠ, হাত ব্যাথায় জর্জরিত। দশ তলায় ভারী ভারী বস্তা গুলো উঠানো কি মুখের কথা?

সারারাত তোঁষা’কে নিয়ে থেকে একেবারে ওর কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়ে বাসায় আসবে আরহাম অথচ তোঁষা হাসিমুখে ঢুকার আগে বলে গেলো,

— আরহাম ভাই পরিক্ষা শেষ হলে একসাথে রসমালাই খাব।

— ডায়াবেটিস বেড়ে যাবে না?

— একদিন।

আরহাম কথা বলে না। অল্প হেসে সম্মতি জানায়। এত ভীরে বসার জায়গা নেই। তুহিনের তখনও বয়স কিছুটা। চাচা’কে বসার জায়গা করে দিয়ে দাঁড়িয়ে রয় আরহাম। দীর্ঘ তিন টা ঘন্টা দাঁড়িয়ে ই রইলো। ঠিক ততক্ষণে দাঁড়িয়ে যতক্ষণ না হাস্যজ্জ্বল মুখে দুই ঝুটি করা তুঁষ’টা দৌড়ে এসে বললো,”গোল্ডেন না আরহাম ভাই ডায়মন্ড আনব এবার”।
.
ভোরের পাখিরা উঠলো সবে তবে আরহামের বুকে থাকা পাখি’কা সজাগ চোখে তাকিয়ে তার দিকে। আরহাম ঘুমিয়ে কিছুক্ষণ আগে। তোঁষা আরহাম থেকে সরে উঠে নামাজে দাঁড়ায়। একটু পর আরহাম ও উঠে যায়।
তোঁষা উৎফুল্ল হয়ে বই হাতে বসে আছে। আরহাম এক পলক ওর দিকে থেকে কিচেনে চলে যায়। চুলায় দুধ বসিয়ে চুপচাপ নাস্তা বানায়। নিঃস্তব্ধতার চাদরে ঘেরা আজ পুরোটা ফ্ল্যাট। গুনগুনিয়ে শুধু তোঁষা’র পড়ার শব্দ।
আরহাম চুপচাপ এসে তোঁষা’কে ইনসুলিন পুশ করে দিলো। একটু পর খাবার ও খাওয়ালো তবে কথা হলো না। তোঁষা ঘড়ি দেখে আবার কলেজ ড্রেসটা ও পড়লো। চুলগুলোতে একটা বেণী করে পুরো রেডি হয়ে পুণরায় বই খুললো।
আরহাম শার্ট ইন করে কোর্ট পড়ে হাত ঘড়ি পড়ছে। তোঁষা পড়ার ফাঁকেই বললো,

— আরহাম ভাই?

— হু।

— আপনি কি ওখানেই থাকবেন নাকি চলে যাবেন?

— দেখ তো ঘড়ি’টা। পড়িয়ে দে।

তোঁষা বই রেখে ঘড়ি পড়াতে পড়াতে বললো,

— ভয় হচ্ছে একটু।

আরহাম কথা বাড়ালো না। তোঁষা ঘড়ি’টা ঠিক মতো পড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আরহামে’র বুক বরাবর ওর মাথাটা। আস্তে করে মাথাটা আরহামে’র বুকের বা পাশে রাখতেই দুই হাতে সাথে সাথে জড়িয়ে নিলো আরহাম। সেকেন্ডের ব্যাবধানে বাঁধনটা শক্ত হলো। তোঁষা’র মাথায় থুতনি রেখে আরহাম খুবই ক্ষীণ গলায় বললো,

— আমি আছি তো। ভয় কেন লাগে?

তোঁষা’র অশান্ত মনটা শান্ত হলো নিমিষেই। নাক, মুখ রাখলো আরহামে’র বুকে। সাদা শার্টে মুখটা ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,

— এটা বলতে এতক্ষণ কেন লাগলো? কেমন জানি লাগছিলো।

আরহাম তোঁষা’র ঘাড়ে হাত রাখতেই তোঁষা মুখ তুললো। সন্তপর্ণে চুমু খেল আরহাম তোঁষা’র কপালে। তোঁষা হাসছে। ভালোলাগে তার এই আদরটুকু। নিজেও আদর দিয়ে বললো,

— আজ পরিক্ষা শেষ হলে ঘুরব হ্যাঁ? আর বাসায় কি ফোন দিবেন একটু। কথা বলতাম আমি। না হলে শুধু বাবা’কে। আচ্ছা আচ্ছা বাবা’কে দিতে হবে না ভাই’কে দিন। ভাইয়ের সাথে কথা বলব। আচ্ছা বাবা’কে দিলে কি হবে? বাবা’কে ও বলি একবার।

একসাথে আবদারের ঝুঁড়ি খুললো তোঁষা। চোখ, মুখ লেপ্টে তার আশার প্রদীপ। এই প্রদীপের আলোয় সময়কাল জানা নেই আরহামে’র। না ই তোঁষা’র। খুব ধীরে তোঁষা থেকে নিজেকে ছাড়ায় আরহাম। ওকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললো,

— আজ একটা মিটিং আছে তুঁষ। গুরুত্বপূর্ণ বুঝলি?

— বুঝলাম।

— আজ তারাতাড়ি পৌঁছাতে হবে আমাকে।

— আমাকে দিয়ে চলে যাবেন।

— আমার ওয়ালেট টা দে তো।

আরহামে’র খাপছাড়া আচরণ বুঝতে অক্ষম তোঁষা। ওয়ালেট দিতেই আরহাম তোঁষা’র কপালে চুমু খেয়ে বললো,

— একটু বস আসছি আমি।

বলেই তোঁষা’কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আরহাম চলে গেল। দরজাটা বাইরে দিয়ে লক করে দিতে নিলেই তোঁষা উঠে দৌড়ে এসে দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে ডাকলো,

— আরহাম ভাই? আরহাম ভাই?

— হ্যাঁ তুঁষ আছি আমি। যাচ্ছি এখন।

— রুমের দরজা কেন লক করলে? খোলো। আমার ও লেট হবে।

— আমি আসব তুঁষ। অপেক্ষা কর।

— কতক্ষণ?

— বেশিক্ষণ না।
.
আরহামে’র সেই “বেশিক্ষণ না” কথাটা আজ ফললো না। তোঁষা অপেক্ষা করলো। দশটায় পরিক্ষা শুরু। এখন বাজে ঠিক নয়টা আটান্ন। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে আছে তোঁষা। আশার আলো ওর এখনও জ্বলছে টিমটিম করে। আরহাম ভাই বলেছে আসবে। তাহলে অবশ্যই আসবে। কোথায় যে গেলো? বললো তো গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। তোঁষা’কে নামিয়ে গেলেই তো হতো তাহলে তো তোঁষা এতটা টেনশন করতো না। বুকটা সমান তালে ধুকপুক করে যাচ্ছে ওর। তোঁষা’র অপেক্ষার পালা শেষ হয় না অথচ ঘড়িটা থমকে নেই সে আপন গতিতে চলে যাচ্ছে। তোঁষা এখনও ভাবছে আরহাম ভাই আসবে। এসেই অস্থির হয়ে বলবে, “তুঁষ জলদি আয় প্রাণ, লেট হচ্ছে”।
হলো না সেটা। দেখতে দেখতে দুই মিনিট পার হলো খুব শিঘ্রই। তোঁষা ঢোক গিললো একটা। দরজার পানে তাকালো একবার। না কেউ এলো না। ঘাড় কাত করে তোঁষা তাকিয়ে রইলো অপলক। ঠোঁট দুটো একসাথে আটকে আছে ওর। শুকনো ঠোঁটদুটো তিরতির করে কাঁপে তোঁষা’র। চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি পরলো টুপ করে। বুকের ভেতর চললো দামামা অথচ তোঁষা কিছু করছে না। দরজায় পিপাসিত চোখ এখনও কি তবে আরহামে’র অপেক্ষায়?

সময় থামলো না। দেখতে দেখতে পার হলো পাক্কা তিন ঘন্টা। এরমানে পরিক্ষা শেষ। হ্যাঁ শেষ পরিক্ষা। তোঁষা বড় বড় চোখ দিয়ে দরজা দেখছে এবার। আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে গিয়ে ডাকে,

— আরহাম ভাই?

উত্তর আসে না। নেই ওর আরহাম ভাই। বারান্দার দরজাটাও লক করা। খুলতে পারে নি তোঁষা। পারলেও কি হবে এই বাইশ তলার উপর থেকে?
ঘন ঘন নাক টানে তোঁষা। পুরো শরীর কাঁপছে ওর। একসময় চিৎকার করে আরহাম’কে ডাকলো সে। পাগলের মতো নিজের বইটা ছিঁড়ে ফেললো। একে একে সব বই ছুঁড়ে ফেললো আলমারি থেকে। এতেও ক্ষান্ত না তোঁষা। বইয়ের পাতা গুলোতে হামলে পড়ে ওর সকল রাগ। সমান তালে ফুঁপানোর শব্দ শুনা গেলো অথচ শুনলো না কেউ।পাগল প্রায় তোঁষা’র মস্তিষ্ক তখন কাজ করে না। চিৎকার করে ফ্লোরে পা দাপড়ে কেঁদে ফেললো সে।ক্ষণে ক্ষণে কাঁপে তার দেহ। পরণের ক্রস বেল্ট’টা টেনে খুলে ছুঁড়ে দিলো। একসময় পাগল হয়ে ড্রয়ার খুলে কিছু খুঁজলো। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি পেতেই তোঁষা বা হাত বরাবর তার খুবই সুক্ষ্ম ব্যাবহার করে দিলো। মুহুর্তেই খিঁচে যায় তোঁষা। ভীতু চোখে তাকায় আশেপাশে। ভীতর থেকে শরীর খিঁচছে তার।একসময় দেয়ালে হেলে পরে আরহামে’র প্রাণ।
আচ্ছা আরহাম কি জানে তার প্রাণে’র নাশ সে নিজেই ডেকেছে?

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে