প্রিয় নয়নতারা পর্ব-০২

0
520

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_দ্বিতীয়

নিজের চরিত্রে নিজেই দাগ লাগানোর মতো বিষাক্ত অভিজ্ঞতা কোনো মেয়ের জীবনে না আসুক। সুনসান নিরবতা বিরাজ করছে চারদিকে। চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে পরিবেশ৷ উত্তর দিকের জানালা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া রুমের ভেতরে ঢুকছে। তারা মেঝেতে বসে আছে। মাথাটা খাটের এক কোনে ঠেকানো। চোখ থেকে পানি পড়তে পড়তে গালের এক পাশে দাগ বসে গেছে। চোখ দুটোও ভয়ংকর ভাবে ফুলে, লাল হয়ে আছে। সারাদিন কিছু না খাওয়ায় শরীরটাও এবার বড্ড দূর্বল লাগছে। সারাদিনে তনয়া, রুবিনা বেগমসহ অনেকেই ডাকাডাকি করে গেছে। কিন্তু কেউ তারাকে ঘর বের করতে পারেনি। বাড়ি জুড়ে নিরবতা চলছে। মেহেন্দীর অনুষ্ঠানটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তারা আজ বড্ড শান্ত। যে মেয়ে সারাদিন পুরো বাড়ি লাফিয়ে বেড়ায়, সে মেয়ে আজ শান্ত। তারার চোখের সামনে শুধু নয়নের চেহারা ভেসে উঠছে। নয়ন সেই যে বেরিয়েছে এখন অব্দি কোনো খোঁজ মেলেনি৷ তারা এবার ডুঁকরে কেঁদে উঠল। কান্নারত স্বরে বলতে লাগল,
“তুমি আমাকে অবিশ্বাস করলে, নয়ন ভাই। তুমি তো জানতে আমি কেমন? তবুও অবিশ্বাস করলে? একটু ভরসা করতে পারলে না আমাকে? তুমি কেনো বুঝলে না যে, তোমার তারা বাধ্য হয়েছে মিথ্যাটা বলতে?
তারার বুকের ভেতরটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কী এক নিদারুণ যন্ত্রণায় ভুগছে মেয়েটা! এ যন্ত্রণার থেকে মুক্তি মিলবে কবে?



ফাহিমের ক্ষত স্থানে রিমা বেগম মলম দিতেই ফাহিম ব্যাথায় নড়েচড়ে উঠল। বিরক্তির স্বরে বলল,
“আস্তে দাও, মা।”
রিমা বেগম অসহায় মুখে বললেন,
“আস্তেই তো দিচ্ছি। কী অবস্থা করেছে আমার ছেলেটার? বলি, তোর কী হাতে শক্তি নেই? তুই কেন শুধু শুধু মা’র খেলি, বল তো?”
ফাহিমের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। হাস্যজ্বল কন্ঠে বলে উঠল,
“আমার ক্ষত তো কিছুদিন পরেই সেরে যাবে, মা। কিন্তু নয়নের বুকে যে ক্ষত দিয়েছি, সে ক্ষত যে জীবনেও সারবে না।”
রিমা বেগম ছেলের কথার মানে বুঝল না। অবুঝের মতো প্রশ্ন করলেন,
“তুই কিসের কথা বলছিস?”
ফাহিম উত্তর দিলো না। শুধু বলল,
“কিছুনা। তুমি বুঝবে না। তুমি বরং এখন নিজের ছেলের বউকে ঘরে তোলার ব্যবস্থা করো। তোমাকে যেভাবে বলেছি সেভাবে গিয়ে চাচ্চুকে বুঝাও। বাকি কাজ চাচ্চু নিজেই করবে।”
রিমা বেগমের মুখটা অন্ধকার হয়ে এলো। অসন্তোষ স্বরে বললেন,
“তারাকে আমার একদম পছন্দ না। কেমন সারাদিন ডিঙ্গি মেয়ের মতো সারা বাড়ি লাফিয়ে বেড়ায়। বকবক করে কানের মাছি উড়িয়ে ফেলে। বিরক্তিকর!”
রিমা বেগমের কথা শেষ হতে না হতেই ফাহিম ধমকের স্বরে বলে উঠল,
“মা। আমি তারাকে ভালোবাসি। তারাকে আমার যে করেই হোক চাই। তারার নামে একটাও বাজে কথা বললে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। যাও এখান থেকে।”
ছেলের এমন ধমকে রিমা বেগম আর কথা বলার সুযোগ পেলো না। বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। ফাহিম মোবাইলের ওয়ালপেপারে তারার হাস্যজ্বল ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
“স্যরি, আমার জান। বিশ্বাস কর, তোকে এভাবে কাঁদতে দেখে আমার বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। আমি তোকে এভাবে কাঁদাতে চাইনি। কিন্তু, কী করব বল? আমি যে তোকে বড্ড ভালোবাসি। তোকে ছাড়া থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমার চোখের সামনে তুই নয়নের সাথে ঘুরে বেড়াবি। অন্য একজনকে ভালোবাসবি। এটা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। তাই তোকে সারাজীবন আমার কাছে রাখার জন্য এই জঘন্য খেলায় নামতেই হলো। আমাকে ক্ষমা করে দিস, প্লিজ সোনা। কথা দিচ্ছি আজকেই শেষ। একবার তোকে পেয়ে যাই আর কখনো তোর চোখে পানি আসার সুযোগ দিব না। প্রমিস।”
বলেই তারার ছবিতে শব্দ করে চুমু খেয়ে, মোবাইলটা বুকের ভেতর আগলে রাখল। ফাহিমের চোখের কোনেও পানি। যতই হোক তারার প্রতি ওর ভালোবাসাটা তো সত্যি। ভালোবাসার লোভে যে ফাহিম অন্ধ হয়ে যাচ্ছে সেটা ও নিজেও জানেনা।



দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই জাহানারা বেগম দেখলেন নয়ন সিগারেট হাতে নিয়ে বেলকনির চেয়ারে বসে আছে। মাথাটা দেয়ালের সাথে ঠেকিয়ে আছে। চুলগুলো উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে৷ মুখটা মলিন।চোখ দুটো ফুলে আছে। ছেলেটাকে দেখেই জাহানারা বেগমের বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। আলতো করে হাত রাখল নয়নের কাঁধে। মায়ের ছোঁয়া পেতেই নয়ন তড়িঘড়ি করে চোখ খুলল। হাতের সিগারেট তাড়াতাড়ি ফেলে দিল। আমতা আমতা করে বলে উঠল,
“তুমি কখন এসেছো, আম্মু?”
জাহানারা বেগম উত্তর না দিয়ে পাশের চেয়ারে বসল। ছেলের এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করতে করতে বললেন,
“ভালোবাসি, তারাকে?”
নয়ন চোখ ঘুরিয়ে নিলো। প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলল,
“আমার একটু কাজ আছে, আম্মু। আমি আসি ”
বলেই উঠে দাঁড়াতে চাইল। জাহানারা বেগম ছেলেকে বাঁধা দিয়ে বলে উঠলেন,
“মায়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায়না, বাবা। তুই তো নিজের মুখেই তখন সবার সামনে বলেছিস।তাহলে এখন আমাকে বলতে প্রবলেম কোথায়?”
নয়ন সময় নিলো না। মাকে ঝাপটে ধরল দুইহাতে। বলতে লাগল,
“আমার তারা আমাকে ঠকিয়েছে, আম্মু। আমার বুকে ছু’ড়ি চালিয়েছে। বিশ্বাস করো, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতরটা যন্ত্রণায় চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আমি আর পারছিনা সহ্য করতে। এই যন্ত্রণার থেকে ম’রে যাওয়াই ভালো।”
জাহানারা বেগম ছেলেকে আরো শক্ত করে বুকে আগলে নিলেন। তার চোখেও পানি। তার এমন শক্তপোক্ত ছেলেটা এমন ভাবে ভেঙে পড়েছে, তা সে মানতে পারছেনা। নিঃশব্দে নয়নের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। ছেলের যন্ত্রণা কমার জন্য দোয়া করতে লাগলেন।



তারা কাল সারারাত ঘুমায়নি। সকাল সকাল বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে। আজকে তাকে নয়নের মুখোমুখি হতেই হবে। সত্যিটা জানাতেই হবে। কালকে ভয় পেয়ে এত বড় অন্যায় মেনে নেওয়াটা তারার জীবনের সবথেকে বড় ভুল। সবার সামনে কালকে সত্যিটা বলে দিলে হয়ত আজকে তারাকে এভাবে কাঁদতে হতোনা। সবার চোখে খারাপ হতে হতো না। তারা অনেক ভেবে শপথ নিয়েছে ওর যা হওয়ার হবে, কিন্তু সব সত্যি নয়নকে জানাতেই হবে। নিজের গায়ে এর বড় একটা মিথ্যা কলঙ্কের দাগ নিয়ে তারা সারাজীবন বাঁচতে পারবে না। কিছুতেই পারবে না। বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। কিন্তু এত সকালে কোনো গাড়ি পাচ্ছে না। দূরে একটা রিকশা দেখে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কেউ একজন পেছন থেকে তারার হাতটা চেপে ধরল। তারার পা জোড়া থেমে গেলো। অবাক নয়নে পেছনে ঘুরে দেখল ফাহিম দাঁড়িয়ে আছে। ফাহিমকে দেখেই তারার রাগটা যেন মাথা নেড়ে উঠল। ঘৃণায় অঙ্গপ্রতঙ্গ শিরশির করে উঠল। এক টানে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। ফাহিমের দিকে তর্জনী আঙ্গুল তাঁক করে গর্জে বলে উঠল,
“আমাকে ছোয়ার বিন্দু মাত্র সাহস করলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না, ফাহিম ভাই।”
ফাহিম হাসল। হাস্যজ্বর স্বরে বলে উঠল,
“আমি তোকে ভালোবাসি, তারা। আ…।”
ফাহিম কথাটা শেষ করতে পারল না। তার আগেই তারা ফাহিমের গালে সপাটে একটা থা’প্পড় মে’রে বসল। ফাহিমের কলার দুই হাতে খাবলে ধরল। চিৎকার করে বলতে লাগল,
“ভালোবাসেন! সত্যি ভালোবাসেন! ভালোবাসার মতো পবিত্র শব্দটা আপনার মুখে মানায় না। যাকে ভালোবাসেন তার সম্মানে এতবড় একটা দাগ লাগাতে যে একবার ভাবল না, সে কোন মুখে ভালোবাসার কথা বলছে? আমারেই ভুল আমি কালকে আপনার মতো জঘন্য মানসিকতার একজনের কথায় ভয় পেয়ে মিথ্যা বলেছিলাম। নিজের প্রতি অন্যায় হওয়ার পরেও প্রতিবাদ করেনি। নিজের সম্মান নিজের হাতে নষ্ট না করে, সবার সামনে আপনার দুই গালে সপাটে থা”প্পড় মা’রা উচিত ছিল। আপনার সব কুকর্মের কথা বলে দেওয়া উচিত ছিল জোর গলায়। আর কেউ না হোক অন্তত নয়ন ভাই আমাকে বিশ্বাস করতো। আমি অনেক চুপ থেকেছি। অনেকদিন ধরে আপনার ভয়ে অনেক অন্যায় মুখ বুঝে মেনে নিয়েছি। কিন্তু আর না। কালকে আপনি সব লিমিট ক্রস করে ফেলেছেন। এবার আমি সবাইকে সব সত্যিটা বলব। আজকেই বলব৷”

#চলবে

[ভুলগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে