প্রিয় নয়নতারা পর্ব-০৩

0
518

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_তৃতীয়

রাস্তার মাঝে ফাহিম পেছন থেকে তারার কাঁধে হাত দিতেই, তারা ফাহিমের দিকে অগ্নী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। হাতটা নিজের কাঁধ থেকে সরিয়ে নিয়ে গর্জন করে বলে উঠল,
“আর একবার যদি আমার গায়ে আপনি হাত দেন, আমি ভুলে যাব আপনি আমার বড়। পায়ের জুতো খুলে মা’রব আপনার মুখে। অনেক অত্যাচার সহ্য করেছি আর না।”
তারার কথা শেষ হতেই ফাহিম হাসল। শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“তুই রাগলে তোকে দেখতে খুব মিষ্টি লাগে রে, তারা।”
তারার রাগটা এবার তরতর করে বেড়ে উঠল। ফাহিমের প্রতি ঘৃণায় চোখ, মুখ কুঁচকে ফেলল। এতটা বেহা’য়া হয় কী করে মানুষ! তারা দাঁতে দাঁত চে’পে বলে উঠল,
“আপনি কোন মাটি দিয়ে তৈরি বলুন তো? আপনার ভেতর কি সামান্য পরিমাণ লজ্জাবোধ নেই? একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিয়েছেন আপনি। একটুও অনুশোচনা হচ্ছে না?”
ফাহিমের মুখের হাসিটা বিলীন হয়ে গেলো। নিম্ন স্বরে বলে উঠল,
“বিশ্বাস কর, আমি এসব কিছু চাইনি। আমি কখনো তোর সম্মান নষ্ট করতে চাইনি। কিন্তু, কী করব বল? চোখের সামনে তোকে অন্য কারোর হতে দেখতে দিতে পারব না আমি।”
ফাহিমের কথা শেষ হতে না হতেই তারা শক্ত কণ্ঠে বলে উঠল,
“তাইলে মে’রে ফেলুন আমাকে।”
ফাহিম আঁতকে উঠল। চোখ দুটো বেরিয়ে আসার উপক্রম। ভয়ে বুকটা ধক করে উঠল। ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল,
“তারা! কী বলছিস এসব?”
তারার চোখ থেকে গড়িয়ে পানি পড়ছে। মুখটা শুকিয়ে গেছে এক রাতেই। তারা এবার শব্দ করে কান্না করে উঠল। কান্নারত স্বরে বলতে লাগল,
“হ্যাঁ! মে’রে ফেলুন আমাকে। এমনিতেও আমি বাঁচতে পারব না। এত বড় কলঙ্কের বোঝা নিয়ে কেউ বাঁচতে পারে বুঝি? আমি তো এক রাতেই হাঁপিয়ে গেছি। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল বার বার। আমি হয়ত পৃথিবীর সবথেকে নিকৃষ্ট মেয়ে যে, নিজের গায়ে নিজে দাগ লাগিয়েছি। আপনার হুমকিতে ভয় পেয়ে আমি সবথেকে বড় ভুল করেছি। আমি আর বাঁচতে পারছিনা ফাহিম ভাই? আমাকে মে’রে ফেলুন প্লিজ। আ’ত্ম’হত্যা মহাপাপ না হলে কাল রাতেই নিজেকে শেষ করে দিতাম। চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারিনি বিশ্বাস করুন। আমাকে প্লিজ মে’রে ফেলুন। এতটা যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। হয় আমাকে আমার মতো বাঁচতে দিন, নয়তো মে’রে ফেলুন। মে’রে ফেলুন আমাকে। মে’রে ফেলুন।”
কথাগুলো বলতে বলতে তারা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়ল। পাগলের মতো শব্দ করে কান্না করতে লাগল। ফাহিম নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের সামনে তারাকে এভাবে কাঁদতে দেখে নিজের ভেতরে জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে৷ সত্যি বলতে ফাহিমের ভেতরে ভেতরে অনুশোচনা হচ্ছে। কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারছেনা। কারণ ও যেকোনো কিছুর বিনিময়ে তারাকে নিজের করে নিবেই। ফাহিম হাঁটু ভেঙে বসল। তারার গালে হাত রাখার জন্য হাত বাড়াতেই, তারা ছিটকে হাত সরিয়ে ফেলল। চিৎকার করে বলল,
“ছোঁবেন না আমাকে।”
ফাহিমের হাত কাঁপছে। তবুও শান্ত স্বরে বলল,
“এভাবে কাঁদিস না প্লিজ। আমি সব ঠিক করে দিব। সবটা ঠিক করে দিব। আমি ভুল করেছি। অন্যায় করেছি। আমি নিজের সব দোষ মানছি। কিন্তু, বিশ্বাস কর আমি তোকে ভালোবাসি। সত্যিই অনেক ভালোবাসি, তারা। আমি সব ঠিক করে দিব, আমার জান। তবুও এভাবে কাঁদিস না।”
তারা অশ্রুসিক্ত নয়নে ফাহিমের দিকে তাকাল। কান্নারত স্বরেই বলতে লাগল,
“সব ঠিক করে দিবেন! সিরিয়াসলি? কী ঠিক করবেন আপনি? পারবেন আমার হারানো সম্মান আমাকে ফিরিয়ে দিতে? পারবেন আমার শরীর থেকে কলঙ্কের দাগ মুছে দিতে? পারবেন, বলেন?”
ফাহিম উত্তরে নিশ্চুপ হয়ে রইল। তারা কিছু বলল না। দুই হাতে চোখের পানিগুলো মুছে নিলো। উঠে দাঁড়াল। শক্ত স্বরে বলল,
“যদি আমাকে এক বিন্দু পরিমান সত্যি ভালোবাসেন, তাহলে দয়া করে আমাকে আটকাবেন না। ”
বলেই এগিয়ে চলল সামনের দিকে। ফাহিম সেখানেই বসে রইল। ফাহিমের চোখের কোনেও অশ্রুকণা চিকচিক করছে। কিছুক্ষণ অনেক ভাবনা চিন্তা করে, পরক্ষণেই চোয়াল শক্ত করে নিজে নিজেই বলে উঠল,
“আমি তোকে কিছুতেই অন্যের হতে দিব না। কিছুতেই না। এতে যদি আমাকে পৃথিবীর সবথেকে নিকৃষ্ট ব্যক্তি হতে হয়, তাহলে আমি তাতেই রাজি৷ ভালোবেসে না হয়ে নিকৃষ্ট হলাম। দোষ কী তাতে?”




নয়ন সারারাত ঘুমাতে পারেনি। বিছানার উপর ছটফট করছে। কাল রাতে জাহানারা বেগম জানিয়েছেন, তারা আর ফাহিমের বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। তনয়াদের বিয়ের পরেই তারা আর ফাহিমের বিয়েটা সেরে ফেলবেন। এসব শুনে নয়ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও এখানে থাকবে না। মা’কে নিয়ে চট্রগ্রাম চলে যাবে। সেখানেই নিজের জীবনটা নিজের মতো করে সাজাবে। নিজের ভেতরের যন্ত্রণা কমাতে ফজরের নামাজ পড়ে নয়ন ছাদে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ করে চোখ গেলো বাড়ির মেইন গেটের দিকে। সেখান দিয়ে তারা হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে আসছে। তারাকে দেখেই নয়নের বুকের যন্ত্রণাটা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেলে। আবার এত সকালে তারাকে এখানে দেখে অবাক হলো বটে। তারা বাড়ির ভেতর ঢুকে আসতেই নয়ন ছাদের থেকে নেমে এলো। দরজার সামনে আসতেই তারার মুখোমুখি পড়ে গেলো। নয়নকে হুট করে এভাবে সামনে দেখে তারা ঘাবড়ে গেলো কিছুটা। তারার মুখের দিকে তাকিয়ে নয়নের বুকটা মুচড়ে উঠল। মেয়েটা একদিনেই ভেঙে গেছে পুরো। চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত। তাই আরো বেশি মায়াবী লাগছে। গায়ের ওড়নাটা মাথায় প্যাঁচানো। বেশি কান্না করায় গাল দুটো ফুলে আছে। ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। নয়নের খুব ইচ্ছে করছে তারাকে বুকের ভেতর ঝাপটে ধরতে। ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখতে না পেরে হাত বাড়াল তারার দিকে। পরক্ষণেই আবার গুটিয়ে নিলো নিজেকে। তারা এখন অন্যের আমানত। ভেবেই নয়ন দু-কদম পিছিয়ে গেল। চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করল,
“তুই এখানে কেন?”
তারা যেন ওই প্রশ্নটার মুখোমুখি হতে এসেছে। তাই দেরি না করে উত্তর দিলো,
“তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে, নয়ন ভাই।”
নয়ন মুখ ফিরিয়ে নিলো। কাঠকাঠ গলায় বলে উঠল,
“আমার তোর সাথে কোনো কথা নেই। চলে যা এক্ষুনি।
তারা এগিয়ে আসল। নয়নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অসহায় স্বরে বলে উঠল,
“প্লিজ, নয়ন ভাই আমাকে এভাবে তাড়িয়ে দিও না। আমার কথাগুলো একবার শুনো।”
নয়নের সাহস নেই তারার চোখে চোখ রাখার। কেন জানিনা মন বলছে তারার কথাগুলো শোনা দরকার। তাই দৃষ্টি অন্যদিকে রেখে বলল,
“কী কথা আছে, শুনি?”
তারা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কাঁপা-কাঁপি হাতে হাত রাখল নয়নের দুই গালে। অসহায় চোখ তাকাল নয়নের দিকে। শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“আমাকে তুমি ভালোবাসো, তাইনা?”
….
“বলো না আমাকে ভালোবাসো?”
….
নয়নকে প্রতিউত্তরে এবারও চুপ থাকতে দেখে তারা অধৈর্য্যের স্বরে বলল,
“প্লিজ, চুপ করে থেকো না। বলো না, ভালোবাসো?”
নয়ন তারার হাত দুটো সরিয়ে নিলো। শক্ত স্বরে বলে উঠল,
“এ সমস্ত আজাইরা কথা বলার থাকলে তুই এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা। নয়ত আমি কী করব নিজেও জানিনা।”
তারার চোখ বেয়ে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। থেমে থেমে বলতে লাগল,
“আমি যদি তোমাকে কিছু বলি, বিশ্বাস করবে আমাকে?”
“বিশ্বাস করার মতো হলে করব।”
তারা পুনরায় বলে উঠল,
“ফাহিম ভাই, আমাকে ফাসিয়েছে, নয়ন ভাই। আমি কালকে যা যা বলেছি সব কিছু বাধ্য হয়ে বলেছি। আমার কথাগুলো একটু শুনবে, প্লিজ। আমার অনেক কিছু বলার আছে তোমাকে। প্লিজ, একটু শুনো।”
“এখন এসব কথা বলার মানে কী?”
নয়নের প্রশ্নে তারা জবাব দিলো,
“কারণ আমি জানি, আমাকে আর কেউ বিশ্বাস না করলেও তুমি আমাকে বিশ্বাস করবে। তা…”
তারার কথা শেষ হতে না হতেই নয়ন সজোরে গালে একটা থা’প্পড় মে’রে, তারার গাল শক্ত করে চেপে ধরল। ব্যাথা তৎক্ষনাৎ তারা শব্দ করে উঠল। নয়ন রাগে, চিৎকার করে বলে উঠল,
“কালকে এতগুলো মানুষের সামনে নিজের সাথে, নিজের পরিবারের সম্মান নষ্ট করার আগে একথাটা মাথায় আসেনি? কালকে নিজের হাতে তুই তোর সাথে, তোর পরিবারের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে, এখন এসেছিস নাটক করতে?”

#চলবে

[ভুল গুলো ক্ষমা করবেন। খুব তাড়াহুড়োয় লিখেছি।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে