#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_নবম[প্রথমাংশ]
“যেই মেয়ের সম্মান নষ্ট করলেন। চরিত্রহীন প্রমাণ করলেন। সেই মেয়েকেই ছেলের বউ করতে চাইছেন, ছোট মামা?”
নয়নের কথা শুনে উপস্থির সবাই বিস্ফোরিত স্বরে তাকাল ওর দিকে। তারা বিয়ের আসরে বউ সেজে নিশ্চিন্তে বসে আছে। নয়নের কথা শেষ হতেই ফাহিম বলে উঠল,
“দেখ নয়ন, আজ আমার আর তারার বিয়ে। কোনো রকম সিনক্রিয়েট করার চেষ্টা করিস না।”
নয়ন রহস্যময় হাসল। হাসতে হাসতে বলল,
“বিয়ে! কার সাথে? তারার সাথে? একজন বিবাহিত মেয়েকে তুই কিভাবে বিয়ে করবি, ফাহিম?”
শেষ কথাটা শুনে ফাহিম বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। বিদ্যুৎ চমকানোর ন্যায় সবাই চমকে উঠল। ফাহিম চ্যাঁচিয়ে বলে উঠল,
“হোয়াট? বিবাহিত মানে?”
তারার কেন যেন খুব হাসি পাচ্ছে ফাহিমের মুখ দেখে। কিন্তু হাসছে না। খুবই শান্ত ভঙ্গিতে গাল দিয়ে বসে আছে। তনয়াও কিছু বলছে না। কারণ তনয়া আগের থেকেই সবটা জানত। সেদিন তারা বাসায় এসে তনয়াকে সব কিছু খুলে বলেছে। ফাহিমের পাশাপাশি রুবিনা বেগম ও প্রশ্ন করলেন,
“তারা বিবাহিত মানে? কিসব বলছিস?”
নয়ন কিছু বলার আগেই আহসান সাহেব বিরক্তি সূচক স্বরে বলে উঠলেন,
“দেখ নয়ন, সেদিন এক বিয়ে বাড়িতে অনেক কিছু হয়েছে। আমার সম্মানহানি হয়েছে। আজকে আর তোরা এমন কিছু করিস না, যেন আমার বাকি সম্মানটুকু ধুলোয় মিশে যায়। আমি আর এইসব সহ্য করতে পারছি না।”
নয়ন আহসান সাহেবের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াল। আহসান সাহেবের হাত দুটো ধরে বলে উঠল,
“আমাকে ক্ষমা করো, মামু। সেদিন আমার জন্যই সব হয়েছে। আমার জন্যই এতগুলো মানুষের সামনে তোমাদের সম্মানহানি হয়েছে৷ কিন্তু আজকে তোমার কোনো সম্মান নষ্ট হবে না। তোমার হারানো সম্মান তোমাকে ফিরিয়ে দিতে না পারি। কিন্তু কিছুটা বলেও চেষ্টা তো করতে পারি, বলো?”
আহসান সাহেব প্রশ্নোত্তর চোখে তাকাল৷ নয়ন পুনরায় বলে উঠল,
“আমার উপর একটু ভরসা রাখো, প্লিজ।”
আহসান সাহেবের কোনো ছেলে না থাকায় ছোট থেকেই নয়নকে ছেলের মতো স্নেহ, ভালোবাসা দিয়েছেন৷ তিনি নয়নকে যতটা বিশ্বাস, ভরসা করেন তা আর কাউকে করেন না। তাই নয়নের কথা ফেলতে পারলেন না। বললেন
“যা করার তাড়াতাড়ি কর। আমার এত সব ঝামেলা আর ভালো লাগছে না।”
নয়ন এবার তনয়াকে ইশারা করল কিছু৷ ইশারার সাথে সাথে তনয়া রুমের ভেতর দৌড়ে গেল। মিনিটের মাথায় সাথে করে ল্যাপটপ নিয়ে ফিরে এলো। ল্যাপটপটা এনে একটা চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করল। কয়েক মিনিটের মাথায় তনয়ার মুখে হাসি ফুটল। মাথা উঁচু করে নয়নের দিকে তাকাল৷ বলল,
“অল ডান।”
প্রতিউত্তরে নয়ন হাসল৷ উপস্থিত সবার মাঝে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। কেউ বুঝতে পারছে না এখানে কি হচ্ছে? মোস্তফা সাহেব অধৈর্য্যে স্বরে বললেন,
“নয়ন, তোর কাছে কি সময়ের দাম নেই? এখানে প্রত্যেকটা মানুষকে ডেকে এনে কি শুরু করেছিস? বাড়ির মানসম্মান কি তোরা আর রাখবি না?”
নয়ন হেসে উত্তর দিলো,
“মান সম্মানটা যেন থাকে তারেই ব্যবস্থা করছি, ছোট মামা। এক মিনিট অপেক্ষা করো।”
বলেই তনয়ার থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে সামনের একটা টেবিলে রাখল। তারপর সবার উদ্দেশ্য বলে উঠল,
“জানি আপনাদের সবার মনে অনেক প্রশ্ন। কেউ বিরক্ত হচ্ছেন। কেউ-বা মজা নিচ্ছেন। সেদিন যখন আপনাদের সবার সামনে এই বাড়ির মেয়ের সম্মানহানি হয়েছে, তখন কিন্তু আপনারা সবাই মজাই নিয়েছেন। আশেপাশের সবাই কম বেশি এত বছর ধরে তারাকে চিনেন। তারা কেমন মেয়ে কম বেশি জানতেন। অথচ সেদিন কিন্তু কেউ তারার হয়ে প্রতিবাদ করে নি। বরং তারার নামে বদনাম রটিয়েছেন। অবশ্য, আপনাদের দোষ দিব কিভাবে? সেদিন ঘটনাটাই এমন ভাবে ঘটেছে যে, না বিশ্বাস করে উপায় কোথায়?”
বলেই নয়ন একটু থামল। পুনরায় বলতে শুরু করল,
“আমরা সবসময় যা চোখে দেখি, যা কানে শুনি তার মাঝেও ভুল থাকে। সব চোখের দেখা সত্যি হয়না। সব কাজের পেছনে একটা করে উদ্দেশ্য থাকে। যেটা আমাদের চোখের আড়াল হয়ে যায়। আজকে আমি শুধু আড়ালে থাকা একটা সত্য তুলে ধরব আপনাদের সামনে। একটা মেয়ের হারানোর সম্মান ফিরিয়ে আনতে পারব না আমি জানিনা। কিন্তু আপনাদের কাছে অনুরোধ আজকে সত্যিটা জানার পর, দেখার পর কেউ তারাকে নিয়ে বাজে কথা রটাবেন না, প্লিজ। পারলে সত্যিটা কথাটা রটাবেন।”
বলেই ল্যাপটপের স্কীনে গিয়ে ভিডিওটায় টাচ করতেই ভিডিওটা প্লে হয়ে গেলো। ল্যাপটপের সাথে সাউন্ড বক্স সংযুক্ত করা ছিল। তাই ভিডিওটা প্লে হতেই উচ্চ স্বরে ভিডিও কথা গুলো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে মোস্তফা সাহেব রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছেন। তার পাশেই খাটের উপর ফাহিম বসা। শুরুতেই ফাহিম বলে উঠল,
“বাবা, তুমি তো সত্যিটা জানো। তাহলে তারাকে আমার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হলে কেন?”
ছেলের কথার প্রতিউত্তরে মোস্তফা সাহেব প্রশ্ন করলেন,
“কোন সত্যি জানার কথা বলছিস তুই?”
ফাহিম হাসল। হাসতে হাসতে বলল,
“তোমার ছেলেকে কি তোমার বোকা মনে হয়?”
মোস্তফা সাহেবও প্রতি উত্তরে হেসেই জবাব দিলেন,
“একদম না। আমার ছেলে একদম তার বাপের মতোই হয়েছে। আমার ছেলে জানে, নিজের ভাগ কি করে আদায় করতে হয়? যদি সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠে তাহলে আঙ্গুল বাকা করতে হয়।”
বলেই তিনি আবার হাসলেন। ফাহিম বিরক্তি সূচক স্বরে বলল,
“বাবা, যা জিজ্ঞেস করছি সেটার উত্তর দাও। বেশি কথা বলতে ভালো লাগেনা আমার।”
মোস্তফা সাহেব এবার উঠে দাঁড়ালেন। ফাহিমের সামনে দাঁড়িয়ে ফাহিমের কাঁধে হাত রাখলেন। বলতে শুরু করলেন,
“ছোটবেলা থেকেই বড় ভাইয়ের যেই জিনিসটা পছন্দ হতো। আমার কেন জানিনা সেই জিনিসটার প্রতি বড্ড হিংসা জন্মাতো। ইনিয়েবিনিয়ে যেভাবেই হোক আমি সেই জিনিসটা আদায় করে নিতাম। কিংবা নষ্ট করে দিতাম। এইযে গোটা বাড়িটা দেখছিস, এটাও বড় ভাইয়ের খুব পছন্দের। ব্যবসাটাও বড় ভাই খুব কষ্টে এত বড় করেছেন। সব কিছু নিজের করে নিতে পারলেও এই দুটো জিনিস নিজের করে নিতে পারলাম না। কতরকম চেষ্টা করলাম, তাও পারলাম না। হিংসা আর রাগের বশীভূত হয়ে যখন বড় ভাইকে মে’রে ফেলার চিন্তা মাথায় ঢুকল, তখনি জানতে পারলাম তুই তারাকে পছন্দ করিস। মাথায় নতুন বুদ্ধির উদয় হলো। তারাকে রপ্ত করে এইসব কিছু হাতানো খুব সহজ হয়ে যাবে। তাই ওইসব চিন্তা ভাবনা দূরে ঠেলে দিয়ে বড় ভাইকে তারার বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হলো না। আমি দমে যাইনি। তারাকে বিভিন্ন ভাবে হুমকি, ধমকি দিয়েও রাজি করাতে পারিনি। ওই মেয়ে বড্ড চালাক। কিছুতেই আমার ফাঁদে পা দিল না। তবুও হার মানলাম না। ধৈর্য ধরলাম। কারন তুই তো আমার ছেলে তাই আমি খুব ভালো করেই জানি, তুই তোর জিনিসটা ছলে বলে কৌশলে যেভাবেই হোক আদায় করবি। আর করলিও সেটা। এমন একটা চাল দিয়েছিস, যেই চালে সবাইকে বাজিমাত করে দিয়েছিস।”
ফাহিম সব কথায় কান না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করল,
“তুমি নাকি তারাকে ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছো? তুমি ভিডিও ব্যাপারে কি করে জানলে? আমি তো তোমাকে বলিনি। তাহলে?”
মোস্তফা সাহেবের মুখে আগের ন্যায় হাসি বজায় থাকল। বললেন,
“তুমি আমাকে ভিডিওর কথা বলোনি, ঠিক আছে। কিন্তু তুমি তো আমাকে সেদিন রাতের প্লানের ব্যাপারে বলেছিলে।”
ফাহিম ভাবুক স্বরে বলল,
“বলেছিলাম। কিন্তু তুমি তো সেদিন আমার সাথে হাত মেলাতে রাজি হও নি। তোমাকে তো আমি ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে রাজি করিয়েছিলাম।”
ফাহিমের কথা শুনে মোস্তফা সাহেব উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন,
“যতই হোক তুমি আমার ছেলে। আমি যদি তোমার প্রস্তাবে একেবারেই রাজি হয়ে যেতাম, তাহলে ব্যাপারটা ভালো দেখাতো না৷ ছেলের কাছে নিজের রেপুটেশন ধরে রাখার জন্য একটু নাটক করেছিলাম। এই যা।”
বলে আবার হাসতে শুরু করলেন। ফাহিম হাফ ছাড়ল। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে উঠল,
“মাই গুডনেস। তুমি তাহলে সেদিন তারার সাথে আমার ছবি তোলার সময় আমার ফোন থেজে ভিডিওটা দেখেছিলে?”
মোস্তবা সাহেব হাসতে হাসতে ফাহিমের কাঁধে কয়েকবার চাপড় মা’রতে মা’রতে বললেন,
“সাব্বাশ বেটা! এইজন্যই তো বলি, তুমি আমার ছেলে। এক চান্সেই কি সুন্দর বুঝে গেলে। তুমি তো তারাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসো৷ তুমি যে কোনোদিনেই তারার ভিডিওটা ভাইরাল করবে না আমি জানি। শুধুমাত্র তারাকে ভয় দেখানোর জন্য ভিডিওটা করেছো এটাও আমি বুঝতে পেরেছিলাম। তাই সেদিন ভিডিওটা দেখার সাথে সাথে আমি আমার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে রেখেছিলাম। তারা সেদিন এতকিছুর পরেও সবটা নিজের মুখে স্বীকার করতে চাইছিলো না৷ তাই আমিই সবার আড়ালে ওকে বাধ্য করেছিলাম সবকিছু স্বীকার করতে। ভিডিওটা নিয়ে তখনি হুমকি দিয়েছিলাম। বুঝেছো?”
ফাহিম সব শুনে বলে উঠল,
“তুমি কাজটা একদম ঠিক করো নি, বাবা। ভিডিওটা এক্ষুনি ডিলিট করো আমার সামনে। আমি চাইনা তারার কোনো ক্ষতি হোক। তারার যতটুকু সম্মান আমি নষ্ট করেছি, ততটুকু ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিব। খবরদার তারার কোনোরকম ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না। তাহলে আমি ভুলে যাব, তুমি আমার বাবা।”
ভিডিওটা শেষ হতেই বিয়ে বাড়ি জুড়ে সুনশান নিরবতা বয়ে গেলো। আহসান সাহেব দাঁড়ানো থেকে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। তারার চোখের কোনে পানি। আহসান সাহেব বসে পড়তেই তারা দৌড়ে এলো। হাটু ভেঙে বাবার সামনে বসে ছলছল চোখে বলে উঠল,
“আমি খারাপ, চরিত্রহীন, নোংরা মেয়ে না, বাবা।”
#চলবে
#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_নবম[শেষাংশ]
বিয়ে বাড়িতে আনন্দের বদলে ছেয়ে আছে নিস্তব্ধতা। বউ সেজে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা। পাশেই তনয়া তারাকে শক্ত করে ধরে দাঁড়ানো। তনয়ার বিয়ে হয়েছে আজ দুদিন হলো। এই দুদিনের ব্যবধানে আজ তারা আর ফাহিমের বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে৷ বাড়ির সবাই যে যার মতো স্থির হয়ে দাঁড়ানো। কেউ কোনো রকম কথা বলছে না৷ মোস্তফা সাহেবের চোখেমুখে ভয়। আহসান সাহেব মোস্তফা সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়াতেই মোস্তফা সাহেব আমতা আমতা করে বলে উঠলেন,
“এসব কিছু মিথ্যা, ভাই। আ…।”
আর কিছু বলার আগেই আহসান সাহেব জোরে থাপ্পড় মে’রে বসলেন তার গালে। বলতে লাগলেন,
“তোকে আমার ভাই বলতেও লজ্জা লাগছে। আমার রক্তের ভাই হয়েও তুই আমার পেছনেই ছু’ড়ি মা’রলি? কী করে পারলি তুই এইসব করতে? আচ্ছা ধরে নিলাম, তোর আমার সাথে শত্রুতা। কিন্তু আমার মেয়েটার কী দোষ ছিল রে? কেন আমার জন্য আমার মেয়েটাকে বলি দিলি? আমার এইটুকু মেয়েটাকে সবার সামনে কেন লাঞ্চিত করলি? আমার সব বিশ্বাস, ভরসা এভাবে কেন ভেঙে দিলি? আরে তুই আমার ভাই। আমার থেকে হাসি মুখে আবদার করলে আমি তোকে আমার জানটাও দিয়ে দিতাম। তুই যদি এসব না করে, আমাকে মে’রে ফেলতি তবুও আমার এতটা কষ্ট লাগতো না।”
আহসান সাহেব আর কিছু বলতে পারলেন না। ভাইয়ের করা বিশ্বাসঘাতকা তাকে কষ্টে অসাড় করে দিচ্ছে। রুবিনা বেগম স্বামীর পাশে এসে আকঁড়ে ধরলেন তাকে। মোস্তফা সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,
“কী করে এতটা নিচে নামতে পারলে তুমি? আমার মেয়ের সাথে যা যা হলো এসব যদি তোমার মেয়ের সাথে হতো, কী করতে তুমি? একটাবার ভেবে দেখেছো? আমার তো তোমার প্রতি ঘৃণা না করুণা হচ্ছে। যে তুমি আসলে মানুষ হয়েও অমানুষ হিসেবে পরিচিতি পেলে। ছিহ!”
তিনি আহসান সাহেবকে ধরে নিয়ে চেয়ারে বসালেন। মোস্তফা সাহেব উপায়ন্তর না পেয়ে আহসান সাহেবের সামনে গিয়ে হাত জোড় করে বলতে লাগলেন,
“আমাকে ক্ষমা করে দাও, ভাইজান। আমি ভুল করে ফেলেছি। শেষ বারের মতো আমাকে ক্ষমা করে। আমি তোমার পায়ে পড়ছি।”
বলেই তিনি আহসান সাহেবের পা জড়িয়ে ধরল। আহসান সাহেব চিৎকার করে নয়নের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“নয়ন, ও’কে আমার চোখের সামনের থেকে নিয়ে যা। ওর জন্য যথাযথ শাস্তি হয় তার ব্যবস্থা তুই করবি। এত বছর ধরে করে আসা সব অন্যায়ের শাস্তি পাবে ও। এক্ষুনি নিয়ে যা ও’কে।”
নয়ন পেশায় একজন পুলিশ অফিসার৷ তাই আগের থেকেই নিজের ফোর্স তৈরি করে রেখেছিল। আহসান সাহেব বলার সাথেই সাথেই নয়নের ইশারায় একজন এসে মোস্তফা সাহেবের হাতে হ্যান্ডকাফ পড়ালো। মোস্তফা সাহেবের কোনো আকুতি-মিনতি কেউ শুনল না। ফাহিম কিছু বলছে না। ওর মুখে ভয় বা অনুতাপের কোনো চিহ্ন নেই। ওর বাবাকে যে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে সেদিকেও ওর খেয়াল নেই। রিমা বেগম এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলেন। স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছেন দেখেও চুপ করে আছেন। তার বলার কিছুই নেই। আজ থেকে তার পরিচয় একজন অপরাধীর বউ। নানারকম ভাবনায় বুকের ভেতরটা যন্ত্রণা করছে।মোস্তফা সাহেবকে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি, মোস্তফা সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কান্নারত স্বরে বলে উঠলেন,
“এর থেকেও বড় কোনো শাস্তি হওয়া উচিত ছিলো তোমার। তোমরা বাপ, ছেলে এত নিচে নেমে গেলে! আমাকে তো সারাদিন কথা শুনাতে আমি নাকি তারাকে সহ্য করতে পারি না। তারাকে তো আমি শুধু সহ্য করতে পারিনা ও মুখে মুখে কথা বলে তাই। তারা তো আমার আপন কেউ না। আমার রক্তের কেউ না। আমি তারাকে সহ্য করতে পারি না বলে, ওর খারাপ চাইনি কখনো। কোনোদিন চাইনি। কিন্তু তুমি তো বলতা তারা নাকি তোমার মেয়ে? তাহলে যাকে মেয়ে ভাবো তার সাথে এতটা নিচু কাজ কিভাবে করতে পারলা?”
মোস্তফা সাহেবের চোখ টলমল করছে। অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে বলে উঠলেন,
“আমাকে ক্ষমা করো পারলে।”
যাওয়ার সময় তারার সামনে পড়তেই, হাত জোড় করে অনুতাপের স্বরে বললেন,
“এই অধম অপরাধীকে পারলে ক্ষমা করে দিস, মা।”
তারা প্রতিউত্তরে কিছু বলল না৷ চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইল। মোস্তফা সাহেবকে নিয়ে যেতেই রিমা বেগম গিয়ে দাঁড়ালেন ফাহিমের সামনে। বললেন,
“তোকে আমার ছেলে ভাবতেও লজ্জা করছে৷ এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোকে? অবশ্য, তোকেই বা কি দোষ দিব? যার বাবা এতটা নোংরা মানসিকতার সে ভালো হবে কী করে?”
ফাহিম এতক্ষণের সবকিছুতে বেশ বিরক্ত। ও অপেক্ষা করছে কখন ওর আর তারার বিয়েটা শুরু হবে। চোখে মুখে বিরক্তিকর ভাব এনে বলে উঠল,
“উফফ! মা! তোমার এইসব আজাইরা ক্যাচাল বাদ দাও। আর এখানে কি নাটক হচ্ছে? বাড়ি ভর্তি আত্মীয়-স্বজনদের সামনে কি নাটক শুরু করছো তোমরা? এতক্ষণ অনেক নাটক হয়েছে। এবার নাটকের হ্যাপি এন্ডিং হবে। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন সবাই এসব বাদ দাও। তারা আর আমার বিয়ে আজকেই হবে। কেউ আটকাতে পারবে না।”
ছেলের কথা শুনে রিমা বেগম প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। রাগে শরীর শিরশির করে উঠল তার। চ্যাঁচিয়ে বললেন,
“তুই এত বড় অন্যায় করে এখনো মাথা উঁচু করে কথা বলছিস?”
“মাথা নিচু করার মতো কোনো কাজ আমি করিনি তো, মা।”
ফাহিমের কথা শেষ হতে না হতেই রিমা বেগম ফাহিমের গালে কষিয়ে থা’প্পড় বসিয়ে দিলেন। বললেন,
“একটা মেয়ের সম্মানে হাত দিয়েছিস তুই। মেয়েটাকে চরিত্রহীন প্রমাণ করেছিস৷ সবার সামনে এই বাড়ির সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিস। এতকিছুর পরেও বলছিস তুই কিছু করিসনি। কোন ধাতু দিয়ে তৈরি তুই?”
ফাহিমের মধ্যে কোনোরকম হেলদোল দেখা গেলো না৷ সে সোজাসাপটা উত্তর দিলো,
“আমি তারাকে ভালোবাসি। যা করেছি সব ভালোবেসে করেছি। যা করেছি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে পাওয়ার জন্য করেছি। ব্যস!”
রিমা বেগম ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন। এ ছেলেকে বুঝানোর সাধ্য তার নেই। এবার মুখ খুলল তারা। ফাহিমের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,
“ভালোবাসেন আমাকে, তাইনা?”
ফাহিম অকপটে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ, ভালোবাসি।”
উত্তর শুনে তারা হাসল। পরক্ষণেই ফাহিমের গালে থা’প্পড় বসিয়ে দিলো। উচ্চস্বরে বলে উঠল,
“ভালোবাসেন! লাইক সিরিয়াসলি! যাকে ভালোবাসেন তার সম্মান নষ্ট করতে না, বাঁচাতে শিখতে হয় আগে। আপনার মতো নোংরা, সাইকো মানুষ শুধু নিজের স্বার্থ বুঝে। অন্য কিছু না। আপনি আমার সাথে সাথে আমার পরিবার, আমার বাবার সম্মান ও নষ্ট করেছেন। আপনাকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করব না। কোনো দিন না। মৃত্যুর আগে অব্দি আপনার দেওয়া প্রত্যেকটা কষ্ট আমি মনে রাখব। আপনার দেওয়া আঘাতটা আমার রুহ অব্দি কাঁপিয়ে দিয়েছে। তাই আমি ক্ষমা করলেও আমার রুহ আপনাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না। কোনোদিন না।”
কথাগুলো বলতে বলতে তারা ডুকরে কান্না করে উঠল। হাটু ভেঙে নিচে বসে পড়ার আগেই এক জোড়া শক্ত হাত ধরে ফেলল। যত্ন সহকারে বুকে টেনে নিলো। মাথায় হাত রাখল। তারা যেন এই আশ্রয়টাই খুঁজছিল। আপন নীড় পেয়ে স্বস্তি পেলো। নয়নের বুকে তারাকে মাথা রাখতে দেখে ফাহিমের আঁখি জোড়া আগুনের ন্যায় ধারণ করল। ফাহিম হেঁচকা টানে তারাকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করল। কিন্তু তার পূর্বেই নয়ন ফাহিমের হাত ধরে ফেলল। শান্ত স্বরে বলল,
“আমার বউকে টাচ করার দুঃসাহস করিস না। ফলাফল খুব খারাপ হবে।”
বলেই ফাহিমকে ধাক্কা মে’রে দূরে সরিয়ে দিলো। ফাহিম রক্তচক্ষু নিয়ে চ্যাঁচিয়ে বলল,
“তারা আমার। শুধু আর শুধুমাত্র আমার৷ আমার তারাকে এক্ষুনি ছেড়ে দে, নয়তো এখানে তুলকালাম হয়ে যাবে।”
নয়ন সাথে সাথে জবাব দিলো,
“অনেক সিনক্রিয়েট করেছিস। সবার সামনে আর সিনক্রিয়েট করিস না৷”
তারপর তারাকে শান্ত করে দাঁড় করাল। সবার উদ্দেশ্য বলতে লাগল,
“আপনাদের সবার সিনেমা দেখার টাইম এখানেই শেষ। আমাদের পারিবারিক ব্যাপার আপনাদের সামনে নিয়ে আসার কোনোরকম উদ্দেশ্য আমার ছিল না। শুধু এনেছি একটা মেয়ের সম্মানে যেই কালি লেগেছে সেই কালির দাগটা যেন একটু হলেও হালকা হয় তাই৷ আশা করি, ভিডিওটা দেখে আপনারা সত্যি, মিথ্যার প্রার্থক্য বুঝতে পেরেছেন। না বুঝলেও সমস্যা নেই। আপনাদের বুঝা না বুঝায় আমার বা আমার পরিবারের কিছু আসে যায় না৷ আর একটা কথা, ‘তারা আমার বউ’। এখন আমাদের কবে, কোথায় বিয়ে হলো? কি করে হলো? এসব আপনাদের জানাতে ইচ্ছুক নই আমরা। যেটুকু জানার দরকার জানিয়েছি। বাকিটুকু আমাদের পারিবারিক ব্যাপার। এবার আপনারা আসতে পারেন। আস’সালামু আ’লাইকুম।”
বলেই নয়ন জাহানারা বেগমকে ইশারা করলেন সবাইকে বিদায় করার জন্য। অতিথীরা সবাই চলে যেতেই ফাহিম খাবলে ধরল নয়নের কলার। চ্যাঁচিয়ে বলে উঠল,
“তুই আমার তারাকে নিজের বউ বলে দাবি করিস কোন সাহসে?”
নয়ন হালকা হাসল। ফাহিমের থেকে নিজের শার্টের কলার ছাড়িয়ে নিলো। সজোরে থাপ্পড় বসালো ফাহিমের গালে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমার সাথে লাগতে আসিস না। ফলাফল খুব খারাপ হবে। ভুলে যাস না আমি কে? তোর বাবা তার পাপের শাস্তি পেলেও তুই কিন্তু তার থেকেও বড় অপরাধী। তোর শাস্তি কিন্তু এখনো বাকি। আমার বউয়ের সাথে নোংরামি করার অপরাধে আমি চাইলে তোকেও এক্ষুনি সারাজীবনের জন্য জেলে ঢুকাতে পারি। সারাজীবন জেলে বসে ম’রতে হবে। কিন্ত এটা আমি করব না। ছোটমামির বুক খালি করার মতো এতটা নিচ কাজ আমি কখনোই করব না। ছোট মামার নিজেকে শুধরে নিলে তাকেও সুন্দর ভাবে বাঁচার জন্য শেষ সুযোগ দেওয়া হবে৷ আর তোকে কেন এখনো আমি কোনো শাস্তি না দিয়ে এখানে রেখেছি ভাবছিস তো?”
কথাটা শেষ করেই নয়ন হাসল। ফাহিমের দিকে সামান্য ঝুঁকে নিচু স্বরে বলল,
“তোর শাস্তিটা কোনো শারীরিক শাস্তি হবে না। তোর হবে মানসিক শাস্তি। ভালোবাসিস তো তারাকে তাইনা? সেই ভালোবাসার মানুষটাকে যখন আমার বুকে সুখে থাকতে দেখবি, তখন বুঝবি যে ভালোবাসা আসলে কী? আর আমার মতে মানসিক শাস্তির চাইতে বড় শাস্তি কিছু নেই।”
ফাহিম প্রতিউত্তরে বলল,
“আমার তারাকে আমি কিছুতেই হারাতে পারব না। কিছুতেই না।”
বলেই পাগলের ন্যায় আচরণ করতে লাগল। তারার হাতটা শক্ত করে ধরল। বলতে লাগল,
“এই তারা! এই! তুই তো আমাকে ভালোবাসিস বল? সেদিন তো নিজের মুখেই স্বীকার করলি। আমাকে বিয়ে করার জন্য রাজিও হয়েছিস। তোর কথায় আমি সেদিন বাবার সাথে এইসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েছিলাম। তোর জন্য আমি বাবাকে বিপদে ফেলেছি। এখন তুই আমাকে ঠকাতে পারিস না, তারা। কিছুতেই পারিস না।”
ফাহিমের কথাগুলো কেমন অদ্ভুত শুনাচ্ছে। মনে হচ্ছে ও নিজের মধ্যে নেই। ফাহিমের চোখের কোনে স্পষ্ট অশ্রুর ছাপ। তারার কেমন মায়া হচ্ছে এই মানুষটার জন্য। এই মানুষটার অতিরিক্ত ভালোবাসাই মানুষটার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। হ্যাঁ, সেদিন তারাই ফাহিমকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে, ভুলিয়ে ভালিয়ে মোস্তফা সাহেবের রুমে পাঠিয়েছিল। মোস্তফা সাহেবের মুখ থেকে সত্যিটা বের করার জন্য ফাহিমকে রাজি করিয়েছিল। ফাহিম যখন তারার কথামতো সবটা করছিল, তখনি তারা রুমের বাহিরের থেকে ভিডিওটা করে রেখেছিল। তারা সবটা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ফাহিমের থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে, খুব শান্ত স্বরে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করবেন, ফাহিম ভাই। আপনাকে ঠকানোর কোনোরকম ইচ্ছে আমার ছিলো না। কিন্তু আপনি আমার সাথে যেই অন্যায় করেছেন, তারপর এই কাজটা করা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিলো না। আমার সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি আমি আপনাকে দিব না। সবটা উপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দিলাম। তিনি যা ভালো বুঝবেন তাই করবেন।”
ফাহিম যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তারা ওর সাথে তাহলে এই কয়েকদিন অভিনয় করেছে। কিছুতেই মানতে পারছে না। পাগলের মতো পুনরায় বলে উঠল,
“না, তারা! তুই আমাকে ঠকাতে পারিস না। আমি তোকে অন্য কারোর সাথে মানতে পারব না। কিছুতেই মানতে পারব না। আমি তোকে সত্যিই অনেক ভালোবাসি, তারা৷ অনেক বেশি ভালোবাসি।”
তারা শান্ত স্বরে বলল,
“এখন আর আমাকে ভালোবেসে কোনো লাভ নেই। আমি এখন অন্যের স্ত্রী। বয়সে আমার স্বামী আপনার বড়। সেই হিসেবে আপনার বউ ভাইয়ের বউ আমি।”
ফাহিম মানতে পারল না। আচমকা-ই অদ্ভুত ভাবে চিৎকার করা শুরু করল।
“কিছুতেই না। আমার তারা অন্য কারোর হতে পারে না। কিছুতেই পারে না। ”
বলতে বলতে কেমন একটা উন্মাদের মতো আচরণ করছে। চারদিকে যা পাচ্ছে তাই ফ্লোরে ছুড়ে মারছে। তারা ভয়ে নয়নের বাহু শক্ত করে ধরে রেখেছে। নয়ন তারাকে অভয় বানীতে শুধাল,
“ভয় পাস না। আমি আছি তো।”
নয়ন আর ফাহিমের বন্ধু যারা সেখানে উপস্থিত ছিল সবাই মিলে ফাহিমকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিছু পারছে না। হুট করে সামনে থাকা একটা ফুলদানি দিয়ে নিজেই নিজের মাথায় আঘাত করা শুরু করল। নিজেকে রক্তা’ক্ত করা শুরু করল…
#চলবে