প্রিয় নয়নতারা পর্ব-০৪

0
500

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_চতুর্থ

নয়ন তারার গাল চেপে ধরে আছে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে। তারার মনে হচ্ছে ওর গাল ভেঙে দাঁতের সাথে মিশে যাচ্ছে। ব্যাথায় বার বার কুকিয়ে উঠছে। চোখ থেকে পানি পড়ছে। তারা নয়নের হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে, আর্তনাদের স্বরে বলে উঠল,
“নয়ন ভাই, ছাড়ো। আমার ব্যাথা লাগছে।”
নয়ন চ্যাঁচিয়ে বলতে লাগল,
“লাগুক। তুই আমাকে যেই আঘাত দিয়েছিস, তার কাছে এই আঘাতটা সামান্য। এই আঘাত তুই প্রাপ্য। কিন্তু আমাকে যেই আঘাত দিয়েছিস সেই আঘাতটা কি আমি প্রাপ্য ছিলাম, তারা?”
তারা চুপ করে রইল। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে লাগল। নয়নের চ্যাঁচামেচি শুনে জাহানারা বেগম ভেতর থেকে দৌড়ে আসলেন। অবাক হয়ে বলে উঠলেন,
“একি, নয়ন! কী করছিস? মেয়েটাকে ছাড়।”
বলতে বলতে তিনি নিজেই তারাকে ছাড়িয়ে নিলো। চোখ গরম করে নয়নের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি আজকাল খুব সহজেই মেয়েদের গায়ে হাত তুলো দেখছি, নয়ন। এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোমাকে? আমার শিক্ষার অপব্যবহার করছো তুমি।”
নয়ন রাগে থরথর করে কাঁপছে। কথা বলতে অব্দি পারছে না। দুই হাতে নিজের চুল গুলো খামচে ধরে বলে উঠল,
“এই মেয়েটাকে আমার চোখের সামনের থেকে এক্ষুনি চলে যেতে বলো, আম্মু। আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছি না। ”
তারা অশ্রু ভর্তি চোখে নয়নের দিকে তাকাল। পরক্ষণেই জাহানারা বেগমকে ঝাপটে ধরে বলে উঠল,
“তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করো, ফুপ্পি। তুমি আমার কথাগুলো একটু শুনো। বিশ্বাস করো, কাল আমি যা করেছি, যা বলেছি সব বাধ্য হয়ে বলেছি। আমার নিজের মুখে সব স্বীকার করা ছাড়া উপায় ছিলো না। প্লিজ, আমার সব কথাগুলো একটু শোনো। তোমরা ছাড়া আমাকে বিশ্বাস করার কেউ নেই, ফুপ্পি।”
তারার কান্না করতে করতে হেচকি উঠে গেছে। তারার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে নয়নের যন্ত্রণা আরো বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু রাগের চোটে কিছু বলতে পারছে না। নয়ন ভেবেই পাচ্ছে না, তারা মতো বুদ্ধিমান মেয়ে কী করে কালকে এত বড় একটা বোকামি করল? নয়ন আগের থেকেই জানত যে, ফাহিম তারাকে বিগত কয়েকদিন ধরে ব্লাকমেইল করছে। ঠিক কী নিয়ে ব্লাকমেইল করছে তা জানার জন্যই, নয়ন কালকে সবার সামনে এনেছিল বিষয়টা। ভেবেছিল তারা কালকে নিজের সম্মান বাঁচাতে সবটা স্বীকার করবে। তারপর নয়ন বাকি প্রমাণসহ ফাহিমের কীর্তিকলাপের কথা সবাইকে জানাবে। কিন্তু তারা কালকে নিজের হাতে নিজের সম্মান নষ্ট করবে, এটা নয়ন কিছুতেই ভাবতে পারছেনা। যতবার ভাবছে ততবার মাথা হ্যাং মে’রে যাচ্ছে। এখন যেহেতু তারা আর ফাহিমের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, সেহেতু এই বিষয়টা নিয়ে নয়ন আর ভাবতে চায়না। নয়নের বাবা নেই৷ মা’কে কাল কথা দিয়েছে আর কোনো ঝামেলা করবেনা। তাই নয়ন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। বারকয়েক নিঃশ্বাস নিলো জোরে জোরে। তারপর শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“তারা, বাড়ি যা। তোর সাথে আমরা কেউ কোনোরকম কথা বলতে চাচ্ছি না।”
বলেই বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। তারা তৎক্ষনাৎ নয়নের পা জড়িয়ে ধরল। বলতে লাগল,
” প্লিজ, নয়ন ভাই। চলে যেও না। আমার কথাটা একটু শুনো। তুমি এভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিলে আমি বাঁচতে পারব না, বিশ্বাস করো।”
নয়ন ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। তারার কথা যত শুনছে তত রাগ বাড়ছে। নিজের সব কালকে শেষ করে আজকে এসব করার মানে খুঁজে পাচ্ছে না নয়ন। তারাকে ও কিছুতেই সহ্য করতে পারছেনা। আজকে ও যত যা বলুক, সবাই যতই বিশ্বাস করুক। কিন্তু কালকে যেই মানুষ গুলো উপস্থিত ছিল, সেই মানুষগুলো তো আর এসব বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করার কথাও না। যা রটার তাতো এক রাতেই রটে গেছে। জাহানারা বেগম তারাকে নয়নের থেকে ছাড়িয়ে এনে বললেন,
“কী করছিস এসব? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর?”
তারা কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলতে লাগল,
“হ্যাঁ, মাথা খারাপ হয়ে গেছে আমার। তোমরা কেউ আমার কথাটা শুনছো না। আমি দোষ করেছি, অন্যায় করেছি। ‘কিন্তু কেনো করেছি?’ এটা কেউ শুনতে চাচ্ছো না। পৃথিবীর কোনো মেয়ে কি চায় তার চরিত্রে দাগ লাগুক? ‘সমাজের লোক মেয়েটাক চরিত্রহীন, নোংরা মেয়ে বলুক’ এটা কেউ চায়? তোমরা কেনো বুঝতাছো না? আমি পরিস্থিতির স্বীকার। আমার কাছে ওই মুহূর্তে সব স্বীকার করা ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। চাচ্চু আর ফাহিম ভাইয়া আমাদের সবাইকে ঠকিয়েছে। তারা বাবা-ছেলে মিলে আমাকে আর আমার পরিবারকে ধ্বংস করার খেলায় নেমেছে।”
তারার কথা শুনে জাহানারা বেগম আর নয়ন দুজনেই অবাকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলো। ফাহিমের কথা না হয় জানত ওরা। কিন্তু ‘মোস্তফা সাহেব’ তার নাম কেন আসছে এখানে? জাহানারা বেগম বেশ অবাক স্বরে বলে উঠলেন,
“ছোটভাইজান! কী বলছিস তুই এসব? পাগল হয়ে গেছিস? ছোট ভাইজানের নাম কেনো আসছে এখানে?”
বলেই থামলেন। তারা পুনরায় বলে উঠল,
“হ্যাঁ, তোমার ছোটভাইজান! যার ভদ্র মুখোশের আড়ালে নোংরা রুপটা তোমরা কেউ দেখোনি।”
জাহানারা বেগম এবার ধমকে উঠলেন,
“তারা! আর একবার তুই আবোল-তাবোল বললে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না৷ যে মানুষটা তোকে নিজের মেয়ের মতো ভাবে, সেই মানুষটাকে নিয়ে তুই এসব বলছিস? তোর কি বিবেক, বুদ্ধি বলতে কিছু নেই?”
জাহানারা বেগম ভাইয়ের নামে এসব শুনে নিজেকে শান্ত রাখতে পারছেন না কিছুতেই৷ নয়ন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো এতক্ষণ। কিন্তু এখন মুখ খুলল। শান্ত বানীতে বলল,
“আম্মু, তারাকে সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে দাও। তারা তুই বল। আমি শুনছি।”
নয়নের অভয়বাণী পেয়ে তারা কিছুটা সাহস পেলো এবার। শান্ত স্বরে বলতে লাগল,
“চাচ্চু, আমাকে নিজের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চায়। আমার বাবার নামের শেষ সম্পত্তির ও ব্যবসার অংশ তাদের নামে করে নিতে চায়৷ তোমরা হয়ত জানো না, চাচ্চু বাবার কাছে প্রস্তাব ও রেখেছিল। কিন্তু আমি রাজি ছিলাম না বলে বাবাও প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। সেই থেকে চাচ্চুর আমার আর আমার বাবা দুজনের উপরেই রাগ ছিল। তোমাদের লোক চক্ষুর আড়ালে সে আমাকে প্রতিদিন হুমকি দিতো। বাজে ভাবে ভয় দেখাতো। কিন্তু আমি কখনোই তার হুমকিতে ভয় পেতাম না। উল্টো প্রতিবাদ করতাম। বাড়ির কাউকে এই বিষয় বলার সাহস হয়নি। কারণ, আমি চাইনি আমাদের পরিবারটা ভেঙে যাক। আমি ঘুমের যে কিছু টের পাইনা তা তোমরা খুব ভালো করেই জানো। আমি তো রুমের দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে ঘুমাই। কিন্তু সেদিন আমরা সবাই অনেক রাত অব্দি জেগে ছিলাম। নয়ন ভাই, তুমিও তো ছিলে আমাদের সাথে, বলো? ফাহিম ভাইয়াও তো ছিলো আমাদের সাথে। আমরা সবাই মিলে তো ছাদে আড্ডা মে-রে প্রায় ভোররাতে দিকে যে যার রুমে গিয়েছিলাম৷ আমার চোখে এত ঘুম ছিল যে, আমি দরজা বন্ধ না করেই সুয়ে পড়েছিলাম। হুট করে ঘুমের মধ্যে টের পেলাম কেউ আমাকে জড়িয়ে ধরে সুয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে বুঝতে পারছিলাম না কে সে? যখন ভয় পেয়ে চোখ খুললাম তখন দেখলাম ফাহিম ভাইয়া আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে…।”
এইটুকু বলে থামল তারা। এর পরের ঘটনাটা নয়নের জানা। সকাল নয়টা বেজে গিয়েছিল, কিন্তু তারা তখনো ঘুমে ছিল। বিয়ে বাড়িতে কেউ এত বেলা অব্দি ঘুমায় না। সবাই যখন যে যার কাজে ব্যস্ত তখন নয়ন খেয়াল করল তারা নেই৷ তাই তারাকে ডাকতে ওর রুমে গিয়েছিল৷ আর তখনেই তারা আর ফাহিমকে নয়ন এক বিছানায় দেখে নিয়েচিল। কিছু সময়ের জন্য নয়ন তারাকে অবিশ্বাস করলেও যখন দেখল তারা ফাহিমকে ধাক্কা মে’রে সরিয়ে দিয়েছিল, তখন নয়ন বুঝতে পেরেছিল এটা ফাহিমের কাজ। তারা কিছুসময় থেমে আবার বলতে শুরু করল,
“সেদিন যখন আমি সবার সামনে সত্যিটা বলার জন্য মুখ খুললাম তখন বার বার ফাহিম ভাই আমাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে৷ যখন ফাহিম ভাইকে তুমি মা’রতে ছিলে, তখন সবাই তোমাকে থামানোর জন্য ব্যস্ত ছিল। ওই টাইমে চাচ্চু আমার কাছে এসে সবার আড়ালে বলেছিল ‘আমি যদি ওই মুহূর্তে সবটা নিজের মুখে না স্বীকার করি, তাহলে সে…। ”
তারার কথার মাঝেই নয়নের মনে পড়ল, ‘ফাহিম তারাকে কেন ব্লাকমেইল করছে?’ প্রশ্নটা মাথায় আসতেই নয়ন সাথে সাথে জিজ্ঞেস করল,
“তুই এসব কথা বাদ দে। আসল কথাটা বল এখন।”
“কোনটা?”
তারার পাল্টা প্রশ্নে নয়ন দাঁত মুখ খিচে প্রশ্ন করল,
“এত কথার মাঝে তুই তো আসল কথাটাই বলতে ভুলে গেলি। ফাহিম তোকে কেন ব্লাকমেইল করে?”
তারা কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“আমার ড্রেস চেঞ্জ করার একটা আপত্তিকর ভিডিও আছে তার কাছে…।”

#চলবে

[বানান ভুলগুলো ক্ষমা করবেন। অনেক তাড়াহুড়োয় লিখেছি। রি-চেক দেওয়া হয়নি]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে