প্রিয় প্রাণ পর্ব-১২+১৩

0
139

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১২

এই তো বেশি আগের কথা না। বছর কতক পূর্বে তোঁষা যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখনকার ঘটনা। স্কুলে রোজকার ন্যায় তুহিন ই আনতে যায় ওকে। তোঁষা ও নেচে-কুঁদে বাবা’র হাত ধরে বাসার পথে রওনা হয়। ঘটনা নিত্যদিনেরই কিন্তু তুহিনের একটা ভুল হয় এখানে। বাড়ী’র মোড়ে তোঁষা’কে নামিয়ে সে যায় অফিসে। কোন এক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিলো বোধহয়। তোঁষা হেলেদুলে পাশের ফুচকা’র দিকে গেলো আগে। বাসা থেকে কেউ ওকে একা ছাড়ে না। ভয় পায় যদি তোঁষা হারিয়ে যায়? তোঁষা’র আগে বিরক্ত লাগলেও বড় হতে হতে ব্যাপারটা বুঝে ও। বাড়ী’র একটামাত্র ছোট সদস্য তা ও কি না এক মাত্র মেয়ে হওয়ার দরুন সকলের এই উপচে পড়া ভালোবাসা। আজ সুযোগ পেয়ে কাজে লাগায় তোঁষা। দোকানে গিয়েই চটপটে গলায় বললো,

— মামা ঝাল দিয়ে ফুচকা দিন।

দোকানী চেনে তোঁষা’কে। শেখ বাড়ীর কন্যা বলে কথা। তিনি ঝটপট আগে তোঁষা’কে দিতেই পাশে থাকা চার পাঁচজন ছেলের একজন বলে উঠলো,

— কি মামা, আগে আমরা থাকা সত্বেও ললনা’কে আগে দিলা? নট ফেয়ার।

তোঁষা’র কানে কথাটা ঢুকতেই চিরবিড়িয়ে উঠে ওর নিউরনগুলো। তখনও ফুচকায় হাত লাগায় নি৷ অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে ছেলেটার দিকে তাকাতেই ছেলেটা মজা নিতে চাইলো,

— কি সুন্দরী, এভাবে তাকাও কেন? বুকে লাগে তো।

কথাটা বলেই বুকে হাত রাখে নিজে। পাশে মটকার উপরে রাখা স্টিলের গ্লাস। তোঁষা ছোঁ মেরে সেটা নিয়ই ছুঁড়ে মা’রে ছেলেটাকে। নিশানা একদম সঠিক কপাল বরাবর। ছেলেটা কপাল চেপে ধরে তোঁষা’র দিকে তাকায়। বাকিরা ঘটনার সূচনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তোঁষা রাগে লাল হয়ে ধমকে উঠে,

— কি রে বল এবার? কে ললনা তোর?

ছেলেটা তেঁড়ে যেই না তোঁষা’র কাছে আসবে তখনই কেউ ওর কলার চেপে ধরে পরপর নাক বরাবর ঘুষি মা’রে। পরপর দুই ধরণের শব্দ শুনা যায় তখন। প্রথমত ছেলেটার ব্যাথাকাতুর শব্দ দ্বিতীয়ত তোঁষা’র উচ্ছাসিত কন্ঠ। উৎফুল্ল তোঁষা বলতে থাকে,

— কিরে এবার বল সুন্দরী।

আরহাম ছেলেটা’কে বলার সুযোগ বুঝি দেয়? পরপর আঘাতে ছেলেটা নীচে পরতেই আরহাম তার বুকে আঘাত করতে করতে বলে,

— বল! বল! বুকে লাগে এবার?

আশেপাশে’র কেউ সাহস সঞ্চার করেও আরহামে’র ধারে কাছে যাওয়ার সাহস করতে পারলো না।
সেই ছেলেকে অবশেষে হসপিটালে ভর্তি রাখা হয় টানা দুই সপ্তাহ। তুরাগ কি বলবে ভেবে পায় না। কারণ ঐ দিন দুপুরে আরহাম তোঁষা’কে নিয়ে খুশি মনে বাসায় ফিরেছিলো। দু’জন’কে দেখে বাসার কেউ ই টের পায় নি এত বড় কান্ড ঘটিয়ে এসেছিলো তারা। দু’জন বেশ হাস্যজ্বল মুখে বাড়ী ফিরে সেদিন।
এমন হাজার ও ঘটনা আরহাম ঘটিয়েছে তোঁষা’কে ঘিরে। শুরুতে শুরুতে ব্যাপারগুলো স্বাভাবিক হলেও পরে আর স্বাভাবিক রইলো না। তোঁষা’কে ঘিরে ছোট্টখাট্ট ব্যাপারগুলোতেও আরহাম রোষপূর্ণ আচরণ করা শুরু করলো। কাউকে পরোয়া করা তখন পছন্দ ছিলো না ওর। বাসায় সবাই যা ই বলুক না কেন আরহাম কারো কথায় কর্ণপাত করে নি। বরং দিন কে দিন তোঁষা’কে ঘিরে তৈরি করেছিলো অদৃশ্য এক দেয়াল যা টপকানো বা ভাঙা কারো দ্বারা সম্ভব ছিলো না। শেখ বাড়ীর সকলে যখন ব্যাপারটা বুঝতে পারে ততদিনে তোঁষা, আরহামে’র সম্পর্ক গড়িয়েছে বহুদূর। হয়তো তারা তাদের অনুভূতি তখন গোছায় নি বা তোঁষা’র বুঝে ততকিছু আসে নি কিন্তু তোঁষা এটা বুঝে গিয়েছিলো তার জীবনের ব্যাপক এক স্থান জুড়ে আরহাম। যার বিরাজমান ব্যাতিত তোঁষা কল্পনা করতে পারে না নিজেকে।

বাসায় সবাই যখন দেখলো তোঁষা’কে নিয়ে আরহাম এর এই ওভার পসেসিভনেস ওদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে তখন তুরাগ ডেকে পাঠায় আরহাম’কে। নিজের বড় ছেলের প্রতি তার ভালোবাসাটা হয় তো সে ততটা প্রকাশ করতে পারে না তাই বলে এমন তো না ভালোবাসে না। আরহাম আসতেই তুরাগ বলে,

— দিন দিন এই অধপতনের কারণ টা কি আরহাম?

— কিসের কথা বলছো আব্বু? সেমিস্টারে টপ করেছি।

তুরাগ এবার রেগে যান,

— ফাজলামো হচ্ছে? জানিস না কিসের কথা বলছি? তোঁষা’কে ছাড়। ওর সাথে এত কি তোর? চাচাতো বোন লাগে। ব্যাস আর কিছু না।

— কোন বোন না ও আমার। চাচা জাত বোন শুধু।
ভালোবাসা আমার।

— পাগলামি বাদ দাও। ফাজিল ছেলে। তোমার এই পাগলামি মে’রে দিবে ওকে!

— ভালোবাসি আমি।

— ভুল ভালোবাসা এটা।

— তোঁষা’কে আমার চাই ই চাই।

কথাটা বলে নিজের রুমে গিয়ে ভাংচুর করে আরহাম। ওর মা ছুটে যান ছেলের রুমে। লাভ হয় না। দরজা লক করা ভেতর থেকে। তুরাগ সহ তুহিন, তোঁষা’র মা এসেও দরজায় কড়া নাড়েন। আরহামে’র সেদিনের গর্জনগুলো ছিলো রুহ কাঁপানো। ওর একেকটা হুংকারে যেন শেখ বাড়ীর দেয়ালে গুঞ্জন তুলেছিলো। তোঁষা কোচিং থেকে ফিরতেই চিৎকার চেচামেচি শুনে। গলাটা আরহামে’র। শুনতেই দৌড়ে হাজির হয় রুমে’র সামনে। তোঁষা’কে দেখা মাত্র ভয় পান তুহিন। তার ছোট্ট মেয়েটা’র উপর না প্রভাব পড়ে এসবের। সবাই ভেবেছিলো তোঁষা ভয় পাবে কিন্তু না। তোঁষা তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে শুধু দরজায় টোকা দিয়ে ডাকলো,

— আরহাম ভাই?

ব্যাস আর কোন গর্জন শুনা যায় না। সবটা নিমিষেই শান্ত হয়ে যায়। তোঁষা পুনরায় আবার বলে,

— দরজা খুলবেন না?

সেকেন্ডর ব্যাবধানে দরজা ও খুলে গেলো। আরহামে’র মা আর চাচি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই চমকে যান। ফ্লোর জুড়ে কাঁচ। আরহামে’র মা আঁতকে উঠেন ছেলে’র হাত দেখে। তোঁষা’র মা তারাতাড়ি হাতটা ড্রেসিং করে দিয়ে বুয়া ডাকেন রুম পরিষ্কার করতে। তোঁষা ভেতরে ঢুকে নি আর। এসব র*ক্ত সহ্য হয় না তার। তাও যদি হয় আরহাম ভাই এর।
তুরাগ, তুহিন বুঝেন আরহাম’কে সামাল দেয়া সহজ হবে না তাই তো সবচেয়ে নিকৃষ্ট পথটা বেছে নেন আরহাম’কে তোঁষা থেকে সরানোর।

__________________

— আজকে পেটে দিব।

আরহাম ভ্রু কুঁচকায়। তোঁষা’র বাহু টেনে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করে,

— হাতে কিছু হয়ে’ছে?

— হু। ব্যাথা।

আরহাম’কে মুহুর্তেই চিন্তিত দেখালো। তোঁষা মুখে থাকা চোরা হাসিটা দমিয়ে রেখে পরণে থাকা কুর্তি’টা উঁচু করলো অতি সামান্য। এতেই যেন আরহামে’র কিছু হলো। ধবধবে সাদা পেট’টা অল্প চর্বি যুক্ত। ঠিক যতটা না হলেই নয়। আরহাম বাজে ভাবে ফাঁসলো যেন। এই বুঁচি ওকে জ্বালিয়ে মা’রছে। কোন মতে দাঁত চেপে পেটে দুই আঙুল রেখে চামড়া উঁচু করতেই তোঁষা মুচড়ে উঠে। প্রচন্ড স্পর্শকাতুরে কিনা। আরহামে’র নিয়ন্ত্রণ রাখাটা এবার যেন কঠিন হলো বেশ। ধমকের স্বরে বললো,

— একদম সোজা দাঁড়িয়ে থাক তুঁষ।

তোঁষা মানলো। দাঁড়ালো সোজা। আরহাম অতিশীতল হাতে স্পর্শ দিলো তোঁষা’র পেটে। শিউরে উঠে এবার মোচড়া মোচড়ি করার সময় পেলো না তোঁষা। আরহাম দক্ষ হাতে পুশ করেছে। তড়িৎ বেগে তোঁষা’র কাপড় ঠিক করতেই দেখলো তোঁষা মুখ টিপে হাসছে। আরহাম ওরদিকে তাকিয়ে শ্বাস টেনে অসহায় গলায় বললো,

— জ্বালানোটা বেশি হয়ে যাচ্ছে না?

তোঁষা যেন অবুঝ সাজলো। বললো,

— মানে?

— জানিস না?

— না তো।

আরহাম কিছু বলার আগেই তোঁষা আজ তাড়া দিলো,

— যাবেন না? লেট হচ্ছে তো।

আরহাম ভ্রু কুঁচকায়। যেই মেয়ে পারলে ওকে টেনে নিজের কাছে রাখে সারাদিন সে আজ তাড়াচ্ছে?
অবশেষে তোঁষা’র কাছে বাধ্য হয়ে আরহাম চলে যায়। যাওয়ার আগে রোজকার ন্যায় তোঁষা’কে কিছু সীমাবদ্ধতা জানিয়ে যেতেও ভুলে না সে। তোঁষা মাথা নাড়ে শুধু। আরহাম যেতেই নিজের কাছে লেগে গেল তোঁষা। এতটা উৎফুল্ল এর আগে কখনো হয় নি ও। অথচ কাজটা করতে তোঁষা’র ভেতর ভেতর ধ্রীম ধ্রীম শব্দ করেই যাচ্ছে কিন্তু তোঁষা দমবার পাত্রী নয়। একবার যেটা চাই তা চাই ই চাই।

#চলবে…

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৩

রানওয়েতে ট্রেনিং চলছে নতুনদের। উচ্চপদস্থ অফিসার হিসেবে তত্বাবধানে তুঁষা’র এসেছে ভিজিটিং এ। ওকে দেখা মাত্রই অন্যান্য সৈনিক’রা অভ্যর্থনা জানালেন। তুঁষা’র তাদের সাথে বেশ কিছু সময় আলাপ করে লাঞ্চের জন্য সামনের দিকে হাটা দিলো। ওকে দেখা মাত্র ই তথ্য নিজের স্লটে’র কাজ থেকে বিরতি দিয়ে ছুটলো তুঁষা’রের পিছু। ও জানে এত মানুষের সামনে তুঁষা’রকে ডাক দেয়াটা ঠিক হবে না তাই দৌড়ে গিয়ে একদম সটান হয়ে ওর সম্মুখে দাঁড়ায়। তুঁষা’র ভ্রু কুঁচকায়। তথ্য এক পা সজোরে মাটিতে হিট করে স্যালুট জানাতেই অল্প হাসলো তুঁষা’র। বিনিময়ে জানালো,

— লাঞ্চ ব্রেকে কথা বলব।

তথ্য’র মুখে খুশির উজ্জ্বলতা দেখা মিললো। তুঁষা’র কথাটা বলেই পা বাড়ায় সামনে। পিছনে রয়ে যায় তথ্য’র তৃপ্তিময় শ্যামলা মুখটা যা রোদের তপ্ততায় এ রং ধারণ করেছে।
.
লাঞ্চ শেষ হতেই দরজায় নক হলো। তুঁষা’র অনুমতি দিতেই তথ্য দুটো কফি হাতে ভেতরে ঢুকে। হাসি মুখে এককাপ তুঁষা’রের কাছে দিতেই তুঁষা’র অভ্যাসবশত ধন্যবাদ জানায়। তথ্য ও বিনিময়ে হাসি দিয়ে আশেপাশে তাকালো। তুঁষা’র সময় নিয়ে দুই এক বার চুমুক বসিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,

— ঐ দিনের ব্যাবহারের জন্য দুঃখীত তথ্য।

— আরে ইটস ওকে স্যার?

— স্যার?

— আপনি না বললেন।

— তখন রেগে ছিলাম।

— এখন?

— নেই।

— আমি কি রাগ নামক এই টেনশন’টার কারণ জানতে পারি তুঁষা’র?

তুঁষা’র ভাবলো। গুমরে ম’রা থেকে শেয়ার করা উত্তম তবে বলার বা অভিযোগ কার বিরুদ্ধে থাকবে তার কথার মাঝে সেখানটাতে আটকে যায় তুঁষা’র। চাইলেও মুখ ফুটে প্রকাশ করতে ব্যার্থ হয় নিজের ভেতরে থাকা জ্বলন্ত আগুনের পিন্ডটা’কে। তুঁষা’রকে চুপ থাকতে দেখে তথ্য বুঝলো কিছু। প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করলো,

— তোঁষা কেমন আছে?

— পুতুল….

আনমনে তুঁষা’র কথা বলতে গিয়ে সামলে নিলো নিজেকে। কফি’র মগে চুমুক দিয়ে বললো,

— দুটো ভালোবাসা একসাথে আছে তথ্য।

______________________

লাল নেটে’র শাড়ীটা গায়ে জড়িয়েছে তোঁষা। কাজটা সহজ ছিলো না তার জন্য। বহু কষ্টে শাড়ী পড়ে এখন বসেছে সাজুগুজু করতে। ড্রেসিং টেবিলে’র ড্রয়ারে যাবতীয় সব রাখা। তোঁষা সাজ বলতে শুধু লাল টকটকা রং’টা ঠোঁটে লাগালো। কোমড় সমান চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে মাঝ বরাবর সিঁথি করতেই সজল চোখে আয়নাতে নিজে দেখলো। সলজ্জ ভঙ্গিতে নিজেকে দেখে হাসে তোঁষা। আজ আরহাম ভাই’কে পাগল বানিয়ে ছাড়বে ও। মনে মনে দীর্ঘ সংকল্প এটেছে তোঁষা। অপেক্ষা শুধু আরহামে’র।

রাত এখন প্রায় আটটা’র কাছাকাছি। ঘড়ি’র কাটা প্রায় রাত আট’টা ছুঁই ছুঁই। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তোঁষা’র বুকের ধুকপুকানি। যেটা একদম শিথিল হয়ে এলো যখন দরজা খোলার শব্দ কানে এলো। আরহাম এসেছে। তোঁষা এখন যেন সব উল্টেপাল্টে ফেললো। একবার ভাবলো দৌড়ে ওয়াসরুমে ঢুকে সব খুলে ফেলবে কিন্তু পরক্ষণেই কিছু মনে করে যেই না দরজা লাগাতে যাবে ওমনিই আরহামে’র আগমন ঘটলো।

লাল রঙা শাড়ীতে মোড়ানো এক অপসরী দাঁড়িয়ে আরহামে’র সম্মুখে। যার ওষ্ঠাধর লালে লালে লেপ্টে। কোমড় সমান চুলগুলো হেলেদুলে যেন বাতাসে মিশতে চাইছে। তোঁষা’র এই লাস্যময়ী রুপ দেখে আরহামে’র জানপ্রাণ উড়ে যাওয়ার উপক্রম যেন। কন্ঠনালী রোধ হলো। শ্বাস প্রশ্বাস হলো ধীমি। চক্ষু ভরা তৃষ্ণা নিয়ে আরহাম ভীতু ঢোক গিললো।
প্রাণঘাতী, প্রাণনাশী এই রুপে কাকে বলি দিবে তোঁষা? এই আরহামকে ই তো। ভয় পাওয়াটা নিশ্চিত স্বাভাবিক। তবে আরহামের হঠাৎ কিছু হলো। একটানে তোঁষা’কে রুমে থেকে বের করে দরজা আটকে জোরে শ্বাস টানলো। না আর সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই।

এদিকে তোঁষা বাকরুদ্ধ, হতভম্ব। কি হলো হঠাৎ? আরহাম কি তবে তাকে প্রত্যাখ্যান করলো? কিন্তু কেন? বিয়ের প্রথম রাতে আরহাম ই তো বলেছিলো যেদিন তোঁষা নিজেকে সমর্পণ করবে ঐ দিন যাতে এই লাল শাড়ী পড়ে। তবে আজ কেন এই প্রত্যাখ্যান? তোঁষা চোখ জ্বলে উঠে। তিরতির করে কাঁপন ধরে তার ঠোঁটে। একসময় ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ফেলে তোঁষা। তার মস্তিষ্ক তাকে বারংবার দংশিত করছে আরহাম থেকে পাওয়া প্রত্যাখ্যানের বিরহে।

#চলবে……

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৩(বর্ধিতাংশ)

রুমে’র দরজার বাইরে ঠাই দাঁড়িয়ে তোঁষা। ঠিক তেমনটাই যেমনটা আরহাম তাকে বের করার সময় ছিলো। শুধু পরিবর্তন এসেছে তার মুখের। চেহারায় ভাঙা এক অবস্থা। তার কান্নার কারণ দাঁড় করানো গেলো না। সবসময়ে জেদ ও রাগে কান্না করা মেয়ে’টা আজ কাঁদছে আরহামে’র জন্য। আরহাম থেকে ভালোবাসার প্রত্যাখ্যান পাওয়ার জন্য। ফর্সা মুখটা নিমিষেই লাল দেখালো। ঘন্টা দেড় এক হবে তোঁষা দাঁড়িয়ে এখানে। নড়ে নি ও। নড়বেও না। হঠাৎ ই খট করে দরজাটা খুলে গেলো। বেরিয়ে এলো আরহাম। তোঁষা’র মুখের দিকে তাকাতেই চমকালো সে। ভরকালো তোঁষা’র দশা দেখে। দ্রুত ভাবে এসে তোঁষা’র মুখটা নিজের হাতের আজলায় নিতেই ঝামটা মে’রে তা ফেলে দিলো তোঁষা। আরহামে’র বুকটা যেন ছ্যাঁত করে উঠলো। ঠিক যেন জলন্ত আগুনে পানি’র ছিটে দিলো। তবে আরহাম গায়ে মাখলো না। পুণরায় তোঁষা’র মুখ’টা আজলায় তুলে অস্থির কন্ঠে বললো,

— তুঁষ? এই? কি হয়েছে? আমার প্রাণ কাঁদছে কেন?

তোঁষা এবারেও একই কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটালো। ঝামটা মে’রে আরহামে’র হাত সরালো নিজের গাল থেকে। এই মুহূর্তে যেন আরহামে’র মাঝে কিছু হলো। তার নিউরনে চিড়বিড় অনুভূতি হচ্ছে। ঘাড় কাত করে দেখে আরহাম। চোখের দুই পাশে লাল দাগ ফুটে উঠে। বহু কষ্টে জিহ্বা পিঁষলো দাঁতের নিচে। নিজেকে মিনিটের মধ্যে ই নিয়ন্ত্রণ করলো এক অনিয়ন্ত্রিত পুরুষ। সবটা আড়ালে রইলো তোঁষা’র। সে দেখে নি। আরহাম’কে পাশ কাটিয়ে সোফায় বসে ফুঁপাচ্ছে। আরহাম পা ফেলে ঝটপট ওর কাছে এলো। হাঁটু ভেঙে বসলো নিচে। তোঁষা’র হাত’টা ধরতেই তোঁষা ছাড়াতে চাইলো। বিশেষ লাভ দেখা গেলো না। আরহাম শক্ত করে ধরেছে। কাতর গলায় জিজ্ঞেস করলো,

— আমার দোষ’টা বল। কেন কাঁদছিস?

তোঁষা কথা বললো না। আরহামে’র ও সহ্য হচ্ছে না এই কান্না। মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করতেই তার যেন কিছু মনে পরলো। মুহূর্তেই বুঝলো তোঁষা’র কান্নার কারণ। সাথে সাথে অধর কোন ঠেসে হাসি উপড়ালো তার। হাঁটু উঁচু করে হাত বাড়ালো। ছুঁয়ে দিলো তোঁষা’র গাল। জোর করে চোখ মুছে ফিসফিস করে বললো,

— আজ তোকে সারারাত কাঁদাব প্রাণ।

তোঁষা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। বুঝে নি এই কথার মানে। আরহাম তোঁষা’র বোকা চাহনি দেখেই বুঝলো তোঁষা বুঝে নি তার কথার গভীরতা। আজ গভীর হবে আরহাম। ঠিক ততটা গভীর যতটা গভীর ছিলো ভালোবাসা। আছে তার প্রাণের প্রতি।

সময় ঘুরলো বলে। ঝট করে তোঁষা’কে পাঁজা কোলে তুলে আরহাম। তোঁষা নামতে চাইলেই আরহাম ওকে কোলে নিয়েই একটা ঘুরান দিয়ে বললো,

— বুঁচি কান্না করার আগে দেখবি তো আদৌ কান্নার মতো কিছু হয়েছে কি না।

— আমাকে কে বের করলো?

— কেউ না।

— মিথ্যা।

— তুমি বের করো নি টেনে?

— কারণ দেখবি না?

তোঁষা এবারেও কিছু বুঝলো না। আরহাম ইশারায় কিছু বললো তাকে। তোঁষা খেয়াল করলো আরহামে’র চুল ভেজা। পরণে থাকা কাপড় ভিন্ন। সুন্দর এক পুরুষ দাঁড়িয়ে যার কোলে তোঁষা। আরহামে’র পরণে সাদা ধবধবে এক শার্ট যা খুবই ফিনফিনে সাথে সাদা প্যান্ট। ভেজা চুলগুলো আজ গোছালো না। বুকের দিকের দুটো বোতাম খোলা থাকার দরুন কিছুটা অংশ ফর্সা বুক দেখা যাচ্ছে। তোঁষা কি চুমু টুমু খাবে সেখানে? ভাবলো। তবে বিশেষ লাভ হলো না। ভাবতেই তার লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। আরহাম তোঁষা’কে নিয়ে দরজার কাছে এলো। তোঁষা’র চোখ মুখে ভর্তি প্রশ্ন। আরহাম উত্তর মুখে না দিয়ে করে দেখালো। এক পলিথিন ভর্তি গোলাপের পাপড়ি থেকে দুই হাত ভর্তি করে ছিটালো তোঁষা’র উপর। হঠাৎ এমন ঘন পাপড়িগুলো তোঁষা’কে পুলকিত করতে সক্ষম হলো। উপচে পড়া খুশি ওর মুখে। দুই হাতে মুখ ঢেকে উপভোগ করছে মুহুর্তটাকে। আরহাম এখানেই থামলো না তাজা টকটকে এক বড় গোলাপ হাতে হাঁটু গেড়ে বসলো তোঁষা’র সামনে যা তোঁষা’কে আরো অবাক করে দিয়ে আরহাম বললো,

— আজ আমার হবি প্রাণ?

তোঁষা নিজেও বসে পরলো আরহামে’র হাঁটু’র ভাঁজের উপর। দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে উচ্চারণ করলো,

— হু।

— কাঁদছিস?

— উহু।

অথচ তোঁষা কাঁদছে। এত বছরের কষ্ট, ক্লেশ যাতনাকে ভুলে আজ তাদের ভালোবাসা কি না পূর্ণ হতে চলছে। কমতো সহ্য করলো না। আজ যখন সব পেতে চলছে তখন কি আর চোখ বাঁধ মানে? উহু। মোটেও মানে না। তোঁষা’র ও মানলো না। আরহামে’র গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুধু বললো,

— সমর্পণ করলাম আজ।

ব্যাস আর কিছু বলা বা শুনার অপেক্ষা করলো না আরহাম। ওভাবেই কোলে তুললো তোঁষা’কে। তোঁষা তখনও ওর গলা জড়িয়ে। আরহাম পা বাড়ালো তাদের রুমের দিকে। তোঁষা যেন আরেকদফা চমকালো। ওদের রুম সাজানো কাঁচা ফুলে। বিছানায় ছড়ানো গোলাপের পাপড়ি। আরহাম তোঁষা’র অবাক হওয়া মুখটা দেখে হাসি মুখে বললো,

— ফুল ছাড়া কিভাবে বাসর হবে প্রাণ?

— আপনি কিভাবে জানলেন আজ….

তোঁষা’কে অতঃপর আর কথা বলার সুযোগ দিলো না আরহাম। আসার সময় ই আরহাম ফুল এনেছিলো। লজ্জায় নত করা মুখ থাকায় তোঁষা তখন দেখে নি। তবে আরহাম কিভাবে জানলো তা এখনও প্রশ্ন। নিজের প্রাণ’কে নিশ্চিত আরহাম এমন একা ফ্ল্যাটে রেখে যাবে না। না কোন ফোন বা যোগাযোগ মাধ্যম অথচ প্রতি মিনিট আরহাম নজর রাখছে ওর তুঁষে’র উপর। প্রতিটা খনের খবর জানা আরহামে’র। এই যে আজ তোঁষা এসব যা করেছে তা আগেই আরহাম দেখেছে। বুঝেছে। শুধু দেখে নি তোঁষা’র এই লাস্যময়ী রুপটাকে। যা সরাসরি দেখামাত্র থমকে গিয়েছে।
এই ঘন্টা খানিক সময় লাগিয়ে এসব ই করতো। বারান্দায় ছোট্ট করে একটা ক্যান্ডল লাইট করা। আজকের খাবারটাও বাইরে থেকে এনেছে আরহাম।
তবে আপাতত অতসব দেখার বা মনে করার সময় হলো না। দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক প্রেমময়ী যুগল ভুলে গেলো তাদের ক্ষুধা’র চাহিদা। তাদের বর্তমান চাহিদা’টা নিজেদের মাঝে। আরহাম তোঁষা’কে বুকে নিয়েই বিছানায় বসলো। এই প্রথমবারের মতো খুবই আলতো হাতে ছুঁয়ে দিলো তোঁষা’কে। তোঁষা বুঝি এতেই নেতিয়ে গেলো। আরহামে’র পুরুষ হাতের স্পর্শ কাঁপিয়ে তুললো তার বদন। মাতাল হলো তোঁষা। মাতাল করলো আরহাম। দেহ জুড়ে যখন তাদের প্রেম বইছে তখনই আরহামে’র প্রথম চুম্বনের আবেশে তোঁষা যেন ঘায়েল হলো। মৃত্যুশয্যা’য় যেতেও যেন রাজি এখন সে। আরহাম নিজেও নিয়ন্ত্রণ হারালো। এত বছরের ভালোবাসা সব ঢেলে দিলো তাদের প্রাণের মাঝে। তোঁষা বোধশক্তি হারালো সাথে হারালো আরহাম। দু’টি প্রাণে’র নাশ ঘটলো বুঝি এই রাতে।
.
আকাশে আজ সুতা’র ন্যায় চাঁদ। এমন লাল চাঁদের দেখা মিলে না সহসা। তবে আজ দেখা মিলছে। নতুন চাঁদে’র এই রুপটা আজ ভয়ংকর সুন্দর। যে কোন প্রেমোদগম বীজ বুননের সর্বোত্তম সময়। তোঁষা আরহামে’র ও তাই হলো। তারা নিজেদের আবিষ্কার করলো নতুন ভাবে। আরহামে’র উন্মাদনায় তোঁষা আজ দিকহারা হলেও তোঁষা’র নরম ছোঁয়ায় আরহাম পাগল হয়েছে। তোঁষা’কে সবটা দিয়ে আজ আরহাম নিজের করলো।
এই লাল চাঁদ’টা সাক্ষী তাদের মিলনের। এ কি সুখ বয়ে আনবে নাকি ধ্বংস তা জানে না কেউ। তবে কেউ কেউ তো বলে লাল রঙা চাঁদ ভয়াবহ দুঃখ বয়ে আনে? তবে কি তোঁষা আরহামে’র জীবনের ধ্বংসের অধ্যায় শুরুর পথে?
________________

সূর্যের দেখা মিলে নি এখনও। এই তো সুবহে সাদিক হতে চলছে। শেখ বাড়ীর সকলেই জাগ্রত। পুরুষ তিনজন নামাজে। আরহামে’র মা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে তোঁষা’র মায়ে’র কাছে এলেন। শরীর খারাপ ঐ যে হলো আর ঠিক হওয়ার নাম নেই তার। হবেই না কিভাবে? যার ঘরে’র কন্যা, বুকের মানিক তার কাছে নেই সে মা কিভাবে ঠিক থাকবে? অথচ বছরের পর বছর উনি ঠিক আছে। এই যে যার মাধ্যমে প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ পেলো। যে ছেলেটা জন্ম থেকে মায়ের ন্যাওটা সে এখন মা’কে দেখে না। চাইলেও কন্ঠ শুনা যায় না আরহামে’র। স্বামী’কে বললেই আগে বলতো,

— আদনান’কে দেখো। একই তো সুরত।

— বাবা কোনদিন মা হয় না। আমার চৌদ্দটা সন্তানের চেহারা এক হলেও তাদের মধ্যের ভিন্নতা আমি বুঝতাম।

বিনিময়ে তুরাগ কথা বাড়াতো না অথচ দিনে দিনে তিনি আদনান দিয়ে আরহামে’র স্বাদ মিটাচ্ছে।
আঁচলে চোখ মুছে রুমে ঢুকলেন তিনি। তোঁষা’র মা কাত হয়ে শুয়ে আছে। মাথায় হাত রাখতেই চোখ মেললেন। আরহামে’র মা’কে দেখেই ম’রা স্বরে বললেন,

— ভাবি আমার পুতুলটা…

এই কথা ছাড়া ইদানীং বিশেষ কিছু বলতেও পারেননা তিনি। কান্না পায় সারাটাদিন। টেনেটুনে তাকে উঠালো আরহামে’র মা। ধমকের স্বরে বললো,

— উঠ। একা রান্না করতে পারব না আমি। চল সাথে।

ঠেলেঠুলে উঠলেন তিনি। মেয়ের শোকে শোকে সংসার ত্যাগের উপক্রম যেন।
সেদিনের সিদ্ধান্ত’টা কতই না ভুল ছিলো। তারা ভেবেছিলো তোঁষা’কে আদনানে’র সাথে বিয়ে দিলে হয়তো আরহাম লজ্জা পাবে ভাইয়ের বউয়ের দিকে নজর দিতে। আর একবার বাচ্চাকাচ্চা হলে হয়তো ফিরেও তাকাবে না। অথচ এক সকালে আরহাম কল দিয়ে শুধু বলেছিলো,

— তোঁষা’র যদি চৌদ্দ বার ও বিয়ে হয় আর একশত বাচ্চা’র মা ও হয় তখনও আমার ওকেই লাগবে। ওর নেতানো, অন্য পুরুষের ছোঁয়া শরীরটাকেই নিব আমি। ওর লা*শ হলেও নিব আমি। ঐ লা*শ বিয়ে করে সংসার ও করব আমি।

কথাগুলো ভাবতেই যেন গায়ে কাটা দেয় তাদের। তোঁষা’টা কি বেঁচে আছে নাকি মে’রে ফেললো আরহাম?

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে