প্রিয় চন্দ্রিমা পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
630

#প্রিয়_চন্দ্রিমা
Sumon Al-Farabi
#শেষ_পর্ব
অবন্তী আর চন্দ্রিমাকে রিসিভ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ পরেই তাদের বাস এসে হাজির হলো। তাদের নিয়ে বাসায় রেখেই আমি আবার অফিসে চলে আসলাম। মায়া হয়তো একটু পরেই আসবে তাই জন্য আমি কাজে চলে আসি।
দুপুরের দিকে মায়া দরজার সামনে কয়েক বার কলিং বেল বাজানোর পর চন্দ্রিমা এসে দরজা খুলে দিলো।
মায়া কোনো কিছু না ভেবেই চন্দ্রিমা কে জড়িয়ে ধরলো।
– আমার কত দিনের ইচ্ছে ছিলো তোমাকে দেখবো। অবশেষে তোমাকে দেখার ইচ্ছে আমার পূর্ণ হলো।
চন্দ্রিমা এতক্ষণ শুধু মায়ার কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলো। মায়ার কথা শেষ হতেই চন্দ্রিমা বললো- আপনি কে?
– আমি তোমার মায়া আপু। তুমি অবন্তী না?
– আমি চন্দ্রিমা। অবন্তী ভিতরে আছে। ভিতরে আসুন।

মায়া অবন্তী আর চন্দ্রিমা তিনজন মিলে রাতের জন্য রান্না করলো। কিন্তু আমি বাসায় ফেরার আগেই মায়া বাসা থেকে চলে গেলো।

রাতে বাসায় ফিরে অবন্তীর থেকে জানতে চাইলাম মায়া এসেছিলো কি না!
– আপু এসে আবার চলে গিয়েছে। তবে আপুর কি কোনো প্রকার মানসিক সমস্যা আছে!
– এমন প্রশ্ন কেন?
– আপু কেমন অস্থির ছিলো পুরোটা সময়। আমি আর চন্দ্রিমা যখন রান্না ঘরে রান্না করছিলাম তখন উনি বড় মা’র রুমে এসে কি যেন খুজছিলো।
এটা শুনে আমি মুচকি হেঁসে বললাম – ও আম্মুর রুমে একটু বেশি যাতায়াত করতো তো। ওর কিছু ছিলো মনে হয় ঐ রুমে তাই খুজেছে।
– হবে হয়তো।
রাতের খাবার একসাথে খেয়ে অবন্তী আর চন্দ্রিমা আম্মুর রুমে চলে গেলো। আমি আমার রুমে এসে কিছুক্ষণ ফেসবুক ঘাটাঘাটি করলাম।

এখন মোটামুটি গভীর রাত। হয়তো অবন্তী আর চন্দ্রিমা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার রুমের বেলকনিতে গিয়ে একটা সিগারেট জ্বলালাম।
– তুমি সিগারেট খাও!
অবন্তী ভেবে তড়িঘড়ি করে সিগারেট লুকিয়ে ফেললাম। কিন্তু সে চন্দ্রিমা ছিলো। তাই আবার বের করলাম।
– হুম।
– এটাতে কি সুখ পাও?
– ঠিক সুখ না তবে পৈশাচিক একটা প্রশান্তি মেলে।
– কিভাবে!
– এই যে ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে আমার মনের মাঝে থাকা সব ডিপ্রেশন আমার সব কষ্ট, যন্ত্রণা সব কিছু সেই ধোঁয়ার সাথে উড়ে উড়ে ঐ আকাশে চলে যাচ্ছে।
– এই সব কিছু মনের ভ্রম।
– তুমি এতো রাতে এখানে কেনো?
একটা হাত এতক্ষণ থেকে পিছনে ছিলো সেই হাতটা সামনে নিয়ে আসলো।
– এটা কোথায় পেলে! আমার এই টি-শার্ট তো হারিয়ে ফেলেছি।
– হারায় নি। আমি চুরি করেছিলাম।
– কেন!
– তোমাকে আমার ভালো লাগে সেটা তো তোমাকে বলার সাহস হয়নি। তোমার সাথে আমার সব সময় কথা বলতে ইচ্ছে হয় সেটাও তো বলতে পারিনি। তাই তোমার টি-শার্ট এর সাথে সব সময় কথা বলতাম।
– এতে করে কি লাভ হয়?
– ঐ যে প্রশান্তি পাই।
– তো ফেরত দিচ্ছো কেন?
– আমি প্রতিনিয়ত এটার প্রতি প্রচন্ড আসক্ত হয়ে পড়ছি। তাড়াছা এখন তো তুমি কাছেই আছো কিছু দিন। ডিরেক্ট তোমার সাথেই কথা বলতে পারবো। তাই এটার দরকার পড়বে না।
– মাথা থেকে এইসব ভুত তাড়িয়ে দাও। যা করতে আসছো সেটা করো। ছোট মা’র কানে যদি এই কথা যায় তবে তোমার কি হবে ভাবছো!
– সেটা তুমি ভাববে।
– রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।
চন্দ্রিমা আর কিছু না বলে রুমে যেতে লাগলো।
– এই শোনো।
– বলো।
– সিগারেটের কথা যেন অবন্তী না জানে।
– আচ্ছা।
এমনটা নয় যে চন্দ্রিমা কে আমার মনে ধরেনি। প্রথম দেখার পর থেকে অবসরে চন্দ্রিমা কে খুঁজতাম। কিন্তু যখন জানতে পারলাম চন্দ্রিমা ছোট মা’র ভাগ্নী তখন থেকে নিজের চাওয়াকে দাবিয়ে রাখতে লেগেছি। তাছাড়া চন্দ্রিমার মায়াবী চোখের চাহনিতে যে কেউ ঘায়েল হবে।

পরের দিন সকালে অবন্তী আর চন্দ্রিমা কে নিয়ে চারপাশে একটু ঘুরলাম। বাসায় ফেরার পথে বাসার পাশের একটা ভালো এডমিশন কোচিং-এ অবন্তী আর চন্দ্রিমা কে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসলাম।

বিকেলের হঠাৎ বৃষ্টিতে চন্দ্রিমা আমি অবন্তী দীর্ঘ সময় ভিজলাম। আমার ছোট বেলা থেকেই অল্প ঠান্ডাতেই অসুখ বেঁধে যায়। এবার অবশ্যই তার ব্যাতিক্রম কিছুই হবে না। রাতের খাবারের সময় হতে না হতেই জ্বর সর্দি এসে জুড়ে বসেছে। অবন্তী জোর করে একটু খাইয়ে দিলো। এরপর ঔষধ খেয়ে নিজের রুমে কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে পড়লাম।
– ভাইয়া!
কাঁপা কাঁপা হাতে মাথা থেকে কম্বল সরালাম।
– এই গরম দুধ খেয়ে নাও। হয়তো ভালো লাগবে।
– আমি এখন কিছুই খাবো না। আমার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে।
চন্দ্রিমা অবন্তীকে ওর রুমে পাঠিয়ে দিয়ে কোলে আমার মাথা তুলে নিয়ে চুলগুলো ধীরে ধীরে টানতে লাগলো। মা’য়ের মতো স্নিগ্ধ কোমল স্পর্শ অনুভব হচ্ছে। প্রতিটি পুরুষের চাওয়া থাকে ঠিক তার মায়ের মতোই কেউ একজন তার জীবন সঙ্গী হোক। আজ চন্দ্রিমার স্পর্শে আমি দীর্ঘ দিন পর আম্মুর স্পর্শ অনুভব করতে পারছি।
পরদিন সকালে যখন চোখ খুললাম তখন বুকের উপর ভারী কিছু একটার উপস্থিতি লক্ষ করলাম। মনে হচ্ছে বুকের মাঝে এই ভারী বস্তুটা কেউ খোদাই করে বসিয়ে দিয়েছে। যখন মাথা তুলে দেখলাম সেটা চন্দ্রিমা ছিলো। মেয়েটা মনে হয় গতকাল রুমেই যায় নি। ধীরে ধীরে চন্দ্রিমার মাথা বুক থেকে নামিয়ে বালিশে দিলাম। এরপর ওকে ভালো করে শুইয়ে দিলাম।
গতকাল রাতের থেকে আজ মাথাটা বেশ হালকা লাগছে। ধীরে পায়ে হেঁটে বাড়ির সামনে আঙ্গিনায় গেলাম। সেখানে ফালানো চেয়ারে বসে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে সকালের মিষ্টি রোদের ছোয়া উপভোগ করেছি।
– তুমি এখানে!
অবন্তী চা হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
– কিছু বলবা?
– তোমার জন্য চা নিয়ে এসেছি।
– ওহ আচ্ছা। দাও এদিকে।
– এখন কেমন লাগছে?
– গতকাল রাতের থেকে ভালো। চন্দ্রিমা কি সারারাত আমার রুমেই ছিলো?
– একবার রুমে এসে শুয়ে পড়েছিলো। কিন্তু মাঝ রাতে আবার তোমার রুম থেকে অদ্ভুত আওয়াজ আসছে শুনে দৌড়ে আসি। তখন তোমার জ্বর অনেক বেড়েছে। আমি তোমার মাথায় পানি পট্টি দিচ্ছিলাম। কিন্তু আমার শরীর ও হালকা খারাপ ছিলো জন্য ও জোর করে আমায় রুমে পাঠিয়ে সারা রাত তোমার মাথায় পানি পট্টি দিয়েছে। মেয়েটা অনেক ভালো জানো। তবে ও কিন্তু এখানে কোচিং ভর্তি হতে আসে নি।
– তাহলে!
– ও তোমার জন্য এসেছে। ঐ কয়েকদিনে তোমার প্রতি অনেক দুর্বল হয়ে গিয়েছিলো। পরীক্ষা শেষ তাই বাসা থেকে ওর জন্য পাত্র দেখছে। এরপর দুজন মিলে বুদ্ধি করে এখানে চলে আসি। যদি তুমি ওকে রেখে দাও সেই আশায়।
– বাহ্। আমার বোন আমার জন্য পাত্রী ঠিক করে সেটা আবার সাথে করে নিয়ে এসেছে।
দু’জনেই হাসাহাসি করছি। হঠাৎই অবন্তী বললো- জানো ভাইয়া ওর আব্বু আম্মু কেউ বেঁচে নেই। ছোট বেলা থেকে আমাদের বাসায়। মাঝে মাঝে ওকে খুব উদাস দেখি। কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতে পারি ও একজন নিজের মানুষের অভাবে উদাস হয়ে যায়। তোমার মাঝে ও নিজের উদাসীনতার সীমান্ত দেখতে পায়। তুমি ওকে রেখে দিলে খুব ভালো হবে।
– তুমি অনেক বড় হয়ে গেছো দেখছি। তোমার আম্মুর ভাইয়ের ( ছোট মা’র ভাই শব্দটা আসতেই ডায়েরির কথা মনে পড়ে গেলো)
– অবন্তী তুমি আমার রুমে গিয়ে আমার বালিশের কাছে তোশক এর নিচে একটা ডায়েরি আছে ঐটা নিয়ে আসো।

অবন্তী উঠে গিয়ে ডায়েরি টা নিয়ে আসলো। সেখানে থেকে আম্মু আর ছোট মা’র ছবিটা বের করে দেখলাম – এটা বিষয়ে কিছু জানো কি তুমি!
বড় বড় চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে অবন্তী – এটা তো অসম্ভব ভাইয়া। আমি কি সত্যি দেখছি?
ডায়েরি টা অবন্তীর হাতে দিয়ে বললাম – যে পেইজটা ভাজ করা আছে সেটা জোরে পড়।
অবন্তী পেইজটা পড়তে শুরু করলো – আল্লাহ এমন অবিচার কখনোই সহ্য করবে না। আমার অপরাধের শাস্তি আমার মেয়ে কেন পাবে! ও তো নিষ্পাপ ছিলো। আমার টুইনস বাবুর একজন কে আজ বিসর্জন দিতে হলো। আমি যদি আগে জানতাম এমন কিছু হবে তবে কখনোই তোকে ঐ বাড়িতে পাঠাতাম না মা। আমায় ক্ষমা করে দিস। তোর আম্মু তোকে বাঁচাতে পারলো না।

– তোমারা টুইনস ছিলে!
– আমি ও এই ডায়েরিটা পড়ার পরেই জেনেছি। সুমন এবং সুনয়না।
– ডায়েরিটা কার! অনেক পুরোনো মনে হচ্ছে।
– ডায়েরি টা আম্মুর। এখানে বিচ্ছেদের পর থেকে লেখা আছে।
অবন্তী তড়িঘড়ি করে বললো- ভাইয়া এখানে দেখে।
ডায়েরির উপরে আঠা দিয়ে একটা ছোট কালো কাগজে কালো কালি দিয়ে কিছু একটা লেখা। যেটা এর আগে আমার নজরে আসে নি। খুব সুক্ষ্ম ভাবে লেখা আমার জীবনের ২য় ডায়েরি।
– ভাইয়া আম্মুর আর ও একটা ডায়েরি আছে। যেটা খুঁজে পেলেই হয়তো আমরা সম্পূর্ণ ঘটনাটা জানতে পারবো।
চন্দ্রিমা অবন্তীর পাশে এসে দাঁড়ালো। আমি অবন্তীর হাত থেকে ডায়েরি টা নিয়ে রুমে চলে আসলাম।

একটু পরেই সকালের খাওয়া শেষ করে কাজে বেরিয়ে পড়লাম। বিকেলের দিকে চন্দ্রিমা কল করে কান্না করতে শুরু করলো।
– কি হয়েছে! কান্না করছো কেন?
কিন্তু চন্দ্রিমা কোনো কথা বলছে না। অবন্তী পাশে থেকে বলছে- এভাবে কান্না করলে কিছুই ঠিক হবে না। আমায় ফোন দাও।
চন্দ্রিমার হাত থেকে ফোনটা করে নিয়ে অবন্তী বললো- ভাইয়া আম্মু একটু আগেই কল করেছিলো। চন্দ্রিমার বিয়ে ঠিক করেছে। আম্মু হয়তো কাল চন্দ্রিমা কে নিতে আসবে। আমি তোমায় সকালেই বলেছি ভাইয়া প্লিজ মেয়েটার লাইফটা নষ্ট হতে দিও না।
– সেখানে তো ও সুখেও থাকতে পারে তাই না?
– ও তোমার মাঝে নিজেকে খুঁজে পায়।
– তুমি কি চাও! আমায় কি করতে হবে!
– আমি চন্দ্রিমা কে আমার ভাবী বলে ডাকতে চাই। প্লিজ ভাইয়া।
– আচ্ছা।
অবন্তীর ফোন কেটে বাসায় আব্বু কে কল করে বলে দিলাম চন্দ্রিমা কে আমি বিয়ে করছি বাসা থেকে যেন কেউ না আসে ওকে নিতে।

এখন রাত।
আমার খুব কাছের কয়েকজন বন্ধু কে ডেকে বাসায় ছোট্ট পরিসরে বিয়ের কাজ শেষ করলাম। মায়াও আসতে পারেনি এইটুকু সময়ে। বাসরঘর, কিন্তু ঘরে ফুলের ছিটেফোঁটাও নেই। চন্দ্রিমা খাটে বসে আছে।
– সব কিছু কেমন হঠাৎই হয়ে গেলো তাই না!
– হঠাৎ হলেও ভালোই হয়েছে।
– তুমি জানো আমি তোমায় কেন বিয়ে করেছি?
– অবন্তী রিকুয়েষ্ট করছে জন্য।
– না, তোমার স্পর্শে আমি আম্মু কে খুঁজে পেয়েছি। পৃথিবীতে খুব মেয়ের মাঝে একজন ছেলে তার মা’কে খুঁজে পায়। কিন্তু আমি খুব সহজেই তোমার মাঝে খুঁজে পেয়েছি তাই আর হারাতে চাই নি।
– তাহলে আমি তোমায় একবার জড়িয়ে ধরি?
– তোমার বর একবার ধরবে নাকি দশবার ধরবে তোমার ইচ্ছে।
চন্দ্রিমা ঝটপট উঠে এসে আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

এখন প্রায় মাঝ রাত। দরজায় অনবরত ঠকঠক শব্দ । দরজা খুললাম। অবন্তী হাপাচ্ছে।
– কি হয়েছে!
অবন্তী আমার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।

(সমাপ্ত)
[ প্রথম সিজন এখানেই শেষ করলাম। দ্বিতীয় সিজনে সকল রহস্য উদঘাটন হবে ইনশাআল্লাহ। তবে এই সিজন সম্পর্কে আপনার মতামত জানাবেন প্লিজ। যাতে আপনাদের মতামতের উপর ভিত্তি করে খুব শীঘ্রই দ্বিতীয় সিজন দিতে পারি।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে