প্রিয় নয়নতারা পর্ব-০১

0
708

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#সূচনা_পর্ব

বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত সব আত্মীয়ের সামনে তারার গালে পর পর দুইটা থাপ্পড় মে’রে নয়ন চ্যাঁচিয়ে বলে উঠল,
“বিয়ে বাড়ির সবার চোখের আড়ালে একটা ছেলের সাথে একা রুমে কি করে যেতে পারলি তুই, তারা? এতটা নির্লজ্জ হয়ে গেছিস! ছিহ! ভাবতেই আমার তোর প্রতি ঘৃণায় গা শিরশির করে উঠছে।”
নয়নের কথা শেষ হতে না হতেই তারার দুই চোখ বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল। লজ্জা আর ব্যাথায় তারা ঠিক কোথায় মুখ লুকাবে বুঝতে পারল না। গাল দুটো ব্যাথায় জ্বলছে। গালে হাত দিয়ে,অশ্রুসিক্ত নয়নে সবার দিকে একবার নজর দিলো। বাড়ির সবাই নয়ন আর তারার দিকে চেয়ে আছে অবাক দৃষ্টিতে। তারা এবার শব্দ করে কান্না করে উঠল। তাতে নয়নের রাগটা যেন দ্বিগুণ হয়ে গেলো। জোরে চিৎকার করে বলে উঠল,
“চুপ! একদম চুপ! একদম আমার সামনে ন্যাকা কান্না কাঁদতে আসবি না। তোর মতো নির্লজ্জ মেয়ে একটাও দেখিনি। এই শিক্ষা দিয়েছে তোকে, মামা আর মামনি? ছিহ!”
বাড়ির সবাই এখনো নিরব। তারার বাবা সোফায় বসে আছে শান্ত হয়ে। নয়নের মা এবার নয়নের দিকে তেড়ে গেলো। ধমকের স্বরে বলতে লাগলেন,
“নয়ন, তোর স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমার ভাইয়ের বাড়িতে দাঁড়িয়ে, আমার ভাইয়ের মেয়ের গায়ে হাত তুলছিস? তাও আবার এতগুলো লোকের সামনে! কোন সাহসে তুই ওর গায়ে হাত দিলি?”
নয়ন রাগে দাঁত কটমট করতে করতে বলল,
“তার আগে তুমি তোমার আদরের ভাইঝিকে জিজ্ঞেস করো, ও একটা ছেলের সাথে একা রুমে দরজা বন্ধ করে কি করছিল?”
কথাটা শুনেই উপস্থিত সবাই চমকে উঠল। তারার বাবা এখনো কিছু বললেন না। কিন্তু তারার মা রুবিনা এবার গর্জে উঠে বললেন,
“নয়ন! কী বলছিস এসব তুই? তারা কেমন মেয়ে সেটা তুই খুব ভালো করেই জানিস, তবুও কেন এসব বলছিস?”
নয়ন প্রতি উত্তরে কড়া স্বরে বলল,
“ভুল চিনতাম, মামনি। তারাকে আমি ভুল চিনেছিলাম। নিজের চোখকে অবিশ্বাস করি কিভাবে, বলো?”
আহসান সাহেব এবার মুখ খুললেন। শান্ত স্বরেই জিজ্ঞেস করলেন,
“নয়ন, আমি তোর কথা এখনো বুঝতে পারছিনা। কী হয়েছে সেটা আমাকে একটু বুঝিয়ে বল তো বাবা। ”
নয়ন সোজাসাপটা উত্তর দিলো,
“তারা আর ফাহিমকে আমি একই রুমে, একই বিছানায় ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেছি, মামু।”
কথাটা শুনেই আহসান সাহেব সোজা বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। বাড়ির সকলের চক্ষু যেন চড়ক গাছে। তারা কথাটা শোনার সাথে সাথে দুই হাতে কান চেপে ধরে চিৎকার করে বলে উঠল,
“চুপ করো, নয়ন ভাই। কীসব বলছো তুমি? তুমি যা দেখেছো তা সত্যি নয়। ফাহিম ভাই আর আমি…।”
তারার সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার আগেই, একজন বলে উঠল,
“তারা আর আমি কাল সারারাত একসাথে ছিলাম।”
কথাটা তারার কানে পৌঁছাতেই তারা পেছনে ফিরে দেখল ফাহিম দাঁড়িয়ে আছে। উপস্থিত সবাই এখনো সব কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। ফাহিম কথাটা বলে সামনে এগিয়ে আসল। নয়ন চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে ফাহিমের দিকে। তারা অবাক স্বরে বলে উঠল,
“এসব আপনি কী বলছেন, ফাহিম ভাইয়া? আমি আপনার সাথে কাল রাতে ছিলাম না। আপনি…।”
ফাহিম তারাকে থামিয়ে দিলো। বলে উঠল,
“তারা মিথ্যা কেন বলছো? ভয় পেও না। আমি তোমার পাশে আছি। সত্যিটা সবার সামনে স্বীকার করে নাও। কেউ তোমাকে বকবে না। আমি আছি তো।”
তারার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। থম মে’রে গেলো মুহূর্তেই। ফাহিম এবার সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
“আমি আর তারা দুজন দুজনকে ভালোবাসি, চাচ্চু। আমরা নিজেদের ইচ্ছায় দুজন দুজনের কাছাকাছি এসেছি, এটা বলতে আমার কোনো লজ্জা নেই। এবার আপনাদের যা করার আপনারা করে নিন।”
তারার এবার চুপ করেই রইল। কোনো উত্তর দিলো না। নয়ন আর সহ্য করতে পারল না। দুই হাতে ফাহিমের শার্টের কলার খাবলে ধরল। ফাহিমের নাক বরাবর ঘু-ষি মে’রে বলে উঠল,
“তুই কোন সাহসে আমার তারার দিকে হাত বাড়িয়েছিস? কোন সাহসে আমার তারাকে ভালোবাসার কথা বলছিস?”
বলেই আরো কয়েকদফা ঘু’ষি মারা শুরু করল। ফাহিমও কম যায় কিসে? দুজনে মিলে মুহূর্তেই এক্টা ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেলো। বাড়ির বাকি সবাই মিলে ওদের দুজনকে থামানোর চেষ্টা করছে। তারা ভয়ে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নয়ন একাধারে ফাহিমকে ঘু’ষি মে’রেই যাচ্ছে। ফাহিমের নাক দিয়ে ইতোমধ্যে রক্ত পড়া শুরু হয়ে গেছে। তবুও নয়ন থামছে না। পরিস্থিতি খারাপ দেখে আহসান সাহেব জোরে চ্যাঁচিয়ে বলে উঠলেন,
“নয়ন, ফাহিমকে ছেড়ে দে। আমার সম্মান এভাবে আর নষ্ট করিস না তোরা।”
নয়ন ছাড়ল না। ওর কানে এখন আর কোনো কথা ঢুকছে না। তারা আর চুপ করে থাকতে পারল না৷ তারা খুব ভালো করেই নয়নকে চিনে। নয়ন কিছুতেই থামবার পাত্র নয়৷ তারা এবার জোরে চিৎকার করে বলে উঠল,
“নয়ন ভাই, থামো প্লিজ। আমি ফাহিমকে ভালোবাসি। ওকে আর মে’রো না।”
নয়ন থেমে গেলো। বিস্মিত চোখে তাকাল তারার দিকে। ফাহিমকে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চুপে উঠে দাঁড়াল। ফাহিমের মুখে জয়ের হাসি। পরিস্থিতি কয়েক মুহূর্তের জন্য থমথমে হয়ে গেলো। এক বিষাক্ত নিরবতা ছেয়ে গেলো পুরো বাড়িতে৷ নয়ন কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে হনহন করে চলে বাড়ির বাইরে। নয়ন চলে যেতেই তারা হাউমাউ করে কান্না করে উঠল। তনয়া দৌড়ে এসে তারাকে জড়িয়ে ধরল। তনয়া হলো তারার বড়বোন৷ সৈয়দ বাড়ি জুড়ে আজ থেকে তনয়ার বিয়ের উৎসব শুরু হয়ে ছিল। সকাল সকাল তনয়ার মেহেন্দীর তোড়জোড় চলছিল। হুট করে কী থেকে কী হয়ে গেলো। কেউ বুঝতে পারছেনা। তনয়া তারার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠল,
“কাঁদে না বোন আমার। কী হয়েছিল সত্যি করে বল? সবটা খুলে বল। আর কেউ বিশ্বাস না করলেও আমি তোকে বিশ্বাস করি। আমার বোন কোনো খারাপ কাজ করতে পারে না৷ প্লিজ বোন, চুপ করে থাকিস না বল আমাকে।”
তারা একাধারে কান্না করেই চলেছে। ফাহিমকে জুড়ে ফাহিমের মায়ের কান্নাকাটি চলছে। তনয়ার কথা শেষ হতেই ফাহিমের রিমা বেগম চ্যাঁচিয়ে বলে উঠলেন,
“ও আর কি বলবে রে, তনু? ওর সেই মুখ আছে নাকি?”
তনয়া ঝাঝালো স্বরে বলে উঠল,
“আপনাকে কেউ জিজ্ঞেস করেনি,চাচি। আপনি চুপ থাকুন৷”
তনয়ার এমন ঝাঁঝালো স্বর শুনে রিমা বেগম চুপসে গেলেন। ফাহিম চুপ করে সোফায় বসে আছে। রুবিনা বেগম এবার তারাকে শান্ত স্বরেই বলে উঠলেন,
“তারা, আর চুপ করে থাকিস না। বল না, মা। ভয় পাস না। আমরা আছি তো।”
তারার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। এতক্ষণ পরে মুখ খুললেন ফাহিমের বাবা মোস্তফা। তারার সামনে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“তারা, মা। তুই ভয় পাস না। আমরা সবাই তোর পাশে আছি। তুই সবটা খুলে বল তো। ফাহিমকে কি তুই সত্যিই ভালোবাসিস? নাকি ফাহিম তোর সাথে খারাপ কিছু করেছে?”
মোস্তফা সাহেবের কথা শেষ না হতেই রিমা বেগম গর্জে উঠলেন। বললেন,
“নিজের ছেলেকে অবিশ্বাস করে, অন্যের মেয়ের মুখের থেকে তুমি সত্যি শুনতে চাচ্ছো?”
মোস্তফা সাহেব চোখ রাঙিয়ে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। বললেন,
“তারা অন্যের মেয়ে না। আমার ছোট ভাইয়ের মেয়ে। আমাদের মধ্যে তোমার বা তোমার ছেলের কথা না বলাই মঙ্গল। চুপচাপ ফাহিমকে নিয়ে ঘরে যাও। ”
রিমা বেগম স্বামীর রাগে চুপ হয়ে গেলেন। ফাহিম বসে বসে তামাশা দেখছে। কোনোরকম রিয়েক্ট করছে না। রুবিনা বেগম পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
“আর চুপ করে থেকে ঝামেলা বাড়িয়ে দিস না, মা। সত্যিটা বল।”
তারা এবার কিছুটা শান্ত হলো। কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না। মেয়েটা যে খুব ভয় পেয়ে আছে তা তনয়া খুব ভালো করে বুঝতে পারছে। তাই বলে উঠল,
“এখন এসব ছাড়ো, মা। পরে সব জানা যাবে। যা হওয়ার তো হয়েই গেছে। আমি এখন ও’কে ঘরে নিয়ে যাচ্ছি। বাকি আলোচনা পরে হবে। ”
তনয়া কথাটা বলেই তারাকে নিয়ে ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আহসান সাহেব চ্যাঁচিয়ে বলে উঠলেন,
“সত্যিটা না বলা অব্দি, তারা এক পাও এখান থেকে নড়তে পারবে না।”
তারা থেমে গেলো। এবার চুপ করে রইল না। আহসান সাহেবের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল। খুব শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিল,
“এতক্ষণ এখানে যা যা শুনেছো সব সত্যি, বাবা। আমি ফাহিম ভাইকে ভালোবাসি। আর কাল সারারাত আমি তার সাথেই, তার ঘরে এক বিছানায় ছিলাম। বাকিটা আশা করি তোমাদের ব্যাখা দিতে হবে না। আমা…।”
তারা সম্পূর্ণ কথা শেষ না হতেই তারার গালে সজোরে থাপ্পড় মে’রে বসলেন আহসান সাহেব। তারা ঘাবড়ালো না। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন এই থাপ্পড়টার অপেক্ষায় ছিল। আহসান সাহেব পর পর দুটো থা’প্পড় মে’রে চিৎকার করে বলতে লাগলেন,
“আমার ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে তুই আমার মেয়ে। তোকে আমি জন্ম দিয়েছি। ছিহ! আজ থেকে আমার কাছে তুই মৃত৷ আজ থেকে আমার একটাই মেয়ে।”
বলেই তিনি নিজের ঘরের দিকে হাঁটা শুরু করল। রুবিনা বেগম মুখে আঁচল গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে স্বামীর পেছনে দৌড়ে গেল। রিমা বেগম ফাহিমকে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। যাওয়ার আগে অবশ্য তারাকে কিছু বাজে কথা শুনাতে ছাড়েনি। মোস্তফা সাহেব অন্যান্য লোকজনদের বিদায় দিতে ব্যস্ত। তনয়াও পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে, বাবাকে বুঝানোর জন্য আহসান সাহেবের রুমের দিকে গেলো। একে একে সবাই চলে গেলেও থেকে গেলো। তারা ড্রয়িং রুমের মেঝেতে বসে আছে। নিশ্চুপ হয়ে৷ চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। শান্ত ভঙ্গিতে বসে বসে চোখের পানি বির্সজন দিচ্ছে। হঠাৎ করেই চিৎকার করে উঠল। পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,
“একটা ভুলের শাস্তি এতটা ভয়ানক কেন হলো? কেন আমাকে এভাবে একা করে দেওয়া হলো? কেনো? কেনো? শুধুমাত্র ভালোবাসার অপরাধে?”

~ইন_শা_আল্লাহ _চলবে~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে