#প্রিয়_আসক্তি
#পর্বঃ১৬
#মাহমুদা_আক্তার_তাহিনা
ভোররাত!, প্রায় সাড়ে চারটার কাছাকাছি সময়। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তাহি। তাহির ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে তার ফোন বিকট শব্দ করে বেজে উঠে। ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে ফোন রিসিভ করে তাহি। ওপাশ থেকে তাহির টিমের একজন অফিসার সালাম দেয়। তাহি সালাম বিনিময় করে। অতঃপর যেটা জানতে পারলো, তা শুনে তাহির ঘুম পালিয়ে গেলো। তারাহুরো করে রেডি হয়ে ছুটলো, যেখানে সব অফিসার রা উপস্থিত রয়েছেন বর্তমানে।
.
সকাল সাতটার কাছাকাছি সময়৷ ফজরের নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে গেছিলো নিষ্প্রভ। উচ্চ শব্দের চিৎকার কানে আসতেই ধরফরিয়ে উঠে বসে। চিৎকার গুলো মূলত বসার ঘর থেকে আসছে। বিছানা থেকে উঠে চশমা পড়ে নিলো, ফোন হাতে নিয়ে সেদিকেই পা বাড়ালো নিষ্প্রভ। উদ্দেশ্য কি নিয়ে সবাই চিৎকার চেচামেচি করছে তা দেখা।
কি হয়েছে মা, এভাবে সবাই চিৎকার চেচামেচি করছো কেনো?
নিষ্প্রভের প্রশ্নে সকলের দৃষ্টি তার দিকে পড়ে। মূলত দীবার বউভাতের জন্য কিছু আত্নীয় এখনো রয়ে গেছেন নিষ্প্রভদের বাসায়। তাদের মধ্যে থেকেই একজন মহিলা বলেন- বাবা নিষ্প্রভ আজ দীবার বৌভাত হবে না, পেছানো হয়েছে। দেশের যা অবস্থা!
ভ্রু কুঁচকে যায় নিষ্প্রভের,-দেশের অবস্থা মানে?
আরেকজন মহিলা বলেন- আরে তুমি জানো না কিছু?
-জানলে কি আর আপনাদের জিজ্ঞেস করতাম?
মহিলাটি নিষ্প্রভকে টিভির দিকে ইশারা করলেন, নিষ্প্রভ ইশারা অনুযায়ী টিভির দিকে তাকালো। টিভিতে একটা খবরের চ্যানেল দেখা যাচ্ছে। চোখ ফিরিয়ে নিতে যাবে তখনই টিভি চ্যানেলে এক দৃশ্য দেখতে পায় নিষ্প্রভ। কোথাও আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা আগুন নিভানোর চেষ্টা করছেন। রিমোট হাতে নিয়ে টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দেয় নিষ্প্রভ।
একজন সাংবাদিক বলে উঠেন- আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, ছয়তলা বিশিষ্ট বিল্ডিংটিতে আগুন লেগেছে। কি কারণে আগুন লেগেছে সেটা পরে তদন্ত করে জানা যাবে। তার আগে বিল্ডিং এর ভিতরে থাকা মানুষ গুলোকে উদ্ধার করতে হবে। আগুন ইতিমধ্যেই কিছুটা নিয়ন্ত্রণের ভিতরে চলে এসেছে। তবে দুঃখের বিষয় হলো বিল্ডিংয়ের ভিতরে আটকে পড়া মানুষদের এখনো বের করা হয়নি। সিআইডির কিছু অফিসার ও ফায়ার সার্ভিসের কিছু অফিসার বিল্ডিংয়ের ভিতরে সতর্কতার সাথে ঢুকেছেন তাদের উদ্ধার করতে, কিন্তু আধাঘন্টা হয়ে গেছে তাদের ও কোনো খুঁজ নেই। ভিতরে ঠিক কি হচ্ছে বর্তমানে তা বলা যাচ্ছে না। তবে ভিতরে অবস্থানরত অফিসারদের মধ্যে কয়েকজনের নাম জানতে পেরেছি, তারা হলেন-ফায়ার সার্ভিসের মধ্যে রয়েছেন- নিলয় শেখ, নাহিদ আহমেদ, জীবন আহমেদ। সিআইডি অফিসারদের মধ্যে যারা রয়েছেন তাদের তিনজনের নাম আমরা জানতে পেরেছি- সিয়াম আহমেদ, নোরা সেন, তাহি মাহমুদ।
তাহি মাহমুদ নামটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে নিষ্প্রভ। তার কানে আর কিছু ঢুকছে না। বিরবির করে বার বার একই নাম আওরাতে লাগলো। মস্তিষ্ক যখন সচল হলো তখনই নিষ্প্রভ বাইকের চাবি নিয়ে বাড়ির বাইরে ছুটে আসে। নিষ্প্রভদের বাসায় উপস্থিত মহিলারা সব আশ্চর্য হয়ে যান, দিয়া হাসানের মুখে রা নেই। যেনো তিনি জানতেন এমনই কিছু হবে। দিয়া হাসান মনে মনে দোয়া করলেন -, আমার ছেলের মুখের হাসি কেঁড়ে নিও না মাবুদ।
.
আরো আধা ঘন্টা পাড় হয়ে গেছে। আগুন নিভাতে সক্ষম হয়েছের ফায়ার সার্ভিস রা। বিল্ডিংটি বাইরে থেকে দেখতে খুবই বিভৎস লাগছে। সেই কবে থেকে পাগলামি করছে নিষ্প্রভ কিন্তু থাকে কোনো অফিসার বিল্ডিংটির আশে-পাশে তো দূর, গেইটের সামনেই দাঁড়াতে দিচ্ছে না। পুলিশ অফিসার রা চারিদিক ঘিরে রেখেছে। সাধারণ মানুষরা ভীড় জমালেও তাদের আশেপাশে আসতে দেওয়া হচ্ছে না।
বিল্ডিংটির পিছন দিকে দিয়ে মানুষ আসতে দেখা গেলো, মুহূর্তেই সকলের দৃষ্টি সেদিকে যায়। কিছু অফিসার রা সেদিকে এগিয়ে যান, উদ্ধারকৃত মানুষদের দড়ি দিয়ে নিচে নামাচ্ছে তাহিসহ বাকি সব অফিসার রা, যারা উদ্ধার করার জন্য বিল্ডিংয়ের ভিতরে ঢুকেছিলেন। আস্তে আস্তে সবাইকে নামানো হয়। সব অফিসারকে নামতে নির্দেশ দেয় তাহি। সবাই নেমে গেলে নিজেও দড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে নামতে শুরু করে। ছয়তলা বিশিষ্ট বিল্ডিং থেকে নামতে উদ্ধার করা মানুষদের কলিজা কেপেছে। তাহির ও ভয় করছে না তেমন নয়। তবে সে এসবে অভস্ত্য হয়ে গেছে। তাহি নিচে নামতেই সবাই সামনের দিকে হাটা ধরে। তাহির পড়োনে আগুন নিয়ন্ত্রিত জ্যাকেট ছিলো। সেটা খুলে হাতে নিয়ে নিজেও সামনের দিকে অগ্রসর হয়। সবাইকে হাসপাতালে পাঠানো হলো। বিল্ডিংয়ের সব চেক করা হয়েছে।বলাবাহুল্য যে ঘর থেকে আগুন লেগেছে সে ঘরের সদস্যরা ছাড়া আর কেউ তেমন দগ্ধ হয়নি। তবে যে ঘর থেকে আগুন লেগেছে সেই ঘরে মোট ছয়জন সদস্য ছিলেন তাদের কে উদ্ধার করে অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে সবার আগেই হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
.
আরো আধা ঘন্টায় সব নিরব হয়ে গেছে। সবাই চলে গেছে। তবে কিছু কিছু সাংবাদিক ও অফিসার রা রয়ে গেছেন।বিভৎস রুপ ধারণ করা বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে তাহি। নিজের বাইকের দিকে এগিয়ে যায়। তখনই নিষ্প্রভের দিকে তার চোখ পড়ে। নিষ্প্রভ একদৃষ্টিতে তাহির দিকেই তাকিয়ে আছে। নিচের ঠোঁট দাত দিয়ে কামড়ে ধরে রয়েছে। চোখ ছলছল করছে। মলিন হেসে তাহি সেদিকে তাকিয়ে। নিষ্প্রভ আস্তে আস্তে তাহির দিকে এগিয়ে আসে। কাঁপা কাঁপা হাতে তাহির গালে হাত রাখে। পর মূহুর্তেই তাহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। তাহিও নিজের হাত রাখে নিষ্প্রভের পিঠে। নিষ্প্রভের কান্নার শব্দ একটু একটু তাহির কানে ভেসে আসছে। তবুও কিছু বললো না তাহি৷ ওভাবেই রইলো। চোখের পানি মুছে তাহিকে ছেড়ে দিয়ে তাহির হাত দুইটা ধরে চেক করতে করতে নিষ্প্রভ বলে- তোমার কোথাও লাগেনি তো পাখি?
মাথা নাড়িয়ে না করে তাহি। নিষ্প্রভের চোখ দিয়ে তখনো পানি গড়িয়ে পড়ছে। নিজের হাতে নিষ্প্রভের চোখর পানি মুছে দেয় তাহি। মুচকি হেসে বলে- কি ব্যাপার, আপনি তো দেখি বাচ্চাদের মতো কান্না শুরু করেছেন ডাক্তার সাহেব। আশে পাশে তাকিয়ে দেখুন। অনেকে আপনার কান্না করা দেখে কেমন করে হাসছে।
কোনো উত্তর দিলো না নিষ্প্রভ তাহির হাতদুটো শক্ত করে ধরে রেখেছে।
আমাদের তো এবার যেতে হবে ডাক্তার সাহেব।
তাহির কথায় মুখে কিছু না বলে নিজের বাইকের দিকে হাত ধরে নিয়ে যায় নিষ্প্রভ। লম্বা শ্বাস নিয়ে কিছু দূরে দাড়িয়ে থাকা সিয়ামের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে বুঝায় ওর বাইকটা যেনো ওর বাসার সামনে রেখে তারপর বাসায় যায়। সিয়াম মাথা নাড়ায়।
নিষ্প্রভের বাইকের পিছনে উঠে বসে তাহি। দুইহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। নিষ্প্রভ হাত দুটোতে আলতো করে ঠোঁট ছুয়ে দেয়। বাইক স্টার্ট দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
.
বাসার কলিং বেল বাজতেই তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে দেন দিয়া হাসান।নিষ্প্রভ ও তাহিকে দেখে সস্থির নিশ্বাস ছাড়েন। দুজনকে ভিতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে ফ্রেশ হতে বলে রান্না ঘরের দিকে চলে যান।
তাহির হাত ধরে নিষ্প্রভ নিজের রুমে নিয়ে যায়, ওয়াশরুমের সামনে দাড় করিয়ে বলে- যাও পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে আসো।
তাহি ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। নিষ্প্রভ দীবার রুমের ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়।
.
খাবার টেবিলে উপস্থিত রয়েছেন দিয়া হাসান, নাইম হাসান। মেহমান রা চলে গেছেন। দীবার বৌভাত পেছানো হয়েছে। নিচের দিকে মাথা নুইয়ে একমনে খেয়ে চলেছে তাহি। নিষ্প্রভ তা দেখে মুচকি হাসে। যতোই সাহসী আর বদরাগী হোক না কেনো, মেয়েরা অনেক সময় না চাইতেও লজ্জা পায়। যা তাহিকে দেখে বুঝা যাচ্ছে।
চলবে, ইনশাআল্লাহ