প্রিয় নয়নতারা পর্ব-০৫

0
494

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_পঞ্চম

“আমার ড্রেস চেঞ্জ করার আপত্তিকর ভিডিওটা যদি ফাহিম ভাই ভাইরাল করে দেয় তাহলে আমার কী হবে, নয়ন ভাই? এখন তো আমি শুধু আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীর ও পরিবারের কাছে খারাপ। চরিত্রহীন মেয়ে। কিন্তু তখন তো পুরো দুনিয়ার কাছে ভাইরাল গার্ল হয়ে যেতাম। আমি সেদিন ভয় পেয়েও নিজের নামে কলঙ্ক রটাতে চাইনি বিশ্বাস করো, ফুপ্পি। কিন্তু চাচ্চু বাধ্য করেছে। চাচ্চুও ভিডিও সম্পর্কে জানত। কাল সবার আড়ালে বলেছিল, ‘আমি যদি স্বীকার না করি তাহলে সে নিজে ভিডিওটা ভাইরাল করে দিবে’ বিশ্বাস করো আমি ওই পরিস্থিতিতে সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম। তাই তখন যা মুখে আসছে বলে দিয়েছি। বিশ্বাস করো, আমার কাছে অন্য কোনো রাস্তা ছিল না। আমি ইচ্ছে করে এসব করিনি। তোমরা একটু বিশ্বাস করো। আমাকে একটু বুঝার চেষ্টা করো, প্লিজ। প্লিজ নয়ন ভাই, একটু বিশ্বাস করো আমাকে। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ।”
কথা গুলো বলতে বলতে তারা মেঝেতে বসে পড়ল। হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করল। জাহানারা বেগম নিজের কানে শোনা কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছে না। নিজের ভাইয়ের এত জঘন্য রুপটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। জাহানারা বেগম ঘৃণা, রাগ, ক্ষোভ নিয়ে বলে উঠলেন,
“ছোট ভাইজান, এতটা নিচে নামতে কী করে পারল? যাকে সবার সামনে নিজের মেয়ে বলে বেড়ায় তারেই সর্বনাশ করতে এত বড় একটা নোংরা কাজ করল? ছিহ! ভাবতেই আমার ঘৃণা হচ্ছে। তুই ওই নোংরা মানুষগুলোকে ভয় পাচ্ছিস, তারা? তুই ওই নোংরা মানুষ গুলোর হুমকিতে এত বড় একটা অন্যায় চুপচাপ মেনে নিয়েছিস? ওই মানুষগুলোর জন্য কষ্ট পাচ্ছিস? চোখের জল ফেলছিস? একদম না। একদম কাঁদবিনা। একদম চোখের জল গুলো নষ্ট করবিনা। উঠ, এক্ষুনি।”
বলেই তিনি তারাকে দাঁড় করাল। দুই হাতে চোখের পানিগুলো মুছে দিতে দিতে বলল,
“একদম কাঁদবি না, মা। তোর ফুপ্পি আছে তো। তোর পাশে সবসময় থাকবে।”
তারা এবার জাহানারা বেগমকে জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে লাগল শব্দ করেই৷ নয়ন চুপচাপ দাঁড়িয়ে। দৃষ্টিতে মেঝেতে সীমাবদ্ধ। কোনো শব্দ করছে না। কথা বলছে না। জাহানারা বেগম তারাকে নিয়ে ভেতরে গেল। সোফায় বসিয়ে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“পানিটা খেয়ে নাও। শান্ত হও একটু, মা। আর কান্না করে না।”
তারা শুনল। পানিটুকু ঢকঢক করে গিলে ফেলল। কোনোরকমে শান্ত করল নিজেকে। নয়ন ভেতরে এসে তারাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমার রুমে আয় তো একটু। কথা আছে তোর সাথে।”
তারা জাহানারা বেগমের দিকে তাকাল। জাহানারা বেগম তারার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“আমরা আছি তো। তুই চিন্তা করিস না। নয়ন, ডাকছে যা। আমি নাস্তা বানিয়ে নিয়ে আসছি। খেয়েছিলি কিছু?”
তারা মাথা নাড়াল। অর্থাৎ ‘না’। জাহানারা বেগমের আদেশ পেয়ে তারা নয়নের রুমের দিকে যেতে লাগল। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। হার্ট বিট বড্ড ফাস্ট চলছে। নয়নের দরজার সামনে এসে রুমের ভেতর উঁকি দিতেই দেখল নয়ন বিছানায় বসে আছে। মুখটা দুই হাতে চেপে মাথা নিচু করে আছে।
“ওখানে দাঁড়িয়ে চোরের মতো উঁকিঝুঁকি দেওয়ার জন্য তোকে ডাকা হয়নি।”
কথাটা তারার কানে যেতেই তারা ধড়ফড়িয়ে উঠল। মাথা নিচু করে ওড়নাটা হাতে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে রুমে ঢুকল। নয়ন বলল,
“তোর তুই আজকাল ড্রেস রাস্তাঘাটে চেঞ্জ করস?”
”এটা কেমন কথা, নয়ন ভাই?”
“তাহলে তোর ড্রেস চেঞ্জ করাটা মানুষ ভিডিও করে কীভাবে?”
তারা দীর্ঘশ্বাস নিলো। শান্ত স্বরে বলল,
“আমার রুমে হিডেন ক্যামেরা লাগানো ছিল।”
এবার নয়ন মাথা তুলে তাকাল। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। তারা সে চোখে তাকিয়ে ভয় পেলো। নয়ন দাঁতে দাঁত চে’পে বলল,
“থা’প্পড় মে’রে তোর দাঁত ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে, বে”দ্দপ।”
তারা সাথে সাথে গালে হাত দিয়ে বসে রইল। নয়নকে এত শান্ত স্বরে কথা বলতে দেখে অবাক হলো। নয়ন উঠে দাঁড়াল। কঠিন স্বরেই বলতে শুরু করল,
“কেমন মেয়ে তুই? তোর রুমে একজন ক্যামেরা লাগিয়ে তোর ভিডিও ধারণ করল আর তুই কিছু টের পেলি না? তোকে এক্সর্টা রুম কেন দেওয়া হয়েছে? তুই বড় হয়েছিস, আলাদা প্রাইভেসি আছে এই জন্যই তো?”
তারা চুপ করে আছে। কোনো উত্তর দিলো না। তারাকে চুপ করে থাকতে দেখে নয়নের রাগ বেড়ে গেলো। ধমক দিয়ে বলে উঠল,
“কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি?”
কথাটা খুব জোরে বলেছে নয়ন। তারা ভয় পেয়ে গেলো। আমতা আমতা করে বলল,
“কী বলব?”
নয়নের ইচ্ছে করছে তারার গালে কয়েকটা থা’প্পড় মা’রতে। নিজের রাগটা দুইভাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। জোরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নিজে নিজেই বলে উঠল,
“শান্ত! শান্ত! শান্ত!”
তারপর একটা চেয়ার টেনে তারার মুখোমুখি হয়ে বসল। তারাকে উদ্দেশ্য করে শান্ত স্বরে বলল,
“যা জিজ্ঞেস করব শুধু তার উত্তর দিবি চুপচাপ। বুঝতে পেরেছিস?”
তারা মাথা নাড়াল। নয়ন শান্ত কন্ঠেই প্রশ্ন করতে লাগল,
“তুই কী এখনো ছোট নাকি এডাল্ট?”
“আমি যথেষ্ট এডাল্ট।”
”বেশ! তোকে আলাদা রুম কেন দেওয়া হয়েছে?”
“আমার প্রাইভেসি মেইনটেইন করার জন্য।”
“বেশ! তাহলে তোর প্রাইভেসি মেইনটেইন করার জন্য কি রুমের দরজা সবসময় আনলক করে রাখা উচিত?”
“না। সবসময় তো আমি…।”
“আমি যা প্রশ্ন করব শুধু ওইটুকুর উত্তর দিবি।”
তারা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। নয়ন প্রশ্ন করল,
“তুই কি সবসময় দরজা লক করে রাখিস?”
“না।”
“কেন?”
তারা চুপ করে রইল। উত্তর দিলো না। নয়ন রাগে সামনে থাকা ট্রি-টেবিলে হাত দিয়ে জোরে আঘাত করল। চ্যাঁচিয়ে বলল,
“এন্সার মি।”
তারা ভয়ার্ত স্বরে আমতা আমতা করে বলল,
“আমি বুঝতে পারিনি, নয়ন ভাই।”
নয়ন এবার রাগে দাঁড়িয়ে পড়ল। ট্রি-টেবিলটায় লা’থি মে’রে চিৎকার করে বলে উঠল,
“বুঝতে পারিনি, মাই ফুট। কী বুঝতে পারিসনি তুই? তোরেই কাজিন তোকে পছন্দ করে, ভালোবাসে এটা তুই জানতি না? এটা বুঝিস নি? সে কেমন এটা তো এটলিস্ট জানতি? সে তোর ক্ষতি করতে পারে এটাও তোর অজানা নয়। তাহলে নিজেকে সেফ রাখতে পারিস নি কেন? হুয়াই?”
তারা ভয়ে জুবুথুবু হয়ে আছে। নয়ন একটু থেমে আবার বলতে লাগল,
“একটা ছেলে তোর রুমে গিয়ে ক্যামেরা সেট করে চলে আসল এটা তুই বুঝতে পারলি না। জানলি না। বেশ! মেনে নিলাম। একটা ছেলে তোর রুমে গিয়ে তোরেই বিছানায় সুয়ে পড়ল, তাও আবার তোকে জড়িয়ে ধরে। এটা কি মেনে নেওয়া সম্ভব?”
তারা চুপ করে আছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।।অপরাধ বোধে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই তো! আজকে যা হচ্ছে সব তারার বোকামির ফল। তারা যদি আগেই নয়নকে সব বলে দিতো তাহলে এত কিছু হতো না। কিন্তু ফাহিম যে নয়নকে নিয়েও হুমক দিয়েছিল, এই ভয়টাই তারা সবথেকে বেশি পেয়েছিল। নয়নকে হাজারবার বলতে গিয়েও বলা হয়ে উঠেনি। ফাহিম নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য সব করতে পারে। কয়েকদিন আগে তারাকে বিশ্বাস করানোর জন্য নয়নের একটা ছোটখাটো এক্সিডেন্ট অব্দি করিয়েছিল। তাইতো তারা চুপ করে সব মেনে নিয়েছে। এই কথাটা যদি নয়ন জানে তাহলে শিওর তারাকে থা’প্পড় মা’রবে আরো কয়েকটা। তারা জানে নয়ন এসব কিছুকে পরোয়া করেনা। কখনো করবেও না। তারার জীবন টাতো এমন হওয়ার কথা ছিলো। আজকে সবার সাথে আনন্দে মেতে থাকার কথা ছিলো। কিন্তু জীবনটা একদিনেই কেমন পালটে গেলো। সব এলোমেলো হয়ে গেলো। স্বপ্ন ভেঙে গেলো। স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার কষ্ট যে তীব্র! তারা শব্দ করে কান্না করে উঠল। নয়ন কিছুটা ভড়কে গেলো। তারার সামনে হাঁটু ভেঙে বসে কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন, বলদ? ভয় পাচ্ছিস?”
তারা মাথা নাড়াল। অর্থাৎ ‘হ্যাঁ’। নয়ন এবার হাসল। তারার দুই গালে হাত রেখে শান্ত স্বরে বলল,
“তোর নয়ন ভাই আছে না? একদম ভয় পাস না। কিছু হবে না বাবু। কান্না করিস না, সোনা। সব ঠিক করে দিব। সব কিছু আগের মতো করে দিব। তোর গায়ে যে কলঙ্ক লেগেছে তা আমি ভালোবাসা দিয়ে মুছে দিব। কান্না বন্ধ কর, তারু।”
এবার তারার আরো জোরে কান্না করে উঠল। কতদিন পর নয়নের মুখে ‘তারু’ ডাকটা শুনছে। গত কয়েকদিন ধরে ফাহিমের সাথে তারার বেশি মেলামেশার জন্য নয়ন অভিমানে তারার সাথে প্রায় কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিল। তারার ইচ্ছে করছে নয়নকে জড়িয়ে ধরে ‘ভালোবাসি’ বলতে। কিন্তু নয়ন যদি রেগে যায় এই ভয়ে চুপ করে রইল।।ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখল। নয়ন তারার মাথায় হাত রাখল। আলতো করে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“কান্না অফ করতে বলেছি, তারু। প্লিজ কান্না করিস না। তোর কান্না যে আমার সহ্য হয়না।”
নয়নের কন্ঠে অসহায়ত্ব প্রকাশ পেলো। তারা অশ্রুসিক্ত চোখে তাকাল নয়নের দিকে। নয়ন জিজ্ঞেস করল,
“কেন কাঁদছিস? সব ঠিক করে দিব, প্রমিস। কাঁদিস না, সোনা।”
তারা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ফাহিম ভাই আমার সাথে..।”
বলে আবার কান্না করে দিলো। নয়নের বুকটা ধক করে উঠল। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসল। যাকে ছোট থেকে এত যত্ন করে বড় করল। যত্ন করে নিজের বুকে রাখল। সেই তারাকে অন্য কেউ ছুঁয়েছে। তবে কী ফাহিম তারার সাথে আরো খারাপ কিছু করেছে…?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে